দিনগুলো সব কেমন যেন দ্রুত চলে যায়। এই যে দেখতে দেখতে কেটে গেল দশদিন। কিভাবে গেল বোঝা গেল না। তবে সময়টা চলে যাওয়ায় বেশ ভালো হয়েছে এবার। তৌহিদ আর শান্ত এখন পুরোপুরি সুস্থ। দিনগুলোও যাচ্ছে বেশ। ফাবিহাদের বাড়ি জুড়ে কেমন বিয়ে বিয়ে গন্ধ নেমেছে। বিয়েটা আহিরের। মেয়ে এই ঢাকার শহরেরই। তাদের প্রেমের বিয়ে। ভার্সিটির জীবন থেকে প্রেম। অবশেষে বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে তারা আবদ্ধ হচ্ছে। আজ তাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হবে। বিয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্বটা আরহান, তৌহিদ আর শান্ত নিয়েছে। এছাড়া আহিরের কিছু বন্ধু-বান্ধবও আছে। বিয়েটা খুব ধুমধাম করে দেয়া হবে। তাদের বংশের এই প্রথম বিয়ে। কোনো ত্রুটিই রাখবেন না মাসুদ উদ্দিন। মেয়ের বিয়েও এমনই ধুমধাম করে দিবেন বলে ইতিমধ্যে ভেবে ফেলেছেন।'
চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে দরজার মাথায় ফুল লাগাচ্ছে শান্ত। আরহান এত বারণ করল তবুও শুনল না। তৌহিদের আজ ভার্সিটিতে ক্লাস আছে। তবে শীঘ্রই চলে আসবে বলে গেছে। আরহান রেডিওতে যাবে রাত ন'টার পর। ততক্ষণে গায়ের হলুদের অনেকটাই শেষ হয়ে যাবে।'
শান্তর পায়ে ব্যাথার কারণে তাকে কোনো কাজ করতে দিচ্ছিল না কেউ। সে এতবার বোঝাল পায়ে ব্যাথা নেই তাও আরহান শুনতে নারাজ। শেষমেশ অভিমান করে বসায় রাজি হলো। গলায় ফুল প্যাচিয়ে হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরহান। সে বলল, “তুই নেমে যা শান্ত পড়ে গেলে ব্যাথা পাবি।”
শান্ত শুনল না। সে আরহানের হাত থেকে ফুল নিল। দরজায় লাগাতে লাগাতে ইশারায় বলল, “কিছু হবে না।"
আরহান আর দিরুক্তি করল না। এবার বলল,
“ঠিক মতো লাগা।”
শান্ত লাগাচ্ছে। তার ঠোঁটে রটানো মিষ্টি হাসি। আচমকাই আরহানের ফোন বাজল। সে শান্তকে সাবধানে দাঁড়াতে বলে— চলে গেল বাহিরে।'
ফাবিহাদের বাড়িটির নাম মায়াকুঞ্জ। বাড়ির কালো গেটটার সামনে তখন একটা গাড়ি থামে। গাড়ি থেকে বের হয় এক যুবতী মেয়ে। পরনে বাসন্তী রঙের চুড়িদার। মুখে তার তীব্র রাগ। কপালে বিরক্তির ভাজ। কানে ফোন। রাগ হওয়ার মুখ্য কারণ সে আসার সময় বিয়েতে পড়ার ড্রেস আনতে ভুলে গেছে। এত বড় ভুল কি করে হলো কে জান! অরিন বিরক্তির বেশে হন হন করে বাড়ির ভিতর ঢুকছিল। মা আর বাবাকে পুনরায় পাঠিয়েছে বাড়ি। অরিন ফোনে বলল,
“মা জামাটা কি পেয়েছ?”
ওপাশ থেকে অরিনের মা বললেন,
“পেয়েছি তুই এত রাগ করিস ক্যান?”
“কি বলো মা– রাগ করব না। এত বড় ভুল কি করে হয়ে গেল। কাল ভাইয়ার বিয়ে আর আজ আমি জামা আনতে ভুলে গেছি।”
“আচ্ছা এখন ফোন রাখ। আমি আর তোর বাবা আসছি।”
“ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসো।”
ফোন কেটে দিল অরিন।'
শান্তর ফুল লাগানোর কাজটা তখন শেষ। সে ধীরে সুস্থ চেয়ার দিয়ে নামতে লাগল। আচমকা কি হলো চেয়ার উল্টে পড়ে যেতে নিল শান্ত। সঙ্গে সঙ্গে তাকে দৌড়ে গিয়ে ধরল অরিন। হতভম্ব স্বরে উচ্চারণ করল, “আরেহ, আরেহ!”
সময়টা তখন কেমন জানো। চারপাশ থমথমে। বাতাস বইছে কি বইছে না বোঝা যাচ্ছে না। নিস্তব্ধ লাগছে চারপাশ। শান্তর চোখ বন্ধ। বুকের ভেতর আচমকা টিপটিপ শব্দ হচ্ছে। শান্ত চাইল। দেখতে পেল এক রমণী বেশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে বিরক্ত। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম লেপ্টে। অরিন বলল,
“এই ছেলে কাজ করার সময় সাবধানে কাজ করবেন না। এখনই তো হাত পা ভেঙে বিচ্ছিরি কান্ড ঘটে যেত।”
কথা শুনে শান্ত দ্রুত নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেয়েদের সংস্পর্শে শান্ত খুব কম এসেছে। আসেনি বললেও চলে। শান্ত বিনাবাক্যে লজ্জিত হয়ে স্থান ত্যাগ করল। অরিন বিমুঢ় চেয়ে। মনে মনে বলল, “কি অভদ্র ছেলে— সাহায্য করল অথচ একটু ধন্যবাদও জানাল না।”
বিগড়ে যাওয়া মেজাজ আরো বিগড়ে গেল। সে উচ্চ আওয়াজে ডাকল, “ফুপুজান, ও ফুপুজান।”
সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন রিনা বেগম। বাড়িতে ফাবিহা নেই। তার নাকি কোন মেকাপ শেষ হয়ে গেছে রাহেলাকে নিয়ে সে গেছে মার্কেটে। এছাড়া পার্লারেও যাবে বলে গেছে। রিনা বেগম অরিনকে দেখে খুশি মনে বললেন,
“আরে অরিন কেমন আছিস?”
অরিন জবাব দিল না। বলল,
“বাড়িতে কিসব মানুষজন রেখেছো ফুপু?”
“কেন কি হয়েছে?”
অরিন তার রাগটা কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা করল। একটু বোধহয় বাড়াবাড়ি হচ্ছে। হঠাৎ মুুড ঠিক করে ফেলল অরিন। হেঁসে বলল,
“কিছু হয়নি। তুমি কেমন আছো ফুপু?”
বলেই দৌড়ে গিয়ে রিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরল অরিন। রিনা বেগম থমকে গেলেন।
•••••••••••••
বাড়ির পিছনটা দাঁড়িয়ে আছে আরহান। কানে তার এখনও ফোন। কে জানো— কথা বলছে। অনেক্ক্ষণ যাবৎই বলছে। আরহান কোনোরূপ জবাব দিচ্ছে না আবার কাটছেও না। অবশ্য নিজ ইচ্ছায় কাটছে না বললেও ভুল হবে। ওপাশ থেকে কেউ বলল, “তুমি আসবে তো আরহান?”
অনেকক্ষণ পর আরহানের জবাব এলো। শক্ত কণ্ঠে বলল, “না।”
ওপরপাশের মেয়েটির তখন করুণ অবস্থা। সে মলিন কণ্ঠে শুধায়,
“তুমি এত নির্দয় কেন?”
আরহানের আচমকা রাগ উঠল। সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলেন? আপনি কি চান আমি আবার সিম বদলে ফেলি। আপনার সমস্যা কোথায়! আপনায় বলেছি না আমার আপনাকে পছন্দ নয়। শুনুন অনেকক্ষণ যাবৎ আপনার কথা শুনছি। কাটতে বারণ করেছেন তাই এতক্ষণ কাটিনি। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন। এই আরহান আপনার জন্য নয়। এখনও সময় আছে– বুঝে যান। আর কখনো যেন ফোন করতে না দেখি। আপনি যদি আর ফোন করেন আমি আমার এই সিমও বদলে ফেলব। রোজ রোজ নাটক হচ্ছে আমার সাথে, আপনার বাবা কতক্ষণ নাটক করছে? আপনি কতক্ষণ নাটক করছেন। পেয়েছেন কি আমাকে? ভালোবাসা জোর করে হয়না বুঝতে পারেন না। আর আপনার বয়স কত? এখনও ইন্টার শেষ হয়নি। আবেগে ভাসা বন্ধ করুন। অহেতুক কথা বার্তা বাদ দিয়ে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকুন। আপনি আমার খুব ছোট তাও আপনি করে বলছি। লাস্ট বার বলছি, আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করুন। আর যেন ফোন না আসে।”
ফোন কেটে দিল আরহান। রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। মেজাজ বিগড়ে গেছে পুরোপুরি। তার ইচ্ছে করছে বাড়ি গিয়ে ঠাটিয়ে দুটো চরম মারতে ওই পুঁচকে মেয়েটাকে। একদিকে তার বাবা যখনতখন অপমান করছে। অন্যদিকে এই মেয়ের নাটক। এত বোঝাচ্ছে পিছু ছাড়তে– মানছেই না।
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেল আরহান। সে পিছন ফিরল। শান্ত দাঁড়িয়ে। সবটা কি শুনেছে? শান্ত ইশারা করল, “কি হয়েছে?"
আরহানের অপ্রস্তুত ভঙ্গিমার হাসি। সে শুধায়,
“কিছু না। তোর ফুল লাগানো শেষ?"
শান্ত উত্তর দেয় না। প্রশ্নসূচক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। আরহান এক প্রকার অসয়হায় দৃষ্টি নিয়ে বলে, “আমি কি করব বুঝতে পারছি না? মেয়েটা পিছুই ছাড়ে না।”
শান্তর তড়িৎ হাত ইশারা,
“বিয়ে করে ফেল।”
'বিয়ে করে ফেল'— কথাটা নিজ মুখে উচ্চারণ করতেই হেঁসে ফেলল আরহান। বলল, “তোর কি মাথা ঠিক আছে?”
শান্ত আবার ইশারা করল। আরহান বুঝতে পেরে বলল, “ঠিকই আছে। বিয়ে করে নিলেই সমস্যার সমাধান।”
শান্তর কাঁধে হাত রাখল আরহান। হেঁসে বলল,
“ঠিক আছে করে নেব। চল এখন।”
•••••••••••
বাড়ির সদর গেটের কাছে আসতেই তৌহিদের সাথে দেখা হলো ফাবিহা আর রাহেলার। তারাও মাত্রই পার্লার দিয়ে বাড়ি আসলো। তাদের মধ্যে কথা হলো না। এক চিলতে হাসি দেখা গেল শুধু। তৌহিদ আগেই ঢুকে পড়ল ভিতরে। রাহেলা বলল,
“দেখছেন আপা মেকাপের কি দাম? হালারা দিনেদুপারে ডাহাতি করে।”
“ওটা ডাহাতি না ডাকাতি হবে।"
“ওই হইছে আপনে আছেন আমার ভুল নিয়া।”
“শোনো শুদ্ধ ভাষায় কথা বললে মানুষ সুন্দর বলে।”
“আমার ওতো সুন্দর দিয়া কাম নাই আপা। আমি যেমন আছি হেমনই ঠিক আছি।”
“না ঠিক নাই। তুমি এত কথা বলো কেন?”
“এয়া কি কন আপা আল্লায় মুখ দিছে কিল-লাইগ্গা কতা কওয়েন লাইগ্গা না?”
“তোমাকে বোঝানো আমার কাম্য নয় রাহেলা।”
রাহেলা একগাল হাসে। যেন ফাবিহাকে হতাশ করতে পেরে সে বিশ্বজয় করে ফেলেছে।
তারা কেবল মায়াকুঞ্জের দরজাটার সামনে এলো এরই মাঝে কোথা থেকে দৌড়ে এসে অরিন ঝাপটে ধরল ফাবিহাকে। রাহেলা ঘাবড়ে গিয়ে ছিটকে গেল দূরে। চেঁচিয়ে ডাকল, “চাচি গো ভূত আইছে।”
.
.
.
চলবে......................................................................