আশিয়ানা - পর্ব ০৫ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


ভারী চশমার আড়ালে দুটি চোখ তূর্ণর দিকে শান্তভাবে চেয়ে আছে। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে সাদাফ বলল,
  'তূর্ণ, ভালো হচ্ছে না। দরজা খোল।'

তূর্ণ ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে উচ্ছল ভঙ্গিতে। ড্রয়িং রুমের দক্ষিণ পাশের ঘরটি অন্যান্য কক্ষের চেয়ে বড়, এর সাজসজ্জা, আসবাবপত্র ও বেশ আকর্ষণীয়। সাদাফ তূর্ণর সেই ঘরটা দখল করে নিয়েছে। প্রতিশোধ নিতে সাদাফের ক্রেডিট কার্ড নিয়ে নেয় তূর্ণ তারপর সাদাফকে ঘরে রেখে দরজা বাহির থেকে বদ্ধ করে রাখল। সাদাফ জানালার ওপাশ থেকে নরম গলায় আবার বলল,
  'ভাই, দরজা খোল, আমি তোকে কিছু বলব না।'

তূর্ণ ঠান্ডা গলায় বলল,
  'তুই কি আমাকে বোকা ভাবিস? আমি বিশ্বাস করব তোকে, ভুলে ও না।'
সাদাফ রেগে বলল,
  'আমি তোকে ছাড়ব না।'
তূর্ণ হাসল। হেয়ালি করে বলল,
  'আগে ধর। আমি এখন শপিং মলে যাব। হাহাহা, আমি আজ তোর টাকা দিয়ে শপিং করব।'
সাদাফ রাগী ও উচ্চকিত গলায় বলল,
  'তোর মাথায় গাড়ির ছাদ ভেঙে পরবে তূর্ণ।'
তূর্ণ প্রায় চলেই গিয়েছিল। সাদাফের কথাটা শোনা মাত্রই পেছনে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল,
  'শকুনের দোয়ায় গরু মরে না ভাই।'

সাদাফের ম্যানেজার এসে দরজা খুলল। সাদাফ রাগ মাটি করে সোফায় হেলান দিয়ে টিভি দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর চ্যানেল পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে টাইম টিভির লাইভ নিউজ দেখতে পেল। সাদাফ বিস্ময়াভিভূত চমকে ওঠে। কয়েকবার কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। তূর্ণর গাড়ির চারপাশ ঘিরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন ফোন বের করে ছবি তুলছে ইতোমধ্যে সাংবাদিক এসে পৌঁছেছে, তূর্ণ দুই হাতে মুখ ঢেকে গাড়িতে বসে আছে । প্রতিটি টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার, বি-এম ব্যান্ডের গায়ক মাহাবুব তূর্ণ বাংলাদেশে এসে ছদ্মবেশে শপিংমল ঘুরে বেড়াচ্ছে। এভাবে লুকিয়ে দেশে আসার কারণ কী?

সাদাফ খানিক ঝুঁকে তার ফোনটা নিল। ইতস্তত করে সেহরিশের নাম্বার ডায়াল করল। টি-টেবিলের উপর ফোন ব্রাইবেট হতে লাগল সেহরিশ ফোন চার্জে রেখে মায়ের ঘরে বসে আছে। মিনিট পাঁচেক পর বাম হাত প্যান্টের পকেটে রেখে হাঁটতে হাঁটতে রুমে আসলো। বিছানায় বসতেই আবার ফোন বেজে উঠল। সেহরিশ কল রিসিভ করে। সাদাফ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
  'তুই কোথায় খবর দেখেছিস? টিভি চালু কর।'
  'খবরে কি দেখব?'
  'তূর্ণ কে দেখাচ্ছে।'
সেহরিশ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল। 
  'কীহ?'
সেহরিশ টিভি চালু করে। নিউজ দেখে প্রচন্ড ক্ষোভের সাথে বলল,
  'স্টুপিট। তুই ওকে একা একা যেতে দিলি কেন?'
সাদাফ বলল,
  'আমাকে রুমে বন্ধ করে রেখে তারপর গেছে। তুই তাড়াতাড়ি গাজীপুর আয়।'
সেহরিশ কড়া গলায় বলল,
  'বোকার মত কথা বলছিস কেন? আমি কিভাবে সিরাজগঞ্জ থেকে শফিপুর তাড়াতাড়ি যাব?'
সেহরিশ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
  'এই ছেলেকে নিয়ে কী করব? আমি আসতেছি। তুই দেখ ওকে সেখান থেকে বের করে আনতে পারিস কিনা।'

চারিদিক থেকে মানুষের চিৎকার ও গাড়ির হর্নের আওয়াজ তূর্ণর কানে আসছে। প্রচুর মানুষ ভিড় করেছে, ধাক্কাধাক্কি করছে তারা। গাড়ি মধ্যে তূর্ণ অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে। 

শপিংমলে এসে এভাবে ধরা খাবে বুজতে পারেনি। মাস্ক ও টুপির আড়ালে থাকার পরও কয়েকজন তাকে চিনে ফেলল। এই জনসম্মুখে তার নাজেহাল অবস্থা। তূর্ণ তার বডিগার্ড এর সঙ্গে এসেছিল। ভিড়ের মধ্যে বডিগার্ড ও ড্রাইভার কোথায় আটকে আছে তূর্ণ বুঝতে পারছে না। তূর্ণ গাড়ি চালাতে পারে না। এই জায়গা থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ তূর্ণ দেখছে না।

মিডিয়ার লোকজনও বাড়াবাড়ি করছে। যদি সম্ভব হত তাহলে তারা গাড়ির লক খুলে তূর্ণকে বের করে আনতো আর জিজ্ঞাসাবাদ করত। তূর্ণ সেহরিশের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছে। ফোনের ব্যাটারি লো, সেহরিশ বা সাদাফকে কল করার জন্য ফোনটা হাতে নিতে বন্ধ হয়ে গেল। তূর্ণ ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল রাগ লাগছে তার। হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে একটা আওয়াজ তূর্ণর কানে এল। গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন মেয়ে নরম গলায় বলল,
  'দরজাটা খুলুন তাড়াতাড়ি।'

তূর্ণ দরজা খুলল আর কেন খুলল সে জানে না। মানবী ড্রাইভিং সিটে বসে তূর্ণকে ফ্রন্ট সিটে যেতে ইশারা করল। তূর্ণর মতো লম্বা ও বলিষ্ঠ পুরুষের গাড়িতে বসে এক সিট থেকে অন্য সিটে যাওয়া কঠিন। তূর্ণ কষ্ট করে ফ্রন্ট সিটে গিয়ে বসল। মানবী কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি চলতে শুরু করে তখন সামনে থেকে লোকজন সরে যেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে সে তূর্ণকে ভিড় থেকে বের করে আনলো। তূর্ণ সোজা হয়ে বসল। পেছনের সিট থেকে পানির বোতল নিয়ে শুকনো গলাখানি ভিজিয়ে নিল। এতক্ষণে সে মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ্য করল।

রাস্তার পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলো গাড়ির জানালা দিয়ে ঢলে পরছে মানবীর মুখে। ফর্সা মুখ, পাতলা ঠোঁট ও সোজা নাকওয়ালা মেয়েটির দিকে চোখ রেখে তূর্ণ গোপনে মৃদু হাসল। 

তূর্ণ নরম গলায় শুধল,
'তুমি কে? আমাকে বিপদ থেকে বের করেছ। তোমাকে ধন্যবাদ কীভাবে দেব?'

পাশ থেকে উত্তর এল,
'আমার নাম জুবিয়া।' বলে থামল জুবিয়া। তারপর ভ্রু কুঁচকে জানালার বাইরে তাকিয়ে একপলক দেখল ব্যস্ত কণ্ঠে ফের বলল,
  'আপনি বিপদে ছিলেন তাই কিছু না ভেবে সাহায্য করেছি। দ্যাটস অল। আর এখন কেউ ফলো করছে না। আপনি এখন নিরাপদে বাড়ি যেতে পারেন।'
তূর্ণ করুণ কণ্ঠে বলল, 
  'আমি গাড়ি চালাতে জানি না। কষ্ট করে আমার বাড়ি পর্যন্ত গেলে অনেক সুবিধা হবে।'

জুবিয়া আর কথা বলল না। একবার মাত্র তূর্ণর কাছ থেকে ঠিকানা জেনে নিল। একটু পর বিশাল এক বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাল জুবিয়া। জুবিয়া নামবে সে-সময় তূর্ণ বলল,
  'তুমি আমার উপকার করেছ। আমাকেও তোমার জন্য কিছু করতে হবে। আমি তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করতে পারব কোন নম্বর থাকে...'

তূর্ণর কথা শেষ হতে দিল না জুবিয়া। সে তার পার্স থেকে একটা কার্ড বের করে তূর্ণর হাতে দিল। তাড়াতাড়ি করে বলল,
  'চিকেন শপ। আমি সেখানে পার্ট টাইমার। আমার নাম বললেই হবে।'
তূর্ণ ভ্রু কুঁচকে উচ্চারণ করে,
  'চিকেন শপ?'

তূর্ণ গাড়ি থেকে নামল। তারপর জুবিয়ার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। তূর্ণ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
  'তুমি বাড়ি এলে চা বা কফি দিতে পারতাম।'
জুবিয়া নিচু গলায় বলল,
  'তার কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমি চা বা কফি খাই না।'
তূর্ণ আমতা আমতা করে বলল,
  'আমি কি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?'
  'হ্যাঁ, করুন।'
  'তুমি গাড়ি কিভাবে চালাতে পারো?'
জুবিয়া সহজভাবে বলল, 
  'আমার ভার্সিটির এক বন্ধু। তার গাড়ি আছে। সে আমাকে শিখিয়েছে কারণ আমি তাকে বলেছিলাম আমি ড্রাইভিং শিখতে চাই।'
জুবিয়া তূর্ণর দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, 
  'আপনি গাড়িতে বসে ছিলেন তখন গাড়ি চালাচ্ছিলেন না কেন?'
তূর্ণ বলল,
  'আমি গাড়ি চালাতে পারি না।'
  'আপনার একটা গাড়ি আছে আর আপনি চালাতে পারেন না?'
তূর্ণ হালকা হেসে বলল,
  'আমার দুই বড় ভাই আছে তাই আমার ড্রাইভিং শেখার দরকার হয়নি।' বলে থামল তূর্ণ। তারপর আবার বলল, 
  'এক মিনিট দাঁড়াও। আমার ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দেবে।'
জুবিয়া যেতে যেতে বলল,
  ' থ্যাংকস তার দরকার নেই। এখন থেকে সাবধানে থাকবেন।'
তূর্ণ উচ্চস্বরে বলল,
  'তুমি তোমার নাম ছাড়া কিছুই বলোনি? আমি তোমাকে কিভাবে খুঁজে পাব?'
জুবিয়া বলল, 
  'খুঁজবেন কেন?'
তূর্ণ বিড়বিড় করে বলল,
  'কেন? কেন এর উত্তর কোথায়?'
.
.
.
চলবে........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন