বাহাদুর শেখের নেতৃত্বে বাড়ির সমস্ত লোকজন যখন লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো তখনই নীলিমা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। তার পিছু পিছু আসছে স্মরণ ও সাদ। তাদের তিনজনকে এভাবে উপস্থিত সকলে বিস্মিত হলো। চাহনিতে জিজ্ঞাসার দেখা মিললো। লিলি বেগম আড়চোখে রাফির দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টিতে খানিক সন্দেহ। এই রাফি ডাকাত বলে মজা করলো না তো! ছোট মামা আনোয়ার সাহেব তৎক্ষনাৎ রাফিকে জিজ্ঞেস করলেন,
" রাত বিরেতে আমাদের সাথে মজা করলি রাফি! ডাকাত কই হুম? এ তো স্মরণ আর সাদ!"
রাফি নিজেও অবাক হয়। ডাকাতের বদলে স্মরণ আর সাদ এলো কি করে? তবে কি ডাকাত বলতে আসলেও কেউ ছিলো না? সে দ্রুত মাথা ঝাঁকালো। নিজেকে নির্ভুল প্রমাণ করতে অসহায় কণ্ঠে বললো,
" আমি সত্যি বলছি ছোট মামা। ডাকাত ছিলো। বিশ্বাস না হলে নীলু আপুকে জিজ্ঞেস করো। "
রাফির কথা এবার আর কেউ পাত্তা দিলো না। আসমানী বেগম বাহাদুর শেখকে পিছনে ফেলে স্মরণের কাছে চলে এলেন। স্মরণের বিশাল দেহের বাহু পর্যন্ত ধরে আদুরে গলায় বললেন,
" কতদিন পর আমার নাতিরে দেখলাম! এই হাট্টাকাট্টা জোয়ানরে তোরা ডাকাত বানাইস ক্যামনে! আহারে আমার সোনার নাতিরে। কত্ত শুকায় গ্যাছে!"
স্মরণ দাদীর কথায় হেসে ফেললো। আসমানী বেগম প্রতিবার তাকে দেখার পর এই কথা বলবেই বলবে! সে যদি ভুঁড়ি নিয়েও হাজির হয় তবুও দাদী তাকে শুকনো বলবে।
স্মরণের প্রতি এত আদরে ঈর্ষান্বিত সাদ স্মরণকে ঠেলে নিজে গিয়ে দাদীর সামনে দাঁড়ালো। দাদীর হাতটা নিজের বাহুতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
" খালি ভাইয়াকেই দেখো! তোমার এই নাতি যে চান্স পাওয়ার জন্য পড়তে পড়তে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে সেসব নজরে পড়ে না? দেখো আমি কত শুকিয়ে গিয়েছি! "
আসমানী বেগম আদুরে হাসি দিলেন। সাদের বাহুতে আলতো চাপড় মে' রে বললেন,
" তোর জন্যি ঘন দুধের ক্ষীর বানাবোনে বুঝছিস? কালকে ইফতারে খাওয়াবোনে তোরে।"
সাদ ভীষণ খুশি হলো। এদিকে তাদের এ কথোপকথনের ফাঁকে স্মরণ একে একে বাড়ির সবার সাথেই দেখা করলো। অতঃপর সাদও দেখা করলো। স্মরণ গিয়ে মাহবুবের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
' সবগুলো রোজা রেখেছিস মাহবুব?"
মাহবুব সরু দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
" তোর মতো চোর না আমি। ২৬টা রোজাই রেখেছি আলহামদুলিল্লাহ। "
" আমিও বেশ চোর নেই আর। আমিও ২৬টা রোজা রেখেছি।"
স্মরণ ও সাদের দেখা-সাক্ষাতের পর্ব শেষ হওয়া মাত্রই নীলিমার মা মিলি বেগম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নীলিমার দিকে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
" ডাকাত কোথায় এসেছিলো রে নীলু? ঘটনা কি বল তো।"
রাফি একটু আগ বাড়িয়ে খোঁচা দিয়ে বললো,
" হ্যাঁ হ্যাঁ নীলুপু বলো। কোথায় ডাকাত, কে ডাকাত।"
নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নীলিমা ভীষণ লজ্জা পেলো। এখন সবার সামনে যে ইজ্জতের দফারফা হবে তা আর বুঝতে বাকি নেই। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও রাফির তেলিয়ে দেয়া দেখে গরম চোখে তাকালো সে। রাফি মুহূর্তেই ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলো।
নীলিমাকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাহাদুর শেখও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। নীলিমা এবার নত দৃষ্টিতে আড়ষ্ট হয়ে বললো,
" দরজায় তখন ধুমধাম আওয়াজ শুনে ভেবেছিলাম মনের ভুল ছিলো। কিন্তু আরোও কয়েকবার শোনার পর মনে করলাম ডাকাত এসেছে। কেননা এত রাতে কে-ই বা বাড়িতে আসবে। আবার পাশের গ্রামের ডাকাতি পড়ার ঘটনাও মনে পড়েছিলো। তাই ভেবেছি ডাকাতই হবে। এজন্য রাফিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানতো স্মরণ ভাই আর সাদ হবে।"
বলেই সে খানিক আড়ালে আড়চোখে বিরক্তিভরা চাহনিতে স্মরণের দিকে তাকালো। স্মরণ তার এ চোখের ভাষা মুহূর্তেই বুঝে নিলো। তবে কিছু বললো না।
আনিস সাহেব এবার বললেন,
" যদি সত্যি ডাকাত আসতো তাহলে? তোর কি আক্কেল আছে নাকি নীলিমা! এমন কেউ করে! বড়দের কাউকে ডাকবি তো...."
নীলিমা চট করে দৃষ্টি নামিয়ে কণ্ঠে নম্রতা ভাব বজায় এনে বললো,
" এটা ভুল হয়ে গিয়েছিলো বড় মামা। বুঝতে পারিনি। আসলে ভয় আর বিপদে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। "
নাজমা বেগম এবার বললেন,
" অনেক কথা বলেছে সব। এই রাত দুটোয় এমন গ্যাদারিং টের পেলে পাশের বাড়ির লোকজন ঠিকই ভাববে কোনো বিপদ এসেছে। এখন যে যার রুমে গিয়ে কদরের নামাজ পড়ে নাও। আবার সেহরির সময়ও হয়ে যাচ্ছে। "
কেউ আর কথা বাড়ালো না। যে যার যার নির্ধারিত রুমে চলে গেলো। তবে নীলিমা যাওয়ার পূর্বে স্মরণের অগোচরে তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে ফিসফিস করে বললো,
" এই ব্যাটা ডাকাত না। ডাকাতের চেয়েও ভয়ংকর কিছু।"
রাফা তার পাশেই ছিলো। কিছু ফিসফিসানি সে শুনলো বোধহয়। তবে নিশ্চিত হলো না। এ নিয়ে আর মাথাও ঘামালো না।
এই গ্যাঞ্জামের ভেতরে বাড়িতে উপস্থিত সকলকে দেখলেও লিলি বেগমের স্বামী ইয়াকুব সাহেবকে দেখলেন না নাজমা বেগম। লিলি বেগমকে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
" কি গো লিলি? তোমার সাহেব কোথায়? এতকিছু হয়ে গেলো অথচ তোমার সাহেবকে দেখলাম না।"
লিলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হেসে বললো,
" আমার সাহেব ঘুমায় ভাবী। ওর ঘুমের কথা তো জানেনই।"
নাজমা বেগম হেসে ফেললেন। ইয়াকুব সাহেবের এই মরার মতো ঘুম সম্পর্কে বাড়ির প্রায় সকলেই অবগত। ৭মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ইয়াকুব সাহেবের কড়া ঘুম ভাঙবে না, এমন ঘুমান তিনি!
সকলে যে যার মতো কদরের নামাজ পড়ে কোরআন তেলোয়াত, দোয়ায় মশগুল হলো। আর বাড়ির মহিলাগণ রান্নাঘরে প্রবেশ করলো। বাড়ির বড় বউ হওয়ায় নাজমা বেগম নামাজের আগেই সবার জন্য ভাত চুলোয় দিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। সেহরিতে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত সকলেই তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে। আর মাসুদা বেগম আলু ও ডাল ভর্তার জন্য সিদ্ধ দিয়ে গিয়েছিলেন।
রান্নাঘরে নাজমা বেগম, মাসুদা বেগম, দু বোন মিলি ও লিলি বেগম সেহরির খাবারদাবার গোছাচ্ছেন। আর গোলাকৃতি বাড়ির ঠিক মধ্যখানের বিশাল খালি জায়গায়, যেটাকে বাহাদুর শেখ খানাপিনার স্থান বলেন, সেই টেবিলে ছয়টা প্লেট বসানো হলো। আর বাকিগুলো রাখা হলো টেবিলের চারপাশের খালি জায়গায়। খাবার টেবিলে বাহাদুর শেখ, আসমানী বেগম, আনিস সাহেব ও আনোয়ার সাহবে এবং ইমাদ সাহেব ও ইয়াকুব সাহেব বসে খাবার খান। আর বাকি সদস্যরা মেঝেতে বসেই খাবার খান।
এ বাড়িতে কোনো ঈদে এত লোকে লোকারন্য পরিবেশ তৈরী হয় না। তবে এবার মানতাসার বিয়ে উপলক্ষে বাহাদুর শেখ বিশেষ ঘোষনা করে বলে দিয়েছেন, এবার তার দু মেয়ে, মেয়ে জামাই, নাতি নাতনি, নাতজামাই, সবাই এ বাড়িতে ঈদ পালন করবে। তাছাড়া প্রতিবার দু মেয়ে যে যার শ্বশুরবাড়িতে বা ঢাকায়ই ঈদ করে থাকে।
গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, আলু ও ডাল ভর্তা, ঘি এবং ডাল রান্না, এদিয়েই সকলে তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে খাবার খাচ্ছে। ক্লাস সিক্সে পড়া পাখি খাবারদাবার খাওয়ায় একটু ধীর বলে লিলি বেগম নিজে দ্রুত খেয়ে ঐ হাতেই মেয়েকে খাইয়ে দিতে লাগলেন। পাখিকে এভাবে খাইয়ে দেয়া দেখে তার জমজ ভাই রাফি এই ঐ নানা আকৃতির মুখভঙ্গিমা করে ভেঙচি কাটলো। পাখি কিছু না বললেও রাগে ঠিকই বেলুনের মতো ফুলতে লাগলো।
সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে যে যার যার রুমে গিয়ে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লো। কালকে বেশ বেলা করেই সবার ঘুম ভাঙবে৷ এ রাতে ঘুম হয়নি যে.........
----------------------
চারদিকে শোঁ শোঁ বাতাসের আওয়াজ। ঝিরিঝিরি বর্ষণে মুখরিত হয়ে আছে প্রকৃতি। সমস্ত আকাশ আঁধারিয়া মেঘে আচ্ছন্ন। বৃষ্টির ঝুম শব্দ টিনের চালে পড়ে দারুণ তালের ধ্বনি তুলছে। এমন পরিবেশে ঘুমও বেশ দারুণ হয়। আলসেমিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে শরীরের প্রতিটি কর্মক্ষম কোষ।
নীলিমার ঘুম ভাঙলো টিনের চালে পড়া বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে। চোখ খুলে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো তুমুল বর্ষণে বাইরের সবকিছু অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। বহুদিন পর এমন বৃষ্টি দেখছে সে। পুরো রোজাই তো গেলো কাঠকাঠ গরমে। শেষে এসে এমন বৃষ্টি অপ্রত্যাশিত ছিলো। শহুরে আমেজে পূর্ণ কুঁড়ে শরীরটা আচমকাই বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। এই ভাবনাতে মুহূর্তেই আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে দেখলো রাফা ফোন চালাচ্ছে। রাফাকে জাগ্রত দেখে চট করে জিজ্ঞেস করে বসলো,
" বৃষ্টিতে ভিজবি রাফা?"
রাফা ভ্রু কুঁচকে একবার বাইরে তাকালো। এমন ঝুম বৃষ্টিতে এ প্রস্তাব নাকচ করার সুযোগ পেলো না। বিস্তৃত হেসে বললো,
" চল যাই। "
খুশিমনে এক লাফে উঠে বসলো নীলিমা। ওড়না গায়ে জড়িয়ে বললো,
" তুই যা। আমি দুই মিনিটে আসছি। একটু ওয়াশরুমে যাবো।"
বলেই নীলিমা চলে গেলো। রাফাও ওড়না নিয়ে উঠোনে বেড়িয়ে পড়লো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মানতাসা, রাফি ও পাখিকে ডাকলো। দু মিনিটের মাঝে তার ডাকে তিনজনসহ নীলিমাও চলে এলো।
মানতাসা, নীলিমা, রাফা,রাফি ও পাখি, পাঁচ ভাইবোন মিলে মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজছে। তবে রাফি বৃষ্টিতে ভেজার চেয়ে দুষ্টুমি করছে বেশি। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠোনের কাদাগুলো পাখি ও নীলিমার গায়ে ছিঁটাচ্ছে। এদের মধ্যে মানতাসা সবার বড় বলে তার থেকে খানিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছে। নচেৎ মানতাসা যে তখনই উদোম কেলানি দিয়ে বসবে!
বৃষ্টিতে ভেজার এক পর্যায়ে সব মেয়েরা যখন একত্রে ভিজতে লাগলো তখন ক্লান্ত রাফি খানিকটা আড়াল হয়ে দাঁড়ালো। এই লাফালাফিতে তার গলাটা শুকিয়ে এসেছে। কিন্তু পানি খাওয়ার যে কোনো রাস্তা নেই। রোজা যে! এদিকে তৃষ্ণাও তো মিটছে না। ঠিক এমন মুহূর্তেই ছোট্ট মস্তিষ্কে চট করে একটা চোরা বুদ্ধি উঁকি দিলো। আল্লাহর কুদরত, এই বৃষ্টির পানি দিয়ে না হয় একটু গলা ভিজানো যাক! ওভাবে গ্লাস ভর্তি পানি খাওয়া তো এখন সম্ভব না। একে তো ধরা পড়ার ভয়, উপরন্তু রোজা ভেঙে যাওয়ার ভয়। এভাবে বৃষ্টির সামান্য পানি খেলে রোজা ভাঙবে না, এই যুক্তিতে বিশ্বাসী রাফি চারপাশ খেয়াল করে আড়ালে জিব বের করলো। একদিকে জিব বের করে তা দিয়ে পানি টেনে খাচ্ছে, আরেকদিকে হাতের মুঠো আঁজলা করে পানি জমাচ্ছে।
এভাবে চোরাই পদ্ধতিতে গলায় পানি চালান করার দু মিনিটের মাঝে আচমকা কেউ তার কান চেপে ধরলো। মুহূর্তেই সে ভয়ে হাত ঝেড়ে পিছনে নিয়ে নিলো। জিবটা তড়িঘড়ি করে গালে ঢুকিয়ে বললো,
" আ- আমি কিছু করিনি। পানি খাইনি আমি। বিশ্বাস করো পানি খাইনি আমি।"
.
.
.
চলবে................................