আমার বয়স তখন ১২-১৩ বছর। বাবা ভাইয়াকে নিয়ে একটা কাজে বের হয়েছিল। তাহুমা আমার সাথেই থাকে সেদিন। রাতে প্রচণ্ড জ্বর আসে। বাবা কখনও আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও রাতে থাকত না। অথচ সেদিন ফিরলই না! শুধু সেদিন না, আর কখনই ফিরল না।
সকালে দুটো লাশ আসে। হাইওয়েতে কার এক্সিডেন্টে স্পটডেথ আমার বাবা আর ভাইয়ার। আমি জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় শুধু এটুকুই দেখেছিলাম, বাবার মাথা থেতলে গেছে, ভাইয়ার হাত ছিঁড়ে গেছে। দাফনের সময় আমি নাকি জ্বর বেড়ে যাওয়ায় সেনস্লেস হয়ে গেছিলাম। এরপর হসপিটালে ছিলাম একসপ্তাহ। সবসময় ভয় হতো, কান্না করতাম। চারপাশে কেউ নেই, আমার মা নেই, বাবা নেই, ভাইয়া নেই! সবসময় ভাইয়া আর বাবার মুখটা দেখতে পেতাম। ওই ভাঙাচোরা মুখ! আল্লাহ! কী ভয়াবহ ছিল, মা! আমার শরীরের অবস্থা দিন দিন বিগড়ে যাচ্ছিল। সুস্থ হতে আরও সময় লাগল।
শারীরিক সুস্থতা এলেও মানসিকভাবে তখনও আমি ভীষণ অসুস্থ। ডিসচার্জের সময় মামা-মামিরা এলো আমাকে নিতে। তারা আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। এরপর আর কখনও আমার বাড়িতে আমি যাইনি। কেন যাইনি, বিষয়টা তখন জানি না। আমার মামা-মামিদের সঙ্গ ভালো লাগত। ও-বাড়িতে তো কেউ নেই, যাওয়ার ইচ্ছেও তাই দেখাইনি।
বছর পরে জানতে পারলাম, বাবার সব সম্পত্তি নাকি চাচাদের দখলে চলে গেছে। কীভাবে গেছে, কী হয়েছে তখনও জানিনা। বয়স ১৩-১৪ তখন মাত্র। আগ্রহও দেখাইনি।
মামা আমাকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলো। ওই ট্রমাতে এমনিতেই আমি সারাক্ষণ ভুগতাম, অসুস্থ হয়ে পড়তাম। মাধ্যমিক টপকাতে টপকাতে আমার আঠারো বছর বয়স হয়ে গেল। বিয়ের প্রস্তাব এলো একটা ভালো ঘর থেকে। মামা-মামি খুশিমনেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন আমজাদের সাথে।
বিয়ের পর আমি প্রতিপদে অবাক হতে লাগলাম। বাবার কাছে ননীর পুতুলের মতো বড়ো হওয়া আমিটা কাজের মেয়ের মতো খাটছি এখানে। নিজের সংসার, নিজের কাজ, তাই ব্যাপারটাকে আমলে নিতাম না। অথচ যখন দেখতাম অন্য জায়েরা পায়ের ওপর পা তুলে বসে আমাকে হুকুম করছে, তখন বিষয়টা বুঝে আসত আমার। আমি দিন দিন নিশ্চুপ হয়ে যেতে লাগলাম।
আমজাদের সাথে বিয়ের প্রথম কয়েকটা মাস কীভাবে যেন কিছু না বুঝেই চলে গেল। চতুর্থমাসে প্রেগন্যান্ট হলাম আমি। তুই হলি। আমার সুখ, আমার শান্তি। বারো-তেরো বছর বয়সে যেই শান্তিটা হারিয়েছিলাম, তোর মাধ্যমে ফিরে পেলাম। দুঃখ আর আমাকে ছুঁতে পারত না।
অথচ সুখ সাময়িক। আমি আর কনসিভ করতে পারি না। শুধু মিসক্যারেজ হয়ে যায়। এদিকে সবাই ছেলে দাও, ছেলে দাও বলতে বলতে আমাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিচ্ছিল। অনেক অনেক চেষ্টার পর বিয়ের ছয় বছরের মাথায় আমি প্রেগন্যান্ট হই আবারও। জানলাম, ছেলেবাবু! সবাই কী খুশি! অথচ সেই খুশিও আমার টিকল না। আবারও বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেল। এরপর আর হলো না। শ্বশুরবাড়িতে লাঞ্চিত হতে লাগলাম ক্রমাগত। ছোট জায়ের যখন প্রথম ছেলে সন্তান জন্মাল, আমি যেন সংসারের সবচেয়ে অবহেলিত প্রাণী হয়ে গেলাম।
অথচ আমার জানামতে, জীবদ্দশায় এমন কোনো পাপ আমি করিনি যে স্রষ্টা আমাকে সংসারস্বরূপ জাহান্নাম দেখিয়ে দেবেন...
আমার স্বামী! আমার স্বামী আমার সবকিছু কেড়ে নেয়। আমার অধিকারটুকু পর্যন্ত আমার জন্য অবশিষ্ট রাখে না। বিয়ে করে। আমার সব সয়ে থেকে যাওয়া এই সংসারটিতে তেইশ বছরের সকল এফোর্টকে এক নিমিষেই ‘অযথা’ প্রমাণ করে দেয়।”
অরণী নিশ্চুপ হয়ে শুনে যায় সবটা। এখানকার নব্বই শতাংশই তার অজানা ছিল। মা কখনও এসব তাকে বলেনি। আজ কেন বলল? হয়তো মনের ভেতর চাপা পড়া কথাগুলো বেশ ভারি হয়ে উঠেছিল বলেই! অরণী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আয়শা আবারও বলা শুরু করল,
-“মা, সংসার জীবনটা বেশ কঠিন। মানিয়ে নিতে শিখতে বলব না আমি তোকে। তোকে শুধু এটুকুই বলব, জীবনে চলার পথটা তখনই মসৃণ হবে, যখন দেখবি সঙ্গী তোর গুরুত্ব বোঝে। তাড়াহুড়ো করিস না এ ব্যাপারে। সময় নে, নিজেকে বোঝ, বিপরীত ব্যক্তিকে বোঝ। আমার অরু সব বোঝে। সে ঠিক বুঝে যাবে সে কোথায় ভালো থাকবে। ঠিক না?”
অরণী ছোট্ট করে বলল,
-“হুম।”
-“আমি খুব ভাবি, তুই না থাকলে আমার জীবনটা কেমন হতো! হয়তো বাঁচতামই না আমি। আল্লাহ সবাইকে বাঁচার জন্য একটা না একটা কারণ ঠিকই দিয়ে রাখেন। আমারটা তুই, সোনা। ঘুম পাচ্ছে, মা?”
-“হু। অল্প।”
-“রুমে চল, ঘুমাবি।”
-“না। এখানে থাকতে ভালো লাগছে।”
-“আচ্ছা।”
আয়শা অরণীর মাথায় হাত রেখে ফের বলল,
-“চুলের যত্ন নিস না?”
-“সময় হয় না।”
-“আমি আছি তো। তাহুমা আমাকে একটা তেল বানিয়ে দিয়েছিল ছোটবেলায়, আমার মনে আছে। আমি তোকে বানিয়ে দেবো, কেমন?”
-“আচ্ছা।”
-“তোর জন্য অন্তরটা পোড়ে খুব, মা।”
অরণী নড়েচড়ে বসল,
-“চিন্তা কোরো না, মামনি। আমি ভালো আছি।”
-“দুশ্চিন্তা হয় তবুও। তোকে আমি সুন্দর একটা জীবন দিতে পারিনি। আমি মা হিসেবে কেমন যেন!”
-“বেশি ভাবছ তুমি, মামনি। আর ভেবো না। জীবন সবসময় সবভাবেই সুন্দর। যতবার হোঁচট খাব, ততবার উঠতে শিখব। তুমিই বলো, সুন্দর না?”
প্রশ্নটা করে অরণী তাকাল আয়শায় দিকে। তার চোখ দুটো জলে টইটম্বুর! এক ফোটা গড়িয়ে পড়ল। অরণী আটকাল না। আয়শাকে কাঁদতে দিলো।
_______
এরপর দুটো দিন অরণীর বেশ ব্যস্ততায় কেটে গেল। মধ্যরাতে যখন বারান্দায় বসে ল্যাপটপে ডুবে ছিল, ফোনে টেক্সট এলো তার৷ প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণায় চোখ দুটো কুঁচকে এলো। ফোন হাতে তুলে দেখতে পেল ইফতি টেক্সট করেছে,
-“ম্যাডাম, বিজি খুব?”
অরণী রিপ্লাই দিলো,
-“কিছুটা।”
-“প্রেশার যাচ্ছে?”
-“উম, প্রেশার যাচ্ছে না ঠিক। নিজ থেকে নিচ্ছি। আমাদের সমাজে এমনিতেই মেয়েদের কাজটাজ করা নিয়ে আজেবাজে নানান কটুক্তি এখনও লোকে করে থাকে। তার ওপর আমি করছি ডিজিটাল মার্কেটিং। কাজ নিয়ে যথেষ্ট ডেডিকেটেড ছিলাম বলে এ পর্যায়ে এসে মামনিকে একটা যথেষ্ট সাচ্ছন্দ্যের লাইফ দিতে পারছি আমি৷ এ নিয়ে লোক আরও বাজে বাজে কথা বলছে। নিচতলার এক আন্টি আসত মামনির কাছে আড্ডা দিতে। তিনি এলাকায় ছড়িয়ে বেরিয়েছেন, আমি নাকি দেহব্যবসা করে সংসার চালাই। কতটা বিশ্রী শোনাচ্ছে, টের পাচ্ছেন? তাই কিছু জায়গায় জবের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি। ভাইবা আছে ক'দিন পর। তাই একটু প্যারা নিতে হচ্ছে এখন।”
টেক্সটটা আসার পর ইফতি থেমে থেমে পুরোটা পড়ল। দীর্ঘশ্বাস আসে তার। মেয়েটার জন্য মনটা আরও কোমল হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে তো ভীষণ ইচ্ছে করে, শক্ত করে মেয়েটাকে বুকের ভেতর নিয়ে রেখে দিতে, খুব যত্নে রাখতে, খুব ভালোবাসতে। দুনিয়াদারি বোঝার দরকার নেই তার। অথচ ইফতি অপারগ, এক আকাশ সমান দায়িত্ব অরণীর কাঁধে।
সময় নিয়ে টাইপ করল ইফতি,
-“বুঝলাম। কিন্তু এভাবে রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে না?”
-“সমস্যা নেই, অভ্যস্ত আমি।”
-“সেটাও বুঝলাম। ঘুমোচ্ছ কখন?”
-“ঠিক নেই, ইফতি। তিনদিন ধরে খাওয়া-ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে না। খুব ক্লান্ত লাগছে। শরীর টানছে না।”
-“ছোট্ট একটা ব্রেক নেবে?”
-“নেওয়া দরকার সম্ভবত।”
অরণী পর পর আরও দুটো টেক্সট করল,
-“আধ ঘন্টার একটা ব্রেক রিফ্রেশমেন্টের জন্য নেওয়াই যাই। তাই না? কী বলেন?”
-“নেওয়া যায়। ছাদে আসো তবে।”
-“আপনি বাসায় আছেন?”
ইফতি এ পর্যায়ে হেসে উঠল,
-“ম্যাডাম, নিচে তাকান। বারান্দাতেই আছি আমি।”
অরণী কোলের কুশনটা টেবিলের ওপর রেখেই উঠে পড়ল। ঝুঁকে দাঁড়াল রেলিং ধরে। ঠিক নিচেই ইফতি সোফায় হেলান দিয়ে রেলিংয়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। তাকিয়ে আছে এদিকেই। অরণীকে দেখে একগাল হেসে বলল,
-“হোয়াটসআপ, ম্যাডাম! চা খাবেন?”
জবাবে এক সুমিষ্ট হাসি দ্বারা অরণী বলল,
-“কেন নয়?”
ইফতি চা আর কফি নিয়ে ছাদে চলে এলো। অরণী সাদা গোলজামা আর অলিভ কালারের প্লাজো পরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ চাঁদের আলো নেই একদমই। দূরের স্ট্রিট লাইটের আলোয় অরণীকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ইফতি পাশাপাশি দাঁড়াল। বরাবরের মতোই চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলো অরণীর দিকে। অরণী প্রশস্ত হেসে কাপটা নিয়ে বলল,
-“আপনার হাতের চা মানে অমৃত, ইফতি! কী দারুণ বানান! নির্ঝঞ্ঝাটে যে-কোনো চা-খোর মেয়েকে পটিয়ে ফেলতে পারবেন কেবলমাত্র এককাপ চা খাইয়েই।”
-“আপনি পটে যান, ম্যাডাম। তাতেই জনম সার্থক হয়ে যাবে।”
জবাবে হাসল অরণী কেবল, কিছু বলল না। ইফতি ফের বলল,
-“কেমন আছো এখন?”
চোখ বুজল অরণী, অধর-প্রসারিত এক ছোট্ট হাসিতে বলল,
-“নিশ্চিন্ত। আপনার কাছে আমার সকল দুশ্চিন্তারা বাঁধা পড়ে যায়। অশান্তিগুলো নাই হয়ে যায়। আপনি আমার অভ্যেস খারাপ করে ফেলেছেন, ইফতি। এত এত ক্লান্তির মাঝে এক টুকরো স্বস্তির জন্য আপনাকে আমি সারাটাক্ষণ খুঁজে ফিরি।”
-“খোঁজার প্রয়োজন কোথায়? আমি তো আছি। এই তো.. হাতের নাগালে, মনের সবচেয়ে কাছে।”
অকস্মাৎ হৃৎপিণ্ডটা বেশ লাফিয়ে উঠল অরণীর। সচকিত হয়ে তাকাল ইফতির দিকে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে তার। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ করে তাণ্ডব চালাতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা অনিয়ন্ত্রিত এখন। সেভাবেই জিজ্ঞেস করল,
-“শেষ অবধি থাকবেন?”
-“মৃত্যুর আগ অবধি থেকে যাব... তোমার হয়ে।”
অরণী ছাদ থেকে ফিরে যখন বারান্দায় এলো, তখন বেশ নিশ্চিন্তমনে সে ছিল; সকল জাগতিক দুশ্চিন্তা, কষ্ট, বাইরের মানুষের উদ্ভট কথাবার্তা থেকে মুক্ত তখন। এসে হাতের কাজগুলো ধরল।
অথচ সুখ সাময়িক। অরণীর কপালে এসব সয় না। ইফতি নামক লোকটা যখন আসে, বোঝায়—তুমি আমার জীবনে সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ, তখন অরণী শান্তি পায়। তার মনে হয়, কেউ তো আছে যার সময় ও সুখের একচ্ছত্র আধিপত্য কেবলই তার! তখন তার পৃথিবীটা নেচে ওঠে। অথচ সেই পুরুষটার নজরের বাইরে এলেই বুকের ভেতর শুরু হয় অসুখের উৎপাত।
এই তো, হাঁসফাঁস লাগছে এখন। বুকের ভেতরটা কেমন করছে। অস্থিরতা কাজ করছে। এই অস্থিরতা বিগত কিছুদিন ধরেই সে অনুভব করছে। কেমন যেন অদ্ভুত, অস্বস্তিকর! মনে হচ্ছে, কিছু একটা হারাতে চলেছে সে। আরও বাজেভাবে সে এই জীবনযুদ্ধে হারতে চলেছে।
আর কাজে মনোযোগ দিতে পারল না। ডাইনিংয়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে পুরোটা শেষ করল। তখন বাজে রাত সাড়ে তিনটা। সে ফিরে এলো বেডরুমে। ডিম লাইটের আলোতে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব। বিছানার একপাশে ঘুমোচ্ছে আয়শা।
অরণী অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তার ঘুম আসছে না। অথচ ঘুম জরুরি। এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে এসে একটুকরো স্বস্তির জন্য অরণী উঠে একটা স্লিপিং পিল নিয়ে ঘুমোতে গেল। আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে লাগল অরণী অচেতন ভুবনে। একটানা সাড়ে ছ'ঘন্টা ঘুমোল সে।
সকালে উঠে মেয়েটা টের পেল, সে নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় মামনির লাশের সাথে এতক্ষণ পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। গতরাতে ঘুমের মধ্যেই তার মা মারা গেছে। অবিশ্বাস্যভাবে তাকিয়ে রইল অরণী। যাকে ঘিরে তার পুরো পৃথিবী ছিল, নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে তাকে একা রেখেই সে চলে গেল।
লাশের পাশে বসেই কাঁপা কাঁপা হাতে কল লাগাল অরণী ইফতিকে। ইফতি রিসিভ করতেই অরণী অপ্রকৃতস্থর মতো বলে উঠল,
-“আমার মা মরে গেছে! আল্লাহ! কার অভিশাপ লাগল আমার ওপর?”
.
.
.
চলবে.......................................