তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ১৪ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রৈনীল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা?
আমি মাথা নাড়লাম। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। রৈনীল হাঁটতে আরম্ভ করলো। নিঃশব্দে ওর পাশে হাঁটছি আমি। ভয়ংকর মন খারাপ নিয়ে কারো সঙ্গ ভালো লাগে না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে রৈনীলের পাশে হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগছে।

কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম আমরা। রৈনীল বসেছে আমার মুখোমুখি। আমি মাথা নিচু করে আছি। হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করলো, কি কারণে মন খারাপ জানতে চাইবো না। মনটাকে ভালো করে ফেলতে হেল্প করবো?

আমি চমকে উঠলাম। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি স্বাভাবিক চেহারা ধরে রাখার। তবুও সে টের পেয়ে গেছে। মৃদু হেসে বললাম, আমার চেহারায় কি লেখা আছে আমার মন খারাপ? 
'হুম। তোমাকে বলেছিলাম না আমি মানুষকে বুঝতে পারি খুব?'
'তাহলে তো এটাও বোঝার কথা আমার কেন মন খারাপ?'
'অত শক্তি কি আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের আছে?'

কথাটা বলে রৈনীল থামলো। খাবারের মেন্যুতে চোখ বুলিয়ে বললো, 'এটা খাবে কিনা দেখো তো?'
'আমি কিছু খাবো না।'
'ভালো খাবার খেলে মন ভালো হয় কিন্তু। অনেস্টলি আমার খিদে পেয়েছে। কিছু খাবো। তুমি কি চুপ করে সামনে বসে থাকবে?'
'আপনি খান। আমি বসে আছি, সমস্যা নেই।'

রৈনীল ওয়েটারকে ডেকে দুজনের জন্যই খাবার অর্ডার দিয়ে দিলো। আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি করলেন? আমি তো বললাম আমি কিছু খাবো না।

রৈনীল আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটো নিজে প্রশ্ন করলো, 'নিশ্চয়ই বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়েছে?'
'হুম।'
'এগুলো জীবনের অংশ সরণী। সায়েম নামক ভদ্রলোকের কি অবস্থা?'

এবার আমি এত বেশী আশ্চর্য হলাম যে আমার মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না। হতভম্ব হয়ে গেলাম একেবারে। এই হতভম্বিতা কাটাতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। রৈনীল কী করে বোঝে এত কিছু! অদ্ভুত মানুষ একটা। 

রৈনীল বললো, বইগুলো পড়া শেষ? 
'না। আস্তে আস্তে পড়ছি।'
'ওগুলো আস্তেধীরে পড়ার মতোই বই। অত তারাহুরো করার কিছু নেই। বইগুলো শেষ হলে জানাবে, আমি আরও কিছু বই পাঠাবো।'
'কিভাবে জানাবো?'
'তাও ঠিক। তোমার তো আবার ফোন নেই।'
'কিভাবে জানলেন!'
'খেয়াল করেছি।'
'আশ্চর্য!'

রৈনীল মুচকি হেসে বললো, 'খাতা দাও। আমার নাম্বারটা লিখে দেই। কারো ফোন থেকে একটা টেক্সট পাঠালেই আমি স্বাগতার কাছে বইগুলো রেখে যাবো।'

আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করে এগিয়ে দিলাম। ঝটপট সেখানে নিজের নাম্বারটা লিখে নিচে নামটাও লিখলো সে। খুব চমৎকার হাতের লেখা। মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাতের লেখার মতো। 

নোটবুকটা ব্যাগে রেখে আমি বললাম, 'এভাবে আমি কোনোদিন কারো সঙ্গে বাইরে কোথাও যাইনি। খাওয়া তো দূরের কথা।'
'ভয় লাগছে?'
'কেমন লাগছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি আমার নেই। একইসাথে আনন্দ, ভয়, উৎকণ্ঠা, এক্সাইটমেন্ট, আরো অনেক কিছু।'

রৈনীল হাসলো না। হাসলে হয়তো আমার কথাটাকে হালকাভাবে নেয়া হতো। সে আমার কথাগুলো যেমন ভীষণ সিরিয়াস ভঙ্গীতে শোনে, তেমনি উত্তর দেবার বেলায়ও খুব সিরিয়াস থাকে। বিষয়টা আমার কাছে খুব আরামদায়ক মনে হয়। 

খাবার চলে এলো। শুরুতে আমি খানিকটা ইতস্তত বোধ করছিলাম। রৈনীল ওয়াশরুমে ফ্রেশ হবার নাম করে চলে গেলো। এরমধ্যে খানিকটা সাহস সঞ্চার করলাম। মা, বাবা ছাড়া কখনো একা রেস্টুরেন্টে যাওয়া হয়নি। সেদিনই প্রথম আপুর সঙ্গে যাওয়া। আর আজ দ্বিতীয়বার রৈনীলের সঙ্গে। আমার কাছে জীবনটা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ধরা দিয়েছে। মাঝেমাঝেই মনে হচ্ছে, এই জীবন যেন আমার নয়। আমার জীবন তো এত রঙিন, এত স্বপ্নময়, এত সুন্দর কখনোই ছিলো না!

রৈনীল এসে সামনে বসলো। ফ্রেশ হবো কিনা জানতে চাইলো। আমি মাথা নাড়লাম। আনমনে একটু একটু করে খাবার খাচ্ছি। 

সে বললো, তোমার লাইফ সবেমাত্র শুরু। এখন খুব কনফিডেন্স নিয়ে বেড়ে ওঠার সময় বুঝলে?
ওর কথা শুনে আমার কাশি শুরু হয়ে গেলো। কাশতে কাশতে বললাম, আপনাকে কিছু না বললেও আপনি আমার ভেতরের কথা বুঝে যান। এটা ঠিক না।

এই প্রথম শব্দ করে হাসলো রৈনীল। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ওর হাসি। বললো, যেহেতু তুমি মুখ ফুটে কিছু বলোনা, তাই আমিই নিজ থেকে বলি। নয়তো আমাদের মধ্যে কোনো আলাপই হতো না।
'তা ঠিক বলেছেন।'
'খাবারটা মজা না?'
'হুম।'

চুপচাপ খাবার খাচ্ছি দুজনেই। এক ফাঁকে রৈনীল জানতে চাইলো কোনো কোল্ড ড্রিংকস পছন্দ কিনা। আমি এবার 'না' বলিনি। নিজের পছন্দের একটা ড্রিংক্সের নাম বলেছি। রৈনীল একসময় বললো, 'তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে আমার লাইফে নতুন করে কিছুই ঘটেনি। কিন্তু তোমার অনেক কিছু ঘটেছে।'
'কি কি ঘটেছে সেটাও কি আপনি জানেন!'
'ভার্সিটিতে ভর্তি হলে, ডে ট্যুরে গেলে, এইতো প্রথমবার নিয়ম ভেঙে রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছো।'
'আরও আছে। বাবা আমাকে ভার্সিটির হলে থাকার পারমিশন দিয়েছেন, জীবনে প্রথমবার আমি একা স্বাগতা আপুর বাসায় গিয়ে কয়েকদিন থেকে এসেছি, সায়েম নামক লোকটা ফ্যামিলি নিয়ে আমার বাসায় এসেছে।'

রৈনীল মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, 'এজন্যই মন খারাপ?'
'কৌশলে আমার মন খারাপের কারণ জেনে নিলেন?'
'বলা যেতে পারে। সায়েম বিয়ে করতে চায়?'
'সেরকমই অনেকটা।'
'এইটুকুন বয়সে বিয়ে? ওর মাথায় আছেটা কি?'
'সরাসরি বিয়ের কথা বলেনি। বাসায় কথা বলে রাখবে। আমি যখন চাইবো তখন বিয়ে হবে। এরকমই বললো স্বাগতা আপু।'
'আর সায়েম?'
'ওনার কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করে না।'
'তোমার পরিবারের শুনতে ইচ্ছে করে?'
'হয়তো করে। না হলে কি আর ফ্যামিলি নিয়ে সে আমাদের বাসায় আসার সাহস পায়।'
'ওর মধ্যে কি এমন দেখলো যে তোমার ফ্যামিলি বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলো?'
'রাজি হয়নি। তবে নিজেরা পরিচিত হচ্ছে এরকম ব্যাপার।'

রৈনীল হঠাৎ এমন একটা কথা বললো যে আমি কয়েক সেকেন্ড শ্বাস নিতে পারলাম না। সে বললো, 'এখন যদি আমি তোমার বাসায় গিয়ে বলি আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, তাহলে তোমার ফ্যামিলি কি ওকে ফেলে আমার সঙ্গে পরিচিত হতে চাইবে?'

আমি আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার মাথা ঘুরছে ওর কথা শুনে। রৈনীল পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো, 'পানি খাও।'

আমি পানি খেলাম। কিন্তু আশ্চর্যভাব কাটলো না। রৈনীল বললো, 'কথার কথা বললাম। মাইন্ড করোনা।'
'আমি অনেক ছোট। বিয়ে কি জিনিস সেটাই তো বুঝি না আমি। আমার এখনো বিয়ের সময় আসেনি। আগে বড় হয়ে নিই।'
'তোমার ফ্যামিলি তো মনে হয় তোমার কথা মানবে না।'

আমি খাওয়া বন্ধ করে গম্ভীর হয়ে গেলাম। রৈনীল খেয়েই চলেছে। বললাম, আমি ওনাকে দুচোখে দেখতে পারিনা। জীবনের প্রত্যেকটা বিষয় চুপচাপ মেনে নেই বলে এটাও নিবো সেটা ভাবতেই পারছি না। জানিনা আমার কপালে কি আছে। বাড়িতে "না" বলার শক্তি আজও আমার হয়নি। 

রৈনীল বললো, 'আমি যদি বিয়ে করতে চাই তুমি কি সম্মতি দেবে?'

আমি গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলাম, 'চিন্তা করে দেখতে হবে।'
'তুমি অনেক বুদ্ধিমতি। বোকা মেয়ে হলে সঙ্গে সঙ্গে মুচকি হাসি দিয়ে বলতো হ্যাঁ করবো।'
'আশ্চর্য, বোকা মেয়েরা 'করবো' কেন বলবে? আপনি তো আমার প্রেমিক নন।'
'কারণ তারা বোকা আর তুমি বুদ্ধিমতি। তুমিও বোকা মেয়ে হলে এতদিনে আমার প্রেমে উন্মাদ হয়ে যেতে।'
'আমি না আপনার কথা শুনে জাস্ট আশ্চর্য হয়ে যাই। এত দ্রুত কি কেউ কারো প্রেমে পড়ে নাকি?'

রৈনীল হাসতে হাসতে বললো, 'তারমানে তুমি সত্যি সত্যি আমার প্রেমে পড়োনি এখনো?'

আমি স্থির হয়ে ওর চোখের দিকে তাকালাম। লোকটা কী বলে এসব! তাও সিরিয়াসমুখে? আমি কেন ওনার প্রেমে পড়তে যাবো। তাছাড়া প্রেমে কিভাবে পড়তে হয় সেটাই তো আমার জানা নেই। প্রেমে পড়ার আচরণ কেমন হয়, কেমন অনুভূতি এসব নির্দিষ্ট করে আমি জানিনা। 

রৈনীল এতক্ষণ পর মুচকি হেসে বললো, 'থাক বলা লাগবে না। পানি খাও।'
'পানি খেতে হবেনা। সত্যিই আমি আপনার প্রেমে পড়িনি। আপনি মানুষটা চমৎকার কিন্তু প্রেমে পড়ার মতো যথেষ্ট নয়।'
'আমি প্রেমে পড়ার মতো যথেষ্ট কেউ নই?'
'ওটা বোঝাতে চাইনি। আমাদের মধ্যে এমন কোনো কিছু ঘটেনি বা আপনি আমাকে এমনভাবে আশ্চর্য করে ফেলেননি যাতে আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাবো।'
'তুমি অনেক ম্যাচিউর কথাবার্তা বলো। ইনোসেন্ট ম্যাচিউর।'

আমি কিছু বললাম না। আমার খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। নিঃশব্দে খাবার খাওয়ার দিকে মনযোগ দিলাম। তবে একটা বিষয় খেয়াল করলাম হঠাৎ, এই টপিক নিয়ে জগতের অন্য যেকেউ আমার সঙ্গে কথা বললে আমি ভয়ংকর রেগে খাওয়া বন্ধ করে উঠে যেতাম। তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম। ঠিক যেমন সায়েমের প্রতি আমার প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। অথচ রৈনীলের প্রতি আমার কোনো রাগ বা নেগেটিভ কোনো অনুভূতি হচ্ছেনা। কী আশ্চর্য! 

খাবার শেষ হলো। রৈনীল এতক্ষণ চামচ রেখে হাত দিয়ে খাচ্ছিলো। সে হাত ধুতে গেলো। আমি বসে রইলাম। টেবিলের ওপর তার ফোনটা রাখা। রিং হচ্ছে, নাম মৌটুসি। মেয়েটা দেখতে অসম্ভব সুন্দরী।

রৈনীল এসে ফোনটা মিউট করে রাখলো। আমি অজান্তেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, 'আপনার প্রেমিকা?'
'কলিগ। হয়তো কাজের ব্যাপারে কিছু বলবে।'
'ওহ আচ্ছা। আই এম সরি।'

আমি লজ্জিত হলাম সত্যিই। কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কখনোই কথা বলার অভ্যেস নেই আমার। রৈনীলকে কেন জিজ্ঞেস করেছি নিজেও বুঝে উঠতে পারলাম না। খাওয়া শেষ করে রৈনীল বিল পরিশোধ করলো। 
আমি বললাম, 'আজকে অফিস নেই আপনার?'
'অফিসের কাজেই বের হয়েছি।'
'দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।'
'হুম। চলো উঠি। তুমি কিসে যাবা?'
'রিকশা নিয়ে যাবো। প্রতিদিন বাসা থেকে নিতে আসে। আজকে আমার ক্লাস টাইম শেষ হয়নি।'
'তাহলে তারাতাড়ি বের হয়েছো?'
'ক্লাসে যাইনি।'
'ক্লাস না করে একটা ছেলের সঙ্গে বাইরে খেতে এসেছো। এটা তোমার বাড়ির লোকে জানতে পারলে সায়েমের গলায় ঝুলিয়ে দিতে একমুহূর্ত দেরী করবে না।'

আমি হেসে বললাম, 'যদি বাড়িতে সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন আপনি আসবেন বিয়ে করতে। আসবেন না?'

নিজের এমন মশকরায় আমি চমকে গেলাম। আজকাল আমার কী হচ্ছে জানিনা। মুখ ফসকে কী সব বলে ফেলছি!

রৈনীল অবশ্য সিরিয়াস ভঙ্গীতে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, 'ভাবনার বিষয় তো।'

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় আমি বললাম, 'আর ভাবতে হবেনা এটা নিয়ে। আমার এখন কোনো বিয়েই হচ্ছেনা। সেটা যার সঙ্গেই হোক।'
'শুভকামনা।'

আমি মুচকি হেসে পা বাড়ালাম। অকস্মাৎ সামনে দেখি আমার বাবার গাড়ি পার্ক করা। গাড়িতে ড্রাইভার বসে আছে। বাবা কিংবা ভাইয়া আশেপাশে কেউ নেই। কয়েক মুহুর্তের জন্য আমার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp