প্রেমান্বেষা - পর্ব ১১ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


মাহবুবের প্রশ্নে নীলিমা যেনো বিষম খেলো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন সে আশা করেনি। এই মাহবুব ভাই ইচ্ছে করে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে। নিশ্চিত স্মরণ জিজ্ঞেস করতে বলেছে। হয়তো তাকে সবার সামনে শায়েস্তা করার জন্য। সে-ও কম যায় না৷ নীলিমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার মাহবুবের দিকে তাকালো। অতঃপর বেশ কৌশলে স্মরণের দিকে তাকালো সে। স্মরণের দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো এখনই চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিবে তাকে। স্মরণও যেনো এ দৃষ্টি ঢের টের পেলো। সে আলতো মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বললো, 
" আমি কিছু করিনি। আমার হাত নেই এতে।"

নীলিমা এরপরও স্মরণের দিকে চেয়ে রইলো। যেনো সব দোষ তার। নওরীন ও রাফা এ ব্যাপারে জানে বিধায় নীলিমার দৃষ্টি অনুসরণ করে স্মরণের দিকে চাইলো। দুজনের মাঝে যে নিঃশব্দে কথোপকথন চলছে তাতে সন্দেহ নেই নওরীন ও রাফার। সাজিদের অবশ্য এমন একটা চলমান দৃশ্য দেখে কিছুটা সন্দেহ হচ্ছে। তবুও সে আপাতত চুপ রইলো। যদি কিছু হয়েও থাকে এ নিয়ে নওরীনকে পরে জিজ্ঞেস করা যাবে। আর মানতাসা! সে আছে অন্য জগতে। যে জগতে শুধু সে এবং তার প্রিয়তম ফাহাদ বিচরণ করছে। যেনো এ কাজিন মহলের মোহমায়া ত্যাগ করে সে ফাহাদের হয়ে গিয়েছে!

নীলিমাকে চুপ করে থাকতে মাহবুব খোঁচালো। বললো,
" কি ব্যাপার নীলিমা? সত্যিই আছে নাকি এখনও?"

নীলিমা এবার স্মরণের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
" এখন নেই, আগে ছিলো। ছিলো একটা অভদ্র পুরুষ।"

মাহবুব, নওরীন, রাফা এ ব্যাপারে জানা সত্ত্বেও বিস্মিত হলো। অনুরূপ স্মরণও। কেউই ভাবেনি নীলিমা এ ব্যাপারে কিছু বলবে। নীলিমা ফের বললো,
" কিশোরী বয়সে একজন অভদ্র পুরুষের প্রেমে পড়েছিলাম। খুবই জঘন্যভাবে প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু কারোর ব্যবহারে সে প্রেম জানালা দিয়ে পালায়, আমাকে বাস্তবতার সাথে পরিচয় করায়। এখন অবশ্য ওসব কিছুই নেই। ধীরেধীরে সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টায় আছি। তখন ছোট ছিলাম তো!"

নীলিমার কথায় মহলে কিছুক্ষণের জন্য পিন পতন নীরবতা বিরাজ করলো। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। রাফি ও পাখি অবাক দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে চেয়ে আছে। প্রেম নামক শব্দটার সাথে তারা বছরখানেক হলো পরিচিত হয়েছে। এই প্রেম জিনিসটা আসলে কি তা প্রকৃত অর্থে কেউই বুঝে না। বোঝার জন্য যে কাউকে জিজ্ঞেস করবে সে সুযোগও নেই। এসব লুকোনো ব্যাপার নিয়ে জিজ্ঞেস করলেই পিঠের উপর ধুমাধুম কিল পড়বে। দুজন শুধু জানে এই শব্দটা ছেলে মেয়ে একে অপরের উপর প্রতি অনুভূতি প্রকাশে ব্যবহার করে। কিন্তু কেমন ধরণের অনুভূতি এ নিয়ে দুজনের ধারণা নেই। রাফি ও পাখি বর্তমান যুগের ছেলেমেয়ে হলেও লিলি বেগম ও রাফা তাদের দুজনকে কঠোর শিকলে বেঁধে রেখেছে। এসব খারাপ নেশায় যেনো দুজনেই কোনোভাবে না জড়িয়ে পড়ে সেদিকে কড়া নজর দুজনের। ইয়াকুব সাহেব অবশ্য অত কড়াকড়ি করেন না। তিনি ব্যস্ত থাকেন কাজ নিয়ে। আর কাজের ফাঁকে একটু সময় পেলে ছেলেমেয়েদের সাথে মজামস্তি করেই সময় কাটিয়ে দেন। 

মাহবুব ঠোঁট টিপে হাসছে। সে নীলিমার জবান হতে স্মরণের নাম বের করার জন্য খোঁচালো এবার। বললো,
" সেই অভদ্র পুরুষটার নামটাও বলে দাও শুনি।"

নীলিমা এবার চট করে গরম দৃষ্টিতে মাহবুবের দিকে তাকালো। চোয়াল শক্ত করে বললো,
" এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে মাহবুব ভাই! এমন হলে আমি খেলা থেকে চললাম।"
বলেই সে উঠতে নিলে রাফা তার হাত চেপে ধরলো। মাহবুবের উদ্দেশ্যে বললো,
" অনেক হয়েছে মাহবুব ভাই। এবার খেলা আগান। শুধু শুধু একজনের পিছনে এতক্ষণ পড়ে থাকলে হবো!"

মাহবুব বললো,
" আচ্ছা সরি সরি। খেলা আবারো শুরু হোক।"

মাহবুবের কথায় সাজিদ ফের বোতল ঘোরালো। এবার পাখির দিকে বোতল এলো। নওরীন তাকে নিজের মতো প্রশ্ন করলো। এদিকে স্মরণ থমথমে দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে চেয়ে আছে। নীলিমা যে ফের তাকে অপমান করলো তা নীলিমার চাহনি ও কথা বলার ধরণ দেখে স্পষ্টরূপে অনুমান করলো সে। মেয়েটা বড্ড খারাপ। বারংবার তাকে কথার ছলে অপমান করে। কখনো একান্তে, কখনো জনসম্মুখে। এর কিছু বিহিত করতেই হবে!

------------------

তারাবির নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে মাত্রই বাড়িতে ঢুকেছে স্মরণ। এসেই ড্রইং রুমে গিয়ে দেখলো রাফি টিভি চালিয়ে প্যাকেট ধরে জিলাপি খাচ্ছে। স্মরণ ক্ষণেই বুঝে গেলো রাফির হাতে নীলিমাকে দেয়া সেই শাহী জিলাপির প্যাকেট। তার বুকটা তড়াক করে উঠলো। তবে কি নীলিমা কিছু না খেয়েই রাফিকে দিয়ে দিয়েছে? তবে কি নীলিমা এবারও তাকে ক্ষমা করেনি? স্মরণের মুখটা ছোট হয়ে এলো। বোধহয় মুখশ্রীতে বিষাদের ছায়াও দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা বারবার এমন করছে কেনো! বারবার তাকে ছোট করছে কেনো?
স্মরণ রাগে, ক্ষোভে, অপমানে তেড়ে গিয়ে রাফির হাত থেকে প্যাকেটটা ছিনিয়ে নিয়ে বললো,
" কোথ থেকে পেয়েছিস এটা? কার অনুমতি নিয়ে খাচ্ছিস এসব?"

হঠাৎ স্মরণের উপস্থিতি ও আচরণে চমকে উঠলো রাফি। বেচারার হাতে ও মুখের ভেতর আধ খাওয়া জিলাপির টুকরোটা এখনও আছে। সে ফ্যালফ্যাল করে স্মরণের দিকে চেয়ে রইলো। মিনমিন করে বললো,
" নীলুপু দিয়েছে।"

স্মরণের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দৃষ্টিতে ক্রমশ ক্রোধের সূচনা ঘটছে। সে জিলাপির প্যাকেটটা রাফির দিকে প্রায় ছুঁড়ে মারলো। অতঃপর দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
" ভালো মতো খা। খেয়ে বেলুনের মতো উড়ে যা।"
বলেই সে বড় বড় পায়ে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এলো। রাফি অবশ্য স্মরণের কথা তেমন কানে তুললো না। সে জিলাপির স্বাদে পুরো মজে গিয়েছে। ইশ এতো সুস্বাদু জিলাপির সাথে তার আগে পরিচয় হলো না কেনো!

প্রায় সবাই রুমেই আছে। কেউ নামাজ পড়ছে। কেউ বিশ্রাম নিচ্ছে। নাজমা বেগম ও মাসুদা বেগম রাতের খাবার প্রস্তুত করছেন। নীলিমা মাত্রই নিজের জন্য এক কাপ গরম গরম চা বানিয়ে রুমে ঢুকেছে। চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে ফ্যান ছাড়ার জন্য সে সুইচবোর্ডের কাছে এলো। হাত এগিয়ে যেই না সুইচ অন করতে যাবে অমনিই স্মরণ প্রায় ঝড়ের গতিতে রুমে প্রবেশ করে নীলিমার হাত চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেলো নীলিমা। বেশ চমকেও উঠলো সে। এদিকে স্মরণ তার হাত চেপে চোয়াল শক্ত করে বললো,
" ভালো মানুষের মতো তোমার পিছে সরি বলছি, এটা সহ্য হচ্ছে না? জোর করাতে চাও? রাফিকে জিলাপি দিয়ে কি বুঝাতে চাও, আমার সরি'র কোনো মূল্য নেই? "

বিস্ময়ে হতবাক নীলিমা আরোও অবাক হলো স্মরণের ব্যবহারে। স্মরণের এমন তিক্ত আচরণের সম্মুখীন হয় না সে বহু বছর। তাই হয়তো এ সম্পর্কে ভুলতে বসেছে। অন্য সময় হলে নীলিমা হয়তো তেজ দেখিয়ে ফুঁসে উঠতো। এক ঝটকায় স্মরণের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার উপর কথা বলতো। কিন্তু আজ কিছুই করতে পারছে না। কারণ স্মরণের ঐ শান্ত দৃষ্টিতে আজ ক্রোধের আগুনের ফুলকি উতলে উঠছে। যেনো ঐ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকলে সে ভস্ম হয়ে যাবে। নীলিমার হাতের কব্জির অংশটুকু এবার ঝিনঝিন করছে। ব্যাথা লাগছে বেশ। তাই আগেপিছে কথা না বাড়িয়ে শুধু প্রয়োজনীয় কথাটাই বললো স্মরণকে। কম্পিত গলায় বললো,
" আমার যতটুকু খাওয়ার ততটুকু খেয়েছি। সম্পূর্ণ খেতে পারিনি দেখে রাফিকে দিয়ে দিয়েছি। "

নীলিমার ঐ কম্পিত স্বরের কাছে স্মরণ যেনো মুহূর্তেই বরফের গোলায় পরিণত হলো। সেই ক্রোধ, সেই তেজ ক্ষণেই বরফের মতো শীতল হয়ে এলো। নীলিমার কথার অর্থোদ্ধার করতে মাত্র কয়েক পল সময় লাগলো স্মরণের। তার দেয়া খাবারগুলো খেয়েছে মানে নীলিমা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে! 
মুহূর্তেই নীলিমার হাত ছেড়ে দিলো স্মরণ। ক্রোধের আগুন শীতল হয়ে এলো। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো। ইশ, রাগের বশে নীলিমার সাথে এহেন আচরণ করা মোটেও উচিত হয়নি। স্মরণ দ্রুত হাত গুটিয়ে নিয়ে অনুতপ্ত সুরে বললো,
" সরি নীলিমা সরি। আবারোও আমার বিহেভিয়ারের জন্য সরি।"

নীলিমা স্মরণের দিকে নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকালো। বিমর্ষ গলায় শুধালো, 
" এবার সত্যিই কি আপনাকে ক্ষমা করা উচিত হবে? ভেবে দেখুন। "
বলেই স্মরণকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। স্মরণ নিজের ভুল বুঝতে পেরে খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেললো। দাঁতে দাঁত পিষে আচ্ছামতো নিজেকে গালি দিলো। 
ওদিকে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো রাফা। সে এতক্ষণ ওয়াশরুমে ছিলো। মানতাসা রুমে নেই। সে নওরীনের সাথে অন্য রুমে বসে গল্প করছে। রাফা বেরিয়ে এসে স্মরণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
" কি হয়েছে স্মরণ ভাই? এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?"

স্মরণ দৃষ্টি মেলে অসহায় সুরে বললো,
" আবারও ব্লান্ডার করেছি আমি।"

" কি করেছেন?"

স্মরণ সম্পূর্ণ ঘটনা রাফাকে বললো। সব শুনে রাফা নিরাশ গলায় বললো,
" নীলিমা ভালোয় ভালোয় আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলো স্মরণ ভাই। আপনার অবুঝপনার জন্য আবারোও ওর কাছে দোষী হলেন। এখন এর ক্ষমা কিভাবে চাইবেন তা ভাবুন। "

স্মরণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। নিজের এই কান্ডে ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। রাফাকে খানিক অনুরোধের সুরেই বললো,
" এটাই লাস্ট ভুল রাফা। প্লিজ নীলিমাকে আপনার পক্ষ নিয়ে কিছু বলো। তুমি তো আমার রাগ সম্পর্কে একটু হলেও আইডিয়া রাখো। আমি সহজে রাগি না। কিন্তু একবার রেগে গেলে নিজের উপর কন্ট্রোল থাকে না। প্লিজ নীলিমাকে মানিয়ে নাও একটু।"

" আচ্ছা আচ্ছা, আমি ওর কাছে আপনার পক্ষ নিয়ে কথা বলবো। কিন্তু আপনাকেও তো সরি বলতে হবে। না হলে আমার বলায় কোনো কাজ হবে না। "

" হ্যাঁ, আমিও সরি বলবো। তুমি একটু নীলিমার কাছে যাও। "

" আচ্ছা যাচ্ছি।"
বলে রাফা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে নিজের আচরণে হতাশ হয়ে নীলিমার রেখে যাওয়া চায়ের কাপটা উঠিয়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা খেয়ে নিলো স্মরণ। 

-----------------

সাজিদ, মানতাসা, নওরীন ও নীলিমা উঠোনের বিশাল আমগাছের নিচে পাটি পেতে বসে আছে। সময় এখন সকাল ১১টা। আজ রোদের তেজ খানিক কম৷ প্রকৃতিতে মৃদু বাতাস বহমান। বাড়িতে গ্রামের চেয়ারম্যান এসেছে। মাহবুবের সাথে কি নিয়ে যেনো কথা বলতে। আধ ঘণ্টা হয়েছে চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন। 

উঠোনে বসে চারজন আড্ডা দিচ্ছে। এমন সময় চেয়ারম্যান সাহেব বেরিয়ে এলেন। তাঁর চোখেমুখে অসন্তোষজনক ভাব বিরাজ করছে। কোনো কারণে বেশ নাখোশ তিনি। সাজিদকে দেখে তিনি সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। 
চেয়ারম্যান সাহেব যেতেই নীলিমা সাজিদকে জিজ্ঞেস করলো,
" বাড়িতে হঠাৎ উনি উদয় হলেন কেনো দুলাভাই?"

সাজিদ এ ব্যাপারে অবগত বিধায় বললো,
" জানোই তো মাহবুব সিমেন্টের ব্যবসা করতে চাচ্ছে। তো যে জমিটা কিনে ও ফ্যাক্টরি বানাবে সেটার উপর চেয়ারম্যানের নজর আছে। চেয়ারম্যান চাচ্ছে মাহবুবের কাছ থেকে ভালো দামে জমিটা কিনে নিতে। কিন্তু মাহবুব রাজি হচ্ছে না। কেননা ও সহজে উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছিলো। এই যা একটা পেয়েছে এইটা বেঁচে দিলে বিজনেসের স্বপ্ন বাদ দিতে হবে।"

" ওহ আচ্ছা, এই ব্যাপার। শুনেছিলাম এই লোকটা ভালো না। গ্রামের অধিকাংশ লোকের মুখে এর বদনাম শুনি। এর চরিত্র, ব্যবহার কিছুই ভালো না।"

সাজিদ এবার চোখেমুখে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করে বললো,
" চেয়ারম্যান হলো জোনাকি পোকা। জোনাকি পোকার মতো এনার পশ্চাৎদেশ দিয়ে সবসময় বাত্তি জ্বলে। বুঝছো? লাইট জ্বলে, লাইট। তবে আফসোস এই লাইট মানবতার কোনো কাজে আসে না।"
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন