তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ১৬ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


রৈনীলের খুব কাছাকাছি বসে আছি আমি, ওর শীতল দুই চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ওর দিকে তাকিয়ে ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই। রৈনীল কথা বলছে, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর কথা গিলে খাচ্ছি। একটা মানুষ এত সুন্দর করে কেন কথা বলে! 

হঠাৎ মা এসে আমার হাত টেনে ধরে বলল, বাসায় চল। মায়ের অগ্নিদৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমি রৈনীলকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললাম, আমায় নিয়ে চলুন এখানে থেকে। প্লিজ। রৈনীল স্তব্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে আছে। আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে না। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমি স্বপ্নের ভেতর আছি। এটা নিছক একটা স্বপ্ন। এক্ষুনি ভেঙে যাবে ঘুম। আমি চাইছি আরো কিছুক্ষণ রৈনীলকে নিয়ে বসে থাকতে। কিন্তু মা বারবার এসে হাজির হচ্ছে। এমনই দোলাচলের মধ্যে আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো।

ফোন হাতে নিয়ে দেখি সবেমাত্র সারে চারটা বাজে। স্বপ্নে কাউকে খুব কাছ থেকে দেখলে সেই রেশটা অনেক্ষণ রয়ে যায়। রৈনীলকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখার পর থেকে ওকে আমার খুব আপন মনে হচ্ছে। স্বপ্নের শেষ দিকে এসে এইযে আমরা বুঝতে পারি এটা স্বপ্ন, চাইলেই আমি এখন জেগে উঠতে পারবো - এই বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। দুঃস্বপ্ন হলে ঘুমের ভেতরই সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠতে ইচ্ছে করে। স্বপ্নের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অথচ আজ ঘুম ভাঙার পরও কেন যেন মনে হচ্ছে, স্বপ্নটার ভেতর আমি খুব আনন্দে ছিলাম। আরো কিছুক্ষণ এই স্বপ্নটা চলতে পারতো। 

আমার মনে হলো আবার ঘুমিয়ে পড়লে আমি বোধহয় স্বপ্নটা আরো কিছুক্ষণ দেখতে পারবো। তাই চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম। আমার কল্পনা দিয়ে স্বপ্নকে আনতে চাইলাম। কিন্তু বেশীদূর এগোতে পারলাম না। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। 

ভার্সিটিতে এসেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। সারাদিন স্বপ্নের রেশ আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো। আমি সময় পেলেই নিজের ফোনের স্ক্রিনে ঘোরাঘুরি করি। নতুন নতুন এপস ডাউনলোড করি, ফোনের কোথায় কী আছে সব দেখি। 

রাত নামতেই আমার ইচ্ছে করতে লাগলো একবার রৈনীলকে কল দিই। পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে আমার কেন তার সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে, আমি জানিনা এর কারণ!

সে আবার ভেবে বসবে আমি তার প্রেমে উন্মাদ হয়ে গেছি। তাই অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সংযত করলাম। সেদিন রেস্টুরেন্টে ওর কথাগুলো ভেবে একইসাথে হাসি আর রাগ দুটোই হচ্ছে আমার। 

কয়েকদিন পরে স্বাগতা আপু এসে দাওয়াত দিয়ে গেলো। ওদের বিবাহবার্ষিকী। শুধু কাছের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসবে। ভাইয়া আর আমি যেন গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে আসি। আমি ইনিয়ে বিনিয়ে রৈনীলের কথা জানতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু লজ্জায় সেটা পারছি না। এখন সায়েমই ভরসা। । 

বললাম, সায়েম নামক লোকটা আসবে নাকি? উনি গেলে আমি যাবোনা।
'সায়েম আসবে না।'
'আর কে কে আসবে?'
'আমাদের কিছু ক্লোজ ফ্রেন্ড।'
'নাম কি তাদের?'

স্বাগতা আপু ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়, 'বললাম তো সায়েম আসবে না। আর কি জানতে চাচ্ছিস?'
'আর কে কে আসবে সেটা। ফ্রেন্ডরা কি শুধু ছেলে নাকি মেয়ে?'
'শুধু মেয়ে।' 

আমি সম্ভবত কিঞ্চিৎ হতাশ হলাম। রৈনীলকে আশা করেছিলাম। নিজের রুমে এসেছি, ঠিক তখন স্বাগতা আপু এসে বললো, 'ছেলে ফ্রেন্ডও আছে। মায়ের সামনে বলতে চাচ্ছিলাম না। ছেলেরা আসবে শুনলে মা তোকে যেতে দিতো না।'
'ওহ আচ্ছা। থ্যাঙ্কিউ।'

স্বাগতা আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, 'তোকে আমি অনেক ভালোবাসি বোন। তুই রাগ করেছিস তাই আমি সায়েমকে ইনভাইট করিনি। শুধু তোর জন্য। যাতে তুই আসিস। আমি জানি, ও আসলে তুই আসবি না।'
'শুধু আমার জন্য ওকে দাওয়াত দাওনি?'
'হুম।'
'তাহলে আমার জন্য আরেকটা কাজ করবা?'
'কি?'
'রৈনীল ভাইয়াকে আসতে বলবা? ওনার সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলবো। লোকটা এত ট্যালেন্টেড। ওনার কাছে কিছু থিওরি জানার আছে আমার। ওনার বইগুলো নিয়েও কথা বলা দরকার।'
'আচ্ছা ঠিক আছে। রৈনীল আসবে কিনা জানিনা। হি ইজ ডিফ্রেন্ট। তবে। তবে বলবো।'
'আবারও থ্যাংকস সায়েমকে দাওয়াত না দেয়ার জন্য।'

আপু খুশি হলো। শেষের থ্যাংকসটা আমি এভাবে বলতে চাইনি। মূলত বলতে চেয়েছিলাম রৈনীলকে আসতে বলার জন্য থ্যাংকস। কিন্তু সেটা তো আর আপুকে বলা যায় না। তাই এভাবে বলে দিলাম।

ক্লোজেট ঘেঁটে নিজের সবচেয়ে সুন্দর জামাটা খুঁজে নিলাম আমি। জামার সঙ্গে ম্যাচিং কানের দুল, জুতা সবকিছু হাতের কাছে রাখলাম। কিছুদিন আগে মা একটা হেয়ারপ্যাক এনেছিল আমার জন্য। কখনো এসব প্যাক ট্যাক লাগাতে আমার ভালো লাগে না। আজকে কী ভেবে সেই প্যাকটা খুঁজে বের করলাম। ওয়াশরুমে বসে বসে প্যাক লাগালাম চুলে। 

মা যদি দেখে ফেলে তাহলে সন্দেহ করতে পারে। ভাববে আমি সায়েমের জন্য রূপচর্চা করছি। তাই ওয়াশরুমেই দাঁড়িয়ে রইলাম হেয়ারপ্যাক লাগিয়ে। অন্যান্য দিন এতক্ষণ সময় ওয়াশরুমে থাকতে নিশ্চিত বিরক্ত হতাম। আজ কেন জানিনা আমার বড্ড খুশি খুশি লাগছে। শরীর জুড়ে এক ধরনের আলোড়ন। 

শুধু জামাটা পরে, কোনোমত চুলগুলো আচড়ে আমি ভাইয়ার সঙ্গে রওনা দিলাম স্বাগতা আপুর বাসায়। বের হওয়ার সময় মা আমাকে বললেন, আরেকটু পরিপাটি হয়ে যাও। 
'কিভাবে মা?'
'মুখে একটু ক্রিম পাউডার কিছু লাগাও।'
'ওসব লাগালে তুমি আবার কি ভাবো সেজন্য লাগালাম না।'

মা খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। 

আপুর বাসায় পৌঁছেই আমি ওর কাছে বায়না করলাম, আমাকে সাজিয়ে দাও আপু। ওই ট্যুরের দিনের মতো করে। ওইদিন আমার নিজেকে দেখতে এত্ত কনফিডেন্ট লাগছিলো!

রান্নাবান্নার ব্যস্ততার মধ্যেও আপু আমাকে সাজিয়ে দিলো। আমি পুরো বাড়ি ঘুরঘুর করতে লাগলাম। রৈনীলের সঙ্গে আজকে আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলবো না। পাত্তাই দিবোনা ওকে। দেখি সে আমাকে কতটুকু গুরুত্ব দেয়!

ধীরেধীরে সবাই আসা শুরু করলো। টেবিলে ব্যুফে স্টাইলে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। আঠারো পদের খাবার। যার যেটা ভালো লাগবে, সেটা নিজে নিয়ে খাবে। 

আমি এখনো কিছুই খাইনি। খেতে গেলে লিপস্টিক বা সাজ হালকা হয়ে যাবে সেই ভাবনায়। এদিকে খিদে পেয়ে গেছে। কিন্তু রৈনীল কেন আসছে না এখনো? সে কি তাহলে আসবে না!

অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। গান, নাচের আসর বসেছে। খাওয়াদাওয়া সবার প্রায় শেষ। আপু আমাকে জোরাজোরি করতে লাগলো কিছু খাওয়ার জন্য। বাধ্য হয়ে একটা প্লেট হাতে নিয়ে আমি খাওয়া আরম্ভ করলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। রৈনীল হয়তো আসবে না। সামনে যা দেখছি, সব তুলে নিয়ে প্লেটটা ভরিয়ে ফেললাম। 

খাবার মুখে দিয়েছি এমন সময় রৈনীল এসে দাঁড়ালো!

কোনোমত নিজেকে সামলে নিলাম আমি। ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, কি অবস্থা বিজয় সরণী?

আমি খাবার মুখে নিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। 

'আস্তে খাও। পানি খাও পানি।'

সে এত পানি খেতে বলে কেন আমাকে? আশ্চর্য! রৈনীল জুবায়ের ভাই ও স্বাগতা আপুকে শুভেচ্ছা জানাতে গেছে। আমি দ্রুত খাবারটা শেষ করার চেষ্টা করছি। এরমধ্যে সে এসে নিঃসংকোচে একটা প্লেটে কিছু খাবার তুলে নিলো। বললো, একা একা খাচ্ছো। আমিও সঙ্গে যোগ দেই কি বলো?
আমি স্মিত হাসার চেষ্টা করলাম। রৈনীল বললো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছো কেন? চলো ওদিকে গিয়ে বসি।

ওদের গানের আসর থেকে অনেকটা দূরে পাশাপাশি রাখা দুটো চেয়ারে এসে বসলাম আমরা। রৈনীল বললো, এতগুলো খাবার পারবে খেতে?
'আমি অনেক ক্ষুধার্ত।'
'তবে খাও। খাবার নষ্ট করোনা।'

আমার আর খাওয়া! রৈনীলকে সামনে বসিয়ে কি সেটা আদৌ সম্ভব? কোনোমত ছোট ছোট করে খাবার গিলছি। উপভোগ তো দূরে থাক। 

রৈনীল বললো, 'তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তুমি যে এত ছোট, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সাতাশ আটাশ বছর বয়স।'
'সাজলে কি মানুষের বয়স এত বাড়ে?'
'সাজের জন্য না। হয়তো ড্রেসটাই এমন। তুমি কি রাগ করলে সরণী? আই এম সরি। আমি আসলে অন্যকিছু বোঝাতে চাইনি।'
'না রাগ করিনি। সাতাশ আটাশ বছরের মেয়ে হতে পারলে আমার ভালোই লাগতো।'
'তাই? কেন?'

আমি স্মিত হেসে বললাম,'তখন আমি অনেক ম্যাচিউর আর ক্যারিয়ারে সেটেল্ড হয়ে যেতাম।'

রৈনীল শব্দ করে হাসলো। কিন্তু আসল সত্যি এটা নয়। বরং সত্যিটা হলো, সাতাশ আটাশ বছরের মেয়ে রৈনীলের বয়সের কাছাকাছি। তাই নিজেকে অমন ভাবতে ভালোই লাগছে আমার। কেন যেন আমার আর ছোট থাকতে ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে ছোট হওয়ার কারণে রৈনীল আমাকে বড়দের মতো ভাবতে পারছে না। 

রৈনীল বললো, 'বইগুলো পড়া শেষ?'
'প্রায়। একটা বাকি আছে। আমি কিছু নোটস করেছি। ওগুলো নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করবো।'
'আজকে থাক। আজ আমার আলাপের মুড নেই।'
'কেন?'
'এমনি।'

রৈনীলের খাওয়া শেষ। সে শুন্য প্লেট নিয়ে বসে আছে। আমি বললাম, 'আপনি কি খাবেন না আর? কিছু নিয়ে আসুন?'
'আর খেতে ইচ্ছে করছে না।'
'আপনার কি আজকে মন খারাপ?'
'কাজের প্রেশারে আছি। একটা প্রজেক্ট নিয়ে খুব স্ট্রেস যাচ্ছে।'
'ইস। আমার কাজের প্রেশার ভালো লাগে।'
'তুমি কাজ করেছো নাকি অফিসে?'
'না। মানে কারো প্রেশার যাচ্ছে শুনলে ভালো লাগে। ওয়ার্ক লাইফটা নিঃসন্দেহে সুন্দর। কত তারাতাড়ি নিজে কর্মব্যস্ত হবো সেটা ভাবি।'
'ক্যারিয়ার নিয়ে এত অল্প বয়সেই ভাবনা থাকা ভালো।'
'অল্প কোথায়? আপনি না বললেন আমার বয়স আটাশ?'

রৈনীল উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। ওর হাসির শব্দে গান বন্ধ করে সবাই আমাদের দিকে তাকালো। রৈনীল তাতে একটুও সংকোচ বোধ করলো না। কিন্তু আমি লজ্জায় মরে যাই যাই অবস্থা। কোনোমত খাবারটা শেষ করে আমি লিভিং রুম ত্যাগ করলাম। অন্য একটা রুমে এসে বসে রইলাম আমি। 

রৈনীলকে টেক্সট দিলাম, 'কোথায় আপনি?'
'আড্ডায়।'
'এদিকে আসবেন?' 

অনেক্ষণ কোনো রিপ্লাই নেই। আমি অপেক্ষা করছি। কোনো উত্তর এলোনা। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে এবার বসে রইলাম। এমন সময় রৈনীলের কল এলো।
রিসিভ করে বললাম, হুম।
'কোনদিকে আসবো?'
'ডানে। প্রথম রুমটাতে।'
'রুমে?'

আমি লজ্জা পেলাম। যদিও সে স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করেছিল। বললাম, বাইরে যাচ্ছি। 

আপুর বাসাটা এত বিশাল যে, চাইলেই যেকোনো জায়গায় আরাম করে বসা যায়। রৈনীল এগিয়ে আসতেই আমিও খানিকটা সামনে এগিয়ে এলাম। রৈনীলকে আগের চাইতে স্ট্রেস ফ্রি দেখাচ্ছে। 

দুজনে মৃদুপায়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা কমন স্পেসে এসে বসলাম। এখানে বড়সড় একটা বেতের ডিভান রাখা। বেশ আরামদায়ক। দুজন দু'দিকে বসতেই দূর থেকে গান ভেসে আসলো। হয়তো কেউ এখন ডান্স করছে।

রৈনীল বললো, 'তোমার কি মানুষজন, আড্ডা, এসব একেবারেই অপছন্দ?'
'হুম।'
'তাহলে তো এরকম প্রোগ্রামগুলো তোমার জন্য কষ্টের।'
'কষ্ট না। আপনার সঙ্গে গল্প করতে ভালোই লাগছে।'
'আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে?'
'তখন আসলে কোনোকিছু বোঝারই অবকাশ পাইনি। সবসময় মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় যেতাম।'
'হুম। আমার একটা সিগারেট খাওয়া দরকার।'
'ধরান।'

রৈনীল অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো। চোখের ভাষাটা এমন - 'তোমার অসুবিধা হবেনা?'

আমি বললাম, 'ধরান। আমি কিছু মনে করবো না।'

রৈনীল আমার চোখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আমি টের পেলাম ক্ষণিকের জন্য আমার হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল!
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp