অতিথি নিবাস - পর্ব ০৮ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


মাসুদ উদ্দিন তাকিয়ে আছেন। সামনেই বিছানায় শান্ত বসা। তার পায়ে ব্যান্ডেজ। ডান পায়ের হাঁটুর নিচে অনেকটা মাংস ছিলে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় শান্ত ছটফট করছে। কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করতে চাইছে না। শান্তর পাশে তৌহিদ বসা। আরহান রান্না ঘরের দিকে গেছে। মাসুদ উদ্দিন বললেন,
 “কি করে হলো?”

তৌহিদ উত্তর দিল,
 “আর বলবেন না আঙ্কেল বেখেয়ালিভাবে কাজ করতে গিয়ে পায়ে গরম পানি পড়েছে।”

মাসুদ উদ্দিন দু'পা এগিয়ে গেলেন। ফাবিহা আর রাহেলা দরজার কাছ দিয়ে দাঁড়ানো। ফাবিহার চোখ বুঝি আরহানকে খুঁজচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত। তবুও ফাবিহা খুঁজছে। আরহানের দেখা পাওয়া গেল। গায়ে জড়ানো কালো রঙের শার্টটা ঘামে ভেজা। আরহান বলল, “আঙ্কেল আপনি?”

এরপরই দৃষ্টি গেল ফাবিহার দিকে। ফাবিহা তাকিয়ে থাকায় চোখাচোখি হলো দুজনের। মাসুদ উদ্দিন বললেন, “দেখতে এলাম। ভালো জখম হয়েছে নিশ্চয়ই?"

আরহান খাটে বসল। মাসুদ উদ্দিনকেও বসতে বলল। তিনিও বসলেন। আরহান বলল,
 “তা একটু হয়েছে তবে ডাক্তার বলেছে বেশি ভয় পাওয়ার দরকার নেই।”
 “যাক আল্লাহ ভরসা। তা রাতের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছ তোমরা?”

বিপাকে পড়ল তিনজনই। রাতের রান্না করা হয়নি। আরহান, তৌহিদ, শান্ত একে-অপরের দিকে তাকাল। মাসুদ উদ্দিন আবার বললেন,
 “কথা বলছ না যে?”

শুঁকনো হাসল আরহান। বলল,
 “হয়নি। তবে চিন্তা নেই আঙ্কেল আমরা একটা ব্যবস্থা করে নিব।”

মাসুদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। আদেশস্বরূপ কণ্ঠে বললেন, “করতে হবে না। আমি রাহেলাকে দিয়ে খাবার পাঠাচ্ছি। আর আগামী কিছুদিন তোমাদের রান্না-বান্না করতে হবে না। আমার বাড়ি থেকেই তোমাদের জন্য খাবার আসবে।”

আরহান সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করল,
 “না আঙ্কেল এমনটার প্রয়োজন নেই।”
 “তুমি ভুলে যেও না আরহান আমি তোমার আঙ্কেলের আগে স্যার হই।”

মাসুদ উদ্দিনের এক কথায় চুপ হয়ে গেল আরহান। আর কিছু বলতেই পারল না।

•••••••••••••••

রাত তখন বারোটা। ফাবিহা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার হঠাৎ মনে হলো সেদিন হাসান মাহবুবের বইটা পড়ে শেষ করার কথা থাকলেও শেষ করা হয়নি। প্রথম একলাইন পড়েই নাস্তা খেতে চলে গিয়েছিল এরপর আর তালে তালে ধরা হয়নি। ফাবিহা ঘড়ির দিকে তাকাল বারোটা দুই। এ রাতে বই পড়াটা খুব একটা আকস্মিক ব্যাপার নয়। তবুও ফাবিহার ইচ্ছে করছে না। সে বিছানায় শুইল। এর ঠিক কিছুক্ষণের পরেই কল্পনায় আরহান হাজির। ফাবিহা অবাক হয়। তবুও চোখ খোলে না। উল্টো সে বলে ওঠে,
 “আপনি আমার বলা গানটা কেন ছাড়লেন না আরহান?"

আরহানের বিস্ময়কর চাহনি। ভরাট কণ্ঠস্বর,
 “নাম না বলা কলটা তাহলে আপনার ছিল?”

ফাবিহা কথা বলে না। আরহান বলে,
 “আমি কি করে জানব ওইটা আপনি ছিলেন?"
 “কণ্ঠস্বর চেনা যাচ্ছিল না তাই না?”
 “একদমই না। রুমাল বেঁধে নিয়েছিলেন নাকি?”
 “কি করে বুঝলেন?”
 “প্রিয়জনদের সাথে কণ্ঠ বদল করতে আমরা এমনই করি।”
 “আপনি আমার প্রিয়জন নন আরহান।”
 
আরহান হাসে। দারুণ সুন্দর দেখায় সেই হাসি। বলে,
 “সত্যিই কি তাই?”
 “হ্যাঁ তাই। এখন বলুন গানটা ছাড়লেন না কেন?”
 “আসলে আচমকাই শান্তর এমন এক্সিডেন্টের কথা শুনলাম যে সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে এসেছি।"
 “বন্ধুদের খুব ভালোবাসেন তাই না?"
 “হুম। তেমনইটাই।”
 “আপনি বড়ই সুন্দর করে কথা বলেন।”
 “জানি আমি।”
 “সবাই বলে?”
 “হ্যাঁ। তেমনটাই।”
 “আমি তো আপনায় কল্পনা করছি সত্যি মনে হচ্ছে কেন?”

আরহান এগিয়ে গেল। কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল,
 “আরহানের প্রেমে পড়বেন না রৌদ্রময়ী, সে যে আপনার ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারবে না।”

আকস্মিক চোখ খুলে গেল ফাবিহার। মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। রুম জুড়ে বাতি জ্বলছে। ফাবিহা লাইট বন্ধ করে দিল। এসব কি ভাবছিল এতক্ষণ! ফাবিহা প্রচুর কল্পনাপ্রবণ মানুষ। জীবনে কিছু হলেই সে কল্পনায় অনেককিছু ভেবে ফেলে। কিন্তু আজ যা ভাবল তা একদমই কাম্য ছিল না। যত যাই হোক ফাবিহা আরহানকে ভালোবাসে না। একদমই বাসে না। কিন্তু আরহান কেন বলল, 'সে ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারবে না। কেন পারবে না!'

••••••••••••••

ক্লাসরুমে গালে হাত দিয়ে বসে আছে মোহনা। সামনেই তৌহিদ তাদের পড়াচ্ছে। মোহনার দৃষ্টি তৌহিদের দিকে থাকলেও তার মনোযোগ অন্য কোথাও। সামনে তার বোনের বিয়ে। প্রায় পনের বিশদিন বাকি। মোহনা আজ থেকেই ভাবা শুরু করে দিয়েছে বিয়েতে কি কি করব! দুলাভাইর বন্ধু-বান্ধব, ভাই সবাইকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়বে, জুতা চুরি করবে, গেটে দাঁড়িয়ে কত টাকা চাইবে, কি পড়বে, কিভাবে সাজবে এসব নিয়ে গভীর ভাবনায় আঁটকে আছে মোহনা। তৌহিদের দৃষ্টি তার দিকে গেলেই তৌহিদ বলে উঠে,
 “এই মেয়ে দাঁড়াও।”

মোহনা দাঁড়াল না। কারণ তার মনোযোগ তো ওদিকে নেই আছে অন্যকোথাও। মোহনার পাশে বসা বেলি ডাকল মোহনাকে। খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, “মোহনা, স্যার তোকে দাঁড়াতে বলেছে।”

মোহনার তখনও হুঁশ আসে না। তৌহিদ বিষয়টা লক্ষ্য করে বেলিকে চোখের ইশারায় ডাকতে বারণ করল। বেলিও ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেল। তৌহিদ ভীষণ রাগী প্রকৃতির মানুষ। সেটা ক্লাসের প্রথমদিনই সবাই বুঝতে পেরেছিল। বেলিদের সামনে বসা নাদিয়া মেয়েটা একটু ন্যাকামো টাইপের। প্রথমদিনই তৌহিদের সাথে ন্যাকামি শুরু করে দেয়। টেনে টেনে কথা বলে। তৌহিদ ভেবেছিল প্রথমদিন কোনোরূপ ঝামেলা করবে না। রাগারাগিও করবে না। কিন্তু না ওই মেয়ের ন্যাকামো তার সহ্য হচ্ছিল না বলে সে কি উচ্চস্বরে ধমক। প্রথম দিনই মেয়েটাকে ভার্সিটি থেকে বের করে দেয়ার হুকুম দিয়ে বসে। ব্যস সেই থেকেই ক্লাসের সব ছেলে মেয়েরা বুঝে গেছে তৌহিদ ঠিক কেমন টাইপের স্যার।'

তৌহিদ এগিয়ে আসলো। মোহনা তখনও ধ্যান মগ্ন হয়ে বসা। তৌহিদ সামনে দাঁড়িয়ে আবার বলল, “এই মেয়ে দাঁড়াও।”

মোহনা দাঁড়াল না। তৌহিদের রাগ উঠল। তার হাতে ছিল কলম। সে মোহনার বেঞ্চিতে দু'বার বারি মারল। এবার হুঁশ ফিরল মোহনার। চোখের সামনে তৌহিদকে দেখে হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়াল। মিনমিনিয়ে কণ্ঠে বলল,
 “স্যার আপনি?”
 “পড়ার সময় মনোযোগ কোথায় থাকে?”
 “না মানে স্যার।”

তৌহিদের ক্ষিপ্ত মেজাজ,
 “চুপ করুন। কাউকে নিয়ে ভাবতে হলে বাসায় বসে ভাববেন। এটা ক্লাসরুম– আপনার ভাবনার শহর নয়। পড়াশোনা করতে ইচ্ছে না করলে বাবা-মাকে বলবেন বিয়ে দিয়ে দিতে। শুধু শুধু আমার এবং আপনার সময় নষ্ট করবেন না।”

মোহনার চোখে পানি আসার উপক্রম। তবুও নিজেকে যথা সম্ভব শক্ত রাখার চেষ্টা করল। সে দূর্বল নয়। তবুও তৌহিদের কথায় খুব খারাপ লাগছে। তৌহিদ আরো বলল,
  “বাকি ক্লাসটুকু আপনি দাঁড়িয়ে করবেন। যদি আবারও দেখি মনোযোগ নেই। তাহলে কান ধরতে হবে।"

কথা বলে চলে গেল তৌহিদ। মোহনা বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আচমকা কি ঘটে গেল! পুরো ক্লাসের সদস্যদের দৃষ্টি তখন মোহনার দিকে।'

মোহনার দু'বছরের ক্লাসে কখনো এভাবে কেউ অপমান করেনি। সে বিনাবাক্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এবং পণ করল আজকের পর তৌহিদ স্যারের ক্লাস সে কোনোদিনও করবে না। লোকটা চরম খারাপ এভাবে রাগারাগি করার কি ছিল? মানছে ভুল করেছে তাই বলে এভাবে বলবে। মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মোহনা। তৌহিদ একপলক মোহনার দিকে তাকিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিল।

••••••••••••••

টেবিলের কাছে বসে আছে শান্ত। ডাইরিতে কি যেন লিখছে! শান্ত ডায়েরি লিখতে পছন্দ করে। পায়ের যন্ত্রনা কালকের থেকে একটু কমেছে। আরহান সাওয়ার নিয়ে বের হলো। তখন দুপুর দু'টো বাজে। আরহানকে বের হতে হবে। তৌহিদেরও আসার সময় হয়ে গেছে। তৌহিদ আসলেই আরহান বের হবে। তৌহিদ তার মাথা মুছতে মুছতে বলল,
 “তুই আবার টেবিলে বসছিস কেন?"

শান্ত উত্তর দিল না। দরজায় নক করার শব্দ পাওয়া গেল তখন। আরহান দরজার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, “কে?”

রাহেলার কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে,
 “ভাইজান আমি।”

শান্তও তাকাল তখন। রাহেলা ভিতরে ঢুকল। হাতে তার খাবারের ট্রে পিছনে রিনা বেগম দাঁড়িয়ে। আরহান তাকে দেখেই এগিয়ে গেল। বলল,
 “আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আসুন ভিতরে আসুন।”

রিনা বেগম ভিতরে ঢুকলেন। স্বামীর এই তিনটে ছেলে ব্যাচেলার ভাড়া দেয়া তার এখনও পছন্দ হয়নি। তবুও কি করার! রিনা বেগম বললেন,
 “শুনলাম তোমাদের মধ্যে কার নাকি পা পুড়েছে?”

আরহান কিছু বলার আগেই রাহেলা বলল,
 “ওই চাচি উনি। শান্ত ভাইজানে।”

রিনা বেগম চাইলেন। অবাক হয়ে বললেন,
 “পা ব্যাথা নিয়ে টেবিলে বসে আছো কেন? খাটে আসো দ্রুত।"

আরহান এগিয়ে গিয়ে শান্তকে খাটে বসিয়ে দিল। তার কাছে মনে হচ্ছে রিনা বেগম ধমক দিয়ে কথা বলছেন। রাহেলা খাবার ট্রে– টা টেবিলে রাখল। সে শুনেছে আরহান দুইটা তিনটার মধ্যে বেরিয়ে যায়। তাই তো এত তাড়াহুড়ো করে খাবার নিয়ে আসা। সেই মুহূর্তে তৌহিদের কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে,
 “আমি চলে এসেছি আরহান। তু..."

পুরো কথা শেষ হয় না। রিনা বেগমকে দেখে স্মিথ হাসে। আরহান বলে,
 “উনি মাসুদ আঙ্কেলের ওয়াইফ রিনা আন্টি।”

তৌহিদ সালাম দিল। রিনা বেগমও উত্তর দিলেন। এরপর বললেন,
 “তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। সবাই খেয়ে নিও। কম পড়লে অবশ্যই জানাবে।”

তৌহিদকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন রিনা বেগম। রাহেলা তখনও দাঁড়িয়ে। সে বলে, “খাইয়া নিয়েন ভাইজানেরা। চাঁচি চেঁচামেচি করলেও এমনিতে খুব ভালা। হইছে কি আমার ডায়না আপার জন্য চাচি আপনে গো পছন্দ করে না। তাই খবরদার আমার আপার দিকে নজর দিবেন না।"

কথাটা বলেই চলে গেল রাহেলা। বাকি তিনজন একে অপরের দিকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছিল কোনো এক কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ।

•••••••••••••

বারান্দায় বসে বই পড়ছিল ফাবিহা। সে আজও ভার্সিটি যায়নি। সারা সকাল বসে বই পড়েছে। চমৎকার বই। এই বইয়ের সবচেয়ে বিশেষ যে আকর্ষণ ছিল তা হলো উপন্যাসের নায়ক নায়িকাকে 'রৌদ্রময়ী' বলে ডাকে। নামটা শুনে ফাবিহার সে কি বিস্ময়সূচক চাহনি। তার বার বার মনে হয়েছে হাসান মাহবুব আসলে আরহান। কারণ এই রৌদ্রময়ী নামটা ফাবিহা আরহানের মুখেই শুনেছিল আগে। এবং প্রথমবার। যেহেতু ফাবিহা বইটার প্রথম মুদ্রণ কিনেছে। সেহেতু বইটা প্রকাশ হওয়ার আগে নামটা সম্পর্কে কারো জানা সম্ভব নয়। তার মানে– তার মানে আরহানই হাসান মাহবুব। ফাবিহার ভাবনার মাঝেই অতিথি নিবাস থেকে আরহান বের হলো। গায়ে জড়ানো মেরুন রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট। চুলগুলো সুন্দর মতো গোছাল। ফাবিহা বইয়ের সমাপ্ত পাতায় চোখ বুলাল যেখানে চার লাইনের ছন্দে লেখা–
  ❝আমি বইয়ের ভাঁজে গল্প খুঁজি
          গল্পের মাঝে প্রেম।
  অথচ, দিন শেষে তারাও বুঝায়
আমরা শুধুই একটা ফ্রেম।❞
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp