দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে। ঘামে ভেজা টি-শার্ট পিঠের সঙ্গে লেপ্টে আছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিচতলার ঘরে আসলো সাদাফ। এই সময়টায় ঘরের মেঝেতে সূর্যের আলো আঁচড়ে পরছে। সাদাফ উইন্ডোর দিকে এগিয়ে গেল। এক হাতে পর্দাগুলো ছড়িয়ে দিল এরপর ঘরের সব আলো নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে সোফায় বসল সে। তারপর চোখ বন্ধ করে মাথাটা সোফার পেছন দিকে রাখল। নতুন এক কনসার্টের জন্য দুই দিন যাবত ড্যান্স প্রাকটিস করছে ওরা। তাই হুট করে শরীরটা দূর্বল লাগছে তার, হাঁটার ও শক্তি পাচ্ছে না সাদাফ। মিনিট পাঁচেক পর তূর্ণ এলো। কোনো প্রকার কথা না বলে অন্ধকার ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে দিল তূর্ণ। সাদাফ বিরক্তিতে ভ্রুকুটি করল। বিরক্ত গলায় বলল,
'তূর্ণ বিরক্ত করলে খুব খারাপ হবে।'
তূর্ণ ক্লান্ত বেশ; তাই কোনো জবাব দিল না। পিপাসায় কাতর সে। হেঁটে গিয়ে সাদাফের পাশে বসল। এক হাতে সেন্টার টেবিলে রাখা পানির বোতলটা তুলে নিল। তারপর শুঁকনো গলা ভিজিয়ে সোফায় হেলান দিল সে। সাদাফের অস্থির লাগছে। সাদাফ তার শার্টের কলারের উপরের তিনটা বোতাম খুললো। তূর্ণ অবাক চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে। সে হঠাৎ সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগল,
'ছি তোর কি লজ্জা করে না?'
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে শুধল,
'লজ্জা করবে কেন?'
হতবাক গলায় তূর্ণ বলল,
'টি-শার্টের বোতাম খুলছিস কেন?'
সাদাফ বিরক্তি গলায় বলল,
'স্টুপিট, অস্থির লাগছে তাই খুলেছি।'
সেহরিশ একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে রেস্ট রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তূর্ণ ও সাদাফের কথোপকথন শুনে তার ভ্রুকুটি কুঁচকে গেল। দরজার সামনে থেকে সেহরিশ গম্ভীর গলায় বলল,
'আমি তোদের সাথে ডিনারের প্ল্যান করেছি। ঠিক আটটায়, রেডি থাকবি। একসাথে বের হবো।'
তূর্ণ খুশিমনে ছুটে এলো। সেহরিশের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল সে। হঠাৎ সেহরিশের এক হাত শক্ত করে ধরে তূর্ণ আদুরে গলায় হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,
'ডিনারের জন্য আমি কি পরে যাবো?'
সেহরিশ সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। তূর্ণর প্রশ্নের জবাবে সে ছোট্ট করে বলল,
'তোর যা ভালো লাগে।'
সাদাফের পিঠে প্রচন্ড ব্যথা করছে। সাদাফ বাড়ি এসেই ডাক্তার নাজ-নে কে কল করে তার বাসায় আসতে বলে। ডাক্তার নাজ-নে আসার পর সাদাফের কিছু চেক-আপ করেন। তারপর বলেন শরীরের উপর চাপ কম দেওয়ার জন্য। কিছু ওষুধ দেন এবং পর্যাপ্ত ঘুমানোর কথা বলে তিনি চলে যান। ওষুধ খাওয়ার পর পর সাদাফের পিঠের ব্যথা কিছুটা কমে যায়। বাড়িতে একা একা বিরক্ত লাগছে তার। একটি গান লেখার কথা ভাবলো সাদাফ। একটা পোর্টেবল টেবিল নিয়ে বিছানায় বসল। মেরুদন্ড টানটান করে একটা গান লিখতে লাগল। সন্ধ্যা 7:30 মিনিট। দীর্ঘক্ষণ ধরে একই ভাবে বসে থেকে সাদাফের পিঠে আবারও ব্যথা করছে। হালকা ব্যায়াম করে শরীরের অসাড়তা দূর করল সে। এরপর বিছানায় রাখা ফোনটা নিয়ে টাইম চেক করল। আটটা বাজতে আর অল্প সময় বাকি আছে। তাই তাড়াতাড়ি তৈরি হতে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
বিশ্বের সেরা রেস্তোরাঁ হল ইতালির অস্টেরিয়া ফ্রান্সসকানা। ছিমছাম পরিবেশ, বেশ মোহনীয়। সেহরিশ, সাদাফ ও তূর্ণ আজকের ভিআইপি অতিথি। তাদের আগমনের বার্তা রেস্টুরেন্ট মালিক ও শেফ ছাড়া কেউ জানে না। টেবিল জুড়ে নানা স্বাদের খাবার রাখা আছে। একজন পুরুষকর্মী তার পরিবেশনের দক্ষতায় তূর্ণর মন জয় করে নিল। সাদাফ পিঞ্চ মেরে শুধল,
'পছন্দ হয়েছে? কথা বলব?'
তূর্ণ এক হাতে ছুরি ধরে সাদাফের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে। চোখ ছোটো ছোটো করে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
'আমি গে নই।'
তূর্ণ আর সাদাফের কথার মাঝে সেহরিশ মাথা তুলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তূর্ণর দিকে তাকাল। একটু পর গম্ভীর গলায় বলল,
'আমি তোদের ইম্পর্ট্যান্ট একটা খবর জানাতে ভুলে গেছি।'
তূর্ণ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। সেহরিশ শান্ত গলায় বলল,
'দুই সপ্তাহ পর ২৪ ফেব্রুয়ারি। দ্যা আর্টিস্ট অফ দ্যা ইয়ার ২০১৭ অ্যাওয়ার্ড শো ফেয়ারমন্ট সেঞ্চুরি প্লাজা হোটেলে অনুষ্ঠিত হবে। ২২ ফেব্রুয়ারি আমাদের আমেরিকা যেতে হবে।'
সাদাফ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
'এবছর ও তালিকায় আমাদের নাম আছে?'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'হুম। গতকাল রাত থেকে ভোট শুরু হয়েছে।'
❐
দুপুরের পর সূর্য পশ্চিমে চলে যায়। আকাশে ছুটেছে মেঘ ও মিষ্টি রোদের ঝলকানি। দিন শেষে পুড়ন্ত বিকেল উপভোগ করতে বারান্দায় এলো আরুশি। সে চায়ের কাপটি রেলিংয়ে রাখল তারপর অপলক দৃষ্টিতে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রইল। ঘড়িতে সময় 5:50 p.m মিনিট। ফারিয়া বেগম ফোন হাতে আরুশির ঘরে ছুটে আসেন। মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় এসে চেয়ার টেনে আরুশির পাশে বসলেন। এরপর তার স্মার্ট ফোনটি আরুশির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন,
'ফোনটা ধর। তোর ভাইকে ফোন দে।'
'মা, তুমি নিজে ও তো কল দিতে পারো। প্রতিবার ফোন নিয়ে আমার কাছে ছুটে আসো কেন?' রূঢ় গলায় জিজ্ঞেস করল আরুশি। ফারিয়া বেগম কোন উত্তর দিলেন না। ফোনটা আরেকটু এগিয়ে দেন।
ইতালিতে এখন দুপুর। সময় 12:50 p.m মিনিট। বাড়ির উত্তর দিকে একটা বিশাল গাছ। গাছের ডালে বসা দু'টি পাখি। বার বার জানালার দিকে উঁকি দিচ্ছে, জানালা বন্ধ। আরুশি কল দিয়ে বারান্দা থেকে রুমে চলে গেল। সেহরিশ ঘুমিয়ে আছে। বালিশের নিচে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিনে নাম না দেখেই কল রিসিভ করল সে। হঠাৎ মায়ের কণ্ঠস্বর কানের পর্দায় এসে পৌঁছাল। ফারিয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
'কেমন আছিস বাবা?'
সেহরিশ ডান হাত দিয়ে কানের লতি চুলকে বলল,
'ভালো মা, তুমি কেমন আছো?'
'আলহামদুলিল্লাহ ভালো, বাবা।' বলে থামলেন ফারিয়া বেগম। কিছুক্ষণ থেমে বিস্মিত গলায় ফের বললেন,
'তোকে একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি।'
'হ্যাঁ, বলো।'
'আরুশির বিয়ে নিয়ে বাড়িতে আলোচনা হচ্ছে। বর তোর বাবার বন্ধুর ছেলে, নাম অনিক। শুনেছি খুব ভালো ছেলে। তোর বাবা চান অনিকের সঙ্গে আরুশিকে বিয়ে দিতে। আগামী সপ্তাহে ওঁরা আরুশিকে দেখতে আসবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মাসখানেক পরই বিয়ে। আমরা চাই তুই বিয়ে উপলক্ষে দেশে আয়। আসবি বাবা?'
অনেকক্ষণ পর সেহরিশের উত্তর এলো। থমথমে সুরে বলল,
'এটা সম্ভব হবে না, মা। অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে যেতে হবে আমেরিকায়। তোমরা যা ভাল মনে করো তাই করো। আমাকে এর মধ্যে টেনো না।'
ফারিয়া বেগম কল কেটে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন। হুইলচেয়ারের আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালেন উনি। পেছন ফিরে দেখলেন তার স্বামী শফিকুল চৌধুরী দুই হাতে হুইল চেয়ারের চাকা ঠেলে এদিকে আসলেন। সেহরিশ যে আসবে না, এই কথাটা স্বামীর কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করল ফারিয়া বেগম। স্ত্রীর মুখ দেখে শফিকুল চৌধুরী বুঝতে পারলেন ছেলে তার দেশে আসবে না, এখনো তার উপর রাগান্বিত। ওনার কষ্ট হবে ভেবেই ফারিয়া কথাটা লুকানোর চেষ্টা করছে। শফিকুল চৌধুরী প্রায় স্ত্রীকে বলতেন,
'শোন তুমি একজন সৈনিকের স্ত্রী। আর একজন সৈনিকের চোখ ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব।'
শফিকুল চৌধুরী সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ১৫ বছর আগে সেনা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার কারণে তিনি পঙ্গু হন। শফিকুল চৌধুরী তার জীবনের পনেরোটি বছর এই হুইলচেয়ারকে দিয়েছেন। এখন চেয়ারটা তার শরীরের সাথে মিশে গেছে যেন।
২০০২ সাল। মুচিপাড়া এলাকায় সরকারি জমিতে এক মাসের জন্য সেনা ক্যাম্প শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবক-বৃদ্ধ সবাই সেনাবাহিনী দেখতে আসে। গ্রামগঞ্জের ছেলেরা মানুষের মুখে আর্মি নাম শুনেছে, নিজের চোখে দেখতে আসছে আর্মি কেমন? গ্রামপ্রধান আসাদুজ্জামান পলাশ এক কিলোমিটার দূর থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আর্মি ক্যাম্প পরিচালনা করবেন লতিফ রহমান, আসাদুজ্জামানকে আসতে দেখে তিনি শফিকুল চৌধুরীর হাতে বন্দুক দিয়ে এগিয়ে যান। আসাদুজ্জামান মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
'এখানে ক্যাম্প করতে আপনার কোন সমস্যা হয়নি তো?'
লতিফ রহমান জবাবে বললেন,
'আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা বরং ক্যাম্প করার জন্য এমন খালি জায়গাই খুঁজছিলাম। আর আপনারা একটু খেয়াল রাখবেন ট্রেনিং শুরু হওয়ার পর ছোট বাচ্চারা যেন এদিকে না আসে।'
আসাদুজ্জামান বললেন,
'চিন্তা করবেন না। এই মাঠের পর বিশাল জঙ্গল, ভূতের ভয়ে এখানে শিশুরা আসে না। আপনি নিসচিন্তে প্রশিক্ষণ করাতে পারেন।'
লতিফ রহমান হালকা হেসে বললেন,
'আচ্ছা। ধন্যবাদ।'
পরের দিন। সকাল ছয়টা বাজে। বন্য পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ কানে বাজতে লাগল। দেড়শ সৈন্য হাতে বন্দুক নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো। সকাল সকাল লতিফ রহমান সব সৈন্য নিয়ে কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শনের জন্য বের হলেন। সৈন্যদের পায়ের থপথপ আওয়াজে লোকজন ঘরে থেকে বেরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে, লতিফ রহমান লাইনে সবার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটছেন। মুখের কাছে মাইক নিয়ে কথা বলছেন তিনি। সৈন্যদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে বেশ কিছু ছোট বাচ্চা। শফিকুল চৌধুরী দেখেন, শিশুরাও তাদের মতো হাঁটতে চেষ্টা করছে। শফিকুল চৌধুরী হেসে বললেন,
'এই বাচ্চারা, দুষ্টুমি করো না। বাড়ি যাও। তোমরা যদি আমাদের পিছন পিছন আসো, আমি তোমাদের বেঁধে নিয়ে যাবো।'
হঠাৎ বাচ্চাদের পা থেমে গেল। তারা ভয় পেয়ে বাড়ির দিকে ছুটে গেল। শফিকুল নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দেখতে দেখতে সাতদিন কেটে গেল। গভীর রাত। গ্রামগঞ্জে মানুষ সন্ধ্যার পর পর ঘুমিয়ে যায় এবং ফজরের আযান হলেই উঠে পড়ে। রাস্তায় কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে, দূর থেকে শেয়ালের হাঁক শোনা যাচ্ছে। শিবিরের চারপাশে মশাল জ্বলছে। সৈন্যরা খুব ক্লান্ত। বেশিরভাগ সৈন্য মাটিতে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শফিকুল চৌধুরী সহ আরও দুইজন আর্মি ক্যাম্পের মাঝখানে বসে নিজেদের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করছেন। শফিকুল চৌধুরী মৃদুস্বরে বললেন,
'আমার চাচাতো ভাই রফিক প্রায় দশ বছর ধরে তার স্ত্রীকে নিয়ে ইতালির রোমে শহরে থাকে। সেখানে এক কোম্পানিতে চাকরি করে সে। ওদের কোন সন্তান নাই। আমার ছোট ছেলে পড়ালেখায় খুব ভালো তাই রফিক তাকে ওর সাথে ইতালি নিয়ে গেছে। ছেলেটাকে জোর করে বিদেশ পাঠিয়েছি এজন্য আমার উপর তার খুব রাগ। ইতালি গেছে এক বছর হয়ে গেল, ছেলের অভিমান একটুও কমেনি। আমার সঙ্গে কথা বলা সেই যে বন্ধ করেছে, আজ ও কথা বলে না।'
দুজন লোক শফিকুল চৌধুরীর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। একজন বললেন,
'ছোট ছেলের বয়স কত ভাই?'
'এখন চৌদ্দ বছর।' বললেন শফিকুল।
হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠেন তারা। মধ্যরাতে কাকন নামের একটি জঙ্গি দল অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সেনা ক্যাম্পে হামলা করল। অন্ধকার চিঁড়ে চারদিক থেকে ফায়ারিংয়ের শব্দ ভেসে আসছে। শফিকুল চৌধুরী প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেননি। হঠাৎ ওনার মনে হলো আশেপাশে লোকজন নেই। সবাই মারা যাচ্ছে। অন্ধকার ভেদ করে কানে এলো মানুষের হাহাকার। দুইটা গুলি শফিকুল চৌধুরীর দুপায়ে লাগল। সহসা মাটিতে লুটিয়ে পরেন। অন্ধকারে বন্দুকটা কোথায় পড়ল সেটা খেয়াল করেননি উনি। আহত পা মাটি হিঁচড়ে টেনে নিয়ে লতিফ রহমান ও অন্যান্য সৈন্যদের ডাকতে লাগল। কারো কোন শব্দ নেই। শফিকুল চৌধুরী কোনোমতে একটি গাছের নিচে এসে আশ্রয় নেন। গাছের ডাল ভাঙা একটু লেগে ছিল। শফিকুল চৌধুরী পা হিঁচড়ে গাছের নিচে বসতেই পায়ের উপর গাছের ডালটা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে শফিকুল চৌধুরী চিৎকার করে ওঠেন।
সকাল হলো। রাতে গুলির শব্দ শুনেও গ্রামের কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। সকাল হতে না হতেই আশেপাশে লোকজন জড়ো হচ্ছে। উদ্ধারকারীরা পৌঁছেছে, ৮০ জন নিহতকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। আর আহত ৬০ জনকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। দেড়দিন ধরে হাসপাতালে নিথর হয়ে পড়ে আছেন শফিকুল চৌধুরী। জ্ঞান ফিরতে চোখ খুলে চারপাশে তাকাচ্ছেন। বিছানার পাশে দাঁড়ানো তার স্ত্রী ও মা কাঁদছেন। বড় ছেলে সোহান ও মেয়ে আরুশি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলেন। চেক-আপ করে তারপর বললেন,
'শফিকুল সাহেব, সময়মতো চিকিৎসা না হওয়ায় আপনার দুই পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। পুরো শরীরে জীবানু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল, সেজন্য আপনার পা কেটে ফেলা হয়েছে।'
কত অযত্নে ডাক্তার এমন বিশ্রী সত্য বললেন। শফিকুল চৌধুরীর স্ত্রী ফারিয়া বেগম ও মায়ের কান্নার আওয়াজ আরও জোরালো হয়ে ওঠে। শফিকুল চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করলেন। তার জীবন অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে গেছে যেন।
শফিকুল চৌধুরী হুইলচেয়ার টেনে ড্রয়িংরুমে আসেন। ফারিয়া বেগম ওনার পাশে এসে দাঁড়ালেন। শফিকুল চৌধুরী ধরা গলায় বললেন,
'তোমার ছেলে আমাকে বুঝলো না ফারিয়া। পনেরো বছর কেটে গেছে। এখনও সে অভিমান, রাগ করে আছে। ফারিয়া একটা কঠিন সত্য কি জানো?'
ফারিয়া বেগম কিছু বললেন না। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বুকের অস্থিরতা লুকিয়ে শফিকুল চৌধুরী বললেন,
'অভিমান জমতে জমতে একসময় ঘৃণাতে পরিণত হয়। তবে কী তোমার ছেলে আমাকে খুব বেশি ঘৃণা করে?'
ফারিয়া বেগম বিচলিত কণ্ঠে বললেন,
'কী বলছেন? আপনি তো জানেন ফাতিন খুব ব্যস্ত থাকে সে নিজের জন্য ও সময় পায় না।'
শফিকুল চৌধুরী ক্ষীণ সুরে বললেন,
'আমার ক্ষেত্রে যত অজুহাত।'
.
.
.
চলবে......................................