বর্ষণমুখর মেঘের বিচরণ সম্পূর্ণ আকাশ জুড়ে, চতুর্দিক ঘন অন্ধকার, তীব্র বাতাস, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। মুহূর্তের মধ্যে কালো মেঘে ঢেকে গেল সারা আকাশ। অন্ধকার চিঁড়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো, তার পরে বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো। হঠাৎ বজ্রের গর্জনে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নাবালক কানে আঙুল ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ব্যস্ত রাস্তায় বিভিন্ন গাড়ি ছুটছিল এমন সময় ছেলে দুটি থেকে একটু দূরে একটা গাড়ি এসে থামল। ইতালির একটি বিখ্যাত শহর রোমে। সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী এ দেশের একজন বিখ্যাত গায়ক। সে একজন বাঙালি। শৈশব থেকেই সেহরিশ পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। এজন্য তার চাচা ওকে সঙ্গে করে ইতালি নিয়ে এসেছিল। সময় বদলেছে, ভাগ্য সেহরিশ কে এই দেশের একজন করে গড়ে তুলে। সাল ২০১৭। বর্তমানে বি-এম মিউজিক বয় ব্যান্ডের লিডার সে। তার খ্যাতি ও গানের মুগ্ধতা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ, সবার পছন্দের তালিকায় তার নাম রয়েছে।
সেহরিশ কনসার্ট শেষ করে গাড়ি নিয়ে বের হয়। আকাশের করুণ অবস্থা দেখে গাড়ি ব্রেক করেছিল। কয়েক সেকেন্ড থেমে মেঘলা আকাশটা দেখে আবার গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করল। তখন সে দেখল দুইজন ছেলে হিমশীতল বাতাসে কাঁপছে। সেহরিশ এক পলক, দুই পলক দেখে ওদের দিকে গাড়িটা একটু এগিয়ে নিয়ে গেল। দুজন ছেলে ইতালীর স্থানীয়। ফুটপাতে একা দাঁড়ানো, রাস্তার আশেপাশে অভিভাবক না দেখে সেহরিশ তাদের উদ্দেশ্য ইতালির ভাষায় জিজ্ঞেস করল,
'তোমরা দুজন কে? এত খারাপ আবহাওয়ায় একা দাঁড়িয়ে আছো কেন?'
দুজনার কেউ সেহরিশের প্রশ্নের উত্তর দিল না। সেহরিশ গাড়ির ভেতরে বসে দরজার দিকে একটু এগিয়ে এল। বাম চোখের ভ্রু তুলে, তারপর তাদের দিকে তীব্র দৃষ্টি স্থির করে, সেহরিশ একই প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করল। দুইজন যমজ, দুজনার চেহারার অনেকটা মিল পেয়েছে সেহরিশ। দুজনে একসাথে সেহরিশের দিকে তাকাল, অপরিচিত ব্যক্তির পরনে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা এবং একটি বড় ক্যাপ। ক্যাপ ও মাস্কে পুরো মুখ ঢাকা তাই সেহরিশকে তারা চিনতে পারল না। প্রথমজন নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
'আমি ইভান!' বলে একটু থামল। তারপর পাশে দাঁড়ানো দ্বিতীয় ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল,
'ও আমার ভাই ইফান। এখানে আমরা দাদির জন্য অপেক্ষা করছি। উনি এসে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবেন।'
সেহরিশ তার ঘড়ির দিকে তাকাল। সময় 9:15 p.m. মিনিট। এই ঝড়ো আবহাওয়া উপেক্ষা করে মিনিটে মিনিটে দ্রুত গতিতে চলছে গাড়ি। সেহরিশ দুই জনকে এই দূর্যোগে একা ফেলে যেতে চাচ্ছে না। সে সাবধানে রাস্তার চারপাশে তাকাল তারপর মৃদু স্বরে বলল,
'আমি তোমার দাদীকে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছি না। খারাপ আবহাওয়ার কারণে তিনি সম্ভবত কোথাও আটকে আছেন। তোমার বাড়ির ঠিকানা বলো আমি তোমাদের পৌঁছে দেব।'
ইভানের মনে পড়ে যে তার মা তাদের, অপরিচিতদের কাছ থেকে খাবার এবং ওদের সাথে একা যেতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন। ইভান ইফানের হাত শক্ত করে ধরে দু পা পিছিয়ে গেল। এরপর নিবিড়ভাবে ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলল,
'আমরা যাবো না।'
সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। একটু পর তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কষলো সে। গাড়ির ভেতরের লুকিং মিররে দুজনকে আরেকবার দেখতে লাগল। সেহরিশের মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে আর ওরা ভিজে যাবে। তারপর হঠাৎ তাদের জ্বর আসবে। ঝড়ো বাতাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্রচন্ড শব্দে বজ্রপাত হলো সেই শব্দে ইফান ভয় পেয়ে গেল। ইভান তাড়াতাড়ি ইফানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সেহরিশ গাড়ির ভিতরে বসে এই দৃশ্যটা দেখল তারপর কী যেন ভাবল? পরোক্ষণেই গাড়িটা আবার ওদের সামনে নিয়ে এসে থামাল।
সেহরিশ তার সিট বেল্ট খুললো, জানালার দিকে একটু ঝুঁকে এসে, কাঁচ গলিয়ে মাথাটা একটু বের করে। এরপর ইভানের দিকে একটা ছাতা বাড়িয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
'এই ছাতাটা নাও। নইলে বৃষ্টিতে তোমরা ভিজে যাবে। তোমার দাদী না আসা পর্যন্ত এই ছাতার নিচে থেকো।'
ইফান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল এরপর ছাতা নেওয়ার জন্য গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো। ইফান ছাতাটা নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
'থ্যাংক ইয়্যু।'
❐
প্রায় মধ্যরাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির ভেতর মৃদু আলোয় স্পষ্ট এক গম্ভীর পুরুষ মুখ। কালো মেঘ হালকা হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। আকাশ এখন ও ঝুম ধরে আছে। এত প্রবল বাতাস হওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টি আসেনি। গাড়ির ভেতর থেকে একবার বাইরে তাকায় সেহরিশ। একটু দূরেই পন্টে সান্ট'অ্যাঞ্জেলো ব্রিজ; দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। এই পথে একটি গাড়ি ও আসেনি। সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। তার কেমন অদ্ভুত লাগছে। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে যেন। চারপাশের সুনসান নীরবতা মধ্যে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। সেহরিশ কলটা রিসিভ করল না। তিন, চার বার কল করার পর সাদাফ বিরক্ত হয়ে ওঠে। সে জানে সেহরিশ কে এই মূহুর্তে কল করে পাওয়া যাবে না। বি-এম গ্রুপের দ্বিতীয় সদস্য সাদাফ ক্যাসানো। সংক্ষেপে একটি মেসেজ পাঠালো সাদাফ,
'টেনশন হচ্ছে কোথায় তুই?'
সেহরিশ নোটিফিকেশন বার থেকে মেসেজটি পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ড শক্ত করে বসল।
'পন্টে সান্ট'অ্যাঞ্জেলো ব্রিজের সামনে।'
মেসেজটা পড়ার সাথে সাথে সাদাফ ওপাশ থেকে উত্তর দিল,
'ওখানেই থাক। আমরা আসছি।'
সেহরিশ মেসেজ পড়ে আর কিছু লেখেনি। কিছুক্ষণ পর সেহরিশের গাড়ি থেকে একটু দূরে একটা সাদা রঙের গাড়ি এসে থামল। সাদাফ বসে আছে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে আছে বি-এম গ্রুপের তৃতীয় সদস্য মাহাবুব তূর্ণ, সে সেহরিশের ওপর ভীষণ রেগে আছে। তূর্ণ দ্রুত গাড়ির সিটবেল্ট খুলে সেহরিশের কাছে ছুটে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে তূর্ণ। খানিক বাদে রাগান্বিত গলায় বলল,
'কল ধরিস না কেন? তোকে কতগুলো কল করেছি? তোর এভাবে উধাও হওয়ায় আমরা কতটা টেনশনে থাকি তার কোনো ধারণা আছে? আমাদের টেনশনে ফেলে মেরেই দম নিবি?'
তূর্ণ দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্ধশ্বাস ফেলল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল সে। তূর্ণর চোখ ভয়ানক লাল হয়ে আছে। সাদাফ গাড়ি থেকে নেমে চুপচাপ হেঁটে এসে সেহরিশের গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
'তুই গার্ড ছাড়া একা বের হওয়া বন্ধ করবি কবে? সেহরিশ, তোর এতটা নির্লিপ্ত হওয়া ঠিক নয়। পথে হঠাৎ বিপদ হলে কি হবে?'
সাদাফ অকপটে প্রশ্নটা করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সেহরিশ। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
'আমি সেইফটি ছাড়া বের হই, কেউ জানবে কী করে?'
তূর্ণ দৃঢ় ও রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
'গত মাসেই তোকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। সেটা কী ভুলে গেছিস?'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'তোর কি মনে হয় কেউ আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেবে আর আমি চার দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ভয় পাব? অসম্ভব।'
সেহরিশের চিন্তাহীন মনোভাব দেখে তূর্ণর রাগ বাড়ছে। শান্ত প্রকৃতির মানুষগুলো যখন রেগে যায় তখন তারা খুব ভয়ানক রূপ নেয়। সেহরিশ তূর্ণকে আর রাগাতে চাইল না তাই চুপচাপ গাড়িতে উঠতে নিল। এ সময় তাদের পেছন দিকে বেশ কয়েকটি গাড়ির হেডলাইট জ্বলে ওঠল। সেহরিশ ভ্রু কুঞ্চিত করে পিছনে ফিরে তাকাল। চারিদিকের অন্ধকারের মাঝে একগুচ্ছ আলো, ভ্রু জোড়া স্থির হলো সেহরিশের। একের পর এক গাড়ির হেডলাইট নিভে গেল। কিছুক্ষণ পর জোহান গাড়ি থেকে নামল। সে ইতালির বাসিন্দা। ইতালির একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সিইওর ছোট ছেলে। জোহান হেঁটে হেঁটে সেহরিশের সামনে এসে দাঁড়াল। সাদাফ অবাক চোখে তাকিয়ে স্পষ্ট ইতালীয় ভাষায় জিজ্ঞাসা করল,
'তুমি কি আমাদের ফলো করছ?'
জোহানের হাসি চওড়া হল। সে হাসিমুখে বলল,
'না, তুমি ভুল ভাবছ সাদাফ! আমি এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তোমাদের দেখতে পাই, তাই এসেছি। যাই হোক, আজ তো তোমাদের রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে কনসার্ট আছে। কিন্তু তোমরা তিনজনই এখানে। কিন্তু কেন?'
তুর্ণ জোহানকে দুদণ্ড সহ্য করতে পারে না। তুর্ণ জানে যে জোহান সেহরিশকে পছন্দ করে না, জোহানের উদ্দেশ্য মোটেও ভালো না, সে প্রতিবার সেহরিশের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আর প্রতিবারই হেরে যায়। তূর্ণ অতীতের কথা ভেবে রাগে ফেটে পড়ে; সে জোহানকে কিছু কড়া কথা বলার জন্য প্রস্তুত হলো। সাদাফ খেয়াল করে সাথে সাথে তূর্ণর হাতটা চেপে ধরল। সাদাফ মৃদু কণ্ঠে জোহানকে বলল,
'আমাদের পারফরম্যান্স প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আগে শেষ হয়েছে। আমরা এখানে সেহরিশের জন্য এসেছি।'
জোহান আকর্ণ হেসে বলল,
'আকাশের অবস্থা সুবিধার না, বৃষ্টি হবে বলে রাস্তা একেবারে ফাঁকা। প্রকৃতি আজ আমাদের সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছে।'
তূর্ণ কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
'কি বলতে চাও? ভান না করে সোজাসাপ্টা বলো।'
জোহান বাঁকা হেসে বলল,
'কার প্রতিযোগিতা করবে? এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। পরাজিত দল এক বছরের জন্য বিজয়ী দলের সকল কথা মানতে বাধ্য থাকবে। কি বলো রাজি?'
জোহানকে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে দেখে তুর্ণ মনে মনে হাসল। তূর্ণ সেহরিশকে বলল,
'গাড়িতে উঠ। অনেক রাত হয়েছে, যেতে হবে।'
জোহান হেসে ফেলল। তারপর ব্যঙ্গ করে বলল,
'সেহরিশ, প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগেই পরাজয়ের ভয়ে পিঠ দেখিয়ে পালাচ্ছো? তোমার নামের সঙ্গে পালানো বেমানান।'
সেহরিশের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে রাগে, ক্ষোভে জোহানের উদ্দেশ্য শক্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'পরে আফসোস করবে না তো?'
'আমিই জিতব।' পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল জোহান।
সাদাফ তূর্ণর হাত ধরে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গেল। তারপর নিচু স্বরে বলল,
'সেহরিশ জোহানের চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করেছে। গাড়ি চালানোর সময় সেহরিশ কতটা বেপরোয়া হয়ে যায় সেটা তো জানিস। এই অসময়ে হঠাৎ যদি সেহরিশের দ্বারা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে জনগণের সামনে তার নাম খারাপ হবে। আমার কথা মন দিয়ে শোন, আজকে তুই আমার পরিবর্তে সেহরিশের সাথে ওর গাড়িতে থাকবি। সেহরিশকে বেপরোয়া হতে দেখলে তাকে সতর্ক করবি।'
তূর্ণ আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
'সেহরিশ যে গতিতে গাড়ি চালায় তাতে আমার ভয় লাগে। তুই আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিস, পরে দেখবি আমার হাত-পা রাস্তায় পড়ে আছে।'
সাদাফ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। তূর্ণ সাদাফের সুক্ষ্ম ও ম্লান চোখ মুখ দেখে ফ্যাকাশে গলায় বলল,
'ঠিক আছে! আমি যাবো।'
জোহান আর সেহরিশের গাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বিশ মিনিট সময়ের মধ্যে যার গাড়ি প্রথমে ফিনিশিং লাইনে এসে পৌঁছাবে। সে আজকের বিজয়ী। এবং শর্ত অনুসারে পরাজিত ব্যক্তিকে এক বছরের জন্য সব কথা মানতে হবে। সাদাফ একটা ছোট কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাওয়ায় কাপড় উড়িয়ে দিতেই গাড়ি দুটি দ্রুত গতিতে চলে যায়। দুজনের মধ্যে সমান উত্তেজনা। কার গাড়ি আগে যাবে? সেহরিশ খুব স্পিডে ড্রাইভ করছে। তূর্ণ ভয়ে সিট আঁকড়ে ধরে। সেহরিশ রাস্তার মোড়ে এসে হঠাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে গেল। তূর্ণর বুক ধুকধুক করছে। একদলা স্বেদজল কপাল বেয়ে স্রোতের মতো বয়ে নিচে নেমে গেল। একটু পর লুকিং মিররে তাকিয়ে জোহানের গাড়ি না দেখে তূর্ণ বলল,
'জোহানের গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। আজও তুই জিতবি। এখন অন্তত একটু ধীরে চালা। ভয়ে আমার আত্মাটা বেরিয়ে আসলো প্রায়।'
সেহরিশ ঠোঁট প্রসারিত করে একটা বাঁকা হাসি দিল। তীব্র, দুর্বোধ্য দৃষ্টি ফেলল তূর্ণর মুখের দিকে। সেহরিশ নির্বিকার চূড়ান্তে; শক্ত গলায় বলল,
'সেহরিশ ফাতিন চৌধুরীকে হারানো অসম্ভব। আর স্লো ড্রাইভ করব? প্রশ্নই আসে না। শত্রুকে দূর্বল ভাবা পরাজয়ের প্রতীক।'
ফিনিশিং লাইনে গাড়ি পার্ক করে গাড়ির বাম্পারে উঠে বসে সেহরিশ। প্রতিযোগিতার বিশ মিনিট, ও আরও পনেরো মিনিট কেটে গেছে। জোহান এখন পর্যন্ত ফিরে আসেনি। সেহরিশের গিটার তার গাড়ির ভেতরে আছে। গিটার বের করে আনলো তূর্ণ। সেহরিশ গুনগুন করে গান ধরল। একটু পরেই জোহানের গাড়িটা তাদের বিপরীত দিকে এসে থামল। জোহান গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে সেহরিশ গিটার বাজানো বন্ধ করে দিল। তূর্ণ আর সাদাফের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি দেখে জোহান রাগে ফুঁসছে। শরীর কাঁপছে তার।
সেহরিশ আর জোহান পূর্ব পরিচিত। তারা হাই-স্কুলে ক্লাসমেট ছিল। সেহরিশ বা জোহান ছোটবেলার বন্ধু নয়। সেহরিশ হাই-স্কুলের টপার ছিল। আর জোহানের শৈশব কেটেছে বন্ধুদের সাথে বাজে আড্ডা, খেলাধুলায়, পড়াশোনায় মোটেও মনোযোগী ছিল না জোহান। সবসময় স্কুলে দেরি করে আসত। শিক্ষক মাঝে মাঝে তার ওপর বিরক্ত হয়ে তাকে ক্লাস থেকে বের করে দিতো।
সেহরিশ লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় ও বেশ ভালো ছিল। খুব সুদর্শন বলে মেয়েরা তাকে পছন্দ করত। যেটা জোহান পছন্দ করত না। সে সবসময় সেহরিশের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকতে চায়। সে ইচ্ছায় সে কখনই সফল হয়নি। সেহরিশের প্রতি তার প্রচন্ড ক্ষোভ একসময় ঘৃণাতে পরিনত হয়। জোহান মাথা নিচু করে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশ ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গম্ভীর সুরে বলল,
'তুমি যদি মনে করো আমাকে হারাবে। তবে এটা তোমার চিন্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখো। আমাকে হারানো তোমার ক্ষমতার বাইরে।'
সেহরিশ তার গাড়িতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেহরিশ চলে যাওয়ার পর জোহান ওই পথের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সে রাগে ছটফট করছে। গাড়ির সামনে থেকে জোহানের বন্ধু হেরাক এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। তারপর জোহানের হাত ধরে নিচু গলায় বলল,
'নিজেকে শান্ত কর জোহান। সেহরিশ কোন সাধারণ মানুষ নয়। তার সাথে ঝামেলায় জড়ালে পরদিন সূর্য উদয় জেলে বসে দেখতে হবে।'
জোহান একটা গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎ গাড়ির টায়ারে সজোরে লাথি মারল সে। জোহান গর্জে ওঠা কণ্ঠে বলল,
'আমি তার জীবন ধ্বংস করে দেব। আমি তাকে ধ্বংস করব।'
.
.
.
চলবে....................................