তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ১০ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


রৈনীলের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমি বহুদূর হেঁটে এলাম। চারপাশে এক শান্ত শীতল বাতাস। আমার মাঝেমাঝেই মনে হচ্ছিল, জীবনটা এখানেই থমকে যেতো যদি! 

রৈনীল আমাকে এক বিশালাকার পুকুরের পাশে নিয়ে এলো। পুকুরের ধারে মাছ ধরার জন্য বড়শি রাখা আছে। সে জিজ্ঞেস করল, 'কখনো মাছ ধরেছো এটা দিয়ে?'
আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম, 'না।'

রৈনীল বললো, 'চলো মাছ ধরি। অনেক মজা পাবে।'
'কিন্তু, আমি জানিনা কিভাবে মাছ ধরতে হয়।'
'শিখিয়ে দেবো। এসো, এখানে বসো। এই বড়শিটা এভাবে ধরো।'

রৈনীল এমনভাবে আমাকে শিখিয়ে দিতে লাগলো যেন আমি একটা বাচ্চা। একদম শিশুসুলভ ভঙ্গীতে সে আমাকে বড়শি ফেলা শেখালো। একজন বেয়াড়াকে ডেকে বড়শিতে লাগানোর জন্য খানিকটা ময়দার খামির বানিয়ে দিতে বলেছিল। বেয়ারা আসা পর্যন্ত আমরা বসে রইলাম। 

রৈনীল বললো, 'তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা কি?'
'আমার ভাবনা? আমি তো উড়ে বেড়াতে চাই। স্বাধীনতা নিয়ে, পাখির মতো দুটো ডানা জন্মাক এই চাই।'
'সেটা আবার কিরকম? ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসো?'
'ঠিক তা নয়। আমার জীবনে তেমন কোথাও ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। আমি শুধু চাই নিজের জন্য একটা মুক্ত জীবন। যখন ইচ্ছে তখন ঘরের বাইরে বের হয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারার স্বাধীনতা, নিজের বিছানায় যেভাবে ইচ্ছে ঘুমানোর স্বাধীনতা, যখন ঝুপ করে বৃষ্টি নামবে তখন ভিজতে পারার স্বাধীনতা। ঠিক এরকম যে স্বাধীনতা টুকুর জন্য আমার মতো মেয়েরা ধুকে ধুকে মরে।'

রৈনীল অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইলো, 'কী বলছো এসব? তোমার জীবনে কি এইটুকু স্বাধীনতাও নেই?'
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।

রৈনীল কয়েক মুহুর্ত চুপ করে রইলো। আমি জানি সে কী ভাবছে। প্র‍থম যেদিন দেখা হলো, আমি একা গিয়েছিলাম বাসার ভেতর। তাই হয়তো রৈনীল ভেবেছিল আমি অনেক স্বাধীনতায় বড় হওয়া মেয়ে। যে মেয়েটা মধ্যরাতে একা একা বোনের বাসায় আসতে পারে, সারপ্রাইজ দিতে পারে। অথচ ভেতরের গল্পটা তার জানা নেই।

আমি ওর সেই ভুল ভাঙাতে চাইনি। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। আজ যদি না বলি, তবে নিজেরই বড্ড অস্বস্তি হবে। আমি বললাম, 'আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটেছে সেদিন রাতে। জুবায়ের ভাইয়ার জন্মদিনে। ওইদিন প্রথম নিয়ম ভেঙে ভাইয়া আমাকে আপুর বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়। নয়তো আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়ও হয়তো হতো না। এর আগে কোনোদিন আমি পরিবার ছাড়া কোথাও যাইনি। তারপর থেকেই একের পর এক বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটছে। স্বাগতা আপুর বাসায় কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। এটাও আমার জীবনের অন্যতম আশ্চর্যজনক ঘটনা।'

রৈনীল বললো, 'আর এভাবে আমাদের বারবার দেখা হয়ে যাচ্ছে। আমার কি মনে হয় জানো? প্রকৃতি ইচ্ছেকৃত ভাবে সেদিন নিয়ম ভেঙে দিয়েছে। যাতে তোমার সঙ্গে আমার আলাপ হয়, পরিচয় হয়। এইযে তোমার মতো এত ইনোসেন্ট একটা মেয়ে আমি আমার জীবনে একটিও দেখিনি। ওইদিন দেখা না হলে কি এটা আমার জানা হতো বলো?'

আমি একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। সত্যিই তাই! আমিও আমার এই ছোট্ট জীবনে রৈনীলের মতো অসাধারণ মানুষ আর একটাও দেখিনি। অবশ্য আমার দেখার গণ্ডিটা খুব ছোট। হতে পারে বাকি জীবনে আরো অনেক মানুষের দেখা পাবো। কিন্তু ওই স্মরণীয় রাতটার কথা কখনো ভুলবো না আমি। 

মাছ ধরার জন্য খামির চলে এসেছে। রৈনীল বড়শির মাথায় ছোট্ট করে খামির পেঁচিয়ে দিয়ে পানিতে ফেললো। বসে রইলাম খানিকক্ষণ। আমিও আমার বড়শি ফেলেছি। মিনিট খানেকের মাথায় আমার বড়শিতে টান পড়ছিল। রৈনীল খপ করে আমার বড়শিটা ধরে এক টানে ওপরে তুলে ফেললো। মাঝারি সাইজের একটা মাছ উঠেছে। আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম আমি। রৈনীল মাছটা ছাড়িয়ে নিয়ে বালতিতে জমিয়ে রাখলো। আবারও বড়শি ফেললাম। 

বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, একদৃষ্টে নজর রাখতে হয়। অন্যদিকে তাকানোর সুযোগ নেই। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার রৈনীলের বড়শির খাবারটা মাছ খেয়ে চলে গেছে। আমি দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটা মাছ ধরলাম। বড়শি ওঠানো ভুলে আমি আনন্দে চেঁচামেচি করছিলাম। রৈনীল নিজে আমার বড়শি তুলে দিলো। 

এভাবেই মজার সময় কাটছিল আমার। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে আমরা বসে রইলাম। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, রৈনীলের বড়শিতে একটা মাছও ওঠেনি। অথচ আমি এরমধ্যে চারটা মাছ ধরেছি! আমি যারপরনাই বিস্মিত। আমার জীবনে এই মাছ ধরার ঘটনা প্রথম বলেই কি প্রকৃতি আমাকে বিস্মিত করছে?

রুমে ফিরে দেখি জুবায়ের ভাইয়া'রা সুইমিংপুলে নামার জন্য তৈরি হচ্ছে। আপু জানতে চাইল আমি এখনই নামবো কি না। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। ছেলেরা দলবেঁধে নামছে। আপুরাও নামবে। আমি একা দাঁড়িয়ে থাকলে সকলে কী ভাববে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমিও এসে পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম। 

ঠাণ্ডা পানির স্পর্শ পেতেই মনটা উড়ুউড়ু করে উঠলো। ইচ্ছে করছিল লাফ দিয়ে এখনই নেমে পড়ি। আমাদের দল ফুটবল নিয়ে পানিতেই খেলা শুরু করেছে। ওদের হৈ হুল্লোড় আর আনন্দের শব্দে চারপাশ হয়ে উঠেছে মুখরিত। আমি পানিতে পা ভিজিয়ে বসে বসে সেই কাণ্ড দেখছি।

হঠাৎ বলটা আমার পায়ের কাছে আসতেই ভাইয়া চিৎকার করে বলল, 'সরণী, ক্যাচ।'

আমি বলটা ধরার জন্য লাফ দিয়ে পানিতে নেমে পড়লাম। পানিতে নেমেছি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করিনি একেবারেই। আমার পুরো ফোকাস'টা ওই বলের দিকে। বল ধরে ছুঁড়ে মারতে গিয়ে বুঝলাম পানিতে বল খেলা এত সহজ নয়। দ্বিতীয়বার আমাকেও বল দেয়া হলো। আমি আবারও বল ধরে আরেকজনকে ছুঁড়ে মারলাম। এভাবে কখন যেন আমিও ওদের খেলায় ঢুকে পড়েছি খেয়াল করিনি। যাকে উদ্দেশ্য করে বল দেয়া হচ্ছে, সে মিস করলেই সকলে হেসে উঠছে উচ্চস্বরে। সেই হাসির শব্দ দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে আবারও। আমিও ভীষণ আনন্দ নিয়ে খেলছি। ভেতরে ভেতরে আন্দোলিত হচ্ছি। মনে হচ্ছে, বুকের ভেতর থেকে অতীতের সমস্ত স্মৃতি আর জমানো বেদনা আজ বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি নিষ্পাপ এক মানুষে পরিণত হচ্ছি। যার কোনো ব্যথা নেই, বেদনা নেই। আছে শুধু জীবন ভরা আনন্দ! 

সবাই উঠে গেলে আমি শুয়ে শুয়ে জলে ভাসলাম কিছুক্ষণ। একসময় খেয়াল করলাম সুইমিংপুলে আমি একা। বাকিরা সবাই উঠে গেছে। আমার বেশ আনন্দ হলো। একা একা পুরো সুইমিংপুলে ভাসতে লাগলাম। কখনোবা ভেসে ভেসে চেয়ে রইলাম আকাশের দিকে। এ জীবন আমাকে হঠাৎ করেই এতকিছু কেন ঢেলে দিচ্ছে, আমি জানিনা। 

গোসলের পর রুমে এসে স্বাগতা আপুর সামনে গিয়ে বাচ্চাদের মতো আবদার করে বললাম, 'আমাকে একটু সাজিয়ে দিবা?' 

আপু আমাকে যত্ন নিয়ে সাজিয়ে দিলো। দুচোখ ভরে টেনে দিলো কাজলরেখা। গালে গোলাপি আভা, ঠোঁটে রক্তিম লিপস্টিক। আমি সাজগোজ করতে পারিনা, করিনি কোনোদিন। আজ নিজেকে এই রূপে দেখে খানিকক্ষণ অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। জনম জনম ধরে নারী ও পুরুষের যে অদ্ভুত আকর্ষণ, সেই আকর্ষণেই কিনা জানিনা, আমার বারবার ইচ্ছে করছে রৈনীলের সামনে যেতে।

খাবারের জন্য ডাইনিং এরিয়াতে এসে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। খাবারের চেয়েও আমার অপেক্ষা'টা বেশী রৈনীলের জন্য। এইযে আমি অপূর্ব করে সেজেছি, এই রূপটুকু ওকে দেখানোর জন্য আমার আর তর সইছে না। আমি বসে আছি, তার পথ চেয়ে। 

সকলের খাবার চলে এলো। এখনও রৈনীলের দেখা নেই। স্বাগতা আপু জিজ্ঞেস করল, রৈনীল ভাইয়া খাবেনা?
জুবায়ের ভাইয়া উত্তর দিলো, রৈনীল ঘুমিয়েছে। 

আমার ঝলমলে রোদে হঠাৎ করেই মেঘের ঘনঘটা। যেন নিজের মনের ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। জোর করে চেষ্টা করেও আমি মনকে টেনে এনে নিজের ভেতর রাখতে পারছি না। আমার বারবার শুধু আপন মনে শুধাতে ইচ্ছে করছে, রৈনীল কেন এলো না? এত সুন্দর করে সাজলাম অথচ তার অদেখাই রয়ে গেলো! 

খেয়েদেয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। একটু আগেও দুচোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছিল। অথচ এইমুহুর্তে একবিন্দু ঘুম নেই। খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লাম। টিভিতে গান ছেড়ে দিয়ে শুয়ে রইলাম। আপুরা সবাই বাইরে আড্ডা দিচ্ছে। একটার পরে গান শুনছি আর গুণগুণ করে গান গাইছি। 

দুপুর গড়িয়েছে অনেক আগেই। মাঝেমাঝে বাইরে তাকিয়ে ঝলমলে রোদের নিভে যাওয়া দেখি। আস্তে আস্তে রোদ কমছে। সন্ধ্যা হলেই আজকের ট্রিপটা শেষ হয়ে যাবে। আমরা ফিরে যাবো ঢাকায়। আবারও সেই যাপিত জীবন, সেই বন্দিদশা, ইট পাথরের শহরে যান্ত্রিক কোলাহল। কিছুতেই মন চাইছে না আজকের দিনটা শেষ হোক। 

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রৈনীল! জিজ্ঞেস করল, 'কোথায় ওরা?'

আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। ধপ করে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতেও পারলাম না। মনে হলো ক্ষণিকের জন্য আমার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে। 

রৈনীল ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকলো। গরম পানির ফ্লাক্সের ঢাকনা সরাতে সরাতে জিজ্ঞেস করল, 'চা খাবা সরণী?'
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp