আশিয়ানা - পর্ব ০৩ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


অমাবস্যার রাত। চারিদিকে নিস্তব্ধতা আর নির্জনতা। সেহরিশ হঠাৎ ল্যাম্পপোস্টের নিচে গাড়ি থামাল। গভীর রাত। হুট করে এখানে ছুটে আসলো সে। রাস্তার পাশে লেজ গুটিয়ে বসে আছে একটি বিড়াল। সেহরিশ লাফ দিয়ে বাম্পারে উঠে বসে সাদাফকে ব্যস্ত হাতে কল দিল। ফোনের ওপাশ থেকে সাদাফ স্থির কণ্ঠে শুধাল,
  'এত রাতে ফোন?'
সেহরিশ ছোট্ট করে জবাব দিল,
  'তোর বাড়ির সামনে আছি। তূর্ণকে বলার দরকার নেই।'
সাদাফ এল। সেহরিশ কিছু বলার আগেই সাদাফ জিজ্ঞেস করল,
  ' আপসেট?'
  'উঁহু।' 
  'তাহলে হঠাৎ এভাবে ডাকলি যে? আর তূর্ণকে বলতে বারণ করলি কেন?'
সেহরিশ সাদাফের দিকে তাকাল। তারপর বলল, 
  'ভালো লাগছে না।'
কালো টি-শার্টটা সেহরিশের বলিষ্ঠ শরীরে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে। চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপালে ছড়িয়ে আছে। সেহরিশ গাড়ির বাম্পারে বসে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। 
সাদাফ বলল,
  'আমাকে বল কি হয়েছে?'
রাস্তার দিকে চোখ স্থির রেখে সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
  'গাড়ির সামনের সিটে বিয়ার রাখা আছে।'
গাড়ি থেকে বিয়ারের বোতল আনতে সাদাফের বেশি সময় লাগল না। সেহরিশ চাঁদের দিকে তাকাল। সাদাফ জিজ্ঞেস করল,
  'খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?'
সেহরিশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
  'হ্যাঁ।'
সাদাফ এগিয়ে গিয়ে সেহরিশের কাঁধে হাত রাখল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
  'এসব চিন্তা বাদ দে! আমাদের পরশুদিন USA যেতে হবে। তাছাড়া রাতে কিছু খেয়েছিস?'
সেহরিশ বলল,
  'না। ইচ্ছে করেনি।'
  'আমাদের সাথে চল। তোর জন্য রান্না করব।'
  'এত রাতে?'
  'হুম।'

২৪ ফেব্রুয়ারী। ফেয়ারমন্ট সেঞ্চুরি প্লাজা হোটেল। ধুমধাম করে অনুষ্ঠান শুরু হয়। একজন মহিলা উপস্থাপক নিখুঁতভাবে উপস্থাপনা শুরু করলেন। মহিলা উপস্থাপক দেখতে ভারী সুন্দর। তার রূপ যে কোনো পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। হাস্যোজ্জ্বল মহিলা মাইক্রোফোন ধরে একের পর এক কথা বলছেন। তূর্ণ তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সাদাফ খানিকটা নার্ভাস বোধ করছে। ডান হাতে চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলল সে। সেহরিশ ঠোঁট কামড়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। মৃদু হেসে পুরস্কার গ্রহণকারী দল ঘোষণা করতে যাচ্ছেন উপস্থাপক। সাদাফের পা কাঁপছে উত্তেজনায়। মহিলা উপস্থাপক ইংরেজিতে চিৎকার করে বললেন, 
  'এ বছর, আর্টিস্ট অফ দ্য ইয়ার 2017 পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্ব বিখ্যাত সঙ্গীত তারকা এম-বি।'

সাদাফ সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। প্রফুল্ল হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে তূর্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরল। পুরস্কার গ্রহণের পর সেহরিশ ইংরেজিতে বলল,
  'সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। এবং আমাদের ফ্যানডম সবার জন্য ভালোবাসা রইল।'

সেহরিশ মাইকে কথা বলার সময় হঠাৎ মহিলা উপস্থাপককে লক্ষ্য করে, মহিলাটি তাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। সেহরিশ কিছুটা দ্বিধা নিয়ে ছোট্ট করে বক্তব্য শেষ করল। সেহরিশ 
মহিলাদের দিকে তাকাতে বা এমনকি তাদের আশেপাশে থাকতেও সেহরিশের বিরক্ত লাগে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। সেহরিশ তার বিরক্তিটুকু না দেখিয়ে দ্রুত তার স্থান পরিবর্তন করল। সাদাফ মহিলাটির হাবভাব লক্ষ্য করে সেহরিশের দিকে তাকাল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেহরিশ।

আগামীকাল ইতালি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেহরিশ। কিন্তু সমস্যা হল তূর্ণকে নিয়ে সে আরও কিছুদিন এখানে থাকতে চায়। সাদাফ তূর্ণর কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল,
  'মন খারাপ করিস না। তোকে একা রেখে সেহরিশ যাবে না। আরেকবার এসে তোর ইচ্ছামত সময় কাটিয়ে নিস। এবার আমাদের সাথে ফিরে চল।'

.

মার্চ মাসের ১ তারিখ। দুদিন ধরে মায়ের জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছে সেহরিশের। চোখ বুজলেই মা-কে নিয়ে আজেবাজে স্বপ্ন দেখছে সে। মা-কে একবার দেখার জন্য দেশে যাবে সেহরিশ। তূর্ণকে নিয়ে সাদাফের বাড়ি আসলো।

চোখে চশমা, বাম হাতে একটা ঘড়ি, মাঝের আঙুলে নীল পাথরের আংটি আর দুই আঙুল দিয়ে বই ধরে বারান্দায় বসে আছে সাদাফ। অবসর সময়ে ইংলিশ বই পড়ে সে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে সে সেদিকে তাকাল। হঠাৎ এ-সময় কে এল?

সাদাফের বডিগার্ড জাসনুর দরজা খুলে দিল। সেহরিশকে দেখে জাসনূর ভয় পেয়ে দরজা থেকে সরে গেল, কাঁপতে লাগল। সেহরিশের পেছন থেকে মাথা গলিয়ে একগাল হাসি দিয়ে বলল তূর্ণ, 
  'ভয় পেও না। আমিও আছি।'
জাসনুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
  'স্যার বারান্দায় আছেন।'

পায়ের আওয়াজ শুনে সাদাফ সোজা হয়ে বসল। সাদাফ ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের উপরে রাখে, ততক্ষণে সেহরিশ এগিয়ে এল। সেহরিশ তার সামনের চেয়ারে বসল। সেহরিশ সমানভাবে ওর ডান হাত ও বাম হাত নাড়াচাড়া করে গম্ভীর ও শান্ত ভঙ্গিতে বলল, 
  'আমি দুই দিনের জন্য দেশে যেতে চাই।' বলে কিছুক্ষণ থেমে দম নিল এরপর বলল, 
  'দুদিন ধরে আমার শুধু অস্থির লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে মায়ের কাছে ফিরে যাই।' 
একথা বলে সাদাফের দিকে তাকাল সেহরিশ। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে আবারও বলল,
  'বাংলাদেশে যাওয়ার খবর মিডিয়ায় ফাঁস করার দরকার নেই। আমি চুপচাপ যাব এবং ফিরে আসব। মানুষ আমাদের চিনতে পারলে বিমানবন্দরে ভিড় ও উল্লাস হবে। এতে আরও ঝামেলা হবে।'

তূর্ণ সোফায় বসা দুই হাতে গাল চেপে ধরে বলল,
  'এবার দেশে যাওয়ার পর আর বাড়ি যাব না। আমি আমার ফ্ল্যাটে থাকব। আমি এসেছি শোনার পর বাড়ির সামনে মানুষের ভিড় জমে যায় আর আমি বাইরে যেতে পারি না।'

সাদাফের ভ্রু কুঞ্চিত করল। সেহরিশকে বলল,
  'তুই শিওর? সত্যিই দেশে যাবি?'
সেহরিশ ভ্রু কুঞ্চিত করল। বিরক্ত গলায় জবাব দিল,
  'এখন কী লিখে দিবো?'


মাস্ক, ক্যাপ ও চশমা পরা তিন ব্যক্তি বাংলাদেশ বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে বেরিয়ে এল। লাগেজ নিয়ে পেছনে দাঁড়ানো দেহরক্ষী। কিছুক্ষণ পর চারজন লোক এসে সেহরিশের সামনে দাঁড়াল। খুব বিনীত কণ্ঠে বললেন,
  'স্যার, আসুন। গাড়িটা ওদিকে পার্ক করা আছে।'

সেহরিশ গাড়িতে উঠে চলে গেল। সাদাফ একটা করুণ দৃষ্টি ছুড়ে দিল তূর্ণর দিকে। তূর্ণ সশব্দে হেসে উঠল। তারপর বলল,
  'কষ্ট পাসনে ভাই। একা মানুষ গ্রামে গিয়ে কী করবি? আমার সাথেই চল।'

এত বছর পর দেশে এসে এতএত বাড়িঘরের মাঝে নিজের বাড়ি খুঁজে বের করা দুষ্কর। রাস্তার পাশে টং দোকানে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে কয়েকজন। তাদের পাশেই গাড়ি থামাল চালক। ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করল,
  'ও, ভাই শুনুন। দেওয়ান চৌধুরীর বাড়ি যাব। আপনি আমাকে রাস্তাটি একটু বলতে পারবেন?' 

একজন মধ্যবয়সী লোক উঠে এল। তিনি বললেন, 
 'সোজা যান তারপর রাস্তার ডান পাশে দেখতে পাবেন বিশাল প্রাসাদের মতো একটা বাড়ি। ওটা মৃত দেওয়ান চৌধুরীর বাড়ি।'
  'ধন্যবাদ ভাই।' বলল চালক।

সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। রাতের খাবার তৈরি করছেন ফারিয়া বেগম, কাজে সহযোগিতা করছেন বড় ছেলের স্ত্রী মায়মুনা। মায়মুনার নয় বছরের একটি মেয়ে আছে। নাম মারিয়া ভীষণ মিষ্টি দেখতে ও দুষ্টু। সন্ধ্যার পর পর আরুশি মারিয়াকে পড়ানোর জন্য বই নিয়ে বসায়। মারিয়া আজ পড়তে চায় না সে হঠাৎ আরুশির বইয়ের একটি পাতা ছিঁড়ে ফেলল। আরুশি সাথে সাথে মারিয়ার হাত ধরে মায়মুনার কাছে রান্নাঘরে নিয়ে আসলো। রুক্ষ গলায় বলল,
  'ভাবী ওর বিচার করো।'

মায়মুনা ব্যস্ত হাতে আরুশি আর মারিয়ার দিকে একবার তাকাল। মায়মুনা চকিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
  'আবার কী করেছে?'
  'আমার বই ছিঁড়ে ফেলছে।' বলল আরুশি।
ফারিয়া ধমক দিয়ে বললেন,
  'ছোট মানুষ ভুল করে ছিঁড়ে ফেলছে। এত কান্না করার কি আছে? নতুন একটা কিনে নিস।'
আরুশি বলল,
  'মা, তোমার আহ্লাদের কারণেই মেয়েটা দিনদিন বানর হচ্ছে। কাউকে ভয় পায় না।'

কলিংবেলের আওয়াজ শুনে নীলু ওড়নার এককোনায় হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলে দিল। সেহরিশকে দুই চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীলু হঠাৎ জোরে চেঁচিয়ে উঠল। নীলুর চিৎকার শুনে বসার ঘর থেকে আসতে আসতে আরুশি জিজ্ঞেস করল, 
  'নীলু আপা, এভাবে চিৎকার করছ কেন?'

সহসা আরুশি বড় বড় চোখ করে সেহরিশের মুখের দিকে তাকাল। সে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। মারিয়া আরুশির ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ভিডিও কলে সেহরিশকে অনেকবার দেখেছে সে। প্রায় চাচার সাথে কথা হয়েছে, প্রথম দেখাতেই সেহরিশকে চিনতে দ্বিধা হলো না তার। মারিয়া রান্নাঘরের দিকে দৌঁড়ে গেল। উচ্চস্বরে বলতে লাগল,
  'দাদু চাচ্চু আসছে। মা চাচ্চু আসছে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।'

ফারিয়ার বুক কেঁপে ওঠল। তিনি তাত্ক্ষণিক বসার ঘরে ছুটে আসলেন দেখল সেহরিশ দাঁড়িয়ে আছে। ফারিয়া ভাবলেন তিনি বোধহয় স্বপ্ন দেখছেন। পাশে দাঁড়ানো মায়মুনাকে উদ্দেশ্য করে ফারিয়া বললেন, 
  'আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি, বউমা। এক চিমটি দাও তো।'
মায়মুনা হাসল তারপর বলল, 
  'এটা স্বপ্ন নয়, মা, সত্যি। আপনার ছোটো ছেলে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।'

ফারিয়া পায়ে পায়ে হেঁটে সেহরিশের সামনে এসে দাঁড়াল। মায়ের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকাল সেহরিশ। ফারিয়া কাঁপা কাঁপা হাতে সেহরিশের গাল স্পর্শ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন, নিচু স্বরে বললেন,
  'এত বছর পর তোর মায়ের কথা মনে পড়ল বাবা?'
সেহরিশ যে অস্বস্তির কারণে দেশে ছুটে এসেছিল তা মায়ের কোমল স্পর্শ নিমিষ হয়ে গেল। সেহরিশ মা-কে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল। লহু কণ্ঠে বলল, 
  'মা, দেরি হলেও আমি তোমার কাছে ফিরে আসছি।'
.
.
.
চলবে......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন