!!১৯!!
সামনে প্রসস্থ নদী!এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রওনক।রাতের আঁধারে জলের এক অদ্ভুত শব্দ শোনা যায় যেন! পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রাতিম।হাতে কয়েকটা কংক্রিটের টুকরো নিয়ে থেমে থেমে নদীর বুকে ছুঁড়ে ফেলছে।খানিকক্ষণ পিনপতন নীরবতার পর বলল রাতিম,
"আসার পর তো সেই চুপ করেই আছিস।ঘরে যে নতুন বউ ফেলে এসেছিস সে খেয়াল আছে?আজকের এই দিনটা জীবনে একবারই আসে।চাইলে তো কালকেও দেখা করতে পারতিস আমার সঙ্গে।
রওনক ঈষৎ হাসলো।গম্ভীর স্বরে কিঞ্চিৎ হতাশ টেনে বলল,
" বাসরের স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।বিয়েটা কিভাবে করেছি জানিসই!এখন যে রুমে গিয়ে কুহুর সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি আলাপন জুড়ে দিব সেটার কোনো উপায় নেই!মেয়েটা নির্ঘাত মাথা ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছে।
"আমি ঠিক বুঝলাম না তোর হাবভাব!সোজা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বীর প্রেমিক পুরুষের মতো কুহুকে নিয়ে আসবি!তা না করে মাস্টার প্ল্যান করে বিয়ে করলি!শালা আরেকটু হলে তোর সুমুন্দি আমাকে জেলে পুরে দিত!
"বাসায় আমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু হয়ে গিয়েছে।কুহুর ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে বললেও মা-বাবা রাজি হতেন না।এদিকে কুহু তো আমাকে ভালবাসে না যে দু'জনে মিলে বিয়ে করে নিব।অনেক ভেবেচিন্তে এই প্ল্যান করেছি।শেষ মুহূর্তে বাবার থেকে অনুমতি নিয়েই আমি জনসম্মুখে কুহুকে বিয়ে করার প্রস্তাব রেখেছিলাম।বাবা জানে আমি সবসময় যা করি সঠিক ভেবেচিন্তেই!খুব বিশ্বাস করে আমাকে।আর কুহুর পরিবারও যে রাজি হবে এতে শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম।আমাকে সর্বক্ষণ একটা ভয় তাড়া করতো যদি কুহুকে হারিয়ে ফেলি?সবদিকে বোঝানোর মতো সময় আমার কাছে ছিল না।
" তা বেশ!বিয়ে তো সম্পন্ন হয়েই গেল!এখন নির্ধিদ্বায় কুহুকে গিয়ে নিজের মনের কথাটা জানিয়ে দে!এখন তো আর ভয় নেই!
রাতিমের দিকে তাকাল রওনক।তার চোখেমুখে আজ উচ্ছলতা!পরিস্থিতি যাই হোক কুহুকে তো তার পাওয়া হয়ে গেছে!
"উহুম!ভালবাসা প্রকাশের চেয়ে অনুভব করানোটা বেশি সুন্দর রাতিম।এতদিন কুহু দেখেছে আমার রাগী রূপ!সেটা ঠিক কতখানি ভালবাসায় রূপ নিতে পারে সেটা এখন বোকা মেয়েটা উপলব্ধি করবে।যখন আমার ভালবাসাটুকু বুঝতে পারবে,তখন প্রকাশ করলে এর গভীরতা অনুধাবন করতে পারবে!আর সে তো এখন পুরোপুরিই আমার কব্জায়!
রাতিম অবাক হয়ে শুনলো রওনকের কথা।কাউকে ভালবাসলে দ্বিধাহীন,নিঃসংকোচে সহজে বলা যায় না!অন্যরকম একটা ভয় থেকেই যায়।এটা বোধহয় রাতিমের চেয়ে ভাল কেউ জানে না!হাত ঘড়িতে তাকিয়ে রওনককে তাড়া দিল রাতিম।ইতিমধ্যে রাত বারোটা বেজে গেছে!আর কিছুক্ষণ দেরি করলে বেচারারা বাসর রাত ভোর হয়ে যাবে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল রওনক,
"তুই আমার অনেক উপকার করেছিস রাতিম।তোর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার নেই।বল কি চাস তুই আমার কাছে?
প্যান্টের পকেটে হাত পুরে নিয়ে হাঁটা ধরল রাতিম।সঙ্গে রওনককে তাড়া দিয়ে বলল,
" এটা তোলা থাক।উপযুক্ত সময় এলে চাইব।তখন কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারবি না।এই প্রতিদানের কথা অবশ্যই মনে রাখবি।
রাতিমের কথায় খানিকটা হাসল রওনক।পিঠ চাপড়ে নিয়ে হাঁটা ধরল পাশাপাশি।জগতে এরকম একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ক'জনের থাকে?
!!২০!!
কুহু বসে আছে রওনকের ঘরে।রিশা খানিক্ষন আগে তাকে রেখে গেছে এখানে।এই কক্ষে কুহুর কেমন দমবন্ধ আর অসস্থি লাগছে!চোখের পলকে কেমন সবকিছু পাল্টে গেল!জীবন অদ্ভুত!আমাদের ভাবনা,চাওয়া মোতাবেক হয়না কিছু!অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে হলেও তথাকথিত আজকে কুহুর বাসর।অথচ রুমে ফুলের চিহ্নটুকু নেই!এই বিয়ের জন্য কি কুহু প্রস্তুত ছিল?বিয়ে সম্পন্ন হতেই বাড়ি অবধি কুহুর সঙ্গে এসেছে রওনক।সর্বক্ষণ লোকটার চোখেমুখে একটা গাম্ভীর্যতা ছিল!বরণ শেষে রিশা বারংবার রওনককে বলছিল, কুহুকে যেন কোলে করে রুম পর্যন্ত নিয়ে আসে।কথাটা শুনেও কানে তোলেনি লোকটা।কুহুকে ফেলে চলে এসেছিল রুমে।কুহু অপমানিত বোধ করেনি।এমনটাই তো হওয়ার কথা!মন থেকে যদি মেনে নিতে নাই পারবেন,তাহলে বিয়েটা করেছিলেন কেন?নিছক দয়া ছিল?কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখে জল জমেছে কুহুর।এতক্ষণ যাবৎ রিশার রুমেই ভাল ছিল মনে হচ্ছে।খানিকক্ষণ বাদে হয়তো রওনক ভাই আসবেন।মুখোমুখি হবে কি করে কুহু?নিজের স্বামীর জায়গায় যতবার রওনক ভাইকে ভাবছে,ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।রওনকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হওয়ার কথা মনে পড়ে গেল।তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে কুহু।স্কুল ছুটির পর রিশার সঙ্গে তাদের বাড়িতে এসেছিল।সবে বিকেল গড়িয়েছিল।রওনকের এই রুমটাতেই কুহু আর রিশা ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে নাচ করছিল।কুহুর পরনে ছিল রওনকের টিশার্ট।রিশার হাত ধরে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচছিল।সেদিনই হোস্টেল থেকে ফিরেছিল রওনক ভাই।তার জামা কুহুর গায়ে দেখে প্রচন্ড রেগে গিয়ে ইচ্ছেমত কথা শুনিয়ে দিয়েছিল।ভয়ে,অপমানে কেঁদে ফেলেছিল কুহু!এরপর রওনক বাড়িতে আসলে এবাড়িতে আসেনি কুহু।ভুলে যদিও রওনকের মুখোমুখি হয়ে যেত তখন এটা-সেটা বলে ক্ষ্যাপাত!ভাল লাগত না কুহুর।একসময় ভয়টা কেটে গেল।সে-ও রওনক ভাইয়ের মুখের উপর তর্ক করার সাহস পেয়ে বসল!কথার জবাব দিতে পারলে স্বস্তি লাগতো।যেদিন উত্তর দিতে পারতো না,সেদিন বাসায় গিয়ে লুকিয়ে কাঁদত কুহু!সবচেয়ে অপছন্দের লোকটা কিনা আজ তার স্বামী!ভাবনার মাঝেই শারমিন বেগম আসলেন।এক প্লেট খাবার রেখে চলে গেলেন।অথচ তার মুখে আর আগের সেই হাসিটুকু নেই!মন থেকে বোধহয় কুহুকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারেননি তিনি।এত অমিলের মাঝে বিধাতা কেন এক করলেন তাদের?
দেওয়ালে ঝুলছে ঘড়ি।সময় রাত একটা।এখানে একটুও ভাল লাগছে না কুহুর।ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যেতে।গায়ের ভারী সাজ নিয়ে হাপিয়ে উঠেছে।খাবারের দিকে দৃষ্টি পরতেই তপ্ত শ্বাস ফেলল।ও খাবার গলা দিয়ে নামবে না।উঠে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল।আসার সময় কান্না করার দরুন সাজ সব লেপ্টে গেছে!কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে!এক এক করে গয়না খুলে নিল কুহু।গলার হার খুলতে গিয়ে আয়নায় কিয়ৎক্ষণ দৃষ্টি থমকে রইল।আজ সকাল অবধিও ভেবেছিল এই সাজ রাতিমের জন্য!রওনক ভাই তো ভাবনার ধারের কাছেও ছিল না!অথচ এখন সে রওনক ভাইয়ের বউ হয়ে চলে এসেছে!আচমকা হাতের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেতেই ভাবনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসলো কুহু!তৎক্ষনাৎ আয়নায় খেয়াল করতেই দেখলো রওনক ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।কুহুর হাত সরিয়ে দিয়ে,যত্ন নিয়ে গলার হার খুলে দিচ্ছে!কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল কুহু।কি বলবে বুঝতে পারলো না।মনোযোগী রওনক ভাইকে দেখল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে!তবে ঘাড়ে রওনক ভাইয়ের মৃদু স্পর্শ পেতেই আড়ষ্ট হয়ে গেল ক্রমেই।হার খসে মেঝেতে পরে গেল।তড়িঘড়ি করে তুলতে ব্যস্ত হলো কুহু।
"শাড়ি পাল্টে নাও,হালকা লাগবে।
গম্ভীর পুরুষালি স্বরটুকু শুনে চকিতে ফিরে তাকাল কুহু!এত ভাল ব্যবহার ঠিক তার হজম হচ্ছে না।রওনক কয়েক পা এগিয়ে গেল কাবার্ডের কাছে।কুহু প্রশ্ন করল,
" হুট করে আমাকে কেন বিয়ে করলেন,রওনক ভাই?যাকে পছন্দ নয় তাকে কি করে সারাজীবনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে এলেন?দয়া করলেন আমাকে?
ব্যস্ত হাত থামিয়ে কুহুর দিকে তাকাল রওনক।মাথামোটা মেয়েটা এরকম প্রশ্ন করবে ভাবতে পারেনি।একটা মানুষ যতই দয়াশীল হোক!নিজের জীবনের পরোয়া তার আছে।এত বড়ো একটা বিষয়কে কিনা কুহু দয়া ভাবছে!আশ্চর্য!দয়া করে কেউ বিয়ে করে না নিশ্চয়ই।চাপা এক রাগ নিয়ে কাবার্ড থেকে টিশার্ট,ট্রাউজার বের করল রওনক।কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল,
"আমি অতি মহান একজন ব্যাক্তি!সে জন্য বিশাল এই দয়া দেখিয়েছি নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে!বাই দ্য ওয়ে!আমাকে বিয়ে করে আফসোস হচ্ছে নাকি তোমার?পোড়া কপালি মনে হচ্ছে নিজেকে?
রওনকের কথায় থতমত খেল কুহু।জবাব টা ভাল লাগল না তার!শক্ত গলায় বলল,
"জীবনের মায়া ত্যাগ করে বিয়ে কেন করলেন?আপনার সাথে তো একদিনও সংসার করা সম্ভব হবে না।ঝগড়া করেই দিন পাড় হবে।
নির্বোধ মেয়ের কথা ধীরে ধীরে রাগ নিয়ন্ত্রাধীন করে দিচ্ছে রওনকের।পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য প্রাণী মনে হয় কুহুকে।কথার কোনো রকম তোয়াক্কা না করে পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে লাগল রওনক।লোমশ চওড়া বক্ষস্থলে দৃষ্টি আঁটকাতেই সরিয়ে ফেলল কুহু।কোনোরকম আমতা আমতা করে বলল,
"চেইঞ্জ করার জন্য তো ওয়াশরুম আছেই।এখানে আপনি ব্যাতিতও অন্য কেউ আছে দেখছেন না?
কুহুর কথা শুনে দৃষ্টি তুলে তাকাল রওনক।ওষ্ঠকোণে ধরা দিল তার দুষ্ট হাসি।জব্দ করার যখন দূর্দান্ত একটা সুযোগ এসেছে,এটাকে কোনোমতে হাতছাড়া করবে না সে।কুহুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ধারালো দৃষ্টি ফেলে বলল রওনক,
" আজকের দিনের কথা ভুলে গেলে তুমি?আমার সঙ্গে নাকি সংসার করা সম্ভব নয়।দেখি আজ থেকেই চেষ্টা করে।সম্ভব হয় কিনা কিছু!
রওনকের কথা শুনে তড়াৎ করে দৃষ্টি তুলে তাকাল কুহু।মনে হচ্ছে অদ্ভুত রকমের এক হাসি লেপ্টে আছে লোকটার চোখেমুখে!রওনক ততক্ষণে কুহুর আরো অনেকটা কাছে চলে এসেছে।বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে পিছিয়ে গেল কুহু।চোখেমুখে ভয়ার্তের ছাপ!রওনক এগোতে লাগল।শুকনো ঢোক গিলল কুহু!বিয়ে তো হয়েই গেছে!পরবর্তীতে কি হতে পারে সেটুকু তো মাথায় ছিল না!রওনক ভাইয়ের মতিগতি খুব একটা ভাল ঠেকছে না!খাটের সঙ্গে ধাক্কা খেতেই টাল সামলাতে পারলো না কুহু।রওনক ধরতে গিয়ে পা পিচলে পেলব বিছানায় পড়লো কুহুকে নিয়ে।চোখমুখ ভয়ানক ভাবে খিচিয়ে নিল কুহু।আঁকড়ে ধরল রওনকের পাঞ্জাবি!লম্বাটে গড়নের বলিষ্ঠ দেহ খানার সম্পূর্ণ ভার পরলো কুহুর গায়ে!শব্দ করে হেসে উঠল রওনক।দ্রুত চোখ মেলে তাকাল কুহু!রওনক ঝুঁকে আছে তার মুখের উপর।দু'জনের নাকের দূরত্ব কেবল এক ইঞ্চি!শ্বাসপ্রশ্বাস মিলেমিশে যাচ্ছে একত্রে!চোখ বড়ো বড়ো হয়ে এলো কুহুর।খেয়াল হতেই দেখল তার একহাত রওনকের উন্মুক্ত বক্ষস্থলে!ফের শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে বলল কুহু,
"একদম কোনো অসভ্যতা করবেন না রওনক ভাই!আমি কিন্তু তাহলে এখন চেঁচাবো!
·
·
·
চলবে.............................................