নিভে যাওয়া মোমবাতি - আরিশান নূর - অনু গল্প


-- "ডক্টর সমুদ্র, ই'মা'র্জে'ন্সি পেশেন্ট এসেছে। আপনি একটু আসেন। পেশেন্টের আপনাকে খুব দরকার।"

ডাক্তার সমুদ্র রাত দশটা বাজে নিজের ডিউটি শেষ করে এপ্রোন খুলে মাত্র সি-গা-রে-টে টান দিবে এমন সুখকর মুহূর্তে সিস্টার ফরিদার কথাগুলো সমুদ্রের কাছে করলা ভাজির চেয়েও তেতো ছিল। সে মুখ শক্ত করে বলে, " ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের ডাক্তার কই?"

-- " রিমি ম্যাডামের ছেলে অসুস্থ আর জিহাদ স্যার আজ আসেননি।"

সমুদ্র মেজাজ খারাপ করে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে মাটিতে পিষে ফেলে৷ প্রচুর রাগ উঠছে তার৷ সারাটা দিন গাঁধার মতো খাটার পরও রাতেও ফুরসত নেই। সে এপ্রোন হাতে নিয়ে বলে, " পেশেন্টের কী অবস্থা? "

ফরিদা আপা বিচলিত হয়ে বলে, " মেয়েটার হাত থেকে গ'ল'গ'ল করে ব্লি/ডিং হচ্ছে স্যার।"

ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের তিন নাম্বার বেডের সামনে আসতেই সমুদ্রের মেজাজ বিগড়ে যায়। বেডের আশেপাশে ছোট-খাটো জটলা বেঁধে গেছে। কারো হিঁচকি টেনে কান্নার দমকা আওয়াজ ভেসে আসে। কান্না দেখার জন্যই মানুষ ভীড় জমিয়েছে। বিরক্তিতে মুখ-চোখ শক্ত হয় তার। সে ভীড় ঠেলে পেশেন্টর দিকে এগিয়ে যেতেই থমকে গেল। লাল রঙের কামিজ পরিহিতা এক মেয়ে আয়েশ করে বসে কাঁদছে। তার হাত থেকে ফোটায় ফোটায় র/ক্ত চুইয়ে বেড ভাসিয়ে দিচ্ছে।কান্নাকাটি যে এক ধরনের বিলাসিতা এটা এই মেয়েকে না দেখলে বোঝা দায়। কাদার ফাঁকে তার এক সখীকে বলে উঠে, "ইশ কী গরম, থাকা যাচ্ছে না। এসি নেই কেন?"

সমুদ্র ইচ্ছাকৃত ভাবে দু'বার কেশে বলে, " রোগী কে এখানে?"

হাতে ক্ষ'ত'প্রা'প্ত মেয়েটা বলে উঠে, " ডাক্তার কে এখানে?"

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সমুদ্র। অস্বস্তিতে মাথা চুলকায় সে। হাতে ধরে রাখা এপ্রোন সঙ্গে সঙ্গে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলে, " আমি।"

এরপর লাল কামিজ পরা, চুলের বেনিতে বেলি ফুলের মালা গুঁজে রাখা মেয়েটার চোখে চোখ রাখে৷ তার শান্ত, শীতল চোখে চোখ পরার সাথে সাথেই মেয়েটা চোখ নামিয়ে কাদা আরম্ভ করে। তার এক বান্ধবী বলে উঠে, " ডাক্তার আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে কিছু করুন।"

সমুদ্র এগিয়ে বেডের কাছে এসে তার আলতা মাখা পায়ের সামনে দাঁড়ালো। হাতের ক্ষ*ত দেখার জন্য নিজের হাত বাড়াতেই তার মেহেদী ভর্তি হাত নজরে এলো। মেয়েটা তাকে উপেক্ষা করে পিছিয়ে যায় এবং প্রতিবাদী গলায় বলে, " ডোন্ট টা-চ্ মি।"

সমুদ্র একথায় বেশ আপমানিত বোধ করে। কেন যেন মেয়েদের কাছ থেকে সে অপমান সইতে পারে না। ইগো হার্ট হয় প্রচুর।

সে থমথমে গলায় বলে, " রোগীর হিস্ট্রি কী? হাত কাটলো কীভাবে? প্রেম করে ছ্যা-কা খেয়ে হাত কেটেছে নাকি অ-নৈ-তি-ক কিছু....... যেহেতু এখন অনেক রাত তার উপর ওনার অতিরিক্ত সাজ-গোজ...... "  

সমুদ্র তার কথায় খুব খারাপ একটা দিককে ইঙ্গিত করে মেয়েটার করা অপমানের শোধ নিতে চাইছে। মেয়েটা টলটলে চোখে তাকিয়ে বলে, " আপনি খুব বাজে একটা লোক।"

সমুদ্র ওসব কথার তোয়াক্কা করে না। সে অনুমতি ব্যতিত মেয়েটার হাত ধরে। আরেক দফা চমকে যায়। এতো নরম তুলতুলে হাত যে এর রেশ একদম হৃদয়ে গিয়ে লাগলো। 

তার ফ্রেন্ড বলে উঠে, " সাজেক ট্যুরে গিয়েছিলাম আমরা। আসার সময় রিকশা থেকে পরে ওর হাতে কাঁচ ঢুকে গেল।"

সমুদ্র তার হাত ধরায় মেয়েটা নড়াচড়া শুরু করে। তাকে কাজ করতে দিতে চাইছে না। ফ্যাচ ফ্যাচ কান্না শুরু করে দেয় এবং বলে, প্লিজ ইঞ্জেকশন দিবেন না। 

সমুদ্র ধমক দিয়ে বলে, " একদম চুপ। ন্যাকামি আমার খুব অপছন্দ। আমার সামনে আমার অপছন্দের কাজ করবে না।"

মেয়েটা বিড়বিড় করে বলে, " আপনার পছন্দ-অপছন্দের খেয়াল রাখার দায়িত্ব আপনার ঘরের বউয়ের। আমার না।"

-- ওড়না কই আপনার?"

মেয়েটা নড়েচড়ে উঠে বলে, " হি-পো-ক্রে-ট একটা লোক।"

সমুদ্র বাঁকা হেসে নার্সের সহায়তায় তাকে আধ শোয়া করে এতো দ্রুত সেলাই দিল যেন যে সে কোন দর্জি আর তার হাত কোন কাপড়। ইঞ্জেকশন পুশ করার টাইমে সমুদ্র মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে চোখ মা-রে ফলে মেয়েটা থম মেরে যায়৷ ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যথা বুঝি একটু বেশিই দেয় ডাক্তারটা। এরপর কাগজ-কলম হাতে নিয়ে বলে, " পেশেন্টের নাম?"

রোগী নিজেই উত্তর দিল, " আয়না নূর জাহান।"

সমুদ্র নামটা শুনে মেয়েটার দিয়ে একবার তাকিয়ে গটগট করে কিছু লিখে কাগজটা প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, " আপা ঘুমের মেডিসিন দিয়ে দেন ওনাকে এখুনি। "

আয়না প্রেসক্রিপশনটা হাতে তুলে নেয় বদমেজাজি ডাক্তার সাহেবের নাম জানার জন্য। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হয়৷ ডাক্তার সাহেবের লেখা দেখে নিজেকেই অশিক্ষিত মনে হচ্ছে। হ্যান্ড রাইটিং বোঝার উপায় নেই। একটা অক্ষরও সে বুঝতে পারলো না। নার্স প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ হা করে দাঁড়িয়ে থেকে হেসে তাকে ঔষধ খাইয়ে চলে যায়। আয়না এই হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স দুজনের ব্যবহারেই হতভম্ব। ঘুমের ঔষধ খাওয়ার জন্য সে একটু পরই ঘুমিয়ে যায়। তার বাকি দুই ফ্রেন্ড বাড়ি ফিরে যায়। 

মধ্যরাতে অস্বস্তির কারনে ঘুম ভেঙে যায় আয়নার। সে চোখ খুলতেই ভারী অবাক হয়। অস্ফুটস্বরে বলে, "আপনি!"

সমুদ্র তার নিকট এগিয়ে আসে। ঘুম ঘুম অবস্থাতেও বিৎঘুটে সি-গা-রে-টের গন্ধ ডাক্তারের গা থেকে পায় সে। চোখ-মুখ কুচকে ফেলে আয়না বলে, " ডাক্তার হয়েও সি-গা-রে-ট খান?

--" ঘরে বউ আসলে আর খাব না।"

আয়না বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো। তাকে অবাক হতে দেখে হেসে দিল সে। আয়না মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। বদমেজাজী মানুষটাকেও হাসলে এতো সুন্দর লাগে! ডাক্তার খিটখিটে মেজাজের হলেও দারুণ সুদর্শন। এপ্রোন পড়লে তার হ্যান্ডসামনেস উপচে পরে। 

সমুদ্র নিজ থেকে বলে উঠে, " আমি রাত বারোটায় বাসায় গিয়েছিলাম। এরপর একটা না বাজতেই ছুটে চলে এসেছি। মনে হচ্ছিল নিজের একটা অংশ ফেলে এসেছি। বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার।

আয়না শুকনো ঢোক গিলে। সমুদ্র আর একটু তার দিকে এগিয়ে এসে বলে, " আপনার আলতামাখা পাজোড়া, নাকের বাম দিকে জ্বলতে থাকা নাকফুল, চুলে গুঁজে রাখা বেলির মালা, হাত ভর্তি মেহেদী আমাকে ঘায়েল করে ফেলেছে। আপনার কান্না করা ফোলা চোখ, ইঞ্জেকশন ভীতি, ঠোঁট উলটানো সবটা আমাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে।"

সমুদ্র তার একটু কাছে এসে তাদের মধ্যকার দূরত্ব খানিক কমিয়ে আনে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ পেশেন্ট ঘুমিয়ে আছে। অন্ধকার কক্ষ। কলিডোরের হলুদ আলোয় যা একটু আলো ঢুকছে খিরকি ভেদ করে। 

মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে। সমুদ্র করুণ গলায় বলে, " প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না, তাহলে বুঝি পাগল হয়ে যাব। রাত একটা থেকে বসে আছি আপনার উত্তরের জন্য। না করলে আমি বুঝি শে-ষ হয়ে যাব৷"

--" প্রেম কী এতো দ্রুত হওয়া সম্ভব? "

সমুদ্র তার চোখে চোখ রেখে বলে, " প্রেম কিছুটা সংঘর্ষের মতোন। দুটো মনের মধ্যকার অনুভূতির তীব্র গতিতে একত্র হওয়াকে প্রেম বলে। প্রেম আর সংঘর্ষ একক সময়ে,এক মুহুর্তের মধ্যেই হয়।"

আয়না কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না। তবে তারও কেমন নাম না জানা অনুভূতি হচ্ছে। কড়া ঔষধের নেশাও ওনার প্রেমের জ্বা-লা-য় ছুটে গেছে বুঝি৷ ওনার গরম নিশ্বাস আয়নায় গালে উষ্ণতা তৈরি করছে।

সমুদ্র হুট করে তার হাত ধরে বলে," আপনাকে দেখার পর আমার দুনিয়াই ওলট-পালট হয়ে গেল৷ কেন যেন মনে হলো, ওড়না ছাড়া আপনার উ'ম্মু'ক্ত গ-লা, কাঁ-ধ দেখার অধিকার শুধু আমার। অসুস্থ হলে সারা রাত জেগে সেবা করার অধিকার শুধুমাত্র আমার।" 

টেবিল ফ্যানের বাতাসে আয়নার চুল মুখে এসে উড়াউড়ি করতে থাকে। সমুদ্র তার চুলগুলোয় হাত দিয়ে বলে, " গরম লাগছিল এজন্য টেবিল ফ্যানের ব্যবস্থা করেছি।

আয়না দেখল শুধু টেবিল ফ্যানই না, ডাক্তার সাহেব তার কাটা হাত এক্সট্রা একটা বালিশের উপর রেখেছে। বদমেজাজী ছেলেটাও এতো খেয়াল করতে জানে! 

সে আস্তে করে বলে, " আমি লাভ ম্যারেজে বিশ্বাসী না। বাসায় প্রস্তাব পাঠাবেন। ভেবে দেখব৷"

--" শুধু ভেবে দেখবেন?"

--" হ্যাঁ, রিজেকশনও খেতে পারেন।"

সমুদ্র হাসে। কিছু বলে না।শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। সত্যি সত্যি আগামী এক মাসের মধ্যে তাদের পারিবারিক ভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়৷ 

 প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিন আয়না দারুণ সাজগোছ করে সমুদ্রের হাসপাতালে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। সে তখন রোগীর হিস্ট্রি শোনায় ব্যস্ত। আয়নাকে দেখে সে হা হয়ে যায়৷ রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখে নিজের প্রেসক্রিপশনের কথা মনে পড়ে আয়নার৷  

সমুদ্রের কেবিনে তারা পাশাপাশি এসে বসে। সমুদ্র ব্যস্ত তাকে আপ্যায়ন করা নিয়ে৷ আয়না তাকে প্রশ্ন করে " আমার প্রেসক্রিপশনে তুমি কী লিখেছিলে?" 

সমুদ্র বলে উঠে, " খুব যত্ন করে লিখেছিলাম আই থিংক আই হাভ ফল ইন লাভ উইথ ইউ। তুমি আমার দেওয়া লাভ লেটার পড়োনি?"

আয়না অসহায় চোখে তাকালো। আজ ডাক্তারের লেখা পড়তে পারে না জন্য তার প্রথম লাভ লেটার কীনা অযত্নে কোন ডাস্টবিনে পড়ে আছে। তবে ভালোবাসাটা সযত্নে আগলে রেখেছে হৃদয়ের গহীনে। 
.
.
.
সমাপ্ত.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন