!!১০!!
আশফিক খাওয়ার মাঝে হাসিমুখে কথা বলল কুহুর সঙ্গে।খুব প্রশংসা করল।অল্পতেই মিশে যাওয়ার মতো দারুণ ক্ষমতা আছে কুহুর।কোনোরকম জড়তা,সংকোচ নেই!রিশা অবাক হয়ে কুহু আর আশফিকের কথা শুনছে!এত মিশুকে তো কখনই মনে হয়নি কুহুকে!কয়েক লোকমা খাবার খেলেও পুরোটা শেষ করতে পারল না রওনক।হাত ধুঁয়ে উঠে চলে গেল।ছেলেকে পিছু ডেকেও সারা পাননি শারমিন বেগম।টেবিলের বেশিরভাগ খাবারই রওনকের পছন্দের।তবে না খেয়েই উঠে চলে গেল কেন ছেলেটা?পায়েশের বাটি নিয়ে ছেলের রুমের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।কেউ না বুঝলেও রিশা ঠিক বুঝতে পেরেছে ভাইয়ের এই অভিমান!আশফিক ভাইয়ের সঙ্গে যতটা খুশিমনে কথা বলছে কুহু তার একভাগও রওনক ভাইয়ার সঙ্গে বলে না!মনে হচ্ছে কুহুকে সামাল দিতে হবে।নয়তো রওনক একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে!কুহুর কানে পাশে ফিসফিস করে বলল রিশা,
"তুই আশফিক ভাইয়ের সঙ্গে যেভাবে কথা বলছিস।তোকে তো গায়ে পরা মেয়ে ভাববে কুহু!ফ্রি হতে গিয়ে নিজের ব্যাক্তিত্ব কমিয়ে ফেলিস না।
রিশার কথায় খানিক দমে গেল কুহু।তবে মনের কথা বের করতে হলে তো অবশ্যই তাকে ফ্রি হতে হবে।যে করেই হোক এবার রিশাকে বলিয়েই ছাড়বে কুহু।নয়তো কৌশল খাঁটিয়ে আশফিককে দিয়ে বলাবে।কারও প্রতি অনুভূতি থাকলে সেটা চেপে রাখতে নেই।মন খুলে জানিয়ে দেওয়া উচিত!ফের হাসিমুখে আশফিকের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হলো কুহু।কতদিন থাকবে জিগ্যেস করল।খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বলল আশফিক,
" চেয়েছিলাম তো একদিন থাকব।কিন্তু এখানে এসে তোমার সঙ্গে পরিচয় হবার পর মনে হচ্ছে সাতদিন থাকলেও বোরিং লাগবে না!তুমি সত্যি অসম্ভব সুন্দর মনের একটা মেয়ে কুহু!
কুহু বেশ ভাবনায় পরলো।মাত্র একদিন থাকলে আশফিকের মনের কথা বের করবে কি করে সে?যে করেই হোক ধরে বেঁধে হলেও সাতদিন রাখতে হবে লোকটাকে।বেশ নাছোরবান্দার মতোই বলল সাতদিন থাকার জন্য জোড়াজুড়ি করল কুহু।আশফিক হাসল কুহুর পাগলামি দেখে।মেয়েটা যে সরলমনা সেটা তার কথাবার্তা,আচরণেই প্রকাশ পায়।
"তুই বরং এক কাজ কর আশফিক।বাকি ক'টাদিন কুহুদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারিস!যতই হোক মেয়েটা এত জোড়াজুড়ি করছে!
গম্ভীর ভরাট স্বর শুনে সবাই একত্রে তাকাল রওনকের পানে।কাঠিন্য মুখাবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!শুকনো ঢোক গিলল রিশা।পরিস্থিতি এখন কোন বেহাল দশায় যায় কে জানে!কুহুর মুখটা এইটুখানি হয়ে এল!সবেতেই এই জল্লাদটার নাগ গলাতে হয়!আশফিল ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি নিয়ে রওনকের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল।কাঁধে হাত রেখে বলল,
"মেয়েটা খুব সরলমনা রওনক!কথার ধরণ খুব চমৎকার!যে বুঝতে পারবে সে কখনই কুহুর উপর রাগ করবে না।
রওনকের স্থির দৃষ্টি কুহুর পানে।আশফিকের মুখে কুহুর প্রশংসা শুনতে একটুও ভাল লাগছে না রওনকের।কুহুকে তারচেয়ে ভাল কে বোঝে?মাথা থেকে পা অব্ধি পুরোটাই জানা রওনকের!তার ভোর নামে এই নির্বোধ মেয়ের ভাবনায়।রাত্রি আসে তাকে নিয়ে স্বপ দেখাতে!সর্বক্ষণ মস্তিষ্কে চলে তার বিচরণ!সেই কুহু সম্পর্কে কিনা আশফিক তাকে ধারণা দিচ্ছে!কুহুর দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল রওনক,
"আমার এত ফালতু সময় নেই যাকে তাকে নিয়ে ভাববার।আমার সময়ের মূল্য অনেক।এটা বোঝার ক্ষমতা সবার নেই।
কথাটুকু বলেই প্রস্থান করলো রওনক।কুহু সেসব কথা পরোয়া করল না।এগিয়ে এসে আশফিককে জানাল কাছেই নদী আছে।নৌকা করে ঘুরবে কিনা।পাশে থাকা রিশার চোখ অক্ষি ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম!নির্ঘাত আশফিক ভাই এখন ভেবে নিবে কুহু তার প্রেমে পরে গেছে!খানিকটা দোনোমোনো ভাব করলেও শেষে রাজি হলো আশফিক।বহুদিন বাদে দেশে ফিরেছে।এসেছে যখন ঘুরে যাবে সব।কুহু জানাল এক্ষুনি তৈরি হয়ে আসছে সে।রিশাকেও তৈরি হতে বলল।আশফিক ভাইয়ের সঙ্গে বেরোবে ভাবতেই একরাশ আনন্দ এসে ঘিরে ধরলো রিশাকে।তবে খানিক চিন্তা হলো তার।ভাইয়া যদি জানতে পারে কুহুও যাবে।তাহলে নিশ্চিত লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে!সব ঠিক থাকলেই হয়।
!!১১!!
সূর্য অস্ত গিয়ে বেলা নেমেছে সন্ধ্যায়।খানিক্ষনের মাঝেই আঁধারে ডুববে ধরনী।আফসানা বেগম বসে বসে কাঁথা সেলাই করছে।কুহু ফিরতেই কিচেন রুম থেকে ফিরল তোহা।কুহুকে বলল রান্নার কাজে একটু সাহায্য করতে।ভাবীর কথায় থমকে গেল কুহু।এখন তো সে বেরোবে!মায়ের দিকে তাকাতেই দেখল নিজ কাজে মনোযোগী হয়ে আছেন।কাঁচুমাচু ভাব নিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসল কুহু।গম্ভীর গলায় বললেন আফসানা বেগম,
" সারাদিন টইটই করে ঘুরিস তুই।বাড়িতে কাজ থাকে।তোহা একা সামলাতে পারে না।দু'দিন পর বিয়ে দিব।কাজকর্ম তো কিছু শিখতে হবে নাকি!নয়তো ছেলের মা আমাকেই কথা শোনাবে।
"রিশা একটু বেরোবে মা।আমিও যাই?কথা দিচ্ছি একঘন্টার মধ্যেই চলে আসব!তারপর ভাবীর সব কাজ করে দিব।রেখে দিতে বলো তুমি।
" এখন কোথাও যাচ্ছিস না তুই।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে দেখেছিস?এই বয়সে দুশ্চিন্তা করতে পারি না।এত বড়ো মেয়ে বাইরে বাইরে থাকলে চিন্তা হয়।ঘরে গিয়ে তোহার সাথে কাজে সাহায্য কর।আমি আর কোনো কথা শুনছি না।
কুহু মন খারাপ করে থমকে বসে রইল।মনে হচ্ছে ছোট বেলার দিনগুলিই ভাল ছিল।কেন যে বড়ো হলো!তোহা বোধহয় খেয়াল করেছে কুহুর মন খারাপটুকু।এমনিতে হাতে হাতে যতেষ্ট কাজ করে দেয় মেয়েটা।অতি জরুরি না হলে বের হয় না কুহু।কেবল রিশা বললেই যায়।হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল তোহা,
"ঠিক আছে কুহু তুমি বরং রিশার সাথে ঘুরে আসো।কিন্তু এর পর থেকে সন্ধ্যার পর তোমার বের হওয়া মানা।আম্মা কিন্তু অনেক টেনশন করে।তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
ভাবীর কথায় অত্যল্পকালে মন খারাপ দূর হয়ে গেল কুহুর!দ্রুত উঠে রুমে চলে গেল।ছেলের বউয়ের আশকারা ভাল লাগল না আফসানা বেগমের।তোহা একটু কড়া গলায় কাজের কথা বললে এতটা লাই পেত না কুহু।তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগী হলেন।
•
রওনকের থেকে শার্ট নিয়েই তৈরি হলো আশফিক।আয়নায় ভালমতো দেখল নিজেকে।হাতে বই নিয়ে চুপচাপ বসে আছে রওনক।গায়ে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কেউ!এই মুহূর্তে কুহুকে সামনে পেলে কি করতো রওনক নিজেও জানে না!রিশা এসে জানাল কুহু ফোন দিয়েছে।রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সে।বই রেখে দ্রুত বেরিয়ে গেল রওনক।রিশার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরুলো আশফিক।
কুহু গাঢ় নীল রঙা স্কার্ট পরল।আর সাদা রঙা টপস।গলায় স্কার্ফ জুলিয়ে নিয়েছে।চুলগুলো পোনিটেল করে বাঁধা।সম্মুখে তাকাতেই দেখল রওনক এগিয়ে আসছে তার দিকে।কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পরলো কুহুর!ভ্রু দুটো কুঞ্চিত হয়ে আসল।এই বজ্জাতটাও কি যাচ্ছে নাকি তাদের সাথে?কদিন আগে পরীক্ষা শেষ হলো!কত খাতা জমে আছে নিশ্চয়ই?সেগুলো দেখা শেষ না করে কুহুদের সঙ্গে বেরোনোর কি দরকার ছিল রওনক ভাইয়ের?বিরক্তি সর্ব মুখ জুড়ে ছড়িয়ে গেল কুহুর।আচমকাই অসস্থি লাগছে।রওনকের সামনে তো আশফিকের সাথে ঠিকঠাক কথাও বলতে পারবে না।ট্রাউজারের পকেটে হাত পুরে কুহুর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল রওনক।আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
"নাইস!এত সাজসজ্জা কি আশফিককে ফাঁসানোর জন্য?একটা কথা মাথায় ভাল ভাবে গেঁথে নাও বোকা মেয়ে।যত চেষ্টাই করো আশফিককে তুমি পাবে না।ফের যদি বাড়াবাড়ি কিছু দেখেছি আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না!
কুহুর ফুরফুরে মেজাজ টা হুট করেই চরম খারাপ হয়ে গেল!দাঁত কিরমির করে বলল,
" সবেতেই আপনার বাম হাত ঢুকাতে হবে?আর এসব ফাঁসানোর ধান্ধা আমার নেই।দয়া করে আমার ব্যাপারে কিছু বলতে আসবেন না।এখন জগড়া করার মুড নেই আমার।
রওনক কিছু বলার পূর্বে আশফিক আর রিশা উপস্থিত হলো।রওনককে আসতে দেখে খানিক অবাক হয়েছিল আশফিক।ঘুরতে বেরোবার কথা বলে কিছুক্ষণ আগে কত জোড়াজুড়ি করল রওনককে।বারবার নাকচ করে দিয়েছে।যেই রিশা এসে বলল বেরোনোর কথা।ওমনি ছুটে চলে আসল রওনক!কুহু রিকশা ডাকল দুইটা।একটাতে রওনক আর আশফিক বসল।অপরটাতে কুহু আর রিশা।প্যাডেল চালিত রিকশা চলছে ধীর গতিতে।ব্যস্ত নগরীতে যানবাহনের ঢল!চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে বলল কুহু,
"তোর ভাইটাকে সাথে নিয়ে আসার কি দরকার ছিল রিশু?আমি কত প্ল্যান করে এসেছি।অলরেডি তোর জল্লাদ ভাই আমাকে খোঁচানো শুরু করে দিয়েছে!প্রচন্ড রাগ উঠে গেছে আমার!
আমতাআমতা করে বলল রিশা,
"ভাইয়ার সামনে আশফিক ভাই-এর সাথে কথা কম বলিস।রওনক ভাইয়া এসব পছন্দ করে না।
" তোর ভাইয়ের পছন্দ-অপছন্দে আমার কিছু যায় আসে না।শিক্ষক শিক্ষকের মতো থাক!সবেতেই নাক গলাতে হয়।আগে যদি জানতাম রওনক ভাই আসবে আমি জীবনেও আসতাম না।দূর!আমার ভাবনায় জল পরলো।
হতাশ গলায় বলল রিশা,
"আমিও কিছুটা আতঙ্কে আছি।না জানি কি হয় আজকে।দয়া করে তুই সাবধানে থাক কুহু।এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই।আশফিক ভাই থাকবে কিছুদিন।
পাল্টা আর কিছু বলল না কুহু।ঘাড় ঘুরিয়ে রিকশার ফাঁকা দিয়ে তাকাল।আশফিকের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে রওনক।হাসলে তো বেশ ভালই লাগে দেখতে!অথচ দুনিয়ার রাগ দেখায় কুহুর সঙ্গে!যেন জন্মজন্মান্তরের শত্রু!ভেংচি কেটে ফের সামনে তাকাল কুহু।
•
সামনে প্রসস্থ নদী।আশেপাশে ফুচকা,ঝালমুড়ির দোকান বসেছে সারিবদ্ধ ভাবে।রিশার হাত ধরে নদীর কাছাকাছি গেল কুহু।তীরে ছোট ছোট ঢেউ খেলছে!হাত ভাজ করে কুহুর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে রওনক।বাতাসের বেগে কুহুর চুল দুলছে!আশফিক কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল রিশার পাশে।আশফিকের উপস্থিতি হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিল রিশার।কুহু কিছুটা বাহানা দিয়ে তীরে চলে গেল।নদীর জলের দিকে তাকিয়ে রিশার সঙ্গে টুকটাক কথা বলল আশফিক।বেশিরভাগ টা কুহুকে নিয়েই বলল।এরকম মনের মেয়ে সচরাচর মেলে না এখন।দু'জনর বন্ধুত্বের প্রশংসা করলো।এই প্রথম কুহুকে কিছুটা হিংসে হলো রিশার।তবে সেটুকু বুঝতে দিল না আশফিককে।ভালবাসা সত্যিই অদ্ভুত!
রওনকের থেকে বেশ অনেকটা দূরত্ব বজায় রাখল কুহু।রওনক আড় চোখে দেখল।আজকে কেবল কুহুর জন্যই এসেছে সে।মেয়েটা আশফিককে নিয়ে বাড়াবাড়ি রকম শুরু করে দিয়েছে।সবসময় সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না।কিয়ৎক্ষণ পর রিশা আর আশফিক ফিরে এলো।কুহু জানাল ফুচকা খাবে।রওনক বাদে সবাই খেতে রাজি হলো।কুহু বেশ খুশি হলো।তারমানে জল্লাদটা তাদের সঙ্গে যাচ্ছে না!দশ,বারো বছর বয়সী এক ছেলে হাতে করে অনেকগুলো বকুল ফুলের মালা নিয়ে আসল।রিশা জানাল ফুল লাগবে না তাদের।আশফিকের সামনে এসে ছেলেটি বলল,
"ভাবীর জন্য একটা মালা নেন।একদম তাজা ফুলের মালা!
রিশাকে ভাবী বলে সম্মোধন করায় খানিক লজ্জায় পরে গেল রিশা।আশফিক কোনোরকম প্রতিক্রিয়া জানাল না।পাশ থেকে কুহু জানাল বকুল ফুলের মালা রিশার খুব পছন্দের!ছেলেটির থেকে দুটো মালা কিনে নিল আশফিক।একটা দিল রিশাকে আরেকটা কুহুকে।আনন্দে আত্মহার হয়ে গেল রিশা!আশফিক সত্যিই মালা কিনবে ভাবেনি!তৎক্ষনাৎ হাতে পেঁচিয়ে বেঁধে নিল সে।কুহু চেষ্টা করেও বাঁধতে সক্ষম হলো না।আশফিক কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে কুহুর হাত থেকে মালাটা নিল।একটুখানি হেঁসে বলল,
" দেখি হাত দাও আমি পরিয়ে দিচ্ছি!
কুহু অসস্থিতে পরে গেল।হাসার চেষ্টা করল।হাতের তালু ঘেমে গেল।হাত বাড়াতেই পাশ থেকে বলিষ্ঠ হাতে চেপে ধরল রওনক!চমকে রওনকের দিকে দৃষ্টি ফেলল কুহু!ভয়ানক ক্রোধ ঝরছে রওনকের চোখে!
·
·
·
চলবে................................................