আশিয়ানা - পর্ব ০৭ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


কলিংবেলটার শব্দে উমাইয়ার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমঘুম চোখে কয়েকবার পলক ফেলে আবার ঘাড় জড়িয়ে শুয়ে পড়ল সে। কিছুক্ষণ পর আবার কলিংবেলটার শব্দে চমকে উঠে বিছানায় উঠে বসল উমাইয়া। তারপর ডান হাত দিয়ে চোখ ঘষতে লাগল একটু পর বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। উমাইয়া তার এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা করে দরজা খুলে দিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রোদেলা আর মাসুদ মিয়া। রোদেলাকে দেখে উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল উমা। দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
  'কতদিন পর তোকে দেখলাম, রোদু। কেমন আছিস? তোমার এত শুকিয়ে গেছিস কেন? ঠিকমতো খাসনি, না?'

উমাইয়া রোদেলাকে ছেড়ে সরে দাঁড়াল। তারপর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাসুদ মিয়ার উদ্দেশ্য বলল,
  'আসসালামু আলাইকুম চাচা। কেমন আছেন?'
মাসুম মৃদু হেসে বললেন, 
  'আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো? কত মাস পর দেখলাম। অন্য একজন কই?'

মাসুদ মিয়ার কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল উমাইয়া। তারপর ব্যাগটা সোফায় রাখতে রাখতে বলল,
  'জুবিয়া? তাকে নিয়ে আর কথা বলবেন না চাচা। প্রতি মাসে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকে। গতকাল একটা চাকরি হারিয়েছে। সারারাত ঘুমায়নি। এখন ঘুমাচ্ছে।'

মাসুদ মিয়া আরাম করে সোফায় বসলেন। রোদেলা উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
  'মামা তুমি বসো। আমি জুবিকে চমকে দিয়ে আসি।'

জুবিয়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। রোদেলা আস্তে আস্তে হেটে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ একটানে কাঁথা সরিয়ে ফেলল। জুবিয়া বিরক্ত চোখে তাকাল। রোদেলা আসবে এই খবরটা উমাইয়া তাকে দেয়নি। জুবিয়া সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর চোখ খুলে বলল,
  'রোদু এটা কি সত্যি তুই না-কি আমি স্বপ্ন দেখছি?'

রোদেলা হাসল। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
  'জুবি! এটা সত্যিই আমি।'
জুবিয়া হতভম্ব হয়ে গেল। সে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বিছানা থেকে নামল। রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
  'আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। সিরাজগঞ্জ থেকে গাজীপুর এলি কিভাবে? তোর মামা তোকে আসতে দিল?'
রোদেলা ভ্রুকুটি করল। শুধল,
  'আমি আসব। উমাইয়া তোমাকে বলেনি?'
জুবিয়া নিবিড়ভাবে ডানে-বামে মাথা নাড়ল, 
  'না।'
রোদেলা তড়িঘড়ি করে ভাবনার ভঙ্গিতে আবার বলল,
  'মামা বসার ঘরে বসে আছেন। চল।'

.

সকাল ৯টা বাজে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। আকাশের অবস্থা ভালো না। হুট করে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তূর্ণ বিছানা থেকে উঠে ঘুমের মধ্যে দুলতে দুলতে ড্রয়িং রুমে এলো। সেহরিশ আর সাদাফ আগে থেকেই ল্যাপটপে বসে কিছু দেখছিল। তূর্ণা এসে সেহরিশের পাশে দাঁড়াল। মিষ্টি গলায় বলল,
  'আমার ক্ষুধা লাগছে। আমার জন্য কিছু বানিয়ে দিবে?'

সাদাফ ভ্রুকুটি করল,
  'তুই নিজের খাবারও রান্না করতে পারিস না। এসব কবে শিখবি?'
তূর্ণ বলল,
  'তোদের মতো বড় দুই ভাই থাকতে এসব শেখার ঝামেলায় যাবো কেন?'
সেহরিশ বলল,
  'নাস্তা সেরে বের হবো।'
সাদাফ জিজ্ঞেস করল, 
  'কোথায়?'
সেহরিশ বলল, 
  'শপিংমল।'

সেহরিশ এর পরনে, সাদা টি-শার্টের ওপর কালো জ্যাকেট, ডেনিম ব্লু জিন্স, পায়ে কেটস। সেহরিশের ফর্সা গালে চাপ দাঁড়ি আর তার কপালের সিল্কি চুল বাতাসে হালকাভাবে নড়ে ওঠল। তূর্ণ বারবার সেহরিশকে তাকিয়ে দেখছে। তাকে অনেক সুন্দর লাগছে। সেহরিশ কথা বলতে বলতে হঠাৎ তূর্ণর দিকে তাকালেই তূর্ণ হেসে ফেলল। তূর্ণ, সেহরিশ ও সাদাফ একসাথে শপিং মলে প্রবেশ করল। বডিগার্ড কঠোরভাবে পাহারা দিচ্ছেন যেন ভক্তরা এসে তাদের জ্বালাতন না করে। তূর্ণ তার পছন্দের কিছু কেনাকাটা করে বেরিয়ে এলো। শপিংমলের সামনে ব্যাপক ভিড়। ভক্তরা তাদের প্রিয় গায়কদের এক ঝলক দেখতে সাগ্রহে জড়ো হয়েছে। আর সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান সবাই তাদের মুখ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায়।

সাংবাদিকদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে সেহরিশ। একজন সাংবাদিক একপর্যায়ে তূর্ণকে জিজ্ঞেস করলেন, 
  'গতকাল কেউ আপনার গাড়ি চালিয়ে আপনাকে ভিড় থেকে নিয়ে গিয়েছিল। সে কে ছিল?'

তূর্ণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মেয়েটির নাম ছাড়া সে কিছুই জানে না। সে হঠাৎ নরম গলায় বলল,
  'আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন।'

সাদাফ মুখ তুলে সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বলল,
  'আমাদের সম্পর্কে আপনার অনেক প্রশ্ন আছে। আমরা বুঝি। আমাদের বাংলাদেশে আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কাউকে কোন আপডেট দেওয়া হয়নি কারণ হঠাৎ আসতে হয়েছে পরিবারের কথা ভেবে। আমরা চাইনি আমাদের আগমনের খবর জনসাধারণের কাছে এভাবে ছড়িয়ে পড়ুক বা আমাদের সম্পর্কে সবার কৌতূহল জাগিয়ে তুলুক। আমরা এখানে দুই দিনের জন্য আছি এবং আগামীকাল সন্ধ্যার ফ্লাইটে চলে যাব। দয়া করে আমাদের জন্য উত্তেজিত হবেন না।'

ভিড়ের ভেতর থেকে একটা আওয়াজ শুনে সেহরিশ সেদিকে তাকাল। একই সঙ্গে অনেকে চিৎকার করছে। অস্পষ্ট শোনাচ্ছে, মাইক হাতে নিয়ে সেহরিশ তাদের উদ্দেশ্য বলল,
  'দুঃখিত আমি বুঝতে পারিনি। আপনারা সবাই চুপ করে একজন বলুন যেন স্পষ্ট শুনতে পাই।'

ভক্তদের দাবি যে তারা তাদের নিজ দেশে বি-এম ব্যান্ডের লাইভ পারফরম্যান্স দেখতে চায়। সেহরিশ গম্ভীর চোখে তাকাল তূর্ণর দিকে। তূর্ণ ঢোক গিলে নিজেকে গুটিয়ে নিল।

সাদাফ বলল,
  'আপনারা আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা এই সময়ে আপনাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারব না। কারণ আমাদের ফ্লাইট আগামীকাল রাতে।'
সেহরিশ মাটির দিকে তাকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল।


শহরের ব্যস্ততা অনেকটাই কমে গেছে। সবাই বাড়ি ফিরছে। চারিদিকে অন্য এক নতুন দিনের অপেক্ষা। চতুর্দিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, হারিয়ে যাওয়া সন্ধ্যার অনুসন্ধানে নামে সেহরিশ। সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে দেশের প্রায় সব প্রান্তে ছড়িয়ে পরেছে বি-এম ব্যান্ড তারকারা বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছেন। দেশের সব বড় শিল্পপতির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা না হলেও বিকেলে কয়েকজন শিল্পপতি ও গাজীপুর জেলা মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা গাজীপুরে একটি বড় কনসার্টের আয়োজন করতে চান। আর পারফর্ম করবে বিএম ব্যান্ড। সেহরিশ তাদের প্ল্যান শুনে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে ছিল আর ভাবার জন্য সময় নিয়েছে।

সাদাফ ইতস্তত করে বলল,
  'কনসার্টের আয়োজন মুখের কথা নয়। দুদিন বা একদিনে হয় না। অনেক সময় লাগবে। হাতে অনেক সময় যেহেতু আছে গ্রাম থেকে ঘুরে আসি?'

সেহরিশ সাদাফের দিকে তাকাল। সোফার কুশনটা তুলে সাদাফের মুখে ছুঁড়ে দিল সে। তূর্ণ তখনও আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে পিষে ফেলতে চাচ্ছে তূর্ণ। সেহরিশ গম্ভীর চিত্তে বসে শান্ত ভঙ্গিতে তূর্ণর দিকে তাকাল। রাগে-ক্ষোভে তার কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। তূর্ণ ভয় পেয়ে সাদাফের ঠিক পেছনে দাঁড়াল। সেহরিশের রাগ বাড়তে থাকল। হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসটা নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারল। অতঃপর রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলল, 
  'আমি এখানে এসব করতে আসছি?'

সাদাফ সেহরিশের মুখের দিকে তাকিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল, 
  'এত বছর বিভিন্ন দেশে পারফর্ম করেছি। নিজের দেশে একটা করলে সন্তুষ্টি পাবো। তুই কি বলিস?'
সেহরিশ কথা বলল না। সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রুমের দিকে চলে গেল। তূর্ণ হতভম্ব কণ্ঠে বলল, 
  'আমি একবার ওর সাথে কথা বলব?'

সাদাফ কিছুক্ষণ বসে থেকে হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ব্যাঙ্গ করে বলল,
  'হ্যাঁ। তুই ওর সামনে গিয়ে অদ্ভুত আচরণ করবি। তখন তোর অদ্ভুত পাগলামি দেখে সেহরিশ আরও রেগে যাবে। তারপর ও তোকে উল্টো হাতে থাপ্পড় মারবে।'

তূর্ণ জবাব দিল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর অভিমান কণ্ঠে বলল,
  'আমি কোনো অদ্ভুত আচরণ করি না। আমি তাকে সুন্দর করে বোঝাবো। সত্য?'
তূর্ণর কথায় বিরক্ত হয়ে ওঠে সাদাফ। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,
  'মোটেই না। তুই সেহরিশের কাছে ও যাবি না। এই সমস্যা তোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। তাই এখন চুপচাপ রুমে গিয়ে চিপস খা।'

তূর্ণ অবাক হল। বিব্রত কণ্ঠে বলল,
  'আমি চিপস খাব কেন? আই এম নট অ্যা বেবি।'
.
.
.
চলবে.....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন