রাফি ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে বললো,
" এ ভাইয়া.....আমাকে উঠাও ভাইয়া.....আমি মরে যাবো.....বাঁচাও ভাইয়া.......বাঁ-চা-ও।"
স্মরণ রাফির এ দুর্দশায় হেসেই কূলকিনারা পেলো না। রাফিকে শায়েস্তা করতে বেশ ভালো লাগে! রাফি তো জানে না যে রাফির তার চেয়েও দ্বিগুন দুষ্টু স্মরণ।
স্মরণ রাফিকে দ্রুত উঠালো। কাঁদায় মাখামাখি তার সমস্ত শরীর। সাপের ভয়ে মুখটা প্রায় রক্তশূন্য হতে বসেছে। স্মরণ চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারছে না। এদিকে রাফি এ নিয়ে খানিক অপমানিত বোধ করছে। এক পড়ে যাওয়া নিয়ে এত হাসার কি আছে! আশ্চর্য!
রাফি নরম কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
" হেসো না ভাইয়া। সত্যিই ভয় পেয়েছি আমি।"
স্মরণ এবার চেষ্টা করে হাসি থামালো। হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। এমতাবস্থায় রাফির কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বললো,
" বাড়িতে যা। জামাকাপড় চেঞ্জ করে আয়।"
রাফি অনুনয়ের সুরে বললো,
" তুমি একাই যাও না ভাইয়া। আবার জামাকাপড় চেঞ্জ করে আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। "
"হাপ.... কিসের অনেক সময়! তুই মেয়ে নাকি! যা, দ্রুত চেঞ্জ করে আয়। আর বাড়ি থেকে বেশি দূরে আসিনি। যা যা। আমি এখানেই ওয়েট করছি।"
স্মরণকে নিজের কথা মানানোর মতো অসম্ভব কাজে আর নিজের সময় অপচয় করলো না রাফি। অগত্যা কাঁদায় মাখোমাখো হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ইশ, শরীর থেকে কেমন পঁচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে!
রাফি কিছুদূর যেতেই স্মরণ সাদকে ফোন করলো। কিছু একটা বলে মিটিমিটি হাসলো সে। বাড়ি আসলে তার ভালোই সময় কাটে। এই যে পিচ্চিপাচ্চাগুলোকে জ্বালানো যায়, দুষ্টুমি করা যায়। বাড়ি এলে সে ভুলেই যায় যে তার বয়স এখন ২০ এ আটকে নেই। সেই ছোটবেলার মতো হাসি ঠাট্টায় দিন কাটিয়ে দেয়। আবার এই ছুটি শেষ হলে ঢাকায় ফিরে ব্যস্ততার স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দেয়। তখন কাজের ফাঁকে স্মৃতিস্বরূপ এসব মজাদার সময় রোমন্থন করে আর মুচকি মুচকি হাসে।
মিনিট দশেক বাদে রাফি ফিরে আসলো। পরনে তার ঝকমকে রঙের একটা লুঙ্গি, যেমনটা গ্রামাঞ্চলের পিচ্চি ছেলেরা সুন্নাতে খৎনার পর পরে। আর গায়ে সাদা একটা টিশার্ট। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে রাফির মাত্রই সুন্নাতে খৎনা হয়েছে।
রাফিকে দেখে স্মরণ নিজের হাসি চাপিয়ে রাখলো। সাদকে কল করে সে-ই বলেছিলো রাফিকে এমন পোশাকে পাঠিয়ে দিতে। এদিকে বেচারা রাফি এমন সাজপোশাকে বাজারে যাবে না তো যাবেই না। পরে স্মরণের ভয় দেখিয়ে জোর করে পাঠানো হলো তাকে। তার ছোট্ট মুখখানা এখনও কাঁদো কাঁদো হয়ে আছে। বেচারা এই ছোট্ট জীবনে এই আধ ঘণ্টার মধ্যে কি ঝড়টাই না উঠে গেলো!
স্মরণ বেশ কষ্টেসৃষ্টে নিজেকে গম্ভীর দেখানোর চেষ্টা করছে। দূর থেকে রাফিকে হাঁক ছেড়ে ডেকে বললো,
" দ্রুত আয়। ইফতারের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। "
রাফি স্মরণের তাড়া দেয়ায় লুঙ্গির অগ্রভাগ সামান্য তুলে হাঁটা আরম্ভ করলো। অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। এভাবে লুঙ্গি পরে হাঁটা যায় নাকি! তার বাপ চাচারা যে এই একপিস খোলা কাপড় পরে সারাদিন কিভাবে কাটায় আল্লাহ জানে। রাফির তো ভীষণ ভয় হয়। পাছে নিচ দিয়ে যদি মানসম্মানে টান পরে!
এবার বেশ সতর্কতার সহিত হাঁটছে রাফি। আবার পিছলে পড়লে স্মরণ না তাকে উলঙ্গ করে নিয়েই ছুট দেয়! এই স্মরণ ভাইয়ার কোনো বিশ্বাস নেই। মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে স্মরণকে ভীষণ বকলো রাফি। তার এই অদক্ষ চলনে পেটে খিল ধরে দেয়ার মতো হাসি পেলো স্মরণের। কিন্তু সে হাসলো না। পাছে রাফি যদি অপমানে এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে যায়!
রাফি ভাঙা পায়ে স্মরণের সামনে এসে দাঁড়ালে স্মরণ তার হাত ধরলো। পিছে রাফি, সামনে স্মরণ, এভাবেই আইল ধরে হাঁটছে দুজন। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আইল শেষ হয়ে এলে মেহগনি গাছের বিশাল বাগানে পা দিলো। এর মধ্যে রাফি বললো,
" লুঙ্গি পরে হাঁটতে পারছি না ভাইয়া। "
স্মরণ মৃদু ধমকে বলে,
" তুই একটা বাঙালি ছেলে। আর ক'দিন পর পুরুষ হবি। এখনও লুঙ্গি পরে হাঁটতে পারিস না! বাঙালি পুরুষজাতিকে তো অপমান করে দিলি!"
রাফি চট করে বলে,
" তুমিও তো লুঙ্গি পরোনি। "
স্মরণ খানিক থতমত খেলো৷ তবে তা রাফির অগোচরে রেখে বললো,
" এখন পরিনি। কিন্তু লুঙ্গি তো পরি আমি।"
" কই? তোমাকে তো পরা দেখিনি। সারাদিন ট্রাউজার পরে থাকো।"
" তোকে কি দেখিয়ে পরতে হবে! এখানে পরি না ঠিকই। কিন্তু বাসায় ঠিকই পরি। আফটার অল, এটা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক। "
রাফি কিঞ্চিৎ প্রতিবাদী হয়ে বললো,
" এই এক টুকরো কাপড় ঐতিহ্যবাহী পোশাক হয় কি করে! এটা পরলে ইজ্জতের ঠিক থাকে না। যখনতখন মানুষের সামনে ইজ্জত পাংচার হয়ে যেতে পারে।"
স্মরণ এবার সশব্দেই হাসলো। প্রত্যুত্তরে বললো,
" কিন্তু দেখ এটা পরলে চারপাশ দিয়ে কি ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে। তাই না?"
এতক্ষণ সব যুক্তিতে দ্বিমত পোষণ করলেও এবার আর তা পারলো না রাফি। সহমত প্রকাশ করে বললো,
" এটা ঠিক বলেছো ভাইয়া। কিন্তু বাজারে গেলে সবাই যে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে! "
" কে বলেছে তাকিয়ে থাকবে! বাজারে গেলে দেখবি তোর মতোই সবাই লুঙ্গি পরে আছে।"
" তাই?"
" হুম। দেখিস। প্রায় চলে এসেছি আমরা।"
বাজারে গিয়ে স্মরণের কথানুযায়ী রাফি ঠিকই লুঙ্গি পরা মানুষজন দেখলো। আশ্চর্যজনকভাবে আশেপাশের সবাই লুঙ্গি পরে আছে। অন্য পোশাক পরেনি কেউ। রাফি খানিকটা অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। এমন বৃহৎ সংখ্যক লোকবলকে লুঙ্গিতে দেখে তার অস্বস্তি ভাবটুকু কেটে গিয়েছে। উল্টো বাঙালি হিসেবে গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছে।
---------------------
ইফতারিতে আর সর্বসাকুল্যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি আছে। বাড়ির বিশাল আধ পাকা রান্নাঘরে আসমানী বেগম, পাখি ও মানতাসা বাদে সবাই উপস্থিত। সকলের হাতেই কিছু না কিছু কাজ। কেউ চপ বানাচ্ছে, কেউ পেয়াঁজু মাখাচ্ছে, কেউ ছোলা ভুনছে, কেউ শরবত বানাচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন কাজ সকলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে। তীব্র গরমে কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলছে গল্প। এই গল্পের মাঝেই ছোট মামি মাসুদা বেগম নওরীনকে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
" কি রে নওরীন? কয় মাস চলছে তোর? বাচ্চা নিয়ে তো কিছু বললিও না আমাদের।"
হাসিখুশি নওরীনের ঠোঁট হতে মিষ্টি হাসিটুকু উবে গেলো। বাড়ি আসার চারদিন আগেই প্রচন্ড পেট ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলো। পরে টেস্ট করে জেনেছিলো তৃতীয়বারের মতো মিসক্যারেজ হয়েছে তার। এবার বেশ আশা নিয়ে নতুন জীবনের অপেক্ষা করছিলো সে আর সাজিদ। কিন্তু পাঁচ বছরের এই বিবাহিত জীবনে তিনবার বাচ্চা পেটে আসার অনুভূতি আস্বাদন করলেও একবারও মা হওয়ার স্বাদ আস্বাদন করতে পারলো না। এবারের মিসক্যারেজ নিয়ে কাউকেই বলেনি দুজনে। আসলে বাড়ির এই হাসিখুশী মহলটাকে নষ্ট করতে মনে সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু মাসুদা বেগম এভাবে হঠাৎ জিজ্ঞেস করায় বিপাকে পড়লো সে। প্রথমে ভাবলো কথাটাকে কাটিয়ে দিবে বা মিথ্যে বলবে। কিন্তু রোজা রেখে মিথ্যে বলতে মনে সায় দিচ্ছে না। তাই সে কথা কাটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তার মুখভঙ্গিমা ও আমতাআমতা করা দেখেই মিলি বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
" কি হয়েছে নওরীন? আবারও?..........."
ইশ, মা এভাবে বুঝে গেলো কেনো! নওরীন ঠোঁট কামড়ে উঠলো। নত দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
" আবারও মিসক্যারেজ হয়েছে।"
নওরীনের কথায় মুহূর্তেই রান্নাঘরে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। শুধু চুলোর আওয়াজ হচ্ছে। সকলের উদ্বিগ্ন ও বিস্ময়ের দৃষ্টি নওরীনের উপর। নীলিমা কাজ বাদ রেখে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। এক মাস আগেই শুনেছিলো নওরীন মা হবে। বহুদিন বাদে সে ভীষণ খুশি হয়েছিলো। অবশেষে নওরীন মা হবে, সে খালা হবে। প্রচন্ড খুশিতে ছেলেমেয়ে উভয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলো। আর আজ এ সংবাদ শুনলো!
নওরীনের মিসক্যারেজের সংবাদে সকলের মন ভারী হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ পূর্বের গল্পগুজবে পূর্ণ পরিবেশটা ছোট্ট প্রাণের শোকে নিঃস্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে উঠলো। নীরবে সকলে যে যার মতো ইফতার বানানোতে হাত চালালো। ওদিকে একই নীরবতাকে আশ্রয় করে মিলি বেগম, নীলিমা ও নওরীনের চোখজোড়া অশ্রুতে ছলছল করে উঠলো। নওরীন নিজেকে বুঝ দিলো, এ শোক সামলে উঠবে সে, শক্ত হয়ে উঠবে, আল্লাহ চাইলে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই তার কোলজুড়ে এক নিষ্পাপ প্রাণের আগমন ঘটবে। ততদিন পর্যন্ত স্রেফ অপেক্ষায় দিন গুনতে হবে।
---------------------
আজকের রাতের আকাশ খানিক মেঘলা। দূরে মেঘের গর্জন হচ্ছে। ইফতার করে নামাজ পড়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে মধ্য উঠোনে বসে আছে নীলিমা। হঠাৎ করেই আজ ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে। তাই শুধু নিজের জন্য কড়া লিকারের এক মগ চা নিয়ে বসে আছে সে। একটু অন্ধকার, হইহট্টগোল থেকে দূরে একান্তে কিছু সময় কাটাতে মন চাচ্ছিলো বলে উঠোনের লাইটটা বন্ধ করে বসেছে।
পরম তৃপ্তিতে কয়েক চুমুক চা পান করতেই হঠাৎ অনুভব করলো পাশেই আরেকটা চেয়ার এনে কেউ বসেছে। দূরে গেটের বাইরের আবছা আলোয় অনুমান করলো এটা স্মরণ। তার এ অনুমান সত্য হলো যখন স্মরণ তার গমগমে কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
" এভাবে রাতের অন্ধকারে একা বসে চা খাচ্ছো কেনো? "
নীলিমা জবাব দিলো না। চা নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো। এক কদম এগুতেই স্মরণ আচমকা তার বাম হাত চেপে কঠিন গলায় বললো,
" এ্যাই মেয়ে, এ্যাই। সমস্যা কোথায় তোমার? "
হঠাৎ স্মরণের স্পর্শে বিস্ময়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো নীলিমা। অতঃপর ক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
" হাত ছাড়ুন স্মরণ ভাই। "
স্মরণ গোঁ ধরে বললো,
" উঁহু। যতক্ষণ না আমার প্রশ্নের জবাব পাবো ততক্ষণ হাত ছাড়বো না। ভালোয় ভালোয় জবাব দিয়ে যাও। আমি হাত ছেড়ে দিবো।"
নীলিমা এবার চট করে তার দিকে ফিরে তাকায়। রাতের টিমটিমে আবছা আলোয় দুজন দুজনকে অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তবে একে অপরের প্রতিক্রিয়া, মুখভঙ্গিমা ঢের টের পাচ্ছে। এই যেমন নীলিমা যে এখন একটু একটু করে রেগে উঠছে, স্মরণ তা জানে। তবুও সে নীলিমার হাত ছাড়লো না৷ এবার জিজ্ঞেস করলো,
" তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো নীলিমা?"
নীলিমা তেরছা কণ্ঠে বললো,
" জি হ্যাঁ! আই এম ইগনোরিং ইউ মিস্টার স্মরণ শেখ। এখন কি প্রমাণস্বরূপ খাতাকলমে লিখে দিবো?"
.
.
.
চলবে............................