প্রেমান্বেষা - পর্ব ১০ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


রাতের খোলা আকাশের নিচে পাটির উপর বসে ভরপুর আড্ডা হচ্ছে। বিশাল কাজিন গোষ্ঠীর সকলেই উপস্থিত এখানে। প্রথমে ছোট দুজনকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। পরে অবশ্য নওরীনের কথায় তাদের ডাকা হয়েছে। 
দুটো বিশাল পাটিতে কেউ বসে আছে, কেউ শুয়ে আছে। যেমন নওরীন বসে আছে আর সাজিদ তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রাফি মাথার নিচে হাত ঠেকিয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে শুয়ে আছে, যেনো রাজার ভঙ্গি! পাখির আবার এমন ভাবভঙ্গি মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। সে কনুই দিয়ে রাফির হাঁটুতে গুঁতো দিলে রাফি ভারসাম্য হারিয়ে হাঁটু ভেঙে পাশে পড়ে গেলো। পাখির এ কান্ডে রাফি প্রতিশোধমুখো হতে গিয়েও মিইয়ে গেলো। কারণ স্মরণ গরম দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। চুপসে গেলো সে। চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো উঠে বসলো। 

বেশ কিছুক্ষণ গল্প চললো। অতঃপর মাহবুব প্রস্তাব দিলো বোতল ঘুরিয়ে ট্রুথ ও ডেয়ার খেলতে। তার এক বাক্য উচ্চারণের সাথে সাথেই সকলে রাজি হয়ে গেলো। পাখি দৌড়ে গিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে আধ খালি একটা বোতল নিয়ে এলো। এনে দু পাটির ঠিক মাঝ বরাবর রাখলে সবাই সেই বোতলকে ঘিরে গোল হয়ে বসলো। 

সাজিদ সবাইকে প্রস্তুত হতে বলে বোতলটা ঘোরালো। প্রথম রাউন্ড পড়লো রাফির উপর। খুশিতে সকলে একত্রে হো হো করে চিৎকার করে উঠলো। সাজিদ জিজ্ঞেস করলো,
" ট্রুথ না ডেয়ার?"

রাফি বেচারা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। এবার কোনটা বেছে নিবে? ট্রুথ নিলে যদি তার কোনো গোপন তথ্য জিজ্ঞেস করে বসে! আবার ডেয়ার নিলে যদি কোনো অকাজ করতে বলে! উভয়সংকটে পড়লো সে। এরপর বেশ চিন্তাভাবনা করে সে ট্রুথ বললো। নিজেকে সাহস জোগালো, কী-ই বা এমন জিজ্ঞেস করবে সাজিদ। ওমন জটিল কিছুও জিজ্ঞেস করবে না নিশ্চয়ই। এই ভেবে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, 
" ট্রুথ নিবো আমি।"

সাজিদ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" তো বলুন ছোট শ্যালক সাহেব, জীবনে কখনো চুরি করে পরীক্ষা দিয়েছেন?"

মুহূর্তেই রাফির মুখটা প্রায় পাংশুটে হয়ে এলো। এই সত্যটাই তো তার ছোট্ট এই জীবনের সবচেয়ে বড় গোপন কথা। আর ঘুরেফিরে একদম বাঁশ দেয়া প্রশ্নটাই করে বসলো সাজিদ! স্মরণ রাফির চেহারা দেখে খুঁচিয়ে বললো,
" কি রে? চুপ করে আছিস কেনো? বল। চুরি করেছিস নাকি কোনোদিন? শোন, একদম মিথ্যে বলা যাবে না কিন্তু। মিথ্যে বললেই কান মলা খাবি।"

শুকনো ঢোক গিললো রাফি। তার আধ শুকনো মুখ থেকে মানতাসা, রাফা, নীলিমা ঠোঁট টিপে হাসলো। রাফি কয়েক সেকেন্ড সময় লাগিয়ে নিজেকে সাহস জোগালো। অতঃপর একটা ঢোক গিলে বললো,
" হ্যাঁ চুরি করেছি।"
বলেই সে খিঁচে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তার এ হাবভাব দেখে সকলেই আন্দাজ করেছিলো সে চুরি করেছে। কিন্তু রাফির এ জবাব দেয়ার পর সবাই বিস্ময় প্রকাশ করে হা করে উঠলো। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে পাখি। কারণ একই ক্লাসে থাকার পরও সে কোনোদিনও রাফির চুরি ধরতে পারিনি। রাফির কথা শুনে পাখি একই সাথে বিস্মিত ও ক্রোধান্বিত হলো। জমজ হওয়ার খাতিরে মুহূর্তেই রাফির পিঠের উপর ধুমাধুম দুটো কিল বসালো পাখি। ক্রোধে নাক ফুলিয়ে, চোখ গরম করে বললো,
" রাফির বাচ্চা! তুই পরীক্ষায় চুরি করেছিস! ছিঃ! আমি তোকে ভালো ভাবতাম। কিন্তু পরীক্ষাতেও তোর শয়তানী যায় না! আমি এক্ষুণি আব্বু আম্মুকে বলবো, দাঁড়া।"

অন্য সময় হলে রাফিও পাখির পিঠে উল্টো কিল বসাতো। কিন্তু এখন নিজের দোষ বলে সে কিছুটা দূর্বল হয়ে আছে। এবার অনুনয়ের সুরে পাখিকে বললো,
" বিশ্বাস কর, একবার মাত্র করেছি। তাও ক্লাস ফাইভের অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষায়। আর কোনোদিন করিনি। প্লিজ আব্বু আম্মুকে বলিস না। আম্মু আমাকে অনেক মারবে। "

রাফির দূর্দশা, পাখির শাসন দুই-ই দেখে সকলে হেসে ফেললো। রাফা এর মধ্যে আর নাক গলালো না। সে ঠিকই জানে, পাখি কখনো তার মা'কে এসব বলবে না। জমজ দুটো একে অপরের কড়াকড়ি শত্রু হলেও একে অপরের ভুলগুলো ঢেকে রাখে।।
মাহবুব এবার দুজনকেই ঠেকালো। পাখিকে মৃদু ধমকের সুরে বললো,
" চুপ কর পাখি। এটা খেলা। এত সিরিয়াস হওয়ার কিছু হয়নি। আর একটা কথাও বাড়াবি না। ভুল মানুষই করে। "

স্মরণও মাহবুবের সাথে একমত হলো। বললো,
" আর এমন তো না যে রাফি এখনও এ কাজ করছে। জীবনে একবার করেছে। ওটাই শেষ। একটু তো এক্সপেরিয়েন্স দরকার হয় তাই না। "

রাফি বিস্মিত নয়নে স্মরণে দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। তার বোধ বুদ্ধি হওয়ার পর এই প্রথম বোধহয় স্মরণ তার পক্ষে কথা বলেছে। আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়লো বেচারা রাফি। 
এদিকটা অল্পতেই মিটমাট করে আবারো খেলা আরম্ভ হলো। এবার বোতল ঘুরে গেলে রাফার দিকে। সে বুদ্ধিমানের মতো ডেয়ার নিলে নওরীন বললো একটা গান গেয়ে শোনাতে। ফাঁকা গলায় মিষ্টি স্বরে বাংলা একটা গান গেয়ে শোনালো সে। গান শেষ হতেই সবাই করতালিতে মহলটাকে আরোও তরতাজা করলো। এরপর একে একে মাহবুব, নওরীন ও পাখিকে পালাক্রমে ট্রুথ ও ডেয়ার দেয়া হলো। এবার পালা এলো মানতাসার। মানতাসার দিকে বোতল ঘুরেছে ঠিকই। কিন্তু সে নিজেই উল্টোদিকে ঘুরে আছে। সবার আড়ালে কখন যে উল্টোদিকে ঘুরে তার হবু স্বামী ফাহাদের সাথে ফোনে কথা আরম্ভ করেছে তা কেউই টের পায়নি। সকলে খেলায় মগ্ন। 
মানতাসার এ অবস্থা দেখে একজনের দূরত্বে বসে থাকা নওরীন আলতো হাতে মানতাসার ওড়নায় টান মারলো। এই ক্যাচক্যাচপূর্ণ জায়গায় বসেও ফাহাদের সাথে কথা বলায় সে এতোটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছে যে ওড়নার টানটাও খেয়াল করেনি। নওরীন এবার অবাক হয়ে জোরে টান মারলে মানতাসা ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দিলো। চট করে সামনের দিকে ফিরে অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বললো,
" ইয়ে মানে খেলা কি শেষ?"

তার এ বেগতিক পরিস্থিতিতে সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। নওরীন টিপ্পনী কেটে বললো,
" এই জামানার জুলিয়েট, রোমিওকে রেখে এদিকটায় একটু মনোযোগ দিন। এতগুলো হতভাগা আপনার অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছিলাম।"

মানতাসা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ফের৷ কি লজ্জায় পড়ে গেলো বেচারি! হবু বধূদের বুঝি এমনই জ্বালা হয়। খেলার মাঝে ফাহাদ তাকে ম্যাসেজ দিয়েছিলো, এখন কথা না বললে সোজা তার ফোনে কল করবে। মানতাসা ভয়ে তখনই কল করে কথা বলে। কিন্তু ফাহাদের এ জিদের জন্য যে আজ কাজিনমহলের সামনে হাসির পাত্র হতে হলো! এর প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে। এজন্য মনে মনে পণ নিলো, গোটা একদিন সে ফাহাদের সাথে কোনোরূপ কথা বলবে না। 

মানতাসার এ অবস্থা দেখে স্মরণ টিপ্পনী কাটলো,
" ফাহাদের কপাল সেই লেভেলের ভালো মানতাসা! তোমার মতো ওয়াইফ পাচ্ছে, যে এই মজার সময়গুলো এঞ্জয় না করে হবু বরকে সময় দিচ্ছে। "

মানতাসা ক্ষণেই নত মস্তকে মিনমিনে সুরে বললো,
" সরি স্মরণ ভাই। আসলে...."

তাকে কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে সাজিদ বাহবা দেয়ার স্বরে বললো,
" আরে এতে সরি কেনো বলছো। বিয়ের আগে সব মেয়েই টুকটাক ওমন ছিলো। তোমার নওরীন আপু তো এর চেয়ে বেশি ছিলো। দিন নেই ক্ষণ নেই সবসময় আমার সাথে কথা বলা লাগবে তার।"

সাজিদের কথাটা সত্য। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর নওরীনই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলো। উতলা হয়ে থাকতো সাজিদের সাথে কথা বলার জন্য। ফলে আজ সাজিদের এ কথায় লজ্জায় তার গাল দুটো রক্তিমাভাব ধারণ করে। 

সবাই খেলায় ফিরলো। মানতাসাকে তার প্রথম ভালোবাসার নাম জিজ্ঞেস করা হলে সে ফাহাদের নাম বললো। সবাই আবারো তাকে লজ্জা দিলো। বিশেষ করে মেয়েগুলো। 
খেলা আবারো আরম্ভ হলো। বোতল ঘুরে এবার নীলিমার দিকে পড়লো। সাজিদ তাকে ট্রুথ ডেয়ারের মধ্যে বাছাই করতে বললে সে ট্রুথ নিলো। সাথে সাথেই সাজিদের কাছ থেকে প্রশ্ন ছিনিয়ে নিয়ে মাহবুব বললো,
" নীলিমাকে আমি প্রশ্ন করবো। "

সাজিদ বললো,
" আচ্ছা করো তবে।"

মাহবুব নীলিমার দিকে সামান্য ফিরে স্মরণের দিকে খানিক আড়চোখে চেয়ে চেয়ে নীলিমাকে জিজ্ঞেস করলো,
" তো নীলিমা, তোমার জীবনে কি কখনো প্রেম এসেছে? আর এলে তোমার প্রথম প্রেমের নাম কি?"
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন