শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৬৫ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


বাতাসে যেভাবে গাছের পাতা নাচে, ঠিক সেভাবেই
মাহিন কাঁধ নাচাল চমৎকার ভঙ্গিমায়। মুখ চালাল বদমাইশি ইশারায়, 

‘আমরা বললেই কালা। তুমি করলেই ভালা।’

তন্ময় দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে, ‘স্কাউন্ড্রেল-এর মতন একই ব্যাপার নিয়ে পড়ে আছিস কেন? থাম এবার।’

মাহিন হোঁচট খেলো যেন গুরুতর, ‘আমি স্কাউন্ড্রেল?’ 

তন্ময় নাক সিটকাল। নির্বিকার গলায় প্রত্যুত্তর করল,
‘না। তবে মুখ চলতে থাকলে হতেই পারিস।’

মাহিন দানবের মতন শব্দ করে হাসল। এগিয়ে এসে তন্ময়ের উসকোখুসকো চুলগুলো এলোমেলো করে জানাল, ‘আই ডোন্ট কেয়ার।’

তন্ময় মাথা ঘামাল না। দু’হাতে চুলগুলো পরিপাটি করে ফেলল দু'ধাঁপে। রিয়ান এইমুহূর্তে অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক শান্ত। চেয়ারে বসে গুনগুন করছে নিজমনে। তন্ময় নির্বিকার চোখে একবার দেখল আপাদমস্তক। আশ্চর্যও হলো বটে। আগ বাড়িয়ে ঝামেলা পাকাতে চাইছে না। এই তো দারুণ ইম্প্রুভমেন্ট। তন্ময় ভাবল প্রশংসা করবে। মুখ খোলার পূর্বেই আচমকা কণ্ঠ দমিয়ে রিয়ান শুধাল,

‘দোস্ত, দিন-দুনিয়া আজ একটু বেশি চমকাল লাগছে না তোর? মনে হচ্ছে না স্বর্গে আছিস? যেখানে রংবেরঙ এর ফুল উড়ছে। মৌমাছি মধু খাচ্ছে। মাধবীলতা…. ’

তন্ময় গিলে নিলো প্রশংসাটুকু। চোখ রাঙাল কঠিনভাবে। বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ওদের ফেলে ভেতরে রওনা হলো। এদের সামনে থাকা আর ধৈর্যের পরিক্ষা দেয়া একই ব্যাপার। মাহিন গান ধরল,

‘ও বন্ধু তুমি কই, কই রে…
এই প্রাণো বুঝি যায় রে…
ও তুমি ছাড়া বাঁচি না…..’

———

মৃদুল হাওয়ায় হেলেদুলে চলেছে কৃষ্ণচূড়া গাছের লতাপাতা। মগডালে বসা পাখি জোড়াও; তালে তাল মিলিয়ে দুলছে আদুরে ভঙ্গিতে। ঝরে পড়ছে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো। কয়েকটি ফুল হাওয়াতে ভেসে এসে ছুঁয়েছে বারান্দার জমিন। গাছের পেছনেই সূর্য বসেছে। গাছের ফাঁকফোকর দিয়েই দীপ্তি ছড়াচ্ছে প্রাঙ্গণে। বারান্দায় একটি সেকেলে কাঠের চেয়ার পাতা। সেটির কয়েকটি যায়গা ঘুণে খেয়েছে। অরু সেই চেয়ারটিতেই বসেছে —দু'পা বুকে জড়িয়ে। মাথাটা হাঁটুতেই এলিয়ে রেখেছে খুব আনমনা ভঙ্গিমায়। চাপাস্বরে গুনগুন সুরে গান গাইছে। একটি সেকেলে বাংলা গান। গানটার নাম তন্ময় জানে না। তবে পূর্বে শুনেছে বোধহয়। গাঢ়ভাবে কান পাততেই দুটো সংলাপ শুনল,

‘একটুস খানি দেখো, একখান কথা রাখো…
ভালোবাইসা একবার তুমি বউ কইয়া ডাকো….’

গোধূলির সময় তখন। নিভৃতে, নিভতে বসা সূর্যের সোনালি রশ্মি অরুর শরীর ছুঁয়েছে। কালো চুলের বাহার পিঠ জুড়েছে। মুখের একটিপাশ চুলে ঢাকা। চোখজোড়া বন্ধ। ওর গায়েতে তখনো তন্ময়ের সুডৌল দেহের কালো শার্ট-টি। ঢোলা একটি সাদা প্যান্ট পরনে। প্যান্টের ভেতরে হারিয়েছে পায়ের পাতা জোড়া। মিনিটখানেক হবে তন্ময় এসে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণচূড়া গাছটার সামনে। সুস্পষ্ট শুনেছে অরুর হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠের সুর। এবেলায় কয়েক'পা এগুতেই, পুরুষোত্তম পা'তলে শুকনো পাতার স্পর্শতেই; খসখসে শব্দ হলো। নীরবতা ভাঙল। অরু তক্ষণ –তড়িৎ মাথা তুলে চাইল। তন্ময়কে দেখতে পেয়েই মুখ ভরে হাসল। হেমন্তের বিকেলের গোধূলির মতন দেখতে সেই হাসি। যা দেখেই শান্তিবোধ করে তার মনপ্রাণ। জুড়িয়ে আসে নয়নযুগল। ধুকপুক করে অন্তর। ঘাসের ওপরে অবলীলায় পড়ে থাকা পাতা গুলো পিষে সামনে এগোয় তন্ময়। আশেপাশে বসে কোলাহল তোলা পাখি গুলো, এযাত্রায় আতঙ্কে ছটফটিয়ে উড়ে পালাল। বসল অদূরের নারকেল গাছটার সুউচ্চ মগডালে। বারান্দার কাছাকাছি এসে কাঠের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় তন্ময়। চাইলেই সে লাফিয়ে উঠে যেতে পারে বারান্দায়। অরুর একেবারে কাছে, ঠিক পাশে। তবে তা সে করল না। সেভাবেই দাঁড়িয়ে দেখল দু'হাত দূরে বসা অরুকে। হাসছে ওর চোখজোড়া। চোখের মণিতে ভাসছে নক্ষত্র। নক্ষত্রে ভাসছে তন্ময়ের মুখ। অরু উঠে না। একইভাবে হাঁটু জড়িয়ে রেখেই উল্লাসিত গলায় শুধায়,

‘ভাইয়ারা বেরিয়ে পড়েছেন?’

‘হুঁ।’ তন্ময়ের সাবলীল জবাবটুকুর পরপরই অরু ফের উৎফুল্ল স্বরে শুধায়, ‘কোথায় যাবেন তারা? চা-বাগান?’

আজ তন্ময়দের বেরুনোর কথা ছিল সকাল-সকাল। যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল চা-বাগানে। অরু যাওয়ার জন্য তীব্র উদগ্রীব ছিল। বলা চলে, ওর দু'চোখ ভরতি উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। তবে গত রাতের ঘটনার পর আজ আর বেরুনোর প্রশ্নই ওঠে না। কোনোভাবেই সে আজ অরুকে বেরুতে দেয়নি। নিজেও কোথাও যায়নি। আজ অরুর দিনব্যাপী বিশ্রাম নিতে হবে। তন্ময় পাশে থেকে সঙ্গ দেবে। 

‘হুঁ। আশেপাশেই। কেন? তোর যেতে ইচ্ছে হচ্ছে?’

অরু মাথা নাড়াল। দৃষ্টি অদূর কৃষ্ণচূড়া গাছে। আদুরে, ভ্রম গলায় বলল, ‘উহুঁ। যেতে ইচ্ছে করছে না।’

তন্ময় ভ্রু তুলল। আগ্রহী হলো। শান্ত-স্থির কন্ঠে জিজ্ঞাসাবাদ চালাল ‘আমি ভুল না হয়ে থাকলে, তুই খুব এক্সাইটেড ছিলি চা-বাগান যাবি বলে। তাহলে এখন কেন ইচ্ছে করছে না?’ 

অরুর ছন্নছাড়া দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটতে ব্যস্ত। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলনে অপারগ। দ্বিধান্বিত মিনমিনে স্বরের প্রত্যুত্তর শোনা গেল সময় নিয়ে,

 ‘আমি সেসব জায়গাতে যেতে এক্সাইটেড যেখানে আপনি আছেন। যেহেতু আপনি এখানে সেহেতু আমি এখানে থাকতেই এক্সাইটেড।’

ধুকপুক, ধুকপুক, ধুকপুক! তন্ময়ের হৃদয়ের এই অশান্ত ধুকপুক শব্দ কি অরু শুনতে পারছে? বুঝতে কি পারছে ওর এই সাধারণ-সাবলীল কথাটুকুর প্রভাব কতটা গাঢ়ভাবে ছুঁয়েছে তাকে? কীভাবে কাঁপছে তার পিঞ্জর— জানতে কি পারছে? নিপুণভাবে চোখজোড়া শক্ত করে বুজে নিলো এইমুহূর্তে। হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে। ধড়ফড়িয়ে উঠছে থেমেথেমে। বুক ভরে লম্বা শ্বাস টানল তন্ময়। চোখ মেলে চাইল। ততক্ষণাৎ তার গভীর দৃষ্টিতে অরুর উৎসুক দৃষ্টির মিলন ঘটল। আশেপাশে কোথাও বজ্রপাত হলো নাকি তার অন্তরে? অরুর নাজুক মুখটা লাজুকলতায় মিইয়ে এলো। তন্ময় এবেলায় মুখ ভরে হাসল। তার গম্ভীরমুখে হাসির ঝলক দেখা আর আকাশের চাঁদ দেখা বুঝি একই বিষয়! নাহলে অরু এত আশ্চর্য হবে কেন? ভ্যাবলার মতন চেয়েই বা রবে কেন? তন্ময় লাফিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ে। অরু সটানদেহে বসেছে এবারে। তন্ময় ওর সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে। মাথা ঝুঁকিয়ে চোখে চোখ রেখে– দারুণ নির্বিকার গলায় বলে ওঠে,

‘আমার সব ব্যথার, অসুখের এক চমৎকার মেডিসিন আছে।’

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বড়ো করে ফেলে চোখজোড়া। আশ্চর্য! সব ব্যথার এক মেডিসিন হয় নাকি? মেডিসিন নাম জানতে অরু ব্যাকুল হয়ে পড়ে, ‘ও মাই গড! সব অসুখের এক মেডিসিন হয় নাকি? কী নাম?’

‘অরু মেডিসিন। আমার আরাধনা।’ 

তন্ময় কাছ থেকে নিবিড়ভাবে দেখে অরুর লজ্জাশীল মুখ। মুখচোরার মতন ছটফট করে চলেছে। দৃষ্টি রেখেছে জমিনে। যেন চাহনি তার দিক ফেললেই ওর ফাঁ সির রায় হবে। হেসে তন্ময় পায়ের পাতায় ভার ফেলে হাঁটু উঁচিয়ে বসে। আলতোভাবে ছোঁয় অরুর ডান'পা। মুহূর্তেই নড়েচড়ে ওঠে অরু। সীৎকার করে চাপাস্বরে,

‘তন্ময় ভাই….’

প্যান্টের শেষ অংশ ভাঁজ করতে নিয়েই তন্ময় চোখ তুলে ভ্রু নাচিয়ে শুধায়,

‘হুমমম?’

অরু নির্বাক চোখে চেয়ে রয় শুধু। পলক ফেলতেও দ্বিধান্বিত যেন। দু'পায়ের প্যান্ট ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ায় তন্ময়। হাত বাড়িয়ে দেয়। অরু হাতে হাত রাখে। দাঁড়াতে নিতেই তন্ময় পাঁজাকোলে তুলে ফেলে ওর ছোট্টোখাটো দেহ খানা। ঠোঁট নামিয়ে কপালে ত্বরিত চুমু বসাল। সূর্য তখন অর্ধেক ডুবেছে। ক্ষণিকের মধ্যেই পরিপূর্ণ রূপে ডুববে বলেই।

———

রুপার থালার মতন গোল একটি চাঁদ ভেসেছে আকাশে। গাছগাছালির মাথার ওপর ওইতো দেখা দিচ্ছে। আবছায়াতে গাঁথা নিস্তব্ধতা ভেঙে ঝিঁঝিঁপোকাদের কোলাহল কর্ণগোচর হচ্ছে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। তন্ময় জানালা দিয়ে একটিবার দেখে নিলো দৃশ্যটুকু। ফের চাহনি রাখল অরুতে। স্যুপ খাচ্ছে বিছানায় বসে। সামনে ল্যাপটপ খোলা। বলিউড মুভি দেখছে। মুভির সারসংক্ষেপ বলছে একটু পরপর। নায়ক-নায়িকার সৌন্দর্যের বিবরণ এই নিয়ে গুণে-গুণে তিনবার দিয়েছে। এইমুহূর্তে অরুর ফোন বেজে ওঠে। তন্ময় ভুল না হলে, মারজির কল এসেছে। সাধারণত এমন অসময়ে মারজি কল করে থাকে। আজও ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। অরু স্ক্রিনে নজর ফেলেই আনন্দিত হলো। চটপট কল রিসিভ করে কানে চাপল। তন্ময় চেয়ার ছেড়ে উঠল। কথা বলার সামান্য প্রাইভেসি দিতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। বাবু মিঁয়া করিডোর জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন অসময়ে। ভদ্রলোক মহা চিন্তায় দরবেশ বনেছেন যেন। তন্ময়কে দেখেই চিন্তিত স্বরে জানালেন,

‘বাবা, সাহেব তো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রুস্তম বাবার কালই ঢাকা ফিরতে হবে।’

তন্ময়ের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আসে মুহূর্তেই, 

‘খুব সিরিয়াস কিছু?’
‘না। তবে জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি ভালোভাবেই শরীরে বিঁধেছে।’
‘রুস্তমকে জানিয়েছেন?’

বাবু মিঁয়া ইতস্তত করেন, ‘না। ভাবছিলাম বাবা ফিরুক। তারপর নাহয় জানাব। রাস্তাঘাট তো ভালো না।'

তন্ময় এক্ষেত্রে একমত। ওরা সহিসালামত ফিরুক সবাই। প্রয়োজনে আগামীকাল একত্রে ঢাকা রওনা দেয়া যাবে। এভাবেও তন্ময়ের একাধিক কাজ পেন্ডিং জমেছে। ঢাকা ফিরে লম্বা সময় ব্যস্ত থাকা লাগবে। তখন অরুর কী হবে? ও তো ব্যস্ততা বুঝতেই চায় না। অভিমান করে, কাঁদে। এখন শুনলেই হয়েছে আগামীকাল ফিরে যাবে; ততক্ষণাৎ মুখ বেজার করে রাখবে দীর্ঘক্ষণ। আর তন্ময় সইতেই পারে না অরুর অভিমান, কান্নারত মুখশ্রী। আলগোছে বেরিয়ে আসে প্রাঙ্গণে। হাত ঘড়িতে আটটা ত্রিশ তখন। পকেটে দু'হাত ভরে চায় আকাশে। অনুভব করে পেছনে কারো উপস্থিতি। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই তার সুডৌল পুরুষোচিত কোমরে— একজোড়া শীর্ণ হাতের অস্তিত্ব মিলে। বিস্তৃত পিঠ ছোঁয় মসৃণ গাল। সুমধুর কণ্ঠস্বর অভিমানে জর্জরিত,

‘কাল ফিরে যাচ্ছি?’

কোমরে থাকা কোমল হাত দুটো নিজ বাম হাতের মুঠোয় ভরে তন্ময় ঘুরে। ওর ডান হাত তার প্রশস্ত বুকে চেপে ধরে। মাথা নুইয়ে দাঁড়ানো অরুকে একচিত্তে দেখে। ডান হাতে অরুর থুতনি ধরে মাথা উঠিয়ে; চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

‘হুঁ। কেন, যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না?’
‘ফিরেই তো কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবেন।’ 

তন্ময় হেসে ফেলে। অরুর চুল বুলিয়ে আওড়ায়, ‘তা তো হবোই। বউ পালতে হলে, টাকা তো কামাতে হবে।’
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন