রোদেলা কাঁচামাল ভর্তি ব্যাগ নিয়ে জুবিয়ার সঙ্গে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। একটা রিকশা ও নেই। রোদেলা জুবিয়ার পাশে ধীরেধীরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
'এই সন্ধ্যায় বাজারে আসার কী দরকার ছিল? এখন ব্যাগ ভর্তি বাজার-সাদী নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি।'
জুবিয়া বিস্মিত গলায় বলল,
'সব সময় কি দেরি হয়? আজ একটু না হয় দেরি হয়েছে।'
রোদেলা অসহায় গলায় বলল,
'তুই দুটো ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে খালি হাঁটছিস। একটা তো নিতে পারিস। আমার হাত ব্যথা করছে।'
জুবিয়া ভ্রু কুঞ্চিত করল বলল,
'তাড়াতাড়ি চল আর একটু এগিয়ে গেলেই রিকশা পাব।'
এ-সময় হঠাৎ রাকিব জুবিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সাত দিন আগে রাকিবের সঙ্গে জুবিয়ার ব্রেকআপ হয়েছে। জুবিয়াকে রাস্তায় দেখে ছুটে আসলো রাকিব। রাকিব দুই বছর জুবিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে থেকে গোপনে আরও একটা সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল। জুবিয়া সত্যটা জানার পর রাকিবের সঙ্গে ব্রেকআপ করে নেয়। আচমকা রাকিবকে দেখে জুবিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার। পাশ দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে রাকিব জুবিয়ার হাত ধরে বিনতি করতে লাগল। রাকিব বারবার ক্ষমা চাচ্ছে সে এই ভুল আর করবে না। জুবিয়া ব্রেকআপ করেছে কেন? এটা কেউ জানে না, রোদেলা জোর করে জুবিয়াকে রাকিবের সাথে আলাদা করে কথা বলতে পাঠায়। আর রাস্তার পাশের আমগাছের দিকে ইশারা করে বলে সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তার ফেরার অপেক্ষা করবে।
বাজারের ব্যাগগুলো খুব ভারী, মাটিতে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল রোদেলা। সময় কাটানোর জন্য গাছের নিচে হাঁটতে লাগল। আচমকা বৃষ্টি আসার সাথে সাথে রোদেলা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে গেল। অন্ধকারে কোথায় যাবে? বুঝতে পারছে না। এই জায়গা তেমন চিনে ও না।
কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় গেল ওরা। চেয়ারে বসে জুবিয়া পা নাড়াচ্ছে। সামনের চেয়ারে বসে রাকিব নরম গলায় বলল,
'মানুষ অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে, শব্দ করো না।'
জুবিয়া তাড়াতাড়ি চেয়ার সরিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর বিরক্ত গলায় বলল,
'আমি রোদেলাকে একা রাস্তায় রেখে আসছি। ওহ এখানে নতুন, হারিয়ে যেতে পারে আমাকে এখন যেতে হবে। ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে।'
রাকিব চেয়ার থেকে উঠে জুবিয়ার সামনে দাঁড়ায়। সে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
'জুবিয়া কত বছরের সম্পর্ক আমাদের তুমি আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিতে পারো না। একটা শেষ সুযোগ দাও।'
জুবিয়ার চোখ ছোটো ছোটো করল কড়া গলায় বলল,
'আমার জীবনে তোমার কোনো জায়গা নেই। দুই বছরের সম্পর্ক, অথচ তুমি আমাকে চিট করেছ। তুমি আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অন্য মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতে। কোন সাহসে তুমি আরেকটি সুযোগ চাও? শোন, আমাকে আর বিরক্ত করবে না। তুমি যদি আমাকে আবার বিরক্ত করো আমি ভুলে যাবো যে আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসতাম তখন আমি তোমার বিরুদ্ধে থানায় রিপোর্ট করব।'
জুবিয়া তড়িঘড়ি করে টেবিল থেকে পার্স নিয়ে চলে গেল। রেস্তোরাঁ থেকে বের হতে জুবিয়া হতবাক হয়ে গেল। রাস্তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা কাঁদাপানিতে ভরা। জুবিয়া রেস্তোরাঁর ভেতরে থাকার জন্য বুঝতেই পারেনি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ রোদেলার কথাটা জুবিয়ার মনে এল। জুবিয়া হাতের ব্যাগটা নিয়ে ছাতার মতো মাথায় চেপে ধরে তারপর বৃষ্টির মধ্যে দৌড়াতে লাগল।
রাস্তার কাঁদা পানি জুতা দিয়ে ছিটকে জামা কাপড়ে পড়ছে। জুবিয়ার নিজের ওপর রাগ লাগতে লাগল। কিভাবে সে এতটা কেয়ারলেস হতে পারে? জুবিয়া আমগাছের নিচে এসে থামাল। রোদেলাকে দেখতে পায় হঠাৎ হতভম্ব গলায় জুবিয়া জিজ্ঞেস করল,
'তুই ছাতা কোথায় পেলি?'
জুবিয়া এগোল। রোদেলার সঙ্গে একই ছাতার নিচে এসে দাঁড়াল। রোদেলা মুচকি হেসে বলল,
'আমি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিলাম দেখে একজন ভাল মানুষ আমাকে সাহায্য করেছে।'
জুবিয়া রোদেলার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে। পরমুহূর্তে সে নিচু গলায় বলল,
'আই এম স্যরি রোদু। আমি তোকে একা রেখে গেছি বলেই তোর বৃষ্টিতে ভিজতে হলো। আমার তখন রাকিবের সঙ্গে যাওয়া উচিত হয়নি।'
চোখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে রোদেলা তার ভারী চোখের পাতা নেড়ে বলল,
'রাকিব ভাইয়ার সঙ্গে সব কিছু ঠিক হয়েছে?'
জুবিয়া শক্ত গলায় বলল,
'আমি তাকে কখনো ক্ষমা করব না।'
রোদেলা ক্ষীণ সময় চুপ থাকল। তারপর বলল,
'আজ রাতে কিন্তু আমি রান্না করব। তুই আমাকে সাহায্য করবি ঠিক আছে?'
জুবিয়া মাথা নেড়ে বলল,
'ওকে।'
❐
সকাল আটটা বাজে। উমাইয়া নার্সারিতে এসে ফুল ও ফলের চারাগাছে পানি দিতে লাগল। হঠাৎ সাদা টি-শার্ট পরা একজন লোককে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল গতকাল সকালে যে লোকটি এসেছিল তিনি আজ আবার আসছেন। উমাইয়া বিস্মিত কণ্ঠে শুধল,
'আপনি আবার?'
সাদাফ উমাইয়াকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,
'আবারও দেখা হলো।'
সাদাফ উমাইয়ার সঙ্গে গাছপালা নিয়ে কথা বলতে লাগল। উমাইয়া হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, যেটা জানে না সেটা সরাসরি বলে দিচ্ছে সে জানে না। সাদাফ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। উমাইয়ার পাশাপাশি হাঁটতে তার অস্বস্তি লাগছে। সাদাফ হঠাৎ থেমে গেল। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। সাদাফ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার উমাইয়া কে দেখল তারপর ঠোঁট মিলিয়ে হাসল। সাদাফ বিড়বিড় করে বলল,
'আমি কি মিস উমাইয়ার প্রেমে পড়েছি?' সাদাফ সাথে সাথে মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। অস্ফুটস্বরে বলল,
'একদিনের দেখায় ভালোবাসা?'
উমাইয়ার বাবা সিরাজগঞ্জ থেকে আজ গাজীপুরে আসবেন। উমাইয়া হাতের কাজটুকু শেষ করে মুজিব মিয়ার থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে নার্সারী থেকে বের হলো। সাদাফ ওর দুই হাত পিছনে নিয়ে মুঠি বদ্ধ করে উমাইয়ার পাশাপাশি হাঁটছে।
সাদাফ হুট করে জিজ্ঞেস করল,
'এই জায়গা থেকে আপনার বাড়ি কত দূরে?'
উমাইয়া বলল,
'তিন কিলোমিটার।'
'আপনি প্রতিদিন এভাবে হেঁটে বাড়ি ফিরেন, উমা?'
সাদাফের মুখে উমা ডাক শুনে উমাইয়া বিষণ্ণ চোখে সাদাফের দিকে তাকাল। অকপটে বলল,
'জি। তাছাড়া আজ আপনি কোনো গাছ নেননি তাহলে নার্সারীতে এসেছেন কেন?'
সাদাফ হাঁটতে হাঁটতে কোমল কণ্ঠে বলল,
'আমি চারা নিতে আসিনি। আপনার সাথে কথা বলার জন্য এত দূর এসেছি।'
উমাইয়া অবাক চোখে তাকাল। সাদাফ হাসল। উমাইয়ার দৃষ্টি একটা গাড়ির উপর পড়ল। উমাইয়া সন্দেহের দৃষ্টিতে গাড়ির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
'দেখুন, গাড়িটি অনেকক্ষণ ধরে আমাদের ফলো করছে। আমার সন্দেহ লাগছে, এক মিনিট আমি পুলিশকে কল করে ইনফর্ম করি।'
সাদাফ পকেটে হাত রেখে একবার পেছনে তাকিয়ে গাড়িটা দেখল তারপর উমাইয়াকে বলল,
'পুলিশকে জানানোর দরকার নেই। ওই গাড়ি আমার তাই ড্রাইভার আমাদের ফলো করছে।'
উমাইয়া বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল,
'গাড়ি রেখে আমার সাথে ফুটপাতে হাঁটছেন কেন?'
জবাবে সাদাফ মুচকি হাসল।
❐
তূর্ণর ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। একটা ঢিলেঢালা টি-শার্ট পরনে টলতে টলতে ড্রয়িংরুমে এলো। ঘড়িতে প্রায় এগারোটা বাজে। সাদাফ ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে ড্রয়িংরুমের মাঝখানে রাখে। তূর্ণ চমকে ওঠল। সাদাফের রুম থেকে খসখসে আওয়াজ আসছে শুনে তূর্ণ রুমের দিকে এগিয়ে গেল। তূর্ণ জিজ্ঞেস করল,
'তুই ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?'
সাদাফ তূর্ণর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
'মেঘনা সিটি।'
তূর্ণ ভ্রু কুঞ্চিত করল।
'সেহরিশ রাজি হলো কিভাবে?'
সাদাফ ফুলের চারাগুলো একসাথে রেখে তূর্ণর মুখের দিকে তাকাল। সাদাফ শুধাল,
'সেহরিশ রাজি হবে কিসের জন্য?'
'তোকে তার বাড়িতে থাকতে দিতে রাজি হয়েছে। কীভাবে?'
সাদাফ সপটচস্ত জবাব দিল,
'আমি সেহরিশের বাড়ি যাচ্ছি না।'
তূর্ণ অবাক হয়ে বলল,
'তোর তো ওখানে কোনো বাড়ি বা এপার্টমেন্ট নেই। তাহলে মেঘনা সিটিতে কোথায় যাচ্ছিস?'
সাদাফ তূর্ণর দিকে তাকিয়ে নরম বলল,
'মেঘনা সিটিতে আজ সকালে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। সেখানেই যাচ্ছি। এখন তোর ফ্ল্যাট তোরই থাকল। তোর ইচ্ছা মতো যে রুমে ইচ্ছা থাকতে পারিস।'
তূর্ণ এগিয়ে এলো। সাদাফকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আহত স্বরে বলল,
'আমি তো একবারও তোকে যেতে বলিনি। তাহলে যাচ্ছিস কেন?'
সাদাফ চশমাটা ঠিক করে বলল,
'জানি না। ওখানে যেতে মন চাচ্ছে।'
তূর্ণ বিরক্ত গলায় বলল,
'তুই ফ্ল্যাট কোথায় কিনছিস?'
সাদাফ অন্য কাজ করতে করতে বলল,
'আমি আগে যাই। সব কিছু গোছগাছ করার পর তোকে এড্রেস সেন্ট করে দেব।'
তূর্ণ হঠাৎ সাদাফের এক হাতে ধরে বলল,
'তুই চলে গেলে আমার জন্য রান্না করবে কে?'
সাদাফ কিছুটা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
'কী বললি?'
❐
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে; সূর্যের আলো জ্বলমল করছে। চৈত্রের ভ্যাপসা গরম। বাড়ির আশপাশের গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। কোথাও বাতাস নেই। গরমে ক্লান্ত, বিরক্ত উমাইয়া সদর দরজা খুলতে চমকে উঠল। ওর ফ্ল্যাটের সামনের ফ্ল্যাটটি বাড়িওয়ালা তার ছেলের জন্য সংরক্ষিত করে রেখেছেন। হুট করে আজ ওই ফ্ল্যাটের দরজা কে খুলেছে? উমাইয়া সিঁড়িতে একাধিক পায়ের শব্দ শুনে সেদিকে তাকাল।
চার-পাঁচজন লোক ভারী আসবাবপত্র নিয়ে উপরে উঠে আসছে। আর তিনজন লোক ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দ্রুত সে জিনিসপত্র ফ্ল্যাটের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের মধ্যে একজন হঠাৎ বলে ওঠে,
'কই জানি শুনছিলাম, টাকা থাকলে না-কি মানুষ ঢালার জায়গা পায় না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে এই ছোট ফ্ল্যাট যে কিনছে সে পাগল ছাড়া আর কী? এর চেয়ে ভালো ফ্ল্যাট আর কত আছে, সেগুলো চোখে দেখে নাই। লোকটা পাগল নিশ্চিত।'
উমাইয়া অবাক হলো। বাড়িওয়ালা এই ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে কখনো রাজি হয়নি। আর আজ কিনা বিক্রি করে দিয়েছে? কথাটা হজম হলো না উমাইয়ার। দরজা বন্ধ করে দৌড়ে রুমে গেল। জুবিয়ার উদ্দেশ্য দৃঢ়ভাবে বলল,
'আমাদের সামনের ফ্ল্যাট কেউ কিনেছে। আজ মাল নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকছে। তুই কি এই বিষয়ে কিছু জানিস?'
জুবিয়া ভ্রু তুলে নিচু গলায় বলল,
'কি? কে ওই ফ্ল্যাট কিনেছে?'
উমাইয়া জুবিয়ার দিকে ফিরে বসল। চোখে-মুখে অন্যরকম রহস্য নিয়ে বলল,
'একজন ভদ্রলোক। শুনলাম সে আবার পাগল। টাকা ঢালার জায়গা না পেয়ে বাড়িওয়ালার ওই ফ্ল্যাট কিনেছেন।'
জুবিয়া গালে হাত দিয়ে বসে রইল। হঠাৎ বলল,
'তোকে এসব উল্টাপাল্টা কথা কে বলেছে?'
উমাইয়া সরু চোখে জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল,
'কর্মচারীরা বলাবলি করছে।'
বারান্দায় বাঁধা দড়িতে রোদেলা ভেজা কাপড় মেললো। মাথা থেকে তোয়ালে খুলে ভেজা চুল হালকা ঝেরে তারপর খালি বালতি নিয়ে রুমে এলো রোদেলা। জুবিয়া ও উমাইয়াকে একসাথে বসে থাকতে দেখে সে মৃদু গলায় বলল,
'এখনো এভাবে বসে আছিস কেন? যা তাড়াতাড়ি গোসল কর দেরি হয়ে যাচ্ছে, লাঞ্চ কখন করবি?'
উমাইয়া উঠে দাঁড়াল। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
'যতই বলিস কোনো লাভ হবে না। ও সেই সন্ধ্যার পরেই গোসল করতে যাবে।'
.
.
.
চলবে....................................