অতিথি নিবাস - পর্ব ০৯ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


আজ সকাল থেকে বৃষ্টি। ফাবিহা নিজের রুমে পায়চারি করছে। কেমন যেন অস্থির লাগছে। আজ দু'দিন যাবৎ আরহানের সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই। কথাবার্তা নেই। রেডিওতে আসছে না। আজও আসবে কিনা কে জানে! ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে। যদিও অদ্ভুত লাগার মতো কোনো কারণ নেই। তবুও লাগছে। ফাবিহা বুঝতে পারছে না আরহানের দেখা সাক্ষাৎ না পাওয়ায় তার অস্থির লাগবে কেন! সে কি– আরহানের প্রেমে পড়ে গেল নাকি। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! ফাবিহার অতিরিক্ত ভাবার একটা রোগ আছে। যাকে ইংরেজিতে বলে ওভারথিংকার। ফাবিহা ইতিমধ্যে ভেবে ফেলেছে একদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে কোনো এক জঙ্গলে ঘেরা পুরনো এক জমিদার বাড়িতে সে আর আরহান আটকা পড়বে। পুরো এক দিন এক রাত তারা একসাথে থাকবে। বাহিরে প্রবল ঝড় থাকবে। তাদের মধ্যে কিছুই হবে না। শুধু সারা রাত তারা গল্প করবে। ভোর হতেই একদল মানুষ তাদের ধরতে আসবে এবং জোরজবরদস্তি করে তাদের বিয়ে দিবে। কি অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা! ফাবিহা জানে এসব কিছুই হবে না। আর হলেও সে অবশ্যই চুপচাপ বসে থাকবে না। প্রতিবাদ জানাবে। বাবাকে কল করবে। এক পর্যায়ে সে আর আরহান পালিয়ে আসবে। আগের যুগ এখন আর আছে নাকি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এক রুমেই থাকলেই বিয়ে দিয়ে দিবে। 

ফাবিহা তার চিন্তাভাবনা বাদ দিল। ভাগ্যিস কেউ মনের কথা শুনতে পায় না। না হলে এই ধরনের আজগুবি পরিকল্পনা সম্পর্কে কেউ জেনে গেলে কি হত। আরহানের সামনে তো লজ্জায় যেতেই পারত না ফাবিহা। ছিঃ ছিঃ!'

 ”আপা, ও আপা, আপা হুনছেন, আপা, আপা গো...”

লাগাতার ফাবিহাকে ডাকছে রাহেলা। কিন্তু ফাবিহার হেলদোল পাওয়া যাচ্ছে না। সে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাহেলা এবার তার হাত ধরে নাড়া দিল। উচ্চ আওয়াজে বলল,
 “আপা উঠেন। চাচায় আপনার জন্য বুইড়া বেডার লগে বিয়া ঠিক করছে।”

এক পর্যায়ে লাভ দিয়ে ঘুম থেকে উঠল ফাবিহা। আশপাশ দেখল। বুঝতে পারল না পায়চারি করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল কখন। চোখে মুখে হাত ছোঁয়াল ফাবিহা। প্রশ্ন করল,
 “কয়টা বাজে রাহেলা?”
 “সকাল এগারোটা।”
 “আমি কি সকালের নাস্তা করেছিলাম?”

রাহেলা চোখ বড় বড় করা চাহনি। সে ভীমড়ি খেয়ে বলল, 
 “কি কন আপা– আপনি নাস্তা করছেন কিনা মনে নাই।”
 “মনে থাকবে না কেন– কি দিয়ে যেন খেয়েছিলাম?”

রাহেলা ভূ-কুচকে তাকাল। সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে বলল,
 “উহু উহু আমি শুয়োর আপনি প্রেমে পড়ছেন আপা?”
 “উহু রাহেলা ফালতু কথা বন্ধ কর। আর ওটা শুয়োর নয় শিওর।”
 “ধুর একই হইল।”
 “না এক হয়নি। মা কই?”
 “চাচি রান্নাঘরে।”
 “আচ্ছা আমার জন্য এককাপ কফি নিয়াও?”

রাহেলা উঠে দাঁড়াল। হেঁটে গেল। তবে ফাবিহার থেকে চোখ সরাল না। এক পর্যায়ে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে বলল, “ও মা গো।”

ফাবিহা চমকে উঠল। তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
 “কি হয়েছে?”
 “কিছু হয় নাই আপা। আপনি বহেন আমি এহনি আইতাছি।”

•••••••••••••

ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দ বইছে। ভার্সিটির নিচতলায় বারান্দার প্রাঙ্গণে বসে আছে মোহনা। আজ ভার্সিটি আসাটা ঠিক হয়নি। মোহনা বুঝতে পারেনি। সে ভার্সিটি আসার পরই তুমুল বর্ষণ শুরু হবে এবং ক্লাস হবে না তেমন। আজ ক্লাস হয়েছিল দুটো। একটা তৌহিদ স্যারের আরেকটা মাহিন স্যারের। মাহিন স্যারের ক্লাসটা করলেও তৌহিদ স্যারেরটা করেনি। সুযোগ বুঝে বেরিয়ে এসেছে। এসেই সোজা লাইব্রেরি। মোহনা উপন্যাস পড়তে পছন্দ করে কিন্তু একাডেমিক বই পড়তে পড়তেই তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বাংলা উপন্যাস পড়বে কখন। তাও হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' বইটা ধরে ছিল। শেষ করতে পারেনি। ধৈর্যহীন হয়ে বেরিয়ে এসেছে। ভেবেছিল বাড়ি যাবে। কিন্তু তুমুল বর্ষণে যাওয়া যাচ্ছে না। মোহনার একটা সমস্যা হলো সে বৃষ্টির পানি সহ্য করতে পারে না। একটু বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলেই মাথা যন্ত্রণা, সর্দি, কাশি-জ্বর সব একত্রে বেড়াতে আসবে। এসব ক্ষেত্রে মোহনার আবার মেহমান পছন্দ নয়। তাই চুপচাপ বসে রয়েছে। পুরো ভার্সিটি ধরতে গেলে খালি। তাদের ভবনে কেউ নেই। তবে অন্য ভবনগুলোতে হয়তো আছে। মোহনা ভেবে নিয়েছে আর আধঘন্টা বসে থাকবে। তার মধ্যে না কমলে ভাইয়াকে কল করবে। মোহনারা তিন ভাইবোন। বড়বোন উর্মি, মাঝখানে ভাই রবিন আর এরপর মোহনা।'

 “আপনি আজ আমার ক্লাসে আসলেন না কেন?”

আকস্মিক এমন কথা শুনে চমকে উঠল মোহনা। উপরে চাইল দ্রুত। তৌহিদ স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। মোহনা খানিকটা ঢোক গিলল। এবার কি বলবে? সে তো ভাবতেও পারেনি– তৌহিদ স্যার এই সময় আসবে এখানে। মোহনা তক্ষৎণাৎ উঠে দাঁড়াল। তড়িঘড়ি করে বলল,
 “না মানে স্যার পেটে ব্যাথা করছিল।”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল তৌহিদ। মোহনা আবার বলে, 
 “না স্যার পেটে ব্যাথা না মাথা ব্যাথা করছিল।”
 “বানিয়ে মিথ্যে কথা বলতেও শেখেননি তাই না?”

মোহনা ঠোঁটে কামড় দিল। যা ধরা পড়ে গেল। তৌহিদ বলল,
 “ওইদিন বকাঝকা করেছিলাম বলেই ক্লাস করেননি তাই না?”

মোহনা আটকা পড়ল। কি বলতে বুঝতে পারছে না। সত্যিই বলে দিবে ভাবছে। মোহনা বলল,
 “জি, না স্যার।”

খানিকটা হাসল তৌহিদ। এই প্রথম তৌহিদ স্যারের হাসি দেখল মোহনা। কি চমৎকার হাসে লোকটা! দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে না ক্লাসরুমে এই লোকটা গম্ভীর হয়ে থাকে। তৌহিদ শান্ত স্বরে বলল,
 “আমি যখন ক্লাস করতাম তখন জাহিদ স্যার নামে একজন স্যার ছিলেন। নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। একবছর আগে রিটায়ার্ড হন।”

মোহনা মাথা নাড়িয়ে বলল,
 “শুনেছি। তবে তার কোনো ক্লাস পাইনি।”
 “বুঝেছি। তো ওই স্যার এমন একদিন যেত না যে আমায় বকাবকি করত না। রোজ বকাঝকা করত। ভার্সিটি না আসলে ফোন দিয়ে আনাতেন। তো আমিও একদিন রাগ করে আপনার মতো দু'দিন ক্লাস করেনি। ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম অফ করে যাতে কলটল না করতে পারেন। তো দু'দিন পর ভার্সিটি আসতেই তিনি আমায় ডেকে নিয়ে একটা কথা বলেছিলেন, 'তৌহিদ তুমি যদি আমার ওপর রাগ করে আমার ক্লাস না করো তবে আমার চেয়ে ক্ষতিটা কিন্তু তোমারই হবে। তোমাকে বকি কারণ আমি চাই তুমি একজন সফল মানুষ হও। একদিন আমার স্থানটা তুমি নেও।'– জানিনা স্যারের কথায় সেদিন কি মুগ্ধতা ছিল এরপর থেকে তার ক্লাস আর বন্ধ দিতাম না। বকলেও সেটা উপভোগ করতাম। তারপর তো দেখছেনই আমি এখন কোথায়। এই কথাগুলো বলার মানে হলো আপনি যদি আমার ওপর রাগ করে ক্লাস বন্ধ দেন। তাহলে ক্ষতি আমার চেয়ে আপনারই বেশি হবে।'

মোহনা এক ধ্যানে তৌহিদের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল। লোকটার শান্ত স্বর এত মধুর তা তো বুঝতেই পারেনি। তৌহিদ বলল,
 “আমার কথা কি বুঝতে পেরেছেন?”

মোহনা একগাল মিষ্টি হেঁসে বলল,
 “জি স্যার।”

তৌহিদ মৃদু হাসল। জবাব দিল,
 “গুড গার্ল। তা বাসায় না গিয়ে এখানে বসে আছেন কেন?”

মোহনা তার ধ্যান মগ্নতা সরিয়ে ফেলল। লজ্জিত হয়ে মাথা নুইয়ে দিল। বলল,
 “এই বৃষ্টির জন্য। আমার আবার বৃষ্টিতে অসুখ আছে। একটু ভিজলেই জ্বর,সর্দি-কাশি, মাথা যন্ত্রণা সবাই একত্রে বেড়াতে আসে। তাই আর কি!”
 “ছাতা নেই?”

মাথা নাড়াল মোহনা। যার অর্থ, 'নেই।'
তৌহিদ বলল, “আচ্ছা আপনি দাঁড়ান আমি দেখছি।”

তৌহিদ সিড়ি বেয়ে অফিস কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। তার ছাতাটা তার রুমেই রয়ে গেছে। তৌহিদ তার ছাতাটা নিয়ে এসে এগিয়ে দিল মোহনার দিকে। বলল, “এটা নিয়ে যান।”

মোহনা ছাতাটা হাতে নিল। বলল,
 “আপনি কি করে যাবেন স্যার?”
 “আমি আবার মেহমান পছন্দ করি সমস্যা হবে না।”

চমৎকার হাসল মোহনা। তৌহিদ বলল,
 “সাবধানে যাবেন।”
 “জি স্যার।”

বেরিয়ে পড়ল মোহনা। তৌহিদের বাড়ি যেতে যেতে সন্ধ্যা হলো। রাত দুটোর সময় তার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসলো।'

••••••••••••••

পরেরদিন শুক্রবার। পরন্ত বিকেলবেলা। রেডিও এফএমে স্টুডিওর চেয়ারে বসে আছে আরহান। গান বাজছে শিল্পী ইমরানের 'এলেমেলো ইচ্ছে যত– ভালোবেসেছি তারই মতো।'

আরহানের চোখে ঘুম। কাল সারারাত ঘুমায়নি। তৌহিদের সেবা করেছে। সে একটা জিনিস দেখেছে তাদের তিনবন্ধুর মধ্যে কারো অসুখ হলে পর পর তিনজনেরই হয়। যেমন প্রথমে শান্তর পা পুড়ল কাল আবার তৌহিদের আচমকা জ্বর আসলো। তার ধারণা এই দু'জন সুস্থ হলেই সে অসুখে পড়বে। গান থেমে গেল। আরহান কানে হেডফোন গুজিয়ে ভাড়ি কণ্ঠে বলে উঠল,
 “আসসালামু আলাইকুম গাইস। আমি আরজে আরহান। আপনারা শুনছেন রেডিও তরঙ্গ নাইনটি টু পয়েন্ট টু রেডিও এফএম। আজ আমি থাকছি বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত..."
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp