সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। রোদেলা উঠোনের বেলী ফুল গাছের গোড়ায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। পুতুল বেগম রান্নাঘরে রান্না করছেন। কড়াইয়ে কাটা সবজি ঢালতে নিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। গলা তুলে বললেন,
'কি রে এখনো চোখের সামনে থেকে যাসনি?'
কড়াইয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তে রাগান্বিত গলায় আবার বললেন,
'আজকে তোর মামাকে বাসায় আসতে দে। তোর একদিন আর আমার যে কয়দিন লাগে। চক্ষু লজ্জা বলতেও নাই। পুকুরে নেমে পাড়ার ছেলেদের সাথে মাছ ধরা? আজ তোকে আমি উচিত শিক্ষা দেব। নাহলে আমি আমার নাম পরিবর্তন করব।'
পুতুল বেগম রাগে কড়াইয়ে ঠাস ঠাস শব্দ করছেন। শব্দগুলো রোদেলার কানে বাজছে। সে মৃদু গলায় বলল,
'এভাবে কথা বলছ কেন মামি? তারা এখনও ছোট হাফপ্যান্ট পরে। আর আমি সিঁড়িতে বসে ছিলাম বিশ্বাস করো।'
পুতুল বেগম ফুঁসে ওঠে বললেন,
'আমার ঘরে খেয়ে, আমার ঘরে থেকে, আমার সাথে তর্ক করছিস। অসভ্য মেয়ে।'
পুতুল বেগম ক্ষোভের কারণে একটা লাঠি রোদেলার দিকে ছুঁড়ে মারল। লাঠিটা চলে গেল উল্টো দিকে। লক্ষ্যে ভুল করে আরো রেগে যান তিনি। হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলেন পুতুল। বড় বড় চোখে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল রোদেলা তার পোষা কুকুরটি পায়ের কাছে লেজ গুটিয়ে বসে আছে। রোদেলা উচ্চকিত গলায় বলল,
'জোজো। মার খেতে না চাইলে পালা।'
সেহরিশ দেশে আসছে দুদিন হয়ে গেছে। আগামীকাল গাজীপুর ফিরবে এবং পরশু ইতালিতে ফিরে যাবে। সেহরিশ বিছানায় বসে আছে। ঠিক তখনই মারিয়া রুমে ঢুকল। মৃদুস্বরে বলল,
'চাচু, তুমি আমাকে মজা কিনে দিবা? দাও না, মজা কিনে।'
মারিয়ার আবদার ফেলতে পারল না সেহরিশ। কিন্তু বাইরে যাওয়ার মতো বাড়তি কাপড় নেই তার। বেশিদিন থাকবে না ভেবে দুটো স্যুট নিয়ে এসেছিল। দুদিন সেগুলো পরা হয়। আজ সকালে ফারিয়া বেগম তার ছেলের স্যুটগুলো ড্রাই ক্লিন করার জন্য দিয়েছেন। আর পরার জন্য একটা ঢিলেঢালা শার্ট ও লুঙ্গি বিছানার পাশে রেখে যান। সেহরিশ তার পোশাকের ব্যাপারে খুবই সচেতন। সে অকারণে তার শরীর দেখানো পছন্দ করে না। এমনকি পারফরম্যান্স করার সময়ও কখনো তার বক্ষঃ দেখা যায়নি। ঢিলেঢালা শার্ট আর লুঙ্গি পরে মারিয়ার হাত ধরে বাহিরে বের হয় সেহরিশ। এক হাতে লুঙ্গির ভাজ ধরে হাঁটতে লাগল। চনমনে রোদ গায়ে মেখে পুকুর পাড়ের সরু পথ ধরে হাঁটছে সেহরিশ মৃদু বাতাসে তার চুলগুলো দুলছে। মারিয়ার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। মারিয়া তার ছোট ছোট পাঁচটি আঙুল দিয়ে সেহরিশের শক্তপোক্ত তর্জনী ধরে লাফাচ্ছে। চোখের পলকে সেহরিশ কে কিছুসংখ্যক লোকেরা ঘিরে ধরল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো পোশাক পরা দুই দক্ষ দেহরক্ষী বিশাল বন্দুক নিয়ে সেহরিশকে কভার করার চেষ্টা করছে।
ভক্তরা ছবি তুলতে চায় কিন্তু বন্দুক দেখে আর এগিয়ে আসলো না। গ্রামের মুরব্বিরা মুদির দোকানে বসে আছে সেহরিশকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। একজন আওয়াজ করে বললেন,
'কি দিনকাল এসেছে? নিজ এলাকায় বন্দুক নিয়ে ঘুরতে হয়? বুঝলাম না বাপু, মৃত্যুকে এত ভয় পেলে ঘর থেকে বের হয় কেন?'
সেহরিশ তাদের কথার জবাব দিল না। দেহরক্ষী দুজনকে কঠোর আদেশে বাড়ি ফিরে যেতে বলল। সেহরিশের আদেশ অমান্য করার সাহস তাদের নেই। সেহরিশ ডান হাতে দোকানের জিনিসপত্র দেখিয়ে বলল,
'তুমি যা নিতে চাও। নাও। চাচ্চু, আজ সব কিনে দেব।'
মারিয়া এগিয়ে যায়। দুই হাতে অনেকগুলো চকলেট আর চিপস নিল তারপর বাড়ির দিকে দৌঁড় লাগাল। মারিয়া একটা পাউরুটির প্যাকেট ছিঁড়ে রেখে গেছে। দোকানী সেটা সেহরিশের হাতে ধরিয়ে দেন। দোকানীকে টাকা দিয়ে পেছন ফিরে তাকাল সেহরিশ, কিছু ছেলেপুলে তখনও রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশের সঙ্গে সেলফি তুলতে চায় তারা। বাংলাদেশে আসার খবর গোপন রাখতে চায় সেহরিশ। এজন্য তাদের সঙ্গে ছবি তোলার পর সেগুলো ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করতে নিষেধ করে। তারা ছবি তুলতে পেরেই খুব খুশি হয়েছে। ছবি আপলোড করবে না বলে কথা ও দিল।
সেহরিশ হাঁটার সময় প্রায় পায়ের দিকে লক্ষ্য করল। তার বারবার মনে হচ্ছে লুঙ্গিটা এই বুঝি খুলে যাবে। সেহরিশ পরিষ্কার চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,
'আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি এই অদ্ভুত পোশাক পরে রাস্তায় হাঁটছি।'
বাতাসের বেগে দৌড়ে আসে এক নারী সেহরিশের সাথে ধাক্কা খেয়ে আবার ছুটে গেল। সেহরিশ মাটিতে পড়ে যেতে নিয়েও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দৌড়ে যাওয়া মেয়ের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো সে। সহসা ভ্রু শিথিল হয়ে গেল তার। পোষাক আর খোলা চুল দেখেই বুঝতে পারলো সে একজন মেয়ে। কিন্তু এভাবে পালানোর কারণ বুঝতে পারল না সেহরিশ। মেয়েটির মধ্যে ভদ্রতা বোধ নেই। ধাক্কা দিল একবার স্যরি ও বলল না। তখনই পেছন থেকে একটা কুকুর জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। সেহরিশ চোখ বড় করে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। কুকুরটি দৌঁড়ে সেহরিশের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং সাথে সাথে তার লুঙ্গির একপাশে কামড় দিয়ে ধরে টানতে লাগল। সেহরিশ হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
'এই কুকুরটা আমার ইজ্জত ধরে টানছে?'
রাস্তার এই ধারে মানুষজন থাকে না। তাই সেহরিশের আওয়াজ কারো কানে পৌঁছালো না। সেহরিশের বাম হাতে একটা রুটির প্যাকেট আছে। প্যাকেটটা মাটিতে ফেলে দিল সে। সহসা কুকুরটি লুঙ্গি ছেড়ে রুটির প্যাকেট মুখে নিয়ে মেয়েটি যেদিকে গেছে সেদিকে দৌড়ে গেল। সেহরিশ তার ডান হাত বুকের উপর রেখে গভীর শ্বাস ফেলল। একটু পর তার পায়ের দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠল। কুকুরটা টানাটানি করে লুঙ্গি ছিঁড়ে ফেলছে। লুঙ্গির এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যাচ্ছে। সেহরিশ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে রাগ দমানোর চেষ্টা করল।
মারিয়া তার ঘরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিল। সে চকলেটগুলো বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখল তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এল। কলিংবেলের শব্দ শুনেই দরজা খুলে দিল মায়মুনা। দরজার সামনে সেহরিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সেহরিশ সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই মায়মুনা লুঙ্গির ছেঁড়া অংশটা লক্ষ্য করল। তারপর শুধল,
'নতুন লুঙ্গি ছিঁড়ল কীভাবে?'
সেহরিশ মুখ ঘুরিয়ে কড়া গলায় বলল,
'কিভাবে ছিঁড়েছে আরেকবার ছিঁড়ে দেখাব?'
মৃদু স্বরে বলল মায়মুনা,
'থাক, তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। নীলু আপার হাতে আরেকটা লুঙ্গি তোমার জন্য পাঠাচ্ছি।'
সেহরিশ রাগ চেপে ধরে বলল,
'না। আর লুঙ্গি নয়।'
ফারিয়া বেগম ড্রয়িংরুমে বসে তাসবীহ পাঠ করছেন। সেহরিশের লুঙ্গির দিকে তাকালেন। ভ্রু কুঞ্চিত করে দৃঢ় গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
'ফাতু, এত বড় হয়েও লুঙ্গি ছিঁড়ে ফেলছিস? আমি কত শখ করে এটা তোর জন্য কিনেছিলাম। তুই একটু সাবধানে থাকতে পারিসনি?'
সেহরিশ চুপ থাকল। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে কড়া গলায় বলল,
'একটা লুঙ্গি ই তো ছিঁড়েছে। তোমরা এমন রিঅ্যাক্ট করছ কেন? আমি কখনো ইউরোপে লুঙ্গি পরিনি। আজ প্রথম। তোমার খুশির জন্য পরেছি। ছিঁড়ে গেছে বলে এখন এত জেরা করছ? মনে হচ্ছে আমি একজন আসামী আর তোমরা পুলিশ।'
সেহরিশ থামল। কিছুক্ষণ পর মায়ের দিকে তাকিয়ে ফের বলল,
'আমাকে ফাতু বলে ডাকবে না মা। নামটা শুনলেই অদ্ভুত লাগে। লোকে শুনে হাসবে।'
সেহরিশ চলে গেল। ফারিয়া বেগম বিড়বিড় করে বললেন,
'আমার ছেলে। আমি যা খুশি ডাকব। মানুষের কি?'
❐
রোদেলা জোজোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
'আমি কি তোকে খেতে দেই না? রুটির জন্য এক মানুষের লুঙ্গি টানলি কেন? লোকটা যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল আমার ভয় লাগছে। সে আমাকে সামনে পেলে আমার গলা চেপে ধরবে নিশ্চিত।'
জোজো রোদেলার বলা কথা বুঝতে পারল যেন। সে মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বসে পড়ল। তারপর মাথা তুলে রোদেলার মুখের দিকে তাকাল। রোদেলা হঠাৎ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। আবদুল লতিফের বিশাল দিঘীর ঘাটে বসে আছে রোদেলা। কিছুক্ষণ পর তার ফোনটা বেজে উঠল। রোদেলা কল রিসিভ করল। উমাইয়া হাসিমুখে বলল,
'রোদু, রোদু! গাজীপুর আসার জন্য প্রস্তুত হ। ভাওয়ালে চান্স পেয়েছিস।'
রোদেলা অবাক হলো। মূহুর্তে মুখ নিচু করল সে। তারপর আলগোছে রোদেলার গাল বেয়ে একফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। রোদেলা বাম হাত দিয়ে গাল মুছে নিল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
'সত্য বলছিস মজা করছিস না তো?'
উমাইয়া ফোনটা কানে চেপে খুব মিষ্টি গলায় বলল,
'সত্যি বলছি রে! ব্যাগ গুছিয়ে দুদিনের মধ্যে গাজীপুর চলে আয়।'
বলে কল কাটলো উমাইয়া। রোদেলা বাসায় ফিরলো প্রায় সন্ধ্যার দিকে। পুতুল বেগম তার ছোট্ট ছেলে রাফসান কে পড়তে বসিয়েছেন। মাসুদ মিয়া ঘরের দক্ষিণ দিকে বসে সংসারের হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। রোদেলা রুমে ঢুকল। মাসুদ মিয়ার ঠিক সামনে বসে বিস্মিত গলায় বলল,
'মামা, একা কথা বলার ছিল।'
মাসুদ মিয়া কাগজের দিকে চোখ রেখে বললেন,
'বলো মা, কি বলবে?'
'মামা, তুমি তো জানো গাজীপুর ভাওয়াল কলেজ অনেক ভালো। সেখানে আমি চান্স পেয়েছি। আমি ওখানে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাই।'
মাসুদ মিয়া বললেন,
'আলহামদুলিল্লাহ। খুবই খুশির খবর। কিন্তু তোমাকে একা একা কিভাবে পাঠাবো? আমি কথা দিয়েছিলাম যখন তোমার মা মারা যায়, আমি সবসময় তোমার যত্ন নেব। গাজীপুর চলে গেলে রোজ দেখা হবে না। একা মেয়ের বাড়ি থেকে দূরে থাকা কঠিন।'
হতাশ, অসহায় গলায় রোদেলা বলল,
'আমি একা থাকব না মামা। উমাইয়া আর জুবিয়া ওদের সাথে থাকব।'
মাসুদ মিয়া গম্ভীর গলায় বললেন,
'ওরা গাজীপুর কোথায় থাকে?'
'শফিপুর এ মামা।'
'আগে থেকেই সব প্ল্যান করে রাখছো যাক ভালো লাগল।'
মাসুদ মিয়া রোদেলার মাথায় এক হাত রাখলেন। তারপর আবার বললেন,
'তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তোমার কোনো ইচ্ছা যেন অপূর্ণ না থাকে। তাই চিন্তা কোরো না, আমি নিজে গিয়ে তোমাকে পৌঁছে দেব। আর সব সময় আমাকে ফোন করে খোঁজখবর দিবে।'
রোদেলা হাসল। বলল,
'আমি তোমাকে দিনে দশবার ফোন করব।'
পুতুল বেগম হতবাক। বিরক্ত গলায় বললেন,
'মেয়ে মানুষ বাসা থেকে বের হওয়ার কি দরকার? এই মেয়েকে তুমি প্রচন্ড মাথায় চড়িয়েছ, দেখো একদিন তোমার নাক কাঁটবে।'
মাসুদ ধমকের গলায় বললেন,
'আহ, আমার ভাগ্নির ব্যাপারে তুমি কথা বলছ কেন? রোদেলার প্রতি আমার অনেক বিশ্বাস আছে। আমার বিশ্বাস ও একদিন অনেক বড় মানুষ হবে। অনেক নাম কামাবে। ওর নাম শুনেই মানুষ ওকে এক ডাকে চিনবে।'
পুতুল বেগম ভ্রুকুটি করে ছেলের হাত ধরে তাকে অন্য ঘরে টেনে নিয়ে গেল। মাসুদ মিয়া সেটা গায়ে মাখল না। তিনি রোদেলার উদ্দেশ্যে কোমল গলায় বললেন,
'নতুন জায়গায় যাবা। অনেক খরচ হবে। তোমার এক মাসের জন্য কত টাকা প্রয়োজন হবে তা হিসেব করে আমাকে বোলো। আমি সে পরিমাণ টাকা আলাদা করে রাখব।'
.
.
.
চলবে.....................................