বেশ ক্লান্তিত ভাব নিয়ে গিফটের বাক্সটা বিছানার ওপর রাখল আরহান। শান্ত তখন খাটের কর্নারের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসা। তৌহিদ রান্নাঘরে। আরহান নিশ্বাস ফেলে বলল,
“এই নে তোর গিফট।”
শান্ত তাকায়। আরহান তার কপালের ঘামটুকু মুছে বলে, “আর কতকাল তোর নাম নিয়ে আমি কুরিয়ারে যাব বলতো?”
শান্ত বলে না। তার নজর তখনও গিফটের দিকে। শান্ত একজন লেখক। কিন্তু তাকে কেউ চেনে না। সে নিজেই নিজেকে প্রকাশ করতে নারাজ। চোখের চশমাটা হাত দিয়ে নাড়িয়ে বাক্সের কাছে এগিয়ে এলো শান্ত। বিশাল বড় বাক্স। কি কি আছে কে জানে! শান্তের ঠোঁট আপনাআপনি হেঁসে উঠল। কি চমৎকার দেখাল সেই হাসি। আরহান মুগ্ধ হলো। বলল, “খুব খুশি লাগছে বুঝি?”
শান্ত চায়। মিষ্টি এক হাসি দেয়। তাতেই আরহান তার উত্তর পেয়ে যায়। আরহান আয়েশ করে বসল খাটে। শান্ত স্বরে বলল,
“আর কতদিন নিজেকে আড়াল করে রাখবি শান্ত, এবার তো একটা ছবি প্রকাশ কর।”
শান্ত ইশারা করে। তা দেখে আরহান বলে,
“প্রকাশ করলেই কি আমি আসমানে উঠে যাব। আমি এমনই ঠিক আছি।”
আরহান বিতৃষ্ণার গলায় বলল,
“তাই বলে সবার সামনে আসবি না।”
মাথায় ঝাঁকায় শান্ত। যার অর্থ, 'না।'
আরহান নিরাশ হয়। সে জানে শান্ত কেন সবার সামনে আসতে চায় না। শান্তর যে একটা দূর্বলতা আছে। সে কথা বলতে পারে না। দারুণ প্রতিভা নিয়ে জন্মানো এই মানুষটা নাকি কথা বলতে পারে না। মাঝে মধ্যে আরহানের এত আফসোস লাগে। নীরব দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো তখন। সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল,
“যা ইচ্ছে কর। তোকে প্রকাশ করতে হবে না নিজেকে।”
শান্ত আরহানের অভিমান বুঝতে পারে। কিছু বলে না। শুধু মলিন হাসে। তৌহিদের উপস্থিতি পাওয়া যায় তখন। সে গরম গরম চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। আরহানের আগমণ আগেই টের পেয়েছিল। তৌহিদ বলল, “গরম গরম চা রেডি।”
আরহান বলল,
“তোরা শুরু কর আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
তৌহিদের জবাব, “আচ্ছা।”
শান্ত তখনও গিফটের বাক্সের দিকে তাকান। তৌহিদ তার অবস্থান বুঝতে পেরে বলল,
“কিরে চেয়েই থাকবি— নাকি খুলেও দেখবি।”
শান্ত তার উত্তেজনা দমিয়ে রাখল। বাক্সটা বিছানা থেকে নামিয়ে দূরে সরিয়ে রাখল। তৌহিদ অবাক হয়ে বলল, “দেখবি না?”
মাথা নাড়িয়ে 'না' বলে শান্ত। তৌহিদ প্রশ্ন করে,
“কেন?”
শান্ত হাতের ইশারা দেয়। তৌহিদ বুঝতে পেরে বলে,
“প্রচুর উত্তেজনা নিয়ে পাঠকদের ভালোবাসা দেখতে নেই।”
তৌহিদ কথা শুনে হাসে। চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,
“চা খা। পাগল একটা।”
বিনিময়ে হাসে শান্ত। আজ তার খুব খুশি লাগছে। পাঠকদের গিফট যেদিনই আসে সেদিনই শান্ত খুব শান্তি শান্তি অনুভব করে। কি একটা ভয়ংকর সুন্দর ব্যাপার! কেউ শান্তকে চেনা না অথচ ভালোবেসে কত গিফট দেয়। এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি। যা প্রকাশ করা যায় না। শুকরিয়া পাঠক।
•••••••••••••••••
নিজের রুমের মধ্যে পায়চারি করছে ফাবিহা। তার কেমন যেন সবটা অবিশ্বাস্য লাগছে। তার প্রিয় লেখক কিনা তাদেরই তৈরিকৃত একটা বাড়িতে ভাড়া থাকছে। ফাবিহার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। আরহানই তার স্বপ্নের লেখক 'হাসান মাহবুব'! তবুও কৌতুহল এখনও পুরোপুরি দমে নি। আরহানকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে হবে। না হলে পুরোপুরি শিয়র হওয়া যাবে না। যদি সত্যি আরহানই হাসান মাহবুব হয় তাহলে সবার আগে ফাবিহা একটা ছবি তুলবে সঙ্গে অটোগ্রাফ নিবে। আল্লাহ্! এমন একটা দিন ফাবিহার জীবনে আসবে সে তো কল্পনাও করতে পারেনি। ফাবিহা উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। রাহেলার পদধ্বনি পাওয়া গেল। সে ধাপধুপ পা ফেলে রুমে ঢুকল। বলল, “আপা, চাচি আপনারে নিচে ডাকে।”
ফাবিহার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। রাহেলা তাকে খেয়াল করল। কি সর্বনাশ! আপা একলা একলা হাসে। এয়া তো ভূতের ধরার লক্ষণ। রাহেলা আচমকা চেঁচিয়ে উঠল। বলল, “চাচি গো কাম সারছে এয়া কি সর্বনাশ হইয়া গেল চাচি। চাচি গো..."
বলতে বলতে ছুটে গেল রাহেলা। ফাবিহা হতভম্ব হয়ে গেল আচমকা। তার ধ্যান ফিরেছে। সে রাহেলাকে ডাকল, “এই রাহেলা কি হলো?”
রাহেলা শুনল না। সে, ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার যীহ্– বলতে বলতে ছুটে যাচ্ছে।'
সোফায় বসে স্টার জলসার নাটক দেখছিলেন রিনা বেগম। তার হাতে চায়ের কাপ আর সামনের টেবিলের ওপর বাটিতে করে মুড়ি রাখা। রাহেলা দৌড়ে পড়ল সেই মুড়ির ওপর। রিনা বেগম তাজ্জব বনে গেলেন। রাহেলা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“চাচি সর্বনাশ হইয়া গেছে আপারে ভূতে ধরছে।”
সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে চা গড়িয়ে পড়ল রাহেলার মুখে। আর চায়ের কাপের ঠায় হলো মেঝেতে। সে নিচে পড়তেই ঝনঝন শব্দ করে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল। রিনা বেগম উত্তেজিত হয়ে তিনবার উচ্চারণ করলেন একই কথা,
“কি কস তুই? কি কস তুই? কি কস তুই?”
রাহেলা তার গায়ের ওড়না দিয়ে মুখের চায়ের পানিটা মুছল। বলল, “হাছা কই চাচি?”
রিনা বেগম এবার উঠে দাঁড়ালেন। আবারও তিনবার উচ্চারণ করলেন,
“আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি না।”
রাহেলা এবার বিরক্তবোধ করল,
“কি চাচি আপনে এক কথা তিনবার কন ক্যা!'
রিনা বেগম উত্তর দিলেন না। তিনি চেঁচিয়ে ডাকলেন, “রাহেলা থুড়ি ফাবিহা, এই ফাবিহা।”
ফাবিহা তক্ষৎণাৎ ছুটে আসলো। রাহেলা লুকিয়ে পড়ল রিনা বেগমের শাড়ির আঁচলের নিচে। ফিসফিস করে বলল, “কি করলেন চাচি ভূতে গো এমনে ডাকে কেউ?”
রিনা বেগম নিজেকে শক্ত করে বলল,
“তুই শিয়র জানিস ফাবিহারে ভূতে ধরছে।”
“হাচা কই চাচি মিছা কথা কইলে চাচায় আওনের কালে দরজার সামনে উস্টা খাইয়া পড়বে।”
রিনা বেগম ফাবিহার দিকে তাকালেন। ফাবিহার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। সে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে। ফাবিহা বলল,
“কি হলো– মা ডেকে এনে কথা বলছ না কেন?”
রিনা বেগম বললেন,
“তোরে নাকি ভূতে ধরছে।”
ফাবিহার ভীমড়ি খাওয়ার মতো উপক্রম। সে শুধায়, “এসব কি বলো তুমি?”
রাহেলা বলে,
“একদম মিছা কতা কইবেন না আপা, আমি দেখছি আপনে ঘরে বইসা একা একা দাঁড়াইয়া হাসতাছেন।”
“আরে ওটা তো এমনি।”
এরই মাঝে বাহিরে কারো পরে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। ফাবিহা দৌড়ে সেদিকে গেল। গিয়ে দেখল, মাসুদ উদ্দিন উস্কা খেয়ে দরজার মুখে পড়েছে। হাতে করে নিয়ে আসা জ্যান্ত শোল মাছ লাফাচ্ছে। ফাবিহা উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে দৌড়ে গিয়ে বলে,
“বাবা।”
রিনা বেগম আর রাহেলাও দৌড়ে আসে তখন। ঘরে থাকা আহিরও বেরিয়ে আসে দ্রুত। কানে ইয়ারফুন লাগিয়ে গান শুনছিল আহির মাত্রই ইয়ারফুন সরাতেই ফাবিহার কণ্ঠ শুনতে পায়।'
অতিথি নিবাসের আরহান, শান্ত, তৌহিদও বেরিয়ে আসে দ্রুত। কি হলো হঠাৎ!'
ফাবিহা দৌড়ে গিয়ে তার বাবাকে ধরল। রিনা বেগম স্তব্ধ বনে তাকিয়ে। রাহেলা ভীত হলো। রিনা বেগম চোখ রাঙিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “রাহেলা বাচ্চা রাহেলা।”
রাহেলা কানে হাত দিয়ে বলল,
“চাচি এইবারের মতো মাফ কইরা দেন।”
•••••••••••••
বিছানায় শুয়ে আছেন মাসুদ উদ্দিন— তাকে ঘিরে ধরে আছে বাড়ির প্রতিটি সদস্যসহ আরহান, তৌহিদ আর শান্তও। মাসুদ উদ্দিন বললেন,
“আমার তেমন কিছু হয়নি খানিকটা আঘাত লেগেছে।”
ফাবিহা রাগ নিয়ে বলল,
“তুমি কি দেখেশুনে হাঁটতে পারো না?”
“দেখেই হাঁটছিলাম রে মা কিভাবে যে পড়ে গেলাম বুঝতে পারিনি।”
আহির বলল,
“বাবা তুমি কিভাবে পড়লে বলো তো?”
মাসুদ উদ্দিন বলতে পারলেন না। তিনি নিজেও জানে না কিভাবে পড়ে গেলেন। শুধু মনে পড়ছে দু'সিঁড়ি উঠতেই আচমকা পা বেঁকে গিয়ে তিনি পড়ে যান। আরহান বলল,
“আঙ্কেল আপনার একটু সাবধানে চলাফেরা করা উচিত।”
মাসুদ উদ্দিন অসয়হায় কণ্ঠে বললেন,
“তুমিও শুরু করলে আরহান।”
এবার রিনা বেগম বললেন,
“শুরু করবে না তো কি করবে? হাঁটার সময় চোখ কোথায় থাকে?”
এই বলে চেঁচামেঁচি শুরু করে দিলেন রিনা বেগম। রাহেলার পাশেই দাঁড়ান ছিল তৌহিদ আর শান্ত। রাহেলা তৌহিদকে বলল,
“ভাইজানেরা এহন আর এহানে থাহা যাইত না। আহেন বাহিরে যাই। চাচি যা ক্ষ্যাপছে তাতে রাত বারোটার আগে থামাথামির কোনো কায়দাই নাই।”
শান্ত কথা শুনতে পেল। তৌহিদ বলল,
“কি বলল?"
শান্ত মাথা নাড়ায়। তৌহিদ বলে,
“ঘর থেকে পদত্যাগ করতে হবে।”
একে একে সবাই কক্ষ ত্যাগ করল। সবার শেষে বের হলো ফাবিহা আর আরহান। বাকিরা আগেই এগিয়ে গিয়েছে। ফাবিহাই বলল আগে, “আপনায় একটা প্রশ্ন করি?”
আরহানের সাবলীল উত্তর,
“জি বলুন।”
“আপনিই কি বিখ্যাত লেখক হাসান মাহবুব?”
আরহান কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল। প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। ফাবিহা আবার বলে,
“কি হলো কথা বলছেন না কেন?”
“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
“না তখন কুরিয়ারে নাম দেখলাম 'হাসান মাহবুব'– তাই আরকি?
আরহান স্মিথ হেঁসে বলে,
“আমরা যা দেখি তা সব সময় সত্যি হয় না ফাবিহা।”
“মানে?”
“আইথিংক আমার কথাটার অর্থ বোঝার ক্ষমতা আপনার আছে।”
“সরাসরি বলে দিলে কি হয়?”
আরহানের পলকহীন চাহনি। ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির রেখা বিদ্যমান। সে খানিকটা ফিসফিস করে শীতল স্বরে আওড়ায়, “আমি বড্ড বিভ্রান্তে ভরা মানুষ রৌদ্রময়ী। এছাড়া মানুষকে বিভ্রান্তে ফেলাটাও আমার দারুণ পছন্দ।”
.
.
.
চলবে......................................................................