একটি কর্মচঞ্চল দিনের পরেই আগমন ঘটে একটি সুন্দর বিকেলের। রোদের তেজ কমতে শুরু করে একটি স্বর্ণালি বিকেল তার মাধুর্য মাখিয়ে মনে দোলা লাগায়। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার রেস্ট্রন্টে আজকাল একটু আধটু সময় ব্যয় করছে আয়ান। সেমিস্টার পরীক্ষার জন্য এক সপ্তাহ তার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়নি। আজ রবিবার দিন শেষে বিকেলের এই সময়টাকে বেছে নিয়েছে আয়ান। এই সোনালী বিকেলটা সে তার প্রিয় মানুষটির সাথে কাটিয়ে বিশেষ মূহুর্ত তৈরি করবে। বিশেষ মূহুর্তটিকে আরও বিশেষ করে তুলতে আয়ান একটা ফুলের দোকানে ঢুকলো। প্রিয় মানুষ টির পছন্দ করা ফুল কিনে অমায়িক হাসি হাসল আয়ান। ফুটপাতের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েক বার ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আয়ান বিড়বিড় করে বলল,
' আশা করি তোমার ভালো লাগবে।'
আয়ান ওঁর কল্পনাপ্রবণ মনকে প্রশ্রয় দিতে লাগল। মন উৎসাহ দিচ্ছে, মনে মনেই হাজার কল্পনা জল্পনা আঁকছে। একটা রেস্ট্রন্টে প্রবেশ করল আয়ান। ফুলের তোড়াটা টেবিলের ওপর রাখে এরপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। অপেক্ষা করছে দশ মিনিট হয়ে গেল। আয়ান মনে মনে ছঁক আঁকতে লাগল, ঈশা আসামাত্র ওঁকে শক্তকরে আলিঙ্গন করবে। এতে অল্প হলেও ঈশার রাগ ভাঙতে সে সক্ষম হবে। ঈশা এলো প্রায় বিশ মিনিট পর, ঈশার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। এতদিন কোনোরকম যোগাযোগ করেনি আয়ান। এতেই সে ভয়ংকর রেগে আছে। রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করল আয়ান। ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এরপর ঈশার দিকে একটু এগিয়ে গেল। ঈশা হাত তুলে আয়ান কে থামতে বলল এরপর শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
' ব্রেকআপ।'
আয়ান বিস্মিত গলায় বলল,
' কীহ?'
ঈশা ভারী এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
' তোমার সাথে প্রেম করছি ছয়মাস হইছে। এই ছয়মাসে তুমি আমার জন্য করেছ টা কী? কিচ্ছু করো নি। শুধু দেখা করতে আসার সময় ফুল নিয়ে আসো। এই ফুল দিয়ে আমি করব টা কী? আমি তোমার থেকে ভালো পেয়ে গেছি। সে আমাকে সময় দেয়। আমার প্রয়োজনের দিকেও সে সচেতন। তোমার মতন সস্তা নয়।'
আয়ান নিস্তেজ গলায় বলল,
' তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না ঈশা। তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তাছাড়া খরচ করার জন্য বাবা আমাকে সেরকম টাকা দেয় না। এই অল্প টাকার ভেতর এর চেয়ে বেশি আমি কিভাবে করব? তুমি আমাকে সময় দাও আমি তোমার জন্য সব করব। তোমার যা প্রয়োজন সব কিনে দিব।'
ঈশা বলল,
' এখন আর দরকার নাই। আমি এখন আর তোমাকে ভালোবাসি না।'
আয়ান এগোল। ঈশার হাতখানা শক্ত করে ধরে বলল,
' তোমার কাছে কী টাকা-ই সব কিছু? আমার ভালোবাসা কিছু নয়?'
ঈশা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
' হ্যাঁ। টাকা-ই সব।'
আয়ান জড়ানো গলায় বলল,
' তোমার মতন মেয়েরা শুধু ছেলেদের টাকা-কেই ভালোবাসে। আমার মতন বেকার ছেলেদের মন, ভালোবাসা তোমাদের কাছে মাইনে রাখে না।'
ঈশা রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
' জানো যখন তো যাইয়া কামাই কর না, বেকার কোথাকার।'
.
.
দুপুরের পর রেস্ট্রন্টে এসে কাজে লেগে পড়ে জুবিয়া। কোনদিক দিয়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে টেরই পায়নি। কাস্টমার আজ বেশি এজন্য কাজ করে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরইমাঝে একজন ছেলে স্টাফ এসে জুবিয়াকে বলল,
' মাথা ঘোরাচ্ছে?'
জুবিয়া হালকা হেসে বলল,
' না। তেমন নয়।'
সে আবারও বলল,
' তোমার অর্ডার আমি নিয়ে নিচ্ছি। তুমি দশমিনিট রেস্ট করে এসো।'
জুবিয়া ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানালো। এরপর রেস্টরুমে এসে ঢুকতেই শুনতে পেল, ওর ফোন বাজছে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল আয়ান কল দিচ্ছে। কল রিসিভ করে হ্যালো বলতে যাবে তার পূর্বে আয়ান কান্না করে ফেলল। নাক টেনে বলল,
' এখন কোথায় তুই?'
' তোদের রেস্ট্রন্টে। কিন্তু তুই কি কান্না করছিস? কি হইছে?'
আয়ান বলল,
' আমাদের রেস্ট্রন্টের বিপরীতে একটা কফিশপ আছি। তুই প্লিজ চলে আয়।'
জুবিয়া কল কাটলো। আয়ান আজ ঈশার সঙ্গে দেখা করতে যাবে এটা জুবিয়া আগে থেকেই জানত। জুবিয়ার সঙ্গে আয়ানের বন্ধুত্ব এক বছর হলো। আয়ান সব ছেলের থেকে আলাদা, তার বাবার সম্পত্তি অনেক হলেও সে সব সময় সাধারণ গরিব ছেলেদের মতোই বড় হয়েছে। সামান্য ক'টা টাকা পকেটমানি দিয়ে মাস পাড় করে সে। মনের দিক থেকে সে নরম, ও ভীষণ ইমোশনাল। অন্যদের মতন কষ্ট বুকে চাপা রেখে হাসতে পারে না সে। ভীষণ কষ্ট পেলে কান্না করে বসে। আয়ানের এমন স্বভাবে মাঝেমধ্যেই বিরক্ত হয়ে উঠে জুবিয়া। তবে বন্ধু হিসেবে আয়ান ভীষণ ভালো। জুবিয়া তারাহুরো করে পোশাক পাল্টে নিল এবং চটজলদি রেস্ট্রন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। ত্রিশ মিনিট সময় ধরে আয়ানের সামনে বসে আছে জুবিয়া। আজ হাউমাউ করে কান্না করে এখন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছে। জুবিয়া আয়ানকে তার কান্না করার কারণ জিজ্ঞেস করার পরও জুবিয়া উত্তর পেল না। নির্বিকার চূড়ান্তে বসে রইল সে। এরপর ফোন বের করে উমাইয়া কে কল করল। তারপর রোদেলা কে কল করে জানালো, রোদেলা রেস্ট্রন্টের আশেপাশেই ছিল। এজন্য তারাতাড়ি আসতে পারল। রোদেলা জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল। রোদেলার সামনে কান্না করতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে আয়ানের সে টেবিলের নিচে মুখ নামিয়ে ফেলল।
রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
' আয়ান ভাইয়া আপনার কি হইছে? কান্না করছেন কেন?'
জুবিয়া কিঞ্চিৎ রাগান্বিত গলায় বলে উঠল,
' কি হইছে বল? না বলবে, কিভাবে বুঝব?'
উমাইয়া এসে পৌঁছালো প্রায় মিনিট দশেক পর। আয়ান এতক্ষণে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে নিয়েছে। অনেকদিন পর বন্ধুরা সব একসঙ্গে আছে। জুবিয়া ইচ্ছে হলো সবাই কে সে ট্রিট দিবে। সামান্য খাবার ও কোল্ড কফি অর্ডার করল।
রোদেলা বলল,
' আমি খাব না। আমার কাছে টাকা নেই।'
জুবিয়া বলল,
' টাকা লাগবে না। আমি খাওয়াচ্ছি।' বলে থামলো জুবিয়া। এরপর ঘুরে তাকালো উমাইয়ার দিকে। ধাতস্থ হয়ে বসে বলল, ' তোর বিল আমি দিবো না। তোর টা তুই দিবি।'
উমাইয়া কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে বলল,
' আমার সাথে এমন করছিস কেন?'
' কারণ তুই বিবাহিত।' বলল জুবিয়া।
এরইমাঝে গ্রাম থেকে কল এলো। রোদেলা কল উঠিয়ে প্রথমে সালাম দিল। ওপাশ থেকে সালামের জবাব নিলেন মাসুদ। শুরুতে রোদেলার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। অবশেষে মূল প্রসঙ্গে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
' যা বেতন পাইছস তাই তো পুরা পাঠাই দিছস মা। তোর ওখানে থাকতে সমস্যা হইব না?'
রোদেলা বলল,
' না, মামা। তুমি আমাকে নিয়ে টেনশন কোরো না। আমি এখানে ঠিক মতোই সার্ভাইব করতে পারব।'
মাসুদ বললেন,
' এখন কি করস মা? সন্ধ্যায় কিছু খাইছস?'
' না, মামা। উমাইয়া৷ জুবিয়া ও আয়ান ভাইয়ার সঙ্গে রেস্ট্রন্টে বসে আছি। আজ জুবিয়া আমাদের ট্রিট দিবে।'
মাসুদ হালকা হেসে বললেন,
' ঠিক আছে মা। নিজের খেয়াল রাখিস। এখন তাহলে রাখি?'
রোদেলা ইতস্তত করে বলল,
' মামা একটা প্রশ্ন করব?'
' হ্যাঁ। বল। কি প্রশ্ন?'
' মামা বিকাশে কত টাকা পাইছো? আমি তখন কত পাঠিয়েছি বুঝতে পারছি না। আমার জানা মনে ১১হাজার পাঠিয়ে ছিলাম। তুমি কত পাইছ?'
মাসুদ বললেন,
' এগারো হাজারই আসছে। আমি তখন কাজে ব্যস্ত ছিলাম রে মা তাই বিকালে কল দিতে পারি নাই।'
রোদেলা কল রেখে দিল। কিন্তু তার কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। তার ব্যাগে ১১ হাজার একশো টাকা ছিল। ১১ হাজার টাকা পুরোটা মামাকে পাঠালে এক হাজার টাকা ওর ব্যাগে কিভাবে এলো? কোথা থেকে এলো? কে রাখল? রোদেলাকে চিন্তিত দেখে আয়ান জিজ্ঞেস করল,
' রোদেলা? কি হয়েছে তোমার? কি ভাবছ এত?'
রোদেলা বিষ্ময় কাটিয়ে ওদের ঘটনাটি জানালো। জুবিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
' তোর ব্যাগ নিয়ে কেউ টাকা রাখবে আর তুই টের পাসনি?'
রোদেলা কোমল কণ্ঠে বলল,
' আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তখন হয়ত কেউ।'
আয়ান বলল,
' তুমি ঘুমিয়ে থাকলেও কেউ তোমার ব্যাগ হাতে নিয়ে টাকা রাখবে না। পকেটমার গুলো উল্টো টাকা নিয়ে যায়।'
রোদেলা কে এবিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখে উমাইয়া বলল,
' তোর হয়ত গোনাতেই ভুল হইছে। এসব বাদ রাখ। এখন খাওয়া শুরু কর। আমাকে আবার তোদের ভাইয়া নিতে আসবে।'
.
.
.
চলবে.....................................