তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ১৫ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


আমাকে স্তব্ধ দেখে রৈনীল জানতে চাইলো, 'কি হয়েছে সরণী?'
'আপনি যান।'
'কোনো সমস্যা?'
'বললাম না আপনি যান?' 

ছোটখাটো ধমকের সুরে বললাম কথাটা। রৈনীল চলে যেতেই আমি কোনোরকম আওয়াজ ছাড়া গিয়ে গাড়িতে বসলাম। ড্রাইভার পিছন ফিরে তাকালো। তার মুখে কোনো কথা নেই। আমি ব্যস্ত ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলাম, 'বাবা কোথায়?'
'আপনি স্যারকে দেখেননি?'
'না তো। কোথায়?'
'রেস্টুরেন্টের ভিতরে।'

মুহুর্তেই আমার সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরে গেলো। কোনোমত ঢোক গিলে জানতে চাইলাম, 'কখন ঢুকেছে?'
'পনেরো/ বিশ মিনিট আগে।'
'কেন?'
'একজনের সঙ্গে আলাপ করতে করতে ভেতরে যেতে দেখলাম।'

আমি বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। বাবা যদি বিশ মিনিট আগে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে, তাহলে আমাকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এখন কি আমার গাড়িতে বসে থাকা উচিৎ নাকি ক্যাম্পাসের দিকে যাওয়া উচিত আমি বুঝতে পারছি না। 

জিজ্ঞেস করলাম, 'বাবা এখানে কেন এসেছে জানেন?'
'না। একবার আমাকে বলেছিলেন আপনাকে নেয়ার জন্য যেতে হবে।'
'সেটা কি রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগে?'
'জি।'

আমি বসে রইলাম চিন্তিত মুখে। হয়তো বাবা আমাকে নেয়ার জন্যই আগেভাগে চলে এসেছেন। এদিকে কোনো মিটিং ছিলো তাই আগে ওনার কাজটা শেষ করছেন। কিন্তু আমাকে রৈনীলের সঙ্গে দেখলেন কিনা সেটাই আমাকে সবচেয়ে বেশী পীড়া দিচ্ছে। 

আমি আর টেনশন নিতে পারছি না। সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। 

গাড়ির দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভাংলো আমার। বাবা এসে গাড়িতে বসলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কখন আসলা?'
'একটু আগে।'
'গাড়ি এখানে ছিলো সেটা কিভাবে জানলা?'
'এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।'
'ওহ। তোমাকে একটা ফোন কিনে দিতে হবে এবার। সীমান্তকে বলবো একটা ফোন নিয়ে এসে দিতে। এভাবে প্রতিদিন গাড়ি পার্ক করে রাখা ঝামেলার।'

আমি কিছুই বললাম না। বাবার গলার স্বর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বোঝার চেষ্টা করছি বাবা সত্যিই আমাকে দেখেছেন কিনা। অনেক্ষণ পরও যখন দেখলাম বাবা একদম স্বাভাবিক, আমি খানিকটা স্বস্তি পেলাম। এতক্ষণে ভেবে ফেলেছি, যদি বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেন ছেলেটা কে? আমি বলবো, সায়েমের বন্ধু। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো তাই সায়েমের ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন নিচ্ছিলাম। 

কিন্তু বাবা এ ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। 

পুরো দিনটা ভীষণ দুশ্চিন্তায় কাটানোর পর রাত্রিবেলা পেয়ে গেলাম বিশাল এক চমক। ভাইয়া আমার জন্য একটা ফোন কিনে এনেছে। বিস্ময়ে আমি কোনো কথাই বলতে পারলাম না। ফোন নিয়ে নিজের রুমে এসে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলাম। 

আমার জীবনে যত আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটছে, তারমধ্যে এটা সবচেয়ে বেশী আশ্চর্যজনক। অন্তত আমার জন্য। আমার নিজের একটা ফোন থাকবে এটা তো কোনোদিন চিন্তাও করিনি। মায়ের মুখ দেখে মনে হলো তিনিও বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। 

অনেক রাত অবধি খুশিতে আমার চোখে ঘুম আসলো না। বারবার ফোনটা আনলক করে স্ক্রিনে ঘুরছি। হঠাৎ মনে হলো রৈনীলকে একটা মেসেজ পাঠাই।

টেবিল ল্যাম্পের আলোয় আমি খাতাটা বের করলাম। ওর নাম্বারটা তুললাম স্ক্রিনে। ছোট্ট করে মেসেজ পাঠালাম, ঘুমিয়ে পড়েছেন? 

একটু বাদেই ফিরতি মেসেজ এলো, না। কে আপনি?

আমি কোনো উত্তর পাঠালাম না। মুখ টিপে হাসছি। আমার অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে। নিজের ফোন থাকার আনন্দের চেয়েও বেশী মজার বিষয় হচ্ছে, এখন রৈনীলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে!

মুহুর্তেই কল এলো ওর নাম্বার থেকে। আমি লাফ দিয়ে উঠে কলটা মিউট করলাম। তারপর রিসিভ করে কানে ধরলাম। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ওর ভারীক্কি গলা, হ্যালো..

আমি নিশ্চুপ।

'হ্যালো..'
আমি এখনো নিশ্চুপ।
এবার সে বলল, 'সরণী?'

আমি যথাসম্ভব নিচু গলায় বললাম, 'হুম।'
'এটা কার ফোন? এত রাতে কল দিয়ে বিপদে ফেললাম?'
'না। এটা আমার ফোন।'
'তাই নাকি?'

আমি ধীরপায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়ে একদমই মৃদু স্বরে বললাম, 'বাবা আজকে আমাকে ফোন কিনে দিয়েছে।'
'বাহ! সারপ্রাইজ।'
'হুম। বিশাল সারপ্রাইজড আমি।'
'খুশিতে ঘুম আসছে না বুঝি?'
'হুম। একদম ঘুম আসছে না।'
'তাহলে একটা কবিতা শোনাই-

হাওয়াকে অনেক বুঝিয়েছি। 
এ রকম ছোটাছুটি ভালো নয়, শান্ত হও, ধীরস্থির হও;
খানিক বিশ্রাম নাও ঘাসের ওপর,ফড়িঙের সাথে গল্প করো।
দিন নেই রাত নেই,জন্মান্ধ প্রেমের মতো এতো আকুলতা অস্থিরতা রীতিমতো বিপদ-জনক।
দুপুরের রোদে তুমি ঝলসে যেতে পারো, 
একটু সুস্থির হও, পুকুরের জলে দ্যাখো ভাসমান তোমার শরীর
নরম ঢেউয়ের মতো হাতছানি দেয়।
হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগে যাবে,গুহার আগুনে বসে থাকো;এতো ছোটাছুটি ভালো নয়।
রাতবিরেতের অন্ধ বহুতল ভবনের গায়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে যাবে বাতাসের ডানা, 
শরীরের ভাঁজগুলো বিদ্ধ হবে ক্যাকটাসে, রক্তপাত হবে।
অনেকভাবেই তাকে বুঝিয়েছি, তবুনীল ট্রেন ছুটে যাচ্ছে, পেছনে পেছনে তার হাওয়ারেল-লাইন ছুটে যাচ্ছে,
প্রতিবেশী পাথরের ডিমে আদমের কথাগুলো পড়ে আছে অপেক্ষার হিমে।'

থামলো রৈনীল। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর আবৃত্তি শুনছিলাম এতক্ষণ। এবারে বললাম, 'ভীষণ সুন্দর!'
'এটা ময়ূখ চৌধুরীর লেখা কবিতা। পড়ছিলাম। তখনই তুমি টেক্সট দিলে।'
'খুব ভালো ক্ষণেই দিয়েছি।'
'হুম। সরণী, আনন্দ হচ্ছে তোমার?'
'খুউউউব।'
'আমি তোমার আনন্দ দেখতে পাচ্ছি।'
'তাই? কিভাবে? '
'তোমার গলা শুনেই কল্পনায় ভেসে উঠছে তোমার আনন্দিত মুখ।'

আমি খিলখিল করে হেসে বললাম, 'আমার আনন্দিত মুখটা কেমন দেখতে? আমারও দেখতে ইচ্ছে করছে।'
'তাহলে ভিডিও কল দাও। তুমিও দেখতে পারবে।'
'না। আমি কোনোদিন ভিডিও কলে কথা বলিনি।'
'ওহ আচ্ছা। তাহলে থাক। প্রথম জড়তাটুকু তোলা থাকুক স্পেশাল কারো জন্য।'

আমি মুচকি হাসলাম। জড়তা! হয়তো তাই। প্রথমবার ভিডিও কলে কারো সঙ্গে কথা বলতে নিশ্চয়ই জড়তা কাজ করবে। সেই জড়তাটুকু তোলা রাখতে বলছে রৈনীল। কিন্তু আমার কেন যেন ইচ্ছে করছে ওকেই সেই জড়তাটুকু ঢেলে উজাড় করে দেই। এই আবছা অন্ধকার রাতে, মুখ টিপে হাসি ওরই সামনে। কেন আমার এই ছেলেমানুষী ইচ্ছে জাগছে? জানিনা। 

আমি ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেয়ার সাহস করলাম না। রৈনীল আরও একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে। কিন্তু আমার মাথায় কোনো শব্দই যেন ঢুকছে না এবার। বরং আমি বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে ওর কণ্ঠটা শুনছি। ওর কণ্ঠে কী একটা মেশানো, যেন সহস্রাব্দের আবেগ জড়ানো গলা। প্রতিটা উচ্চারণ খুব মোহ জাগায়, শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। 

আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। বাহিরে এখন তমসাচ্ছন্ন রাত। কোথাও হতে কোনো আওয়াজ আসছে না। আমিও চেষ্টা করছি নিঃশব্দতা ধরে রাখতে। আমার গলার আওয়াজ যেন দেয়ালও শুনতে না পায় এতটুকু ছোট্ট কণ্ঠে, বলা যায় ফিসফিসিয়ে আমি কথা বলছি। 

'আপনি গান গাইতে পারেন না?'
'আমি আর গান.. '
'আপনার গলায় গান সুন্দর শোনাবে মনে হচ্ছে।'
'গান শুনতে চাইছো? কিন্তু আমি তো পারিনা তেমন একটা গান গাইতে। আমার কবিতা তোমাকে যতটা মুগ্ধতা দিয়েছে, আমার গান ততটা বিরক্তি এনে দেবে।'
'শুনি?'

রৈনীল শব্দ করে হাসলো। তারপর শুরু করলো একটা গান। মাত্র কয়েক লাইন গাইলো। খুব দরদ দিয়ে। যেন আমার শরীরে পুলকিত সুরের সঞ্চার ঘটলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উচ্চশব্দে বলে উঠলাম, 'এত সুন্দর!'

রৈনীল বললো, 'এত জোরে বললে এবার?'
'ওপসস। বিরক্তি আসেনি। আনন্দ পেয়েছি।'

আমি আবারও শান্ত হয়ে গেলাম। কতক্ষণ কেটে গেলো নীরবে। একসময় রৈনীল বললো, 'সরণী..'
'হুম।'
'ঘুমাবে না?'
'হুম। আচ্ছা কল কেটে দেই?'
'দাও। শুভরাত্রি।'

আমি ফিরতি শুভরাত্রি না বলেই কল কেটে দিলাম। এরপর মনে হলো একবার শুভরাত্রি জানানো দরকার ছিলো। শুয়ে শুয়ে খানিকক্ষণ ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালাম। হঠাৎ হয়ে গেলাম অন্যমনস্ক। রৈনীলের সঙ্গে কথা বললে আমার মনটা অদ্ভুতভাবে ভালো হয়ে যায়। ওর কথা বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। ফোনের সুবাদে ওর কথা শুনতে পেরেছি বলে মনেমনে বাবাকে ধন্যবাদ জানালাম। 
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp