নীলিমা চিরকুটটা খুলে দেখলো অপরিপক্ক হাতের লেখনী। এমন হাতের লেখা কার হতে পারে তার জানা নেই। সে ভ্রু কুঁচকে খানিক কষ্ট করে পড়তে আরম্ভ করলো,
" বিশাল নীল আকাশের নীলিমা,
হাতের লেখার জন্য আগে থেকেই সরি বলে রাখছি। একটু কষ্ট করে পড়ার চেষ্টা করো। "
এটুকু পড়েই সে চট করে রাফার দিকে তাকালো। কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" কে লিখেছে এই চিঠি! হাতের লেখার কি ছিরি! মনে হচ্ছে কাগজের উপর তেলাপোকা ছেড়ে দিয়েছে!"
রাফা ঠোঁট টিপে হাসলো। বললো,
" পড়তে থাক। বুঝবি।"
নীলিমা আবারও পড়তে আরম্ভ করলো। তবে এবার ভীষণ বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে পড়ছে। চিরকুটে লেখা,
" শুনেছি মানুষের মনের রাস্তা পেটের মাধ্যম দিয়ে যায়। তাই ভাবলাম তোমার উপরও এই ট্রিক এপ্লাই করি। আসলে আমি এসব সরি বলা, অভিমান ভাঙানো, রাগ ভাঙানো, এসবে ভীষণ কাঁচা। মেয়েদের নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা শূন্যের কাছাকাছি। এজন্যই বোধহয় ছয় বছর আগে তোমার কোমল মনটাকে ওভাবে ভেঙে দিয়েছিলাম,অপমান করেছিলাম। এবারও বুঝতে পারিনি তুমি কেনো রেগে আছো। বুঝতেই পারছো, এসব মেয়েঘটিত ব্যাপার-স্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা একদম নেই। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলে বোধহয় তোমার রাগটা আগেই ভেঙে ফেলতাম। এবার বড় করে 'সরি' লিখছি। আমার ব্যবহার, কথাবার্তার জন্য অনেক অনেক সরি। আশা করি আমাকে মাফ করতে পারবে। তোমার জন্য স্পেশালি এই শাহী জিলাপি ও আলুর চপ এনেছি। পেট পুরে খেলে ভাববো আমার সরি বলা কাজে লেগেছে।
~ স্মরণ। "
চিরকুটটা হাতের ভাঁজে রেখে কয়েক সেকেন্ড হা করে রাফার দিকে চেয়ে রইলো নীলিমা। বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললো,
" এটা স্মরণ ভাই লিখেছে! ঐ খাটাশ!"
রাফা হাসতে হাসতে বললো,
" আস্তে বল। স্মরণ ভাই শুনে ফেলবে তো!"
নীলিমা চট করে আঙুল নিয়ে ঠোঁটের উপর রেখে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলালো। গলার স্বর খাদে নামিয়ে সাবধানী গলায় জিজ্ঞেস করলো,
" স্মরণ ভাই রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি নাকি?"
" সেটা তো জানি না। তবে এটা আপাতত লুকিয়ে রাখ। ইফতারের পর খেয়ে নিস।"
নীলিমা মুহূর্তেই স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে ফিরে এসে খানিক ভাব বললো,
" তোকে কে বললো আমি উনার দেয়া জিনিসগুলো খাবো?"
রাফা মৃদু বিস্ময়ের স্বরে বললো,
" এর মানে কি! তুই উনার সরি একসেপ্ট করবি না?"
নীলিমা প্যাকেট দুটো ওয়ারড্রোবের উপরে রাখতে রাখতে দায়সারা গলায় বললো,
" চিন্তাভাবনা করবো। দেখা যাক আমার কোমল মনটা কি বলে।"
বলেই সে ফিক করে হেসে ফেললো। তার হাসির তোড়ে রাফা নিজেও হেসে ফেললো। ইতোমধ্যে রান্নাঘর থেকে তাদের ডাক এসেছে। ইফতার বানানোর কাজে সাহায্য করার জন্য।
আজ বড় ডেকচি পাতিলে হালিম রান্না করা হচ্ছে। সাথে পেঁয়াজু আর ছোলা ভুনা। মানতাসাকে এই পুরো রোজা চুলোর কাছে যেতে দেয়া হয়নি, সামনে বিয়ে বলে। এজন্য রোজ তার কাঁধে ফল কাটার দায়িত্ব পড়ে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আজ নীলিমার দায়িত্ব পড়েছে শরবত বানানোর। বাড়ির মহিলাগণ তড়িঘড়ি করে কাজ সারছে। ইফতারে আর বেশি সময় বাকি নেই। আজই হয়তোবা এ বছরের শেষ রোজা হতে পারে। এজন্য সকলের মাঝে একটু বেশিই তাড়াহুড়ো দেখা যাচ্ছে। দোয়া করতে হবে যে!
ইফতার সামনে নিয়ে বসেছে সবাই। বাহাদুর শেখ আজ জোরে জোরে দোয়া পড়ছেন। পরকাল নিয়ে দোয়া শেষে তিনি এবার ইহজাগতের দোয়া করতে লাগলেন। তার দোয়ার নমুনা অনেকটা এরকম,
" হে আল্লাহ, আমার নাতনিডার ভালোভাব বিয়া হওয়ায় দিও। ও যানি সারাজীবন খুশি থাহে।
হে আল্লাহ, আমার নাতিগুলার রোজগার বাড়ায় দিও। সবাইরে সুস্থ সবল রাইখো।
হে আল্লাহ, আমার নীলুর জন্যি খুব সুন্দর একখান জামাই দিও। ওরে তাড়াতাড়ি বিয়া দিয়া দিও। আমার নীলুরে লাল শাড়ি পইরা দেহার খুউব ইচ্ছা। মরার আগে আমার এ ইচ্ছাডারে পূরণ কইরো আল্লাহ। আমিন।"
বলে তিনিসহ সকলে দু হাত দিয়ে মুখ মাসহ করলেন। দোয়া শেষ হওয়া মাত্রই রাফি বললো,
" নানার দোয়া বিয়ে দিয়ে শুরু, বিয়ে দিয়ে শেষ।ভাগ্যিস নিজের বিয়ের জন্য দোয়া করেনি উনি।"
রাফির এ কথায় উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো। কিন্তু স্মরণ হাসতে হাসতে তার পিঠে একটা কিল বসালো। রাফি চট করে ভ্রু কুঁচকে ক্রোধান্বিত চাহনিতে চেয়ে বললো,
" শুধু শুধু মারলে কেনো স্মরণ ভাইয়া?"
স্মরণ ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
" নানার বিয়ের কথা বললি কেনো!"
" আমি কি সত্যি সত্যি বলেছি নাকি! মজা করে বলেছি।"
স্মরণ আর প্রত্যুত্তর করলো না। সে জানে রাফি মজা করেই বলেছে। এটা শুধু রাফিকে মারার একটা বাহানা।
ইতোমধ্যে আজান দিয়ে দিয়েছে। সবাই একসাথে ইফতারি খেতে আরম্ভ করলো। আজ আবার দ্রুত ইফতার করে নামাজ পড়ে চাঁদ দেখতে যাবে সবাই।
মাগরিবের নামাজ পড়ে বাড়ির প্রায় সবাই উঠোনে চলে এলো৷ ছেলেরাও সবাই মসজিদ থেকে বাড়িতে চলে এলো। সবার মাঝে চাঁদ দেখার প্রচন্ড উৎসুকতা কাজ করছে। কাল ঈদ নাকি এ জানার আগ্রহ প্রত্যেকের মাঝে বিদ্যমান। কিন্তু গায়ের এ ফাঁক, ও ফাঁক দিয়েও চাঁদের দেখা মিলছে না৷
নীলিমা এতক্ষণ নামাজ পড়ছিলো। তারই একমাত্র নামাজ পড়তে দেরি হয়েছে। তাই নামাজ শেষ করে প্রায় দৌড়ে উঠোনে চলে এলো। এসেই উৎসুক গলায় শুধালো,
" ঈদের চাঁদ দেখা গিয়েছে?"
নীলিমার উৎসুক কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে স্মরণ তার দিকে তাকালো। মাত্রই নামাজ পড়ে এসেছে সে। সাথে সাদ ও সাজিদ। স্মরণের দৃষ্টি নীলিমার উপর নিবদ্ধ। নীলিমার ভাবসাব বুঝতে ব্যস্ত। নীলিমা আদৌ তাকে মাফ করেছে কি না এ নিয়ে জানতে মরিয়া হয়ে উঠছে সে। এদিকে এতগুলো মানুষের সামনে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করাও সম্ভব না। কি জ্বালা!
সবার দৃষ্টিজোড়া আকাশে নিবদ্ধ। কই চাঁদ? কোন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে সে? নাকি আজ চাঁদ দেখা যায়নি? তবে কি কাল ঈদ হবে না?
এরই মধ্যে সাদ অকস্মাৎ গলার স্বর উঁচু করে বললো,
" গাইস গাইস, একটা জরুরী ঘোষনা।"
তার কণ্ঠস্বর শোনামাত্রই সকলের দৃষ্টি আকাশ হতে নেমে গিয়ে তার দিকে নিবদ্ধ হলো। সাদ এবার বললো,
" আজ আকাশের কোথাও শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যায়নি। সো কাল ঈদ হচ্ছে না।"
সাদের কথায় সবার মুখেই উদাসীনতা নেমে এলো। রাফি বলতে লাগলো,
" ইশ, আরো একটা রোজা করতে হবে!"
রাফা তা শোনা মাত্রই রাফির মাথায় ঠাস করে গাট্টা মেরে বললো,
" রোজা চোর কোথাকার! "
রাফির এ মা' র খাওয়া দেখে পাখি মিটমিটি হাসতে লাগলো। রাফিকে মা' র খেতে দেখলে তার ভীষণ মজা লাগে। কারণ রাফি ছেলেটা তাকে ভীষণ জ্বালায়। ছেলেটা ভাই কম শত্রু বেশি।
পাখিকে হাসতে দেখে রাফি জিব বের করে ভেঙচি কাটলো। পাখিও ফিরতি ভেঙচি কাটলো। এভাবে দুজনের মধ্যে ভেঙচি কাটার প্রতিযোগিতা চলতে লাগলো।
যেহেতু আজ ঈদের চাঁদ দেখা যায়নি তাই সবার মধ্যেই কম বেশি হতাশা কাজ করছে। বড়রা একে একে বাড়ির ভেতর যেতে লাগলে সাজিদ চট করে কাজিন মহলের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব দিলো,
" চলো, সবাই একসাথে উঠানে বসে আড্ডা দেই।"
কাজিন মহলের সকলেই রাজি হয়ে গেলো এক সুযোগেই। সবাই দুঃখী ভাবটা কাটিয়ে আনন্দ উৎসব করার মনঃস্থির করলো। নওরীন বললো,
" রাফা আর নীলিমা গিয়ে বড় পাটি দুটো নিয়ে আয়। "
রাফা ও নীলিমা নওরীনের কথামতো বাড়ির ভেতর পাটি আনতে গেলো। সকলের দৃষ্টি উপেক্ষা করে স্মরণও তাদের দুজনের পিছু পিছু গেলো। সিঁড়িঘর পার হওয়া মাত্রই স্মরণ আগ্রহী কণ্ঠে নীলিমাকে জিজ্ঞেস করলো,
" নীলিমা? আমার সরি কি একসেপ্টেড?"
নীলিমা চট করে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কোনো জবাব দিলো না। এতক্ষণে তিনজনেই হাঁটতে হাঁটতে পাটি নিয়ে এসেছে। স্মরণ ফের একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো,
" কি হলো? খাওনি ওগুলো?"
নীলিমা অনাগ্রহী সুরে বললো,
" আপাতত এর জবাব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি না। "
বলেই সে রাফা ও স্মরণকে ডিঙিয়ে পাটি নিয়ে উঠোনে চলে গেলো। পিছে স্মরণ হতাশ গলায় রাফাকে জিজ্ঞেস করলো,
" রাফা? এ ব্যাপারে কিছু জানো?"
রাফা অসহায় কণ্ঠে বললো,
" এখনও জানি না ভাইয়া। তবে আশা রাখুন। আমার মনে হয় নীলিমা আর ঘাঁটাবে না ব্যাপারটাকে। হয়তো আপনার সরি একসেপ্ট করবে।"
বলেই সে চলে গেলো। পিছে স্মরণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে হতাশ গলায় বিড়বিড় করে বললো,
" মেয়ে মানুষের কাছে ভুলের ক্ষমা পাওয়া এত জটিল প্রসেস, এটা জানলে সেদিনই নীলিমার প্রপোজাল একসেপ্ট করে নিতাম। তাহলে এতদিনে বিয়ে করে ফুটবল টিম বানিয়ে ফেলতাম। এরপর কোনো ভুল করলে আমার একটা প্লেয়ারকে পাঠিয়ে দিতাম, আমার হয়ে সরি বলার জন্য। উফ, মেয়েদের মতি-গতি বোঝা এত কঠিন কেনো!"
.
.
.
চলবে...............................