শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৬৩ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


‘যার কথা মন ভেবে যায়,
        যার ছবি মন এঁকে যায়…
ওহ, যারে হায় এই মনে চায়।
    জীবনে পাব কি তার দেখা?
সহে না যাতনা, তোমারো আশায় বসিয়া…
মানে না কিছুতে— মন আমার, যায় যে কাঁদিয়া…
     পুড়ি আমি আগুনে…
ওহ, ওহ, ওহ।
দিন গেল তোমার পথ চাহিয়া,
     মন পড়ে সখি গো কার লাগিয়া।’

সৈয়দের পুরুষসুলভ কণ্ঠের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে গিটার এর সুর, বন্ধুদের বাহবা। এই ঝুম বৃষ্টিমুখর রাত আর তার কণ্ঠ এবং গিটার সুর— মিলেমিশে একাকার। হাত ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে দশটা উনিশে। বাগানের ফুল গুলো ভিজছে। ভূমির ঘাস গুলো দুলছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটার অস্তিত্ব স্বয়ং যেন এক মোহনিয়া। বাগানবাড়ি, কৃষ্ণচূড়া গাছ, রাতের ঝুম বৃষ্টি, সহস্ররকম ফুলের সাথে গিটার এর সুর; খালি কণ্ঠের গান এবং অনেক গুলো প্রিয় মুখের সঙ্গ, এক অলৌকিক মুহূর্তের আধিপত্য সৃষ্টি করল। শীতল বাতাস গা ছুঁতেই– মানব দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠছে। সৈয়দের বাংলা গানটা গাওয়া শেষ হয়েছে সবেমাত্র। করতালিতে মুখরিত চতুর্দিক। মাহিন গদগদ গলায় বলতে বলতে দাঁড়াল,

‘দোস্ত, এত দারুণ গান শুনালি যে কিছু একটা দিতে আমি বাধ্য। দাঁড়া.. দাঁড়া…’

সবার উদগ্রীব দৃষ্টির সামনে, মানিব্যাগ হাতড়ে আট আনার একটি কয়েন বের করল মাহিন। আলতোভাবে কয়েনটা সৈয়দের বুকপকেটে ভরে দিলো। হেসে শুধাল,

‘পছন্দ হইছে?’ শুধিয়ে থামল না। ফের বলল, ‘এই কয়েনের যুগ আর নেই। কিন্তু তোর বন্ধু যুগযুগ ধরে এই কয়েন হেফাজতে রেখেছিল। আজ তোকে দেয়ার জন্যে। ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করিস না। এতটুকু তুই প্রাপ্য।’

সৈয়দের ভোঁতা মুখের সামনে রিয়ানও মানিব্যাগ খুঁজে খুঁজে দিগভ্রান্ত। অনেক খোঁজার পর, একটি এক টাকার কয়েন সে পেয়েছে। পিতলের কয়েনটি হাতে নিয়ে উচ্ছ্বাসিত বদনে সৈয়দের হাতে ধরিয়ে বলল, 

‘বড়ো হ। সিঙ্গার হ। অনেক ছেলে-মেয়ে তোর পিছু ঘুরুক। ফুঁউ..ফুঁউউউ।’

 রুস্তমের মানিব্যাগ থেকে বেরোল দু'টাকার নোট। দোয়েল পাখির ছবি থাকা পুরাতন দু'টাকার নোট দেখে কয়েক দফায় হৈ-হুল্লোড় হলো। রুস্তম এগিয়ে গিয়ে সৈয়দের মুখে ফুঁ দিয়ে বলল,

‘একটি সুন্দ্রি রমণী দ্রুত তোর লাইফে এন্ট্রি নেক। এসে তোকে দ্রুত ছ্যাঁকা দেক। ফুঁ..।’

সৈয়দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘তুই চাচ্ছিস প্রেম না করেই ছ্যাঁকা খাই?’
‘হ্যাঁ। তুই বসে বসে কাঁদবি। আমরা তোর চোখের জল, নাকের জল —গাছের পাতা দিয়ে মুছব।’

বলেই মাহিন মাথা ঘোরাল, ‘কীরে তন্ময়…তুই দিচ্ছিস না কেন? তাড়াতাড়ি একটি চার আনার কয়েন বের কর। তোর দোয়া অনেক ইম্পরট্যান্ট।’

তন্ময় নির্বিকার কণ্ঠে জানাল, ‘খুচরো নেই। আজকে মাফ করুন।’

হাসির তাণ্ডব পড়ল মুহূর্তেই। এবারে ইব্রাহিমের কার্যকলাপ অসহায় চোখে দেখে চলেছে সৈয়দ। বন্ধুদের কার্যকলাপ শেষ হতে না হতেই, শুহানি, এলিজা এবং ঐশীও পাঁচ টাকার নোট বের করে বসে। এতে তীব্র অসহায় হয়,

‘তোরাও? এই মাহিন, রিয়ান, রুস্তম —ইব্রাহিম ওরা নাহয় সাতবেলায় চারবার করে গাঁজা খায়। তোরাও কি খাস?’

শুহানি চোখ রাঙাল। টাকাটা হতে ধরিয়ে বলল, ‘ধর। গাঁজার ব্যবসা ছেড়ে সেলেব্রিটি হ। তোর কণ্ঠ যা সুন্দর। নিশ্চিত সুপারডুবার হিট খাবি।’

মাহিন দাঁড়িয়ে সবগুলো মুখপানে নজর বুলাল। থামল অরুর দিকে। অরু গুটিশুটি মেরে বসে তন্ময়ের সুবিশাল শরীরের পাশেই। দুজনকে পাশাপাশি চমৎকার লাগছে দেখতে। দুষ্টু হাসল মাহিন। ভ্রু তুলে–বাঁকাল হেসে ডাকল,

‘অরু! তোমার টিপস কই? সৈয়দ কিন্তু কেঁদে দিবে। এত সুন্দর গান শোনাল বেচারা। আর তুমি কিচ্ছুটি দিবে না?’

অরু চমকাল। থমকাল। কাঠকাঠ হলো শরীর। অনুভব করল পেটের কাছে থাকা পুরুষোচিত রুক্ষ হাতটা সরে গেছে। আটকে রাখা রুদ্ধ শ্বাসটুকু ফেলল এযাত্রায়। তন্ময় একরোখা, বেধড়ক বেয়ারা দৃষ্টিতে চেয়েই ছিল। অরু আড়চোখে পাশে চাইতেই চোখাচোখি হলো। অরু তাড়াহুড়ো গতিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মাহিনের দিকে চেয়ে মিনমিনে গলায় জানাল,

‘আমি তো ব্যাগ আনিনি, ভাইয়া। রুমে আছে। নিয়ে আসি?’

মাহিন ঠোঁট কামড়ে হাসল, ‘আরেহ কী যে বলো না! তোমার হাজবেন্ড… শাহজাহান কোম্পানির উত্তরাধিকার তো পাশেই বসে। তার মানিব্যাগ থেকে দাও। তার যা, সবই তো তোমার।’

ঠোঁটের কোণে ভীড় জমাতে চাওয়া হাসিটুকু, তন্ময় গিলে নিলো সযত্নে। মনের গোপন ঘরে অগুনিত ফুল ফুটল। আপ্লুত হলো হৃদয়। হাজবেন্ড সম্বোধনটুকু তার পছন্দ হয়েছে। তোলপাড় তুলেছে পিঞ্জরে। অনুভব করতে পারল, পাশেই অরু হাঁসফাঁস করছে। কী জবাব দেবে বা কি করবে হয়তোবা বুঝেই পাচ্ছে না! এবারে শুহানিও ঠোঁট টিপে হেসে তাড়া লাগাল,

‘এই অরু, মানিব্যাগটা বের করো।’ 

সৈয়দ নিজেও তালে তাল মেলাল সুস্পষ্ট কণ্ঠে, ‘অপেক্ষা করছি কিন্তু!’

অবশেষে অরু পাশে ফিরে চাইল। তন্ময়ও ভ্রু তুলে তাকাল। দৃষ্টিতে দৃষ্টির মিলন ঘটল যেমনটা বৃষ্টির সঙ্গে ভূমির হয়ে থাকে। তন্ময় নির্নিমেষ চোখে দেখল.. সুশ্রী মুখ, কুচকুচে কালো খোলা লম্বা চুল, লিপস্টিক দেয়া ভরাট ঠোঁট; তিরতির করে কম্পমান লাজুক চোখ দুটো। শুভ্র রঙা জর্জেটের শাড়ি, যা মলিন; ফরসা গতরে লেপ্টে আছে। তার গভীর চোখে চেয়ে অরু চুপসে যায়। দৃষ্টি নামায়। ভাবুক স্বরে জানায়, 

‘টাকা চাচ্ছে। আমি তো ব্যাগ আনিনি।’

বুকের মধ্যে হয়ে যাওয়া ঝোড়ো তাণ্ডব সামাল দিয়ে, তন্ময় বোঝবার ন্যায় মাথা দোলায়, ‘হুঁ? তো?’
‘আপনার থেকে দিতে বলছে।’ 

তন্ময় দৃঢ় চোখে চেয়ে থেকে, সাবলীলভাবে শুধায়, ‘তুই দিতে চাচ্ছিস?’

অরু মাথা দোলাল দু'বার, ’হুঁ।’
‘তাহলে দে।’
‘মানিব্যাগ?’ অরুর সরল প্রশ্ন।
‘পেছন পকেটে।’ 

অরু আড়চোখে দেখল —সবাই আগুন চোখে এদিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসছে। তাদের উচ্ছ্বাসিত দৃষ্টির সামনে অরু কুণ্ঠিত। লজ্জায় লাল হয়ে আসা মুখ লুকোতে যেন মাটির নিচে ঢোকা অতি প্রয়োজন তার। কোনোরকমে দৃষ্টি নুইয়ে হাত বাড়াল। তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে মানিব্যাগটা বের করল। মানিব্যাগ হাতের অরুকে আরও শোচনীয় দেখাল। ওর হাপিত্যেশ করা মুখের দুর্দশা দেখে তন্ময় চুপ থাকতে পারল না। মাথা ঝুঁকিয়ে নরম গলায় শুধাল,

‘কী?’
‘কত দেব?’ অরুর ফিসফিস কণ্ঠের চাপা প্রশ্নটি শুনে তন্ময় নিঃশব্দে হাসল। রিয়ান উচ্চকণ্ঠে আদেশ ছুঁড়ল,

‘অরু, তুমি সবচেয়ে ছোটো নোটটা বের করো।’ 

সৈয়দ প্রতিবাদ করে উঠল, ‘কীসের ছোটো নোট? বড়ো নোটের দুটো দাও।’

অরু দিগভ্রান্ত চোখে রিয়ান এবং সৈয়দকে দেখল। দোটানায় ডুবো জল খেয়ে সে আলগোছে মানিব্যাগটা টেবিলে রাখল। ঠেলে এগিয়ে দিলো সৈয়দের দিক। বিড়বিড় করে বলল,

‘ভাইয়া, আপনি নিন।’

অট্টোহাসির রোল পড়ল ক্রমান্বয়ে কিছু। সরল অরুকে জব্দ করতে যেন ভীষণ মজা। তন্ময় হাসল না। আড়ালে বন্ধুদের কঠিনভাবে চোখ রাঙাল। মাহিন মানিব্যাগ তুলে নিলো উৎসুকভাবে। মুহূর্তেই হাজার টাকার নোট গুলো সবার মধ্যে ভাগাভাগি করে বিলিয়ে দিলো। ফাঁকা মানিব্যাগ তন্ময়ের দিকে ছুঁড়ে চোখ টিপল,

‘যেই সারপ্রাইজ দিচ্ছি আজ তোকে, সেই সুবাদে এতটুকু তো আমরা নিতেই পারি।’

তন্ময় প্রত্যুত্তর করল না। মানিব্যাগটা পকেটে ভরে রাখল। সবাই পুনরায় গানের আসরে মশগুল হয়ে পড়ল। এবারে ইব্রাহিম গাইছে। হাবিব ওয়াহিদের গান। গিটার বাজাচ্ছে সৈয়দ। অরুর নীরব দৃষ্টি গেল অদূরেই। টেবিলের ওপরপ্রান্তে দুটো বোতল। ভেতরে লাল পানিদ্রব্য। নিভু-নিভু চোখে কিয়ৎক্ষণ বোতল দুটো দেখল। তন্ময় ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করেছে। অপেক্ষা করছে প্রশ্নবাণের। মিনিটখানেকের মধ্যেই অরু চাপাস্বরে শুধাল,

‘ওগুলোতে কী?’
তন্ময়ের নির্লিপ্তি জবাব, ‘অ্যালকোহল।’

অরু আশ্চর্য হয়ে বসে, ‘আপনি খাবেন, তন্ময় ভাই?’

তন্ময় মাথা ঘোরায়। কয়েক পলক চেয়ে অসন্তোষ গলায় জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে, ‘শেষে তন্ময় ভাই লাগানো কি জরুরি?’

অরু হকচকিয়ে উঠল। ঘনঘন পলক ফেলল। কয়েকবার কথা বলতে নিয়ে থামল। থতমত খাওয়া কণ্ঠে সময় নিয়ে জবাবে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে কী বলে ডাকব?’

তন্ময় নিগূঢ়ভাবে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রয়। মাথা ঝুঁকিয়ে, কণ্ঠ খাদে নামিয়ে আকস্মিক বসে ওঠে, ‘জামাই।’

অরুর স্তম্ভিত শরীর এবারে বরফের মতন ঠান্ডা হয়ে আসে। শ্বাসপ্রশ্বাসও যেন বন্ধ। তন্ময় হাসল ওর এমন শোচনীয় দুর্দশায়। ইতোমধ্যে গানবাজনার পর্ব শেষ। বৃষ্টিও ঝুমঝুম করে নেমে চলেছে বিরতিহীন। রাতের বারোটা বাজতে চলল। মাহিন তাড়ানো ভঙ্গিতে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলল,

‘এবার তোরা বিদেয় নে। যা ভাগ।’

শুহানি ভেংচি কাটল। এগিয়ে এসে অরুকে তন্ময়ের পাশ থেকে উঠিয়ে নিলো, ‘চলো অরু। আমরা গল্প করব।’

 তন্ময়ের ডান হাতটা তখনো অরুর চেয়ারে। দৃষ্টি শুভ্রত্বে মোড়ানো অরুতেই। বাতাসে দুলতে থাকা আঁচল, হাঁটার তালে নড়তে থাকা কুঁচি–সবই যেন নিখুঁত কিছু। অরু যেতে নিয়েও দু'বার ফিরে-ফিরে তাকাল। তন্ময় অবলীলায় দেখল পূর্ণ দৃষ্টিতে। যেতে নিয়ে সামান্য ভিজল। সুদূর আকাশ থেকে নামা বৃষ্টিও যেন তার থেকে ভাগ্যবান। দুয়ার পেরিয়ে অরুর দেহ অদৃশ্য হলেও তন্ময়ের দৃষ্টি সরে না। মাহিন গম্ভীর কণ্ঠে হাসছে,

‘মামা, তোর তো শোচনীয় অবস্থা। ইশ! শ্বাস নিতে পারতেছস তো?’

তন্ময় এবেলায় দৃষ্টি ফেলে বন্ধুর মুখপানে, ‘অক্সিজেন মাস্ক আনা।’ কথাটুকু বলে নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ধরায়। রিয়ান পাশেই এসে বসেছে। হেসে বলল, ‘তোর অক্সিজেন মাস্ক তো ঘরে।’

বোতল দুটো ইতোমধ্যে খুলেছে রুস্তম। সিগারেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে তন্ময় জানাল, সে ড্রিংক করবে না। তবে না শোনার মতন বন্ধু তার নয়। সবগুলো কথার মারপ্যাঁচে, কাণ্ডকারখানার প্যাঁচে ফেলে খাইয়ে ছাড়ল। দুটো বোতল ফাঁকা হতে ঘণ্টাখানেকেরও প্রয়োজন হলো না। 
অথচ তন্ময়ের মস্তিষ্ক স্বচ্ছ। নেশার মতন কিচ্ছুটি নেই। তবুও কেন এক অদ্ভুত নেশা লেগে আছে তার মধ্যে?

———

রাত দুটো তিন। বৃষ্টির মাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। পূর্বে ঝোড়ো হাওয়ার লক্ষণ ছিল না। তবে এখন তাণ্ডবকর ঝোড়ো, অশালীন বাতাসের উৎপত্তি ঘটেছে। নিগূঢ় রাতকে করে তুলেছে অশুভংকর। ইতোমধ্যে মাহিন, রিয়ান ওরা দলবেঁধে নিজেদের ঘরে ঢুকে দুয়ার আটকে দিয়েছে। তন্ময়কে ঢুকতে না দেবার পঁয়তারা। আজ অবশ্য তন্ময় ওদের সাথে থাকতে চাচ্ছিল। আড্ডা দিয়ে কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে দেবার চিন্তাভাবনা ছিল। তার নিজের ওপর এক পার্সেন্ট ভরসা আপাতত নেই। মাথাটাও চিলিক দিয়ে উঠছে। দেহের সর্বাঙ্গ অদৃশ্য উত্তেজনার উত্তাপে ঝলসে যাচ্ছে। বিশেষ করে দেহের অন্দরে। সামনের চিত্র সব পরিষ্কার দেখাচ্ছে। তবুও কেন ঘোলাটে? সে ত ওসব ড্রিংক দু ঢোকের বেশি খায়নি। ভেতরে এক অকথিত সর্বনাশা চাহিদারা ওঁৎ পেতে রয়েছে। বিদ্রোহ করছে। আশকারা চাচ্ছে। তন্ময় পা বাড়াল তাদের রুমের দিক। দরজা আটকানো। অরু এখনো ফেরেনি। তন্ময় দরজা খুলে প্রবেশ করল। নাকে ভেসে এলো সহস্র ফুলের সুভাস। বাতি জ্বালাল। ঘরের সম্পূর্ণ আদল পরিবর্তন করা হয়েছে। বিছানাটা যেন ছোটোখাটো ফুলের বাগান। মেঝেটা সাজানো হয়েছে অজস্র ফুলের পাপড়ি দ্বারা। রেড লাভ ক্যান্ডল রাখা কোণায়-কোণায়। তন্ময় চোখ বুজল। বাতি নেভাল। দরজা আটকাল। আঁধারেই হেঁটে এসে বসল চেয়ারে। ঠিক জানালার সামনে। দু'হাতের ভেতরে মুখ গুঁজে রাখল। বিড়বিড়িয়ে ওঠল নিজমনে,

‘ফিরিস না, প্লিজ।’

তন্ময়ের আকুতি যেন স্রোতে গা ভাসিয়ে পালাল। কারণ তার উক্তি জাহির হতে না হতেই দরজা খোলার মৃদু ধ্বনি শোনা গেল। ধুকপুক করে উঠল তন্ময়ের পিঞ্জর। কেঁপে উঠল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। মাথা তুলে চাইল। আঁধারে আবছায়াতে জড়ানো অরু ধীরেসুস্থে ভেতরে প্রবেশ করছে। ওর পরনের সাদা শাড়ি দৃশ্যমান। ওর শ্রুতিমধুর কণ্ঠ বিড়বিড় করল,

 ‘সুইচবোর্ড কোথায়?’

তন্ময় কিয়ৎক্ষণ ওর ব্যস্ত দেহ দেখল। অতি প্রচেষ্টায়ও সুইচবোর্ড খুঁজে না পাওয়া অরু তখন দিশেহারা। তন্ময় এযাত্রায় উঠে দাঁড়াল। এগুলো নিঃশব্দে। অরু তখনো দেয়াল হাতড়ে চলেছে। তন্ময় নীরবে, নিভৃতে পেছনে দাঁড়াল। অস্পষ্ট দেখল অরুর ফরসা মসৃণ পিঠ। মুখ বাড়িয়ে ততক্ষণাৎ ঠোঁট ছোঁয়াল। অরুর দেহ লাফিয়ে ওঠার পূর্বেই তন্ময় ওর কোমর দু'হাতে পেঁচিয়ে নিলো। নিজের বুকে জাপ্টে ধরল সেভাবেই। অরু চিৎকার করতে গিয়েও করল না। যেন বুঝে নিয়েছে পেছনে কে!
কম্পিত কণ্ঠে মৃদু স্বরে ডাকে,

‘তন্ময় ভাই?’

তন্ময় মাথা ঝুঁকাল। অরুর কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁয়ে অস্পষ্ট স্বরে আওয়াজ করল, ‘মমম…’ আওয়াজটুকু করতে নিতেই হাত দুটো শাড়ি ভেদ করে পেট ছুঁতে উদগ্রীব, ব্যাকুল নিজের সম্পত্তি বুঝে নিতে, ছুঁয়ে দিতে। থরথর করে কেঁপে ওঠা ছোটোখাটো দেহখানা তার থেকে পালাতে মরিয়া। তবে তন্ময় আজ আর পালাতে দেবে না। সম্ভব না তার পক্ষে। অরুর তোতলানো ভয়ার্ত কণ্ঠ,

‘সুইচবোর্ড পাচ্ছি না।’

তন্ময় সময় নিয়ে জবাব দিলো, ‘উই ডোন্ট নিড দ্যাট।’ বলতে বলতেই ঘোরাল বুকের মধ্যিখানে থাকা অরুর শরীর। নিজের সঙ্গে লেপ্টে নিলো মুখোমুখি। অরু আঁতকে ওঠে,

‘ত..তন্ময় ভাই…’ বাক্যের বাকিটুকু কথা অব্যক্ত রয়। দেহের সংস্পর্শে দেহ, ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁতেই যেন পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটে। আবহাওয়া, বায়ুমণ্ডল পরিবর্তন। সবকিছুই যেন নতুন, ভিন্ন, অদেখা এবং অব্যক্তিত। অরুর মুষড়ে ওঠা শরীর ছাড়া পেতে অধৈর্য। পিছুতে চাইলে তন্ময় পিছুতে দেয়। তবে ছাড়ে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে অরুর পিছুবার সুযোগটুকুও ফুরিয়ে আসে। মাথা ঘুরিয়ে নিতেই তন্ময়ের ঠোঁট ঘাড় ছুঁয়ে দেয়। অরুর অস্পষ্ট স্বরের গোঙানো শোনা গেল নীরব রুমজুড়ে,

‘বিশ্রী টে…গন্ধ…আপনি কী খেয়েছেন?’

আঁধারে তন্ময় গম্ভীরমুখে হাসে, ‘গন্ধ? নাকি টেস্ট, হুঁ? আরেকবার টেস্ট করে গেস কর কী!’

অরু সঙ্গে-সঙ্গে উতলা হলো, ‘আ.. আমি জানতে চাই ন… ’ কথাটুকুর পূর্ণতা মিলল না। এনেস্থিসিয়ার মতন কাজটা তন্ময় ফের করে বসল। এবারে অধৈর্য হয়ে অরুকে পাঁজাকোলে তুলে ফেলল। বেশ কিছু পদক্ষেপ ফেলে বিছানায় এলো। অরুর পিঠ ফুলের ওপর স্পর্শ করল। শিউরে উঠল তার নাজুক শরীর।
পরপরই তন্ময়ের সুঠাম, ভারী শরীরও সংস্পর্শে চলে এলো। অরু এযাত্রায় তীব্রভাবে অস্থির হলো। এই অসহনীয় অনুভূতি থেকে পালাতে চাইল। তন্ময় ওর অস্থিরত্ব হাত দুটোতে নিজের পাঁচ আঙুল ঢুকিয়ে মুঠোভরতি করে ফেলল। অধৈর্য গলায় আদেশ ছুঁড়ল,

‘স্টপ মুভিং।’

অরু যেন শুনল না। আকুতি করল বাতি জ্বালাতে। সরে যেতে উতলা। তন্ময় ওর অধৈর্য কর্মকাণ্ড, নড়েচড়ে ওঠা শরীরে এবার শক্তিপ্রয়গ করল। জাপ্টে বন্দি করল নিজের মধ্যে। হিসহিস করে চাপাস্বরে আওড়াল,
‘নড়ে না, জান।’ অরুর নড়চড় তো বন্ধ হলোই সাথে শিথিল হলো সর্বাঙ্গ। ফানুশের মতন নরম হয়ে এলো। তন্ময় ঠিক বুঝতে পারল প্রিয়তমার আশ্চর্যতা। সন্তুষ্ট হলো বড্ড। ওর মাথায় চুমু বসিয়ে গভীর স্বরে বলল, ‘আমার সোনা বউ।’

অরু এবারে অস্পষ্ট কণ্ঠে আঁতকে ওঠে। তার কণ্ঠজুড়ে অবিশ্বাস্যতা, 
‘আ..আপনি ত–তন্ময় ভাই হতেই পারেন না।’

তন্ময় আলতোভাবে কামড় বসাল অরুর ব্যস্ত ঠোঁটে, ‘ঠিক বলেছ। আমি তন্ময় ভাই নই। তোমার জামাই।’
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন