ইফতেখার মাহমুদ,
আমার সকল ধারণাকে এপিঠ-ওপিঠ করে তোলার এক অদ্ভুত এবং অভাবনীয় কারণ, শুনুন! আপনি এমন এক কাজ করেছেন, যা আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত কঠিন এবং আপনি আহামরি কিছু না করেই তা করতে পেরেছেন। আপনি এক মেয়ে হৃদয়ের ক্ষত নিরাময়ে স্বকীয়তাকে কাজে লাগিয়েছেন। মনের সকল ভীতি আমার আংশিক দূর হয়েছে, কিন্তু কিছু কিছু প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে।
আপনার সংস্পর্শে এসে আমি এক পাথর হৃদয়ের মেয়ে থেকে অনুভূতিপ্রবণ নারী হয়ে উঠেছি। আমার ভেতরে লুকানো অনিশ্চয়তা, ভীতি এবং দ্বিধা ধীরে ধীরে হালকা হয়েছে। আপনার নীরব উপস্থিতি আমাকে এক অন্য ধরনের শক্তি দিয়েছে। আমি আপনার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেছি—এটা এক গভীর উপলব্ধির মতো। অথচ শুধুমাত্র অনুভূতির উপলব্ধিতেই জীবন চলে না। প্রয়োজন কিছু অঙ্গীকারের। আপনার কাছ থেকে না পাওয়া কিছু কথা আমাকে ভাবাচ্ছে বেশ। এই ভাবনাগুলো আমাকে নতুন করে আপনাকে ভাবতে বাধ্য করছে। আর সে থেকেই চিঠি। চিঠির উত্তরও চিঠির মাধ্যমেই চাইছি আমি।
আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই আমাকে চেয়ে থাকেন, তবে আমাকে পুরোপুরি জানাতে হবে—আপনার অনুভূতি, আপনার ইচ্ছা, এবং আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ আপনি কেমন দেখতে চান। আপনার সংস্পর্শে আসার পর থেকে আমার ভেতরের পরিবর্তনগুলো আমি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। কিন্তু আপনি কি চান? আপনি কি এই সম্পর্কের দায়িত্ব নিতে আসলেই প্রস্তুত?
এটা সত্যি, আমি আপনার কাছে আসার পর নিজেকে অনেকাংশে মুক্ত এবং সাবলীল অনুভব করছি। আমার জীবনের সেই সকল ভাঙাচোরা ক্ষত, যেগুলোকে আমি দীর্ঘদিন ধরে ধারণ করে রেখেছিলাম, আপনার নীরব উপস্থিতিতে তা সেরে উঠেছে। আপনি এক নিরাময়ের রূপক হয়ে দাঁড়িয়েছেন আমার জীবনে। তবে এই নিরাময় শুধু ততটুকুই নয়—আমার মনে হচ্ছে, আপনি আমাকে এক নতুন পথের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি আপনাকে আরেকভাবে অনুভব করতে বিশেষভাবে প্রয়োজনবোধ করছি।
কিন্তু আমার মনে কিছু প্রশ্নও তো রয়ে গেছে। আমি আপনাকে শুধুমাত্র একজন অনুভূতির মানুষ হিসেবে চাই না। আমার ভালোবাসা কেবলমাত্র হৃদয়ের বিষয় নয়; এটি দায়িত্ব, এটি প্রতিজ্ঞা। ভালোবাসা আমার কাছে এক ধরনের অঙ্গীকার, যেটা আপনি ও আমি দুজনেই পূরণ করতে বাধ্য। আপনি কি সেই অঙ্গীকারের দায়ভার গ্রহণ করতে প্রস্তুত? নাকি আপনি আমাকে শুধুই সেই মেয়েটি হিসেবে দেখেন, যে একা, যে ভঙ্গুর?
আপনার সান্নিধ্য আমাকে মুক্তি দিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে এক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আমাদের এই চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্কটা কি শুধুই অনুভূতির হবে? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? আপনি যদি সত্যিই আমাকে চান, তাহলে আমার হৃদয়ের প্রতিটি খাঁজে থাকা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার চাই। আপনি কি সেই উত্তর দিতে পারবেন? আমার চাওয়া পূরণের দায়িত্ব নিতে পারবেন? আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে? আপনি কি আমার পথচলার সঙ্গী হতে চান, নাকি আর বাকি পুরুষদের মতো নিয়ম পালনে আপনিও একসময় ব্যস্ততা দেখাবেন, বাস্তবতার সাথে সুন্দর করে ফের পরিচয় করাবেন?
আমার মন বলে, আমাদের মধ্যে যে সংযোগ তৈরি হয়েছে, তা খুব সহজে ভেঙে যাওয়ার নয়। আপনি যদি সত্যিই আমাকে চান, তবে সেই প্রতিজ্ঞার পথে একসাথে চলতে প্রস্তুত কিনা, তা জানাই হবে আমার শেষ চাওয়া। ইফতেখার, এ কথা আমি বারবার বলব—আমার কাছে ভালোবাসা মানে কেবল একটা অনুভূতি নয়; আমার কাছে ভালোবাসা মানে দায়িত্ব, যত্ন, শেষ অবধি থেকে যাওয়ার এক অঙ্গীকার।
ইতি,
অরণী....
চিঠিটার মধ্য দিয়ে শুকনো বকুলের সুবাস পাওয়া যাচ্ছে। ইফতি খামটা খুলে দেখল, সেখানে পাঁচটা শুকিয়ে যাওয়া বকুল ফুল আর ছোট্ট একটা চিরকুট আছে। ইফতি চিরকুটটা বের করল। সেখানে লেখা,
-“পাঁচটা বকুল মানে পাঁচটা অঙ্গীকার: সময় দেওয়া, যত্ন করা, গুরুত্ব বোঝানো, বিশেষ অনুভব করানো আর শেষ অবধি থেকে যাওয়া।”
ইফতি চোখ বন্ধ করে চিঠি-চিরকুট আর খামটা ডানহাতে বুকে চেপে রাখল। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে ফেলতে বিরবির করে বলল,
-“প্রিয়নারী আমার, তোমার চাওয়াগুলো আমার কাছে আদেশের অনুরূপ। আমি দিতে বাধ্য তোমায়।”
______
অরণী ছাদের একটি কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চারপাশটা ভীষণ শান্ত, মধ্যরাতের আকাশ বিস্তৃত। চাঁদের মৃদু আলো তার মুখে এবং শাড়ির ওপর রূপালী আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। শাড়িটি নীল রঙের, যা চাঁদের আলোতে রূপালী ও সাদা আলো দিয়ে মিশে গেছে, ফলে এটি একটি জাদুকরী ছাপ সৃষ্টি করেছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোতে তার মুখের ভাবের সূক্ষ্মতা আরও প্রাকৃতিক মনে হচ্ছে—কিছুটা দুঃখের মিশ্রণ, কিন্তু সেই সঙ্গে এক গভীর আনন্দও ফুটে উঠছে চোখে-মুখে।
আকাশে তারাগুলো চকচক করছে, প্রকৃতি যেন একটি নিস্তব্ধ সঙ্গীত বাজাচ্ছে, যা রাতের শান্ত পরিবেশকে আরও মুগ্ধকর করে তুলছে। হালকা বাতাসে তার শাড়ির আঁচল এদিক-ওদিক ঢেউ খেলছে, যেন রাতের সুবাসের সাথে মিশে যাচ্ছে। তার চোখ দুটি ঝলমল করছে, জোৎস্নার সাথে তা যেন এক অদ্ভুত মাধুরী ছড়িয়ে পড়েছে।
এককাপ কফি ও এককাপ চা হাতে ইফতি যখন ছাদে প্রবেশ করল, বাতাসে তীক্ষ্ণ পুরুষালি পারফিউমের গন্ধে অরণী চোখ বন্ধ করে বড়ো করে শ্বাস টানল। এই সুন্দর পরিবেশে, প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে তার উপস্থিতি একটি স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে—একটি সুন্দর রাতের গল্পের অংশ, যেখানে তাদের কথোপকথন ও মধুর স্মৃতিগুলো রাতটায় ছড়িয়ে পড়বে।
ইফতি এগিয়ে এসে পাশাপাশি দাঁড়াল। হাতের চায়ের কাপটা অরণীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“সুন্দর দেখাচ্ছে।”
অরণী আড়চোখে তাকাল ইফতির দিকে,
-“তারপর?”
-“সত্যি বলছি। বিশ্বাস হচ্ছে না?”
অরণী হেসে বলল,
-“বিশ্বাস না হওয়ার মতো না। চাঁদের আলোয় গাছের শুকনো পাতাটিকেও অসম্ভব স্নিগ্ধ দেখায়, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্য কিছু তখন করতে ইচ্ছে করে না।”
ইফতি কার্ণিশ থেকে অপরাজিতা ফুল ছিঁড়ে এনে অরণীর কানে গুঁজে দিয়ে ফোন বের করে বলল,
-“একটা ছবি তুলি?”
-“ঠিক আছে।”
অরণী তাকাতেই ইফতি ফোনের ক্যামেরা অন করে বলল,
-“এমন সুন্দর তুমি আর চাঁদ একসাথে, ছবি না তুললে পাপ হবে।”
অরণী হাসল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
-“ইফতি?”
-“হু-উম?”
-“আপনার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কী?”
ইফতি সময় নিয়ে অরণীর দিকে তাকাল। অরণী মেয়েটা দেখতে ভীষণ মিষ্টি। সারাদিন মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ থাকে, কাজের চাপ থাকে, আর রাতের শেষান্তে এসে সে সামান্য নিশ্চিন্ত হয়। তাই দিনের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই সময় তাকে আরও স্নিগ্ধ দেখায়। তার ওপর যখন চাঁদ স্বয়ং অরণীকে সাজাতে নিজের আলো দেয়, তখন সে যেন আরও মোহময়ী হয়ে ওঠে। সোনামুখে রূপালী চাঁদের আলোয়, অরণী এদিক-ওদিক তাকিয়ে মুচকি হাসল। ইফতি তা দেখে বলল,
-“আমার কাছে ভালোবাসা মানে অনুভূতি কেবলই। তবে আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে, তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। তোমাকে ভালো রাখতে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ।”
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল অরণী,
-“ভালোবাসেন? অনিচ্ছাকৃত না-কি ইচ্ছাকৃত?”
ইফতিও হাসল। মাথার পেছনের চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
-“ভালোবাসাটাও অনিচ্ছাকৃত। এখন যে বললাম, তা-ও অনিচ্ছাকৃত। তোমার প্রতি আমার সব ধরনের আকর্ষণ অনিচ্ছাকৃত। শেষমেষ জানতে এসে তোমাতে ডুবলাম, অনিচ্ছেদের শীর্ষে তা।”
অরণী তাকাল ইফতির দিকে। চোখ-মুখে তার অজানা এক আভা। প্রচণ্ড লোভ তার ভালোবাসা পাওয়ার। তাই ইফতিকে সে না চাইলেও তার মন চেয়ে বসেছে। ইফতিকে সে ভালো না বাসলেও, তার মন ভীষণভাবে তার দিকে ঝুঁকছে প্রতিনিয়ত। তার মন স্বার্থপরের মতো কাজ করছে। ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় সে ভালো না বেসেও এক পুরুষের সান্নিধ্য চাইছে। সবসময় পুরুষজাতিকে ঘৃণা করে আসা অরণী নামের মেয়েটা এই নির্দিষ্ট পুরুষকে ভালোবাসতে উঠে-পড়ে লেগেছে, যেন ভালোবাসা আনতেই হবে, জোর করেই হোক সে আনবেই।
অকস্মাৎ অরণীর চোখে অন্য এক দ্যুতি খেলে গেল। থমথমে গলায় সে বলল,
-“আপনি প্রস্তুত, ইফতি?”
ইফতিও আটকাল এই প্রশ্নটায়। অরণী কীসের প্রস্তুতির কথা জিজ্ঞেস করছে তা বোঝার মতো মানসিকভাবে যথেষ্ট বিকশিত সে। অথচ এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত’ ধরনের উত্তর অরণীর মনে ভালো কোনো প্রভাব ফেলবে না। সে সময় নিয়ে বলল,
-“নিঃসন্দেহে।”
ইফতি থামল, ফের বলল,
-“আর তুমি?”
-“প্রেমের প্রতি আমার আগ্রহ নেই, বিয়ের প্রতি আরও না। অথচ নিয়মমাফিক দুটোই মানুষ করে, না পারলে অন্তত একটা করে। নিজের কথাগুলো আমি জানিয়েছি। আপনার থেকেও শুনতে চাই। মনের সাথে যদি ইচ্ছে ও চিন্তাভাবনাও মিলে যায়, তবে আমি শর্তসাপেক্ষ বিয়েতে এগোতে চাই।”
এতক্ষণ অবধি সবটা ঠিক থাকলেও, এ পর্যায়ে এসে ইফতির কপাল কুঁচকে এলো। সে জিজ্ঞেস করল,
-“কেমন শর্ত?”
সম্পর্কহীন অবস্থায় সম্পর্কে জড়ানোর মুহূর্তে অরণী সরাসরি বৈবাহিক প্রস্তাবনা রাখল, তাও শর্তজুড়ে। ব্যাপারটা অত্যন্ত অবাক করার মতো। অন্য কোনো ছেলে হলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাত জানা নেই, তবে ইফতির কাছে এখনও খুব অস্বাভাবিক লাগছে না।
অথচ অরণী যেন চাইছে ইফতি প্রচণ্ড অস্বাভাবিক অনুভব করতে করতে হতবিহ্বল অবস্থায় হা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুক, তাই বলল,
-“বিয়ে যদি হয়, তবে বিয়ের পর আমরা দু'জন আলাদা থাকব। আপনি আপনার বাবার কাছে, আমি আমার মায়ের কাছে।”
অবিলম্বে ইফতি বলে উঠল,
-“এ কী অলক্ষুণে কথা, অরু!”
.
.
.
চলবে.................................