ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে বারান্দার মেঝে ভিজিয়ে যাচ্ছে। সবে স্নান করে এসে বারান্দার এক কোণে বসে ঠান্ডায় কাঁপছে জুবিয়া। রোদেলা দুই কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এলো। জুবিয়ার পাশের চেয়ারে বসে এক কাপ চা জুবিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। হাতে থাকা চায়ের কাপ থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। গরম গরম চা মুখে নিলে জিভ পুড়ে যায়। চা'টা একটু ঠাণ্ডা করার জন্য রেলিংয়ে রেখে বাড়ির গেটের দিকে তাকাল রোদেলা। একটা গাড়ি এইমাত্র থামল। কিছুক্ষণ পর একজন লোক গাড়ি থেকে নামল। সঙ্গে সঙ্গে উমাইয়া গাড়ি থেকে নামল। জুবিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে। রোদেলার উদ্দেশ্যে বলল,
'ওটা উমাইয়া না?'
রোদেলা অবাক গলায় বলল,
'হ্যাঁ দেখতে অবিকল উমাইয়াদের মতো। কিন্তু ওর সাথে ছেলেটা কে?'
সাদাফকে নিয়ে বাড়ির কেঁচি গেটের দিকে এগিয়ে যায় উমাইয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা তৃতীয় তলায় পৌঁছে গেল। রোদেলার হাত ধরে সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়ায় জুবিয়া। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দিল। উমাইয়া বিস্মিত গলায় বলল,
'এত তাড়াতাড়ি দরজা খুললি কিভাবে? দরজার সামনেই ছিলি নাকি?'
উমাইয়া ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসল। জুবিয়া আর রোদেলা তাকে ঘিরে বসে পরল। উমাইয়ার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় রোদেলা দৃঢ়ভাবে বলল,
'কে ছিল?'
রোদেলার কথায় হঠাৎ চমকে উঠল উমাইয়া। বিচলিত হয়ে বলল,
'কী?'
রোদেলা গম্ভীর গলায় শুধল,
'লোকটা কে?'
জুবিয়া উমাইয়ার সামনে বসল। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে উমাইয়ার হাত ধরে উমাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
'তুই তার প্রেমে পড়েছিস? প্রেম করার আগে ছেলেটা কে? পরিচয় কি? তিনি কি করেন? এগুলো সব খোঁজ নিয়ে তারপর সম্পর্কে জোড়াবি।'
উমাইয়া দূরে তাকিয়ে বলল,
'আমরা কোনো সম্পর্কে নেই। সে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের ফ্ল্যাটে থাকে। তাছাড়া আমি জানি না সে কী কাজ করে। সেরকম কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি। আর...'
রোদেলা প্রশ্ন করল,
'আর কি?'
উমাইয়া বলল,
'সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।'
জুবিয়া সাথে সাথে বলল,
'বিয়ে করতে চায় বললেই কি বিয়ে হয়? বিয়ে করতে কতশত নিয়ম মানতে হয়। সে সম্পর্কে কোন ধারণা?'
উমাইয়া ফিসফিস করে বলল,
'উনি আমার বাবার সাথে কথা বলতে চায়।'
ভাবনার সুরে বলল রোদেলা,
'খালেদ চাচা এসব শুনলে রাগ করবেন না?'
উমাইয়া আগের কণ্ঠে বলল,
'বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে?'
জুবিয়া বলল,
'মারবে কেন?'
উমাইয়া দৃঢ়ভাবে বলল,
'বাবা আমাকে এখানে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছে। আর আমি বিয়ে করার জন্য পাত্র নিয়ে সামনে দাঁড়ালে বাবা কি আমাকে ছেড়ে কথা বলবে?'
উমাইয়া ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে গোসল করতে বাথরুমে যায়। ক্ষুধার জ্বালায় জুবিয়া আর রোদেলা খেতে বসে গেছে।গামছা দিয়ে ভেজা চুল মুড়ে উমাইয়া ড্রয়িংরুমে দাঁড়াল। তখনি কলিংবেলের শব্দ শুনে সে ভ্রুকুটি করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ফোটক দিয়ে বাড়িওয়ালী হালিমা বেগমকে দেখে দরজা খুলে দিল উমা। হালিমা বেগম একটা কাগজ উমাইয়ার হাতে দিয়ে বললেন,
'তোমাদের বাড়ি ভাড়া তিনগুণ বেড়েছে। মাসের এক তারিখে তিনজনের ভাড়া প্রস্তুত রাখবে।'
উমাইয়া ইতস্তত করে বলল,
'খালা, তিনগুণ কেন?'
কর্কশ গলায় বললেন হালিমা,
'তোমরা আগে দুজন ছিলে এখন তিনজন আছো তাই ভাড়া বাড়ছে।'
'এটা কেমন নিয়ম খালা? বাসা ভাড়া দেওয়ার আগে এমন নিয়ম তো বলেননি?'
হালিমা বেগম বললেন,
'মানুষ বাড়লে ভাড়াও বাড়বে। থাকতে না চাইলে চলে যাও, সমস্যা নেই।'
উমা হতভম্ব অবস্থায় বিছানায় বসে আছে সে রাতের খাবারও খায়নি। রোদেলা প্লেটে খাবার নিয়ে রুমে এসে লাইট জ্বালালো। পাশ থেকে জুবিয়া শুধল,
'হঠাৎ কি হয়েছে তোর? মুখটা ভারী লাগছে কেন?'
উমাইয়া বলল,
'বাড়িওয়ালা খালা আসছিলেন।'
'কি বলে গেছেন?' বলল রোদেলা।
জুবিয়া তটস্থ গলায় বলল,
'মহিলা আবার কিছু বলছে?'
উমা একদৃষ্টিতে জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
'তিনি বলে গেছেন ভাড়া বাড়াতে। এক মাসে বারো হাজার টাকা ভাড়া। এই মুহূর্তে ভাড়া বাড়ালে চলব কীভাবে?'
জুবিয়া ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করল,
'আর কি বলেছে?'
'হুহ।'
'কী?'
'ভাড়া বাড়িয়ে দিতে না পারলে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন।'
রোদেলা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
'আমরা তিনজন পার্ট টাইম জব করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।'
উমাইয়া কড়া গলায় বলল,
'এইখানে চাকরি পাওয়া এত সহজ না আর তিনজনের একসাথে চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব।'
জুবিয়া হঠাৎ বলে উঠল,
'আমার বন্ধু আয়ান। ওর বাবার রেস্টুরেন্টের বড় ব্যবসা। তার সাথে একবার কথা বলব? ওখানে ওয়েটারের কাজ পেলে সুবিধাই হবে।'
রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
'কোন বন্ধু?'
জুবিয়া নরম গলায় বলল,
'আয়ান। আমি তোকে সেদিন ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।'
রোদেলা বলল,
'ওইযে, লম্বা আর ফর্সা করে ছেলে?'
মৃদুস্বরে বলল জুবিয়া,
'হুম।'
জুবিয়া হঠাৎ উমাইয়ার দিকে তাকাল। তারপর আবার বলল,
'রেস্তোরাঁর কাজ হয়ে গেলে তোকে আর নার্সারিতে কাজ করতে হবে না।'
উমা উঠে দাঁড়াল। জুবিয়ার বাটন ফোনটা টেবিল থেকে এনে জুবিয়ার হাতে দিয়ে বলল,
'রাত বেশি হয়নি। আয়ান কে এখনই কল কর।'
জুবিয়া বাটন ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে গিয়ে আয়ানের নাম্বার খুঁজে বের করে কল দিল। দুইবার রিং হওয়ার পর আয়ান কল রিসিভ করে। আয়ান বিছানায় শুয়ে ঠোঁট বাঁকা করে হেসে জিজ্ঞেস করল,
'এত রাতে আমার কথা মনে পড়ল কীভাবে?'
জুবিয়া নিচু কণ্ঠে বলল,
'আমাদের তোর সাহায্য চাই।'
'কি সাহায্য প্রয়োজন? বল, আমি তোদের জন্য তাঁরা গুলোকে আকাশ থেকে মাটিতে নিয়ে আসব।'
একটু বিরক্ত গলায় বলল জুবিয়া,
'না থাক, তোকে আর ওই তাঁরাগুলো মাটিতে আনতে হবে না। তাদের ওই আকাশে থাকতে দে।' বলে একটু থামল জুবিয়া। তারপর স্থির কণ্ঠে ফের বলল, 'তোমার বাবার তো রেস্টুরেন্ট আছে, তাই না?'
'হ্যাঁ, আছে। কেন বল?'
'সেখানে আমাদের চাকরি দিতে পারবি?'
আয়ান জোরে হেসে উঠল। তারপর বলল,
'আরে এটা আমার বাঁ হাতের খেল। কিন্তু আগে এটা ক্লিয়ার কর, আমাদের বলতে তোর আর কার?'
জুবিয়া একবার রোদেলার দিকে আর একবার উমাইয়ার দিকে তাকায়ে গভীর কণ্ঠে বলল,
'আমি, উমাইয়া ও রোদেলা। আমাদের তিনজনের চাকরি দরকার।'
আয়ান বলল,
'আমি ব্যাপারটা দেখছি, ভেবে নে, চাকরি কনফার্ম।'
কল কেটে দিল আয়ান।
❐
বারান্দার গাছের পাতাগুলো বাতাসে একটু দুলছে। সাদাফ রেলিংয়ে রাখা একটা ছোট চারাটার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর প্রশস্ত কণ্ঠে বলল,
'মেয়েরা এত কঠিন কেন?'
হঠাৎ পাশের বারান্দা থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এল। কণ্ঠস্বরের মালিককে চিনতে বিড়ম্বনা হলো না সাদাফের। উমাইয়া বিদ্রুপের সুরে বলল,
'শুধু মেয়েরাই কি কঠিন? পুরুষরা না?'
সাদাফ ভ্রুকুটি করে উমাইয়ার দিকে তাকাল। হঠাৎ উমাইয়ার উপস্থিতিতে বিব্রত হলো সাদাফ। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। তারপর দ্বিধা করে বলল,
'আমি এভাবে বলতে চাইনি।'
উমাইয়া শক্ত কণ্ঠে বলল,
'কিভাবে বলতে চাইছেন?'
এ প্রশ্নের উত্তর দিল না সাদাফ। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাল সে। তারপর জিজ্ঞেস করল,
'এখন প্রায় মধ্যরাত। আপনি এখনো জেগে আছেন উমা। কী কারণে আপনার চোখে ঘুম নেই?'
উমাইয়া মলিন কণ্ঠে বলল,
'চাকরির জন্য চিন্তিত। চাকরি না পেলে আমাদের এখানে থাকা সম্ভব হবে না। ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে। আগামীকাল আমাদের বন্ধুর বাবার রেস্টুরেন্টে যাব। ভাগ্য যেন সহায় হয়, এই মূহুর্তে চাকরিটা খুব দরকার।'
সাদাফ ভাবুক গলায় বলল,
'কোন রেস্টুরেন্ট? নাম কি?'
'চায়নিজ ফুড কর্ণার।'
উমাইয়া বিনীতভাবে আবারও বলল,
'আমি এখব যাই। অনেক রাত হয়ে গেছে আর আমাকে কাল তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।'
সাদাফ হাসিমুখে বলল,
'আচ্ছা।'
সকাল 10:30 p.m মিনিট। কপোলদ্বারের স্বেদজল সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বিষণ্ণ চোখে উমাইয়া তাকাল রোদেলার দিকে। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
'এত রোদে আমরা ছাদে দাঁড়িয়ে আছি কেন?'
বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রোদেলা। বলল,
'জুবিয়া মাথায় মেহেদির পেস্ট লাগিয়ে বসে আছে। আমরা যদি এখন ওকে এখানে একা রেখে যাই, ও কি আমাদের আস্ত রাখবে?'
ছাদের দরজা খোলা এইসময় তূর্ণ আর সাদাফ আসলো। তূর্ণ ভ্রু যুগল কুঁচকে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
'অনুমতি দিলে, আমি তোমাদের বন্ধুর সাথে থাকব।'
রোদেলা ভ্রু তুলে। জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
'আপনি কে?'
জুবিয়া দ্রুত হেঁটে তূর্ণর সামনে দাঁড়াল। কর্কশ গলায় বলল,
'আপনি এখানে আসছেন কেন?'
তূর্ণ একটু ঝুঁকে পড়ল জুবিয়ার দিকে। তারপর জুবিয়ার মাথার দিকে তাকিয়ে বলল,
'আমি তোমাকে এই অবস্থায় দেখব বলে এসেছি।'
রাগে ফেটে পড়ল জুবিয়া। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
'আপনাকে দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে মেহেদি দিয়েছি।'
মুখে হাসি নিয়ে বলল তূর্ণ,
'তাহলে আরেকটু দেওয়া উচিত ছিল।'
জুবিয়া কপট রাগী চোখে তাকাল। তূর্ণ হাসিমুখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
'মিস চিড়িয়াখানা তোমার কী গিফট পছন্দ হয়েছে?'
জুবিয়া বলল,
'আমি খুলিনি।'
অবাক হয়ে বলল তূর্ণ,
'প্যাকেটটা এখনো খোলোনি?'
'না। আমি আর কখনো খুলবও না।'
'কেন, কেন?'
জুবিয়া তাকে এড়িয়ে গেল।
সাদাফ বলল,
'উমা আপনি কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন? আপনি আমাকে পছন্দ করেন না?'
উমাইয়া ইতস্তত করে বলল,
'আমি আপনাকে ঘৃণা করি কখনো বলেছি?'
সাদাফ হেসে বলল,
'তাহলে কী ভালোবাসেন?'
উমাইয়া লাজুক হাসল। তারপর রোদেলার হাত ধরে ছাদ থেকে চলে যেতে নিল। সাদাফ গলা তুলে ডাকলো,
'উমা?'
আওয়াজ শুনে উমাইয়া ঘুরে তসকাল। সাদাফ মিষ্টি করে হাসল। তারপর বলল,
'কিছু না!'
.
.
.
চলবে...................................