পূর্ণিমা সন্ধ্যা - পর্ব ০৯ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


বিশাল আকাশের নিচে ঢাকার এক শান্ত গলির শেষ মাথায় অবস্থিত বাড়িটির ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অরণী। পরনে খয়েরি পাড়ের ধূসর শাড়ি। চুলগুলোয় বেনি গেঁথে বাঁ পাশে এনে রাখা। অলংকার বলতে আছে পায়ে একজোড়া নূপুর আর হাতে কিছু আংটি। কানে ছোট্ট টপ। 

ইফতি এগিয়ে এসে পাশাপাশি দাঁড়াল অরণীর। তার হাতে কফির মগ। ঠোঁটের কোণঠাসা এক অদৃশ্য হাসি। চোখ আড়াআড়িভাবে এসে পড়ছে অরণীর আপাদমস্তকে। সে ভেবে পায় না, একটা মানুষের রুচিবোধ এত চমৎকার কী করে হতে পারে! আজ অবধি যতবার অরণীকে দেখেছে সে, তার আভিজাত্যপূর্ণ সজ্জাহীন বেশভূষায় মুগ্ধ হয়নি, এমনটা বিরল। এমন কখনও হয়নি যে অরণী নিজেকে বিশেষ দেখানোর জন্য সেজেছে। অথচ তার এই অবিশেষ ধরনটাই তাকে সকলের তুলনায় বিশেষ করে এনেছে ইফতির নজরে। ইফতি কফির মগে দ্বিতীয় চুমুক লাগিয়ে এ কথা স্বীকার করল—মেয়েটা নিজেকে অভিন্ন করতে চায় না অন্যদের থেকে, আর এই দিক থেকেই সে নজরকাঁড়া। 

অরণী তাকাল ইফতির দিকে,
-“ইফতেখার, কী চাইছেন আপনি?”

তৃতীয় চুমুকে ঠোঁট পুড়ল। কী চাইছে মানে? জ্বালাপোড়ায় সে দু ঠোঁট চেপে নিল, ছোট ছোট চোখে তাকাল অরণীর দিকে। সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“শুনলাম তুমি না-কি ইটিশপিটিশ করতে চাইছ?”

করিম চাচা! অরণী মনে মনে নিজের কপাল চাপড়াল। কী সুন্দরভাবে করিমচাচা এভাবে বলে ফেলেছে লোকটাকে! ইটিশপিটিশ! ইশ! কী সাংঘাতিক শব্দ! অরণী তখন কীভাবে যে বলেছিল, ‘ইটিশপিটিশ করব, আপনে করবেন?’
এ কথাটা অমন মুরুব্বি লোককে কী করে অরণী বলল! এ-ও তো চরম লজ্জাজনক বিষয়। 

বড়ো করে শ্বাস টেনে অরণী লজ্জা লুকিয়ে বলল,
-“ভুল শুনেছেন।”
-“আচ্ছা?”
-“হ্যাঁ।”
-“কিন্তু আমি তো ইটিশপিটিশ করতে চাই।”

বলে কী লোক! অরণী বাঁ দিকে ঘুরে ইফতির দিকে তাকাল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
-“ইটিশপিটিশ কী—বলেন তো?”
-“ফ্লার্ট করা। যেটা তুমি আমার সাথে করতে আগ্রহী।”

কী অভদ্র জবাব! উত্তরটা দিয়ে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেল ইফতি। সেই সঙ্গে সামান্য বাঁকানো হাসি তার ঠোঁটের একপাশে খুব করে লক্ষ করা গেল। অকস্মাৎ অরণী টের পেল, ইফতি সুদর্শন বটে!

অরণীর থমকানো নজর অবলোকন করে ইফতিও থেমে গেল অদ্ভুতভাবে। সময়ের স্রোত বেহিসাবি এগোতে লাগল। ততক্ষণে নিঝুম প্রকৃতিতে কিছু পাখির মিষ্টি রকমের কলতান শোনা যাচ্ছে কেবল। গাঢ় বাদামি রঙের চোখের মনির দিকে স্থির তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা ইফতি বলে উঠল,
-“আমি বোধহয় তোমাকে ভীষণভাবে নিজের করে চাইছি।”

অরণীর প্রেম-হৃদয় এ বাক্য শুনে তৎক্ষনাৎ স্পন্দনশীল হয়ে গেল, পরমুহূর্তেই ত্রুটিপূর্ণ বাক্যের উপলব্ধিতে প্রেম-প্রেম ভাবটা পায়রা সেজে আকাশে উড়াল দিলো। কঠিনগলায় বলল,
-“বোধহয়? অনিশ্চিত?”

