মেয়েপক্ষের পক্ষ থেকে আহিরের গায়ে হলুদে আসলো চারজন সদস্য। মেয়ের দুই ভাইবোন রবিন, মোহনা আর তাদের চাচা-চাচি। বউয়ের নাম উর্মি। আহিরের ভালোবাসার মানুষ। রবিন আর মোহনার হাতে ফুলের তোড়া। তারা বেশি সময় থাকবে না। খুবই সাময়িক সময়ের জন্য তারা এসেছে। বাহিরের জাঁকজমক দেখে মুগ্ধ হলো মোহনা। দারুণ সাজানো হয়েছে। আরহান তখন কেবল মাত্র কুঞ্জছায়ার বাড়িটি থেকে বের হয়ে আসছিল। যাওয়ার পথে চার সদস্যকে দেখে সালাম জানাল। তারাও উত্তর দিল। আরহান মিষ্টি হেঁসে শুধাল, “আপনারা মেয়েপক্ষ তো?”
আরহানের কথায় এক প্রকার সবাই অবাক হলো। মোহনা বলল,
“কি করে বুঝলেন?”
“আসলে মাসুদ আঙ্কেল বলেছিলেন আপনারা আসবেন। আপনাদের দেখে মনে হলো মেয়েপক্ষ তাই বলে ফেললাম। মিলে যাবে ভাবিনি।”
কিঞ্চিৎ হেঁসে বলল আরহান। আরহানের কান্ডে বাকিরাও হাসল । রবিন বলল,
“আপনার কণ্ঠটা বড্ড চেনা চেনা ঠেকছে কোথায় শুনেছি বলুন তো?”
আরহান বুঝতে পারলেও আসল কথা বলল না। অন্য উত্তর দিল, “ধরতে পারছি না। কোথাও শুনে থাকবেন হয়তো।”
মেয়ের চাচি আকলিমা খাতুন বললেন,
“তুমি ছেলের কি হও?”
“বিশেষ কেউ নই। ওই সামনে অতিথি নিবাস দেখছেন ওখানে আমরা তিনবন্ধু ভাড়া থাকি।”
“ব্যাচেলার?”
মেয়ের চাচা আব্দুল মিয়ার প্রশ্ন। আরহানের দ্বিধাহীন উত্তর, “জি। এছাড়া আরো একটা বিষয় আছে মাসুদ উদ্দিন একসময় আমার টিচার ছিলেন।”
আব্দুল মিয়া অবাক হলেন। হেঁসে উত্তর দিলেন,
“ওহ আচ্ছা।”
“জি৷ আপনারা ভিতরে যান মাসুদ আঙ্কেল আপনাদের অপেক্ষা করছেন।”
কথা বাড়ানো হলো না আর। সবাই অগ্রসর হলো মায়াকুঞ্জের ভিতরে। আরহান গেল নিজ গন্তব্যে।
একে একে সবাই ভিতরে ঢুকল। পিছন থেকে আকলিমা খাতুনের দৃষ্টি তখনও আরহানের যাওয়ার পানে। ছেলেটাকে কেন যেন চমৎকার লাগল। দেখতেও সুদর্শন। গম্ভীর কণ্ঠস্বরটা ভীষণ সুন্দর।
••••••••••••••
ছাদের ভিড়ে তুমুল বেগে হুল্লোড় করছে সবাই। অরিন একস্থানে বসা। তার পাশে ফাবিহা। অরিনকে নাচার জন্য ডাকা হলে শেষ মুহুর্তে গিয়ে বলল, “সে নাচবে না।” — কেন নাচবে এর উত্তর এখনও জানা যায় নি। ফাবিহা রীতিমতো ঘাটাঘাটি করছে ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু কোনোকিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অরিনের এই এক সমস্যা মেয়েটা একবার চুপ হয়ে গেলে হাজার চেষ্টা করলেও কথা বলানো যায় না। আবার একবার কথা বলা শুরু করলে ননস্টপ চলতেই থাকবে। এ রাহেলার চেয়েও প্রচুর কথা বলে। একবার আহির মজা করে রাহেলা আর অরিনের তুমুল ঝগড়া বাজিয়ে দিল। টানা চারঘন্টা সেই ঝগড়া চলে। ঝগড়ার কারণ ছিল লিপস্টিক। রাহেলা বলে লিবিস্টিক। সেই ঝগড়ায় শেষ পর্যায়ে বিজয়ী হয় অরিন। আর ব্যর্থ হয় রাহেলা। সেদিনের পর থেকে রাহেলা অন্যসব শব্দ ভুল বললেও লিপস্টিককে লিপস্টিকই বলে।'
অরিনদের থেকে খানিকটা দূরে তৌহিদ আর শান্ত দাঁড়িয়ে। তৌহিদের পরনে সাদা রঙের পাঞ্জাবি- সাদা পাজামা। পাঞ্জাবির বুকের একপাশে আকাশীরঙের কারুকাজ। চুলগুলো সিল্কি। হাতে ঘড়ি। একদম পারফেক্ট পারসন। অন্যদিকে শান্ত সেও পাঞ্জাবি পড়েছে। তারটা ব্লাক কালার। শান্তের কালো রঙ খুব পছন্দ। সে বেশিরভাগ সময়ই কালো রঙের নিজেকে রাঙিয়ে রাখে। গায়ের রঙ খুব সুন্দর হওয়ার কারণে তার গায়ে কালো রঙ সবসময় মানায়। শান্তর চোখে চশমা। তৌহিদ বলল,
“আরহানের বাচ্চা এখনও আসছে না কেন?”
শান্ত তার পকেট থেকে ফোন বের করল। তৌহিদের হাতে দিয়ে ইশারায় বোঝাল, “ফোন কর।”
তৌহিদ ফোন দিল। কিন্তু আরহান ফোন ধরল না। তৌহিদ বলল, “তুই এখানে দাঁড়া আমি ওদিকটায় গিয়ে কল করে আসি।”
মাথা নাড়াল শান্ত। যার অর্থ, “ঠিক আছে।”
তৌহিদ অন্যদিকে যেতে না যেতেই মোহনারা পা রাখল ছাঁদে। সাউন্ড বক্সের তীব্র শব্দ তখন চারিপাশ বাজনা বাজাচ্ছে। মোহনারা সরাসরি চলে গেল আহিরের কাছে। তার গায়ে হলুদ লাগানো হচ্ছে। মোহনা একটা দৌড় দিতে নিল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ধরল রবিন। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“একদম দৌড় দিবি না। আমরা শুধুমাত্র পনের বিশ মিনিটের জন্য আছি। যদি বাড়াবাড়ি করিস। এখানেরই একটা ছেলেকে ধরে বিয়ে পড়িয়ে দিব।”
মোহনা বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। এটা কি ধরনের থ্রেট হলো। সেও তো বিয়ে চায় করতে। এই সুযোগে বিয়েটা সেরে নিলেও হয়। তৌহিদ স্যারের মতো একটা গম্ভীর, রাগী মুডের মানুষ পেলে মন্দ হয় না। কথা ভেবে নিজেই চমকে উঠল মোহনা। আশ্চর্য! এখানে তৌহিদ স্যার আসলো কোথা থেকে। সে অবশ্যই বাকি স্টুডেন্টের মতো তৌহিদ স্যারের ওপর ক্রাশ-ট্রাশ খায়নি। মাথা ঝাড়লো মোহনা। যেদিন থেকে তৌহিদ স্যারের ভালো মানুষির কথা বার্তা শুনেছে। সেদিন থেকেই কেমন কেমন লাগছে। এই কেমন কেমনের উত্তর মোহনা এখনও খোঁজে।'
মোহনা আহিরের কাছে এগিয়ে গেল। খানিকটা উচ্চ আওয়াজে টেনে বলল, “দুলাভাইইই।”
রবিনের চোখে মুখে হাত। এই মেয়ে শুধরানোর নয়।'
আচমকাই কোনো মেয়ের কণ্ঠে 'দুলাভাই' শব্দটা শুনে চমকে উঠল আহির। পরবর্তীতেই নিজের শালিকাকে দেখে মৃদু হাসল সে। মোহনার সাথে তার আলাদা বন্ডিং আছে। বলা যায় আহির আর উর্মির প্রথম প্রেমে ধরা খাওয়ার মানুষটিই ছিল মোহনা। মেয়েটা এক নাম্বারের ধুরন্ধর। পুরো দু'বছর আহিরের কাছ থেকে দেড়শো টাকা দামের চকলেট খেয়েছে যতবার দেখা হয়েছে ততবার। আহির কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,
“শালিকা তুমি?”
“আপনায় দেখতে আসলাম।”
“তোমার আপা পাঠিয়েছে?”
“হুর। আপা তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়?”
“কি বলো?”
“সত্যি বলছি। আহেন দুইটা সেলফি তুলি।”
আহির তুলল। এরপরই সেই ছবি পাঠানো হলো উর্মিকে।
••••••••••••••
লাগাতার কল বাজছে আরহানের ফোনে। সে তখন কেবলমাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়। ফোন তুললেই তৌহিদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে,
“ওই শালা এতক্ষণ কোথায় ছিলি– একটা ফোন তুলতে এত সময় লাগে?”
“ওয়াশরুমে ছিলাম।”
“ও আচ্ছা। ছাঁদে আসবি না।”
“আসতে ইচ্ছে করছে না। ভাবছি এখান থেকেই বেরিয়ে যাব।”
“পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও আয়।”
“দেখছি।”
“আচ্ছা পাঞ্জাবি পড়ে আসিস।”
“হুর। পাঞ্জাবি পড়ার কি আছে?”
“হলুদের অনুষ্ঠান না। পাঞ্জাবি না পড়লে ভালো দেখায়।”
“এত এনার্জি হবে না আমার। একেবারেই স্টুডিওর জন্য রেডি হয়ে বের হব আমি।”
তৌহিদ আর জোর করল না। বলল,
“ঠিক আছে।”
ফোন কেটে গেল। তৌহিদ পিছন ফিরল এরই মধ্যে সাউন্ড বক্সে সাকিব খানের অতিব পুরনো একটা মুভির গান ছাড়া হলো। গানটা ছিল এমন—
“মন ভাসাইয়া প্রেমের সাম্পানে
মন থাকেরে তোমার সন্ধানে
আগুন জ্বালাইয়া মনের লনঠনে
আছো লুকাইয়া তুমি কোনখানে
নয়নও ঘুরাইয়া খুঁজি তোমারে তোমারে।
তোমারে তোমারে..
অন্তরও বিছাইয়া খুঁজি তোমারে তোমারে।
তোমারে তোমারে।”
ছাঁদে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তখন স্টেজের মাঝখানে। কারণ এই গানে নাচছে আহিরের শালিকা মোহনা নামের মেয়েটা। মোহনার কান্ডে সবাই বিমোহিত। তৌহিদের দৃষ্টিও গেল ঠিক সেই মুহূর্তে। আকাশি রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে মোহনা। চোখে কালো চশমা পড়ে সে কি নাচের অঙ্গভঙ্গি। তৌহিদের চোখ চড়ুইগাছ। মুখে রটে একটাই কথা, “এই মেয়ে এখানে কি করছে?”
একপ্রকার ছাঁদ ভেঙে ভাড়ি লালরঙের কাঁচ করা থ্রি-পিস পড়ে হাজির হলো রাহেলা। তার সখের গান ছাড়া হয়েছে ছাঁদে। এখন কি আর রাহেলাকে ধরে রাখা যাবে। রাহেলা দু'পাঁচ কিছু না ভেবেই ছুটে গেল মোহনার কাছে। এরপর কি দুই পাগল মিলে উড়াধুরা নাচানাচি। উপস্থিত সবাই ব্যাপারটার জন্য হাসছে, মজা করছে। মোহনাও রাহেলাকে পেয়ে খুশি হলো।
'একে একে সবাই নাচতে শুরু করল। আহিরের বন্ধুরাও সঙ্গ দিল ওদের। ফাবিহা অরিন তখনও চুপচাপ বসা৷ ফাবিহা সম্পূর্ণ বিষয়টাকে এনজয় করলেও অরিন আছে গম্ভীর মুডে। ফাবিহা নাচতে জানে না। তাই নাচানাচি তাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু অরিন ও তো নাচতে জানে তাও চুপচাপ বসে আছে। ফাবিহা বলল, “তুই ও যা না অরিন।”
অরিন গেল না। গম্ভীর মুডে বসে রইল। ফাবিহা বলল, “হয়েছেটা কি বলবি তো?”
অরিন বলল না। চুপ করে রইল। ফাবিহা নিরাশ হয়ে তাকিয়ে রইল। সামনের মোহনা মেয়েটাকে খুবই চমৎকার লাগল। কি সুন্দর অপরিচিত জায়গায় এসেই মিশে গেল সবার সাথে। অরিনও কিছুটা ধাপ করে সবার সাথে মিশে যাওয়ার মতো মিশুক মানুষ। আর এক হলো ফাবিহা। কারো সাথে মেশা তো দূর। অপরিচিত কারো সামনে পড়লেও অস্থিরতায় ভোগে। মাঝে মাঝে বড্ড মন খারাপ হয় ফাবিহার। খালিই ভাবে, কেন সে বাকিদের মতো ধাপ করে সবার সাথে মিশতে পারে না। কেন পারে না?”
গান আর নাচ যখন একেবারে শেষ পর্যায়ে ঠিক সেই মুহুর্তে মোহনার চোখ গেল ছাদের কর্ণারের লাইটার কাছে চশমা পড়া একটা ছেলের পাশে তৌহিদ স্যার দাঁড়িয়ে। মোহনা সত্যি দেখছে কিনা বুঝতে পারছে না। কিছু সময় পর যখন মনে হলো সত্যি সত্যিই ওইটা তৌহিদ স্যার। সঙ্গে সঙ্গে তার পা থেমে গেল। তৌহিদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। রাহেলা মোহনার হাত ধরে লাফায়। মোহনাকে থেমে যেতে দেখে বলে,
“কি হইল আপা এনারজি শেষ?”
মোহনা বলল না। তার দৃষ্টি তখনও তৌহিদের দিকে।
আরে আল্লাহ! এসব কি হয়ে গেল! মোহনা শুঁকনো ঢোগ গিলল। তার মনে হলো তার পুরো পৃথিবী ঘুরছে। এবং ঘুরে ঘুরে গান গাইছে, “আমি ফাইসা গেছি, ও আমি ফাইসা গেছি মাইনকা চিপায়।”
.
.
.
চলবে.......................................................................