খুঁতখুঁতো স্বভাবের অরণীর সামনে এমন ভুল কী করে যে হলো ইফতির, তা বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গেল সে। অবিলম্বে নিজেকে শুদ্ধ করে বলে উঠল,
-“আমি যত্ন করতে জানি। আমি ভালোবাসতে জানি। আমি যত্ন করে ভালোবাসতে জানি।”

ইফতি থামল, ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল অরণীর দিকে, ছোট্ট করে বলল,
-“নিশ্চিত আমি। অনিশ্চয়তা নিয়ে আর যাই হোক কাউকে নিজের করে চাওয়া যায় না। অথচ আমি তোমাকে চেয়ে বসেছি।”

ভালোবাসি তোমাকে, প্রেম করব, বিয়ে করব—এমন কোনো কথা নেই, চাওয়া নেই। তবুও ইফতির বলা বাক্যটিগুলোতে কী যেন ছিল, শক্তপোক্ত অরণীর হৃদয়টাও কেঁপে উঠল এই বিশেষ জনের নাম নিয়ে। 

_____

সেই সন্ধ্যেরাত, সেই প্রথম সরাসরি চাওয়া-পাওয়ার প্রকাশ, সেই দৃষ্টিমিলন! সেই রাতটায় আর কেউ কোনো কথা বলেনি। একযোগে কতগুলো মুহূর্ত উৎসর্গ করেছিল নিজস্ব অনুভূতিদের নামে।

তারপর প্রজেক্টের কাজে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ইফতি, আজ এক সপ্তাহ ধরে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। সুযোগ করে যখন ইফতি বাসায় ফেরে, অরণী তখন থাকেই না। রাতেও অরণীকে ছাদে অথবা বারান্দায় দেখতে পাওয়া যায় না। ইফতির বড়ো অস্বস্তি হয় অরণীকে কল-টেক্সট করতে৷ যেহেতু মেয়েটা নিজ থেকে করছে না, ইফতির আর না এগোনোই ভালো। একা আর কতটুকুই বা এগোবে? কিছুটা তো বিপরীত ব্যক্তিরও করতে হবে। তবেই না একটা সম্পর্কের সবটা গঠিত হবে।

আজ যখন ইফতি কাজিপাড়ার বাসায় গেল, করিম তাকে একটা খাম হাতে দিয়ে বলল,
-“তিনতলার ভাড়াটিয়া ইটিশপিটিশ করার জন্য চিঠি দিসে।”

ইফতি মনে মনে ভীষণ পুলকিত বোধ করলেও সম্মুখে কিঞ্চিৎ হেসে উঠল। চিঠিটি নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে এলো। পড়া শুরু করল মধ্যরাতে। ইফতি মনে-প্রাণে বিশ্বাসী, রাত মানেই অনুভূতির ঊর্ধ্বলগ্ন। বেশ আয়োজন করে বারান্দায় বসে সে চিঠিটা পড়তে শুরু করল,

______

জনাব,
বাসি বকুলের সৌরভে আচ্ছাদিত আমার আটপৌরে জীবনে আপনাকে স্বাগত। আমি যখন ভেবেছিলাম, আমার দিকে এগোনো আপনার গুটিগুটি কদমগুলোকে সেখানেই থামিয়ে দিতে আমি অত্যন্ত উন্মুখ, চুপিসারে আমার অভদ্র মন তখন আপনার পথ চেয়ে বসে রইল। স্তব্ধ আমি মনের বিশ্রী ধরনের কাণ্ডে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। হতবিহ্বল চোখে দেখে গেলাম আপনাকে। আমার তেইশ বছরের জীবনে এর আগে কোনো পুরুষ প্রেম আনতে পারেনি, অথচ আপনি ধরা দিলেন একরাশ মুগ্ধতা হয়ে...

আমার জীবনটা আর বাকি দশটা মেয়ের মতো সুন্দর ছিল না, নিজেকে সুন্দর করে নিতে হয়েছে। আমি আমার বাবার প্রিন্সেস ছিলাম না, নিজের সাম্রাজ্য তৈরি করে নিতে হয়েছে, সেই সঙ্গে তৈরি করতে হয়েছে নিজেকে। আর বাকি মেয়েরা যেখানে জন্ম থেকেই একটা গোছানো জীবন পেয়ে যায়, সেখানে আমাকে খাঁটতে হয়েছে। ছোট থেকেই মাকে কাজ করতে করতে আত্মা শুকিয়ে যেতে দেখেছি, অথচ কারো মন সে পেত না। দেখতাম, বাবা সকাল-সন্ধ্যা অফিস করে ফিরে মা'কে এটা-সেটা নিয়ে খোঁটা দিত। বলত, ‘কাজটাজ তো কিছু করো না। ঘরের ভেতর আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করো। এক পয়সা কামাই করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা লাগে। আর সেই টাকা তোমরা ওড়াও। বাইরে কামাই করতে যাও, কুকুর-বিড়ালে ছিঁড়ে খাবে, এক পয়সাও পাবে না।’

আমি অবাক হয়ে শুনতাম। সাতটা টু পাঁচটা অফিসে বাবা কী এমন কষ্ট করত, আমার জানা ছিল না। তবে টুয়েন্টি-ফোর সেভেন মা যে-রকম খাঁটত, তাতে এটুকু বলতে পারতাম—একাংশ বাবা করতে পারত না, উলটো মায়ের প্রতি সম্মানটা আনত। বাবারা উইকেন্ড পায়, সরকারি ছুটি পায়, মায়েরা তো পায় না। তবুও তারা কীভাবে অভিযোগ আনে যে মায়েরা আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করে?

আমি মাকে ঘরে সাহায্য করতে লাগলাম। তাতে অন্তত একটু কষ্ট কম হতো মায়ের। মাকে সাহায্য করতে করতে এটা সেটা নিয়ে গল্প করতাম। মা সঙ্গ পেত, মা সঙ্গী পেত; আর আমি পেতাম এক টুকরো স্বস্তি।

বড়ো হতে হতে এক পর্যায়ে আমি আমার মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম। মায়ের সুখ-দুঃখ সব তখন আমাকে ঘিরেই। মায়েরা ব্যথা লুকোতে ওস্তাদ। অথচ আমি বড়ো হবার পর আমার মাকে ঠিক একটা বাচ্চার মতো প্যাম্পার করা শুরু করলাম। মা তখন থেকে সবকিছু আমাকে বলা শুরু করে। আহ্লাদ, অভিযোগ সবই করে। সামান্য অসুস্থতায়ও আমাকে বলে। আমি যত্ন নিই, সেই যত্নে ত্রুটি আনি না। আমার মা ঠিক আমার কাছে ননীর পুতুলের মতো। যখন আমি কথা বলতে শিখিনি, তখন আমার কী কী লাগবে—সেসব মা বুঝে ফেলত। আমার মা তো বলতে পারে, তবে কেন আমি মাকে বুঝব না?

বয়স ষোলোর পর থেকে সাংসারিক জীবন নিয়ে বিশ্রী বিশ্রী ধারণা মনে ঢুকতে লাগল। বিয়ের প্রতি তিক্ত একটা ধারণা এলো। একটা মেয়ের জীবন এরকম! অবাক হতে লাগলাম। মাঝে মাঝে এ-ও মনে হতে লাগল, মেয়ে জীবন অভিসপ্ত!

উদাহরণস্বরূপ আমার মাধ্যমিকের একটা ক্লাসমেটের কথা বলি। ওর নাম মায়া। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল, নামের মতোই মায়াবী ছিল। ক্লাস নাইনে ওর বিয়ে হয়। বিয়ের পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ওর সাথে আমার দেখা হয় এইচএসসির সময়, হসপিটাল রোডে। আটমাসের ভারি পেট নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে মুখে মলিন হাসি ঝুলিয়ে বলেছিল, ‘অরু, ভালো আছিস?’

আমি সেই হাসির প্রত্যুত্তরে হাসতে পারিনি। মুখটা না চাইতেও কঠিন হয়ে এসেছিল। এত সুন্দর মেয়েটার মুখে সামান্য জৌলুশ ছিল না। চোখের নিচে এক ইঞ্চি পুরু কালি। রোগাটে হয়ে গেছে। ভাঙা শরীর তার। আমি ওকে নিয়ে রোডসাইডের বেঞ্চে বসলাম। এরপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে কেন?’

ও বলল, ‘চেকাপে আসছিলাম।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর হাজব্যান্ড আসেনি?’
মায়া হেসে বলল, ‘ব্যস্ত আছে ও।’

যেই পুরুষ স্ত্রীকে এমন একটা সময়ে একা ফেলতে পারে কেবল ব্যস্ততার দোহায় দিয়ে, সেই পুরুষ স্ত্রীকে কেমন সুখে রেখেছে ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছিল আমার। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সংসার জীবন কেমন চলে।’

মায়া নরম গলায় বলা শুরু করল, ‘ঠিকঠাক চলছে। বাড়ির বড়ো বউ আমি। একান্নবর্তী পরিবার আমার। এত এত মানুষ। সেই সঙ্গে এতগুলো দায়িত্ব। আমার ননদ, দেবর সবাই ভালো। সারাক্ষণ ভাবি ভাবি করে মাথায় তুলে রাখে। ভাবি এটা করে দাও, ভাবি ওটা করে দাও। আর শ্বশুর-শাশুড়িও ভালো। সবসময় বলে, বউমা, তুমি বাড়ির সব, বাড়িটা গুছিয়ে রাখবা, সবকিছু দেখে রাখবা, সবকিছুর খেয়াল রাখবা, সবাইকে মান্য করে চলবা, স্বামীর খেদমত করবা। দাদিশাশুড়ি একটু কড়া, তবে সামলে চললে সব ঠিক থাকে। চাচিশাশুড়িরাও ভালো সবাই। বড়ো পরিবার তো! অনেক কাজটাজ থাকে। এজন্যই আর কী...’

আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে, ‘আর তোর স্বামী?’

আমি জানি না কী হলো। আমার এই এক প্রশ্নে ও ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল। বলতে লাগল, ‘আমি বুঝি না ওকে। ও কী চায় বুঝি না। রাতে আদর করে কাছে টেনে নেয়। শেষ হলেই ছুঁড়ে ফেলে বিছানার এক কোণায় যেন আমি একটা আবর্জনা ছাড়া কিছু না। আমার যত্ন নেয়। ঠিকঠাক না খেলে বকাবকি করে। বলে, খাওয়া-দাওয়া না করলে শরীর নষ্ট হয়ে যাবে, যত্ন নিবা নিজের, সেজেগুজে থাকবা। আমাকে বিভিন্ন গিফট দেয়, ঘুরতেও নিয়ে যায়। অথচ এই তিনমাস ধরে ও আমার কাছে আসতে পারছে না বলে আমার সাথে কথাও বলছে না। সময় পাচ্ছে না নাকি। এখন তো সকালে অফিসে চলে যায়, অফিস আওয়ার ৬টায় শেষ, ও বাড়ি ফেরে দশটা-এগারোটার পর। বলে বাড়িতে ভালো লাগে না। আমি ওর জন্য না খেয়ে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করি, ও খেয়ে আসে বাইরে থেকেই। সারাদিনে একটা কল করে না, ম্যাসেজ করে না। আমার খোঁজ নেয় না। আমি কল করলে বলে ব্যস্ত আছে। সারাদিনে কী এমন ব্যস্ততা থাকে যে একটু খোঁজ নেওয়া যায় না! এখন তো আমি একা নই, বাবুও আছে।
জানিস, ও আমাকে এ অবধি একবারও ভালোবাসি বলেনি। আমি চাইওনি। সবাই শুধু ভালোবাসা চায় না। কেউ কেউ একটু যত্নের অভাবেও কাতরায়। আর প্রেগ্ন্যাসির এই টাইমটা একটা মেয়ের জন্য কতটা কষ্টের যায়! আল্লাহ! খুব ইচ্ছে হয় ওর যত্ন পেতে, গুরুত্ব পেতে। কিছু না করুক, অন্তত পাশে একটু বসে থাকুক! একটু সময়ও দেয় না। একটুও না। মেজাজ খিটখিটে থাকে। নিজেকে সামলে রাখতে হয় সবসময়। কিছু বললেই রেগে যায়। কথা বলা বন্ধ করে দেয়। অথচ আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারি না।
আর এ বাড়ির এত এত কাজ, আমি জাস্ট হাঁপিয়ে উঠছি। সবার মন রক্ষা করে চলতে হয়। সবাই যা ইচ্ছা আমাকে বলতে পারে। আমি কাউকে বিপরীতমুখী জবাব দিতে পারি না। সেই অধিকার আমার নেই। 
একবার শাশুড়ি বাপের বাড়ির খোঁটা দিচ্ছিলেন। আমার বাপ-মা এটা শেখায়নি, ওটা শেখায়নি বলে আমাকে গালিগালাজ করছিলেন। আমি শেষ অবধি সইতে না পেরে রাগের চোটে বলেই ফেলেছিলাম, তাহলে ছেলেকে এখানে বিয়ে করিয়ে আনলেন কেন? 
তাতেই আমি বেয়াদব, আমি মুখে মুখে তর্ক করি। আরও বানোয়াট নানান কথা ছেলের কাছে অভিযোগ করল। আমি মার খেলাম। স্বামী ভালো হলে সব মেনে নেওয়া যায়। অথচ আল্লাহ আমার কপালে দুনিয়াতেই জাহান্নাম লিখে রেখেছেন।’

আমার কিশোরী মনটা কেঁদে ওঠার আগেই মায়া আবারও বলেছিল, ‘আমি ক্লান্ত। বাচ্চাটার জন্য বেঁচে আছি।’

পাথর হয়ে গেলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ভুলে গেলাম। দুনিয়াতে এমন অজস্র মেয়ে মানুষ আছে। একশতে নব্বইটা মেয়েই বৈবাহিক জীবনে সুখী নয় কেবলমাত্র শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে পারে না বলে। আর যারা সাহসী, তারা সুখ খুঁজতে সংসার ধর্ম ত্যাগ করে। নয়তো কপাল গুণে কিছু মানুষই আছে, যারা সাংসারিক শান্তি ও স্বামী সোহাগ একযোগে পায়, তাদের ওপর স্রষ্টার বিশেষ রহমত আছে। 

আর কিছু নির্দিষ্ট স্বামী! এসব স্বামী নামক নিকৃষ্ট পশুর প্রতি আমার আজন্ম ঘৃণা। আমার বাবাই তো একজন জানোয়ার, যে এক বছর আগে আমার বয়সী এক নারীকে বিয়ে করে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল। ঘৃণায় তৎক্ষণাৎ মামনিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম বাড়ি থেকে....

_____

এটুকু পড়ে ইফতি থেমে গেল। শেষে অরণী এটা কী বলল? এমনও হয়? অরণীর বাড়ি ছাড়ার পেছনের কারণ এটা? এইটুকু একটা মেয়ে কতটা গভীরভাবে বাস্তবার সাথে সংযোগ রেখেছে নিজের! অরণীর বাবার প্রতি প্রচণ্ড রাগে ইফতির কপালের শিরা ফুলে উঠল। চিঠির আরও অনেকটা বাকি আছে।

একহাতে চিঠিটি রেখে ইফতি এসব ভাবছিল। অরণী যে ঠিক উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে তাকে দেখছিল এতক্ষণ ধরে, তা হতে ইফতি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। অরণী কল লাগাল ইফতিকে। কলিং টিউনে ইফতি সচকিত হলো। ফোন হাতে তুলে কলার আইডি দেখতে পেয়েই এতক্ষণের রাগ, হতাশা সব মুছে গিয়ে ঠোঁট প্রসারিত হলো কিঞ্চিৎ। স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে কলার আইডি, “রানিসাহেবা”।

ইফতির ঠোঁটের ভাঁজের সেই অল্পটুকু হাসিতে অরণীর ঠোঁটের কোণায় বাঁকা চন্দ্রের মতো একটুকরো হাসি ধরা দিলো। কল রিসিভ করেই ইফতি বলল,
-“রানি সাহেবা, আপনার সেবায় আমি সর্বদা হাজির। বলুন, এই অধম আপনার জন্য কী করতে পারে?”
-“পত্র পড়া শেষে পত্রদাতার জন্য এককাপ দুধচা নিয়ে ছাদে হাজির হবার আহবান জানাচ্ছি। আজকের রাতটা সুন্দর, আপনার সঙ্গ চাইছি।”

শেষবাক্যে ইফতি ডান হাতটা বুকের বাঁ পাশে এনে নিল, তাতে কপালে হাত রেখে শব্দ করে হেসে উঠল অরণী। একটু দুঃখের সাথে এক চিমটি হাসি, এক চামচ কড়া লিকার দিয়ে এককাপ মিষ্টি চা। জীবন সুন্দর!
.
.
.
চলবে.....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন