চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছেন রিনা বেগম। হাপপ্যান্ট এসেছে মানে– এসব কি ধরনের কথাবার্তা! রাহেলা একগাল হেঁসে বলল,
“চাচি যাইবেন না?”
“তুই কি বললি?”
“কি কইছি?”
“হাপপ্যান্ট আবার কি?”
“এয়া কি কন চাচি হাপপ্যান্ট জানেন না?”
চোখ খিচে উত্তর দিল,
“তুই কোন হাপপ্যান্টের কথা বলছিস?”
“আরে চাচি ইংলেজি হাপপ্যান্ট, হাপপ্যান্ট আমনের হাপপ্যান্ট।”
রিনা বেগম বুঝলেন না। তেতে উঠে বললেন,
“হট ডু ইউ মিন বাই হাপপ্যান্ট।”
ফাবিহা মাথায় হাত দিল। এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন বলল, “মা ওটা হট ডু নয় হোয়াট ডু হবে।”
রিনা বেগম এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বললেন,
“তুই চুপ থাক আমার চেয়ে বেশি ইংরেজি পারো।”
ফাবিহা চুপ হয়ে গেল। রাহেলা বলল,
“দেহেন চাচি খামোখা ঝগড়া করবেন না। আই ও কিন্তু ইংলেজি কম জানি ন।”
“আগে ইংলেজিরে ইংরেজি বলা শেখ। আর 'ন' কি তোর ন আমি বাইর কইরা দিমু।”
“দেহেন চাচি ভালে মতো কতা কন।”
“নে ভালো মতো। হইছে?”
রাহেলা কি বলবে বুঝতে পারছে না। এবার ফাবিহা বলল, “আহ্ মা খামোখা রেগে যাচ্ছো কেন ও হাসবেন্ডের কথা বলেছে। নিশ্চয়ই বাবা এসেছে।”
কথাটা বলে দরজার দিকে তাকাতেই মাসুদ উদ্দিনকে দেখা যায়। তিনি ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে এসেছেন। রাহেলা লজ্জিত কণ্ঠে বলল,
“ওই একই হইল?”
রিনা বেগম বললেন,
“এক হইল কেমনে।”
“আমনের হোয়াট যদি হট হয় তাইলে আমার হাসবেন্ড হাপপ্যান্ট হইলে কি সমেস্যা?”
“মুখে মুখে তর্ক করিস না রাহেলা।”
“তর্ক না চাচি এইডা হইল হক কতা।”
এই নিয়ে ঝগড়া লেগে গেল রাহেলা আর রিনা বেগমের সাথে। ফাবিহা আর মাসুদ উদ্দিন হা হয়ে চেয়ে রইলেন। এই ব্যাপারটা খুব একটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। রোজই একবার করে হলেও ঝগড়া বা ঠুনাঠুনি লেগে যায় রাহেলা আর রিনা বেগমের মধ্যে। ফাবিহা এবার উঠে দাঁড়াল। দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমরা দুজন চুপ করবে?”
রিনা বেগম থামলেন না। উল্টো বললেন,“তুই আমারে চুপ করতে বলিস কেন– ওরে বল।”
রাহেলার জবাব,
“হ পারবেন তো খালি আমারেই চুপ করাইতে।”
ফাবিহা চরম বিরক্ত। সে হতাশ হয়ে বলল,
“তোমরা দুজনেই চুপ কর আর মা তুমিও কি বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি রোজ রোজ শুধু ঝগড়া কর।”
তাও ঝগড়া থামল না। এরই মাঝে দরজার সামনে এসে হাজির আহির। সে চেঁচিয়ে বলল,
“সারপ্রাইজ।”
সঙ্গে সঙ্গে সবাই তাকাল আহিরের দিকে। রিনা বেগম অবাক হয়ে বললেন, “তুই?”
আহির একগাল হেঁসে বলল,
“কি ভেবেছিলে মা, আমি আজও আসছি না।”
রিনা বেগম খুশি মনে এগিয়ে গেলেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। আহির ফাবিহার বড় ভাই। এক সপ্তাহের জন্য বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিল। ফেরার কথা কাল থাকলেও আজই হাজির হলো। ভাইয়ের আগমনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ফাবিহা। যাক পরিবেশ তো শান্ত হলো। রাহেলা ফাবিহার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
“খালি ভাইজানে চইলা আইছে দেইখা, নাইলে আইজ গো ঝগড়ায় কেউ হারাইতে পারত না আপা।”
ফাবিহার নিরাশ চাহনি। মনে মনের ভাবনা, “এই মেয়ে কোনোদিনও ঠিক হওয়ার নয়।”
••••••••••••••
ঘড়ির কাঁটায় দশটা পয়তাল্লিশ ছাড়িয়ে। মুখে কলম রেখে নিরাশ ভঙ্গিমায় বসে আছে মোহনা। রাতুল স্যারের ক্লাসটায় আজও সময় মতো আসতে পারেনি। ওই সময় যদি ওই ছেলেটার সাথে ধাক্কা লেগে দু'মিনিট লেট না হতো তাহলে বোধহয় পারত। দিনের শুরুটা আজও খবিশ স্যারের ভাষণ শুনে শুরু হলো। মোহনার কিছু ভালো লাগছে না। রোজ রোজ একই ঘটনা কেন ঘটছে– সে কি কোনোদিনও ভালো হবে না! রোজ রাতে ভাবে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সকাল হলেই আর ভালো হওয়া হয়না। জীবনটা চরম বেদনাময়। কবে যে ভার্সিটির প্যারা চুকিয়ে বিয়ে-সাদী করবে কে জানে! মোহনা অর্নাস সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। পড়াশোনার পাঠ চুকাতে এখনও ঠের দেরি। পড়াশোনা তার ভালো লাগে না। একান্তেই পড়াশোনা করা প্রয়োজন তাই কোনোরকম টেনেটুনে পড়াশোনা করছে। না হলে এই ছাতার-মাথা কে করে? প্রথম বর্ষ পর্যন্ত ভালোই ছিল। ইদানীং কেমন যেন ভালো লাগে না। পড়তে ইচ্ছে করে না মোহনা পড়াশোনায় ভালো ছাত্রী। ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করে।'
হঠাৎই রাতুল স্যারের আগমন ঘটল। পেট-মোটা স্বাস্থ্যবান একজন স্যার। মোহনার সাথে সবসময় তর্ক করে বলে তার ভালো লাগে না। তাই মোহনা তাকে ডাকে পেট-মোটা টাকওয়ালা খবিশ স্যার। এত বড় নাম মোহনা শুধু মনে মনেই ব্যবহার করে। কিন্তু এই সময় ওনার আগমন দেখে চমকে উঠল। ক্লাস তো শেষ তাহলে— হঠাৎই নজর গেল রাতুল স্যারের পাশাপাশি আরো একজনের আগমন দেখে। মোহনার বিস্ময়কর চাহনি। কারণ পাশে সকালের ছেলেটা দাঁড়িয়ে। সে বিস্ময়ের ন্যায় উঠে দাঁড়াল।'
রাতুল স্যার আসায় সব স্টুডেন্টই উঠে দাঁড়িছে। রাতুল স্যার বিনয়ের সাথে বললেন,
“বসো সবাই।”
সবাই বসল। মোহনা একা দাঁড়িয়ে। রাতুল স্যার ধমক দিয়ে বললেন,
“তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন– সবাই বসে গেছে দেখিস না।”
লজ্জায় পড়ে গেল মোহনা। বসল আস্তে করে। তবুও তার বিস্ময় কাটে না। তৌহিদের দৃষ্টি পড়ল তখন। তারও বিস্ময়ের শেষ নেই। এই মেয়েটা তো তখন...। ভাবনা নিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল তৌহিদ। রাতুল স্যার বললেন,
“ও হলো তৌহিদ। তোমাদের নতুন ইংরেজি শিক্ষক। আজ থেকে উনি তোমাদের পড়াবেন। আর সবচেয়ে চমৎকার বিষয় কি জানো? তৌহিদ তোমাদের ভার্সিটিরি স্টুডেন্ট ছিল। মাসখানেক আগে পড়াশোনা শেষ করল।”
ক্লাসের সবাই অবাক হলো। খুশিও হলো। কেউ কেউ বলল, “এই ছেলেটাকে তারা এর আগেও দেখেছে।"
তৌহিদকে স্বাগতম জানাল সবাই। তৌহিদও বিনয়ের সাথে গ্রহণ করল। রাতুল স্যার বললেন,
“তাহলে ক্লাসটা শুরু করে দেও তৌহিদ।”
তৌহিদও মিষ্টি হেঁসে বলল, “জি স্যার।”
রাতুল স্যার চলে গেলেন। শুধু মোহনাকে বললেন, “ভালো মতো থাকতে।”
কথা শুনে মোহনার ভীমড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। আশ্চর্য! সে কি খারাপ হয়ে থাকে নাকি। নতুন স্যারের সামনে মানসম্মান বলে কিছুই রাখল না।'
তৌহিদ বলল,
“আজ আমার প্রথম ক্লাস। তোমরাও আমার জন্য নতুন আমিও তোমাদের জন্য নতুন। আশারাখি তোমরা আমায় বুঝতে পারবে। আর আমিও তোমাদের বুঝতে পারব। আজ যেহেতু প্রথম দিন। ক্লাসের শুরুটা তাহলে পরিচয় পর্ব দিয়ে শুরু করা যাক।"
ক্লাসের প্রতিটা মেয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে তৌহিদের দিকে। এত ইয়াং স্যার। একটা মেয়ে বলল, “স্যার আপনার সম্পর্কে বলুন।"
তৌহিদ দ্বিধা করল না। তার নাম, বাড়িসহ আরো অনেককিছু বলল। এরপর শুরু হলো স্টুডেন্টদের পরিচয় পর্ব। সব মিলিয়ে মোটামুটি জমজমাট পরিবেশ। তৌহিদের জন্য পড়ানোটা নতুন কিছু নয়। সে এর আগেও বহু জায়গায় টিউশনি করিয়েছে। তবে ভার্সিটির টিচার রূপে প্রথম। অনুভূতিটা দারুণ। বেশ চমৎকার।
••••••••••••••
তখন সন্ধ্যে। রেডিও এফএমে আরহান হাজির। তার ভাড়ি কণ্ঠ তখন শোনা যাচ্ছে রেডিওতে। ফাবিহা বেলকনিতে বসে শুনছে। তার হাতে মোবাইল। কানে ইয়ারফুন। আরহানের কণ্ঠটা প্রবল আকৃষ্টজনক। এত মিষ্টি। শুনতে ভালো লাগে। আরহান বলছে,
“আজকাল দিনগুলো যেন কেমন কাটে। হঠাৎ বিষণ্ণে, হঠাৎ আনন্দে অথবা মন খারাপের দৌলতে। মাঝে মাঝে আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে হয় মানুষের মন খারাপ কেন হয়! মন খারাপ হওয়াটা খুব একটা বাজে ব্যাপার এমনটা কিন্তু নয়। যখন মন খারাপ হয় তখন খারাপ লাগে কিন্তু কিছু সময় পর যখন মন ভালো হয়ে যায়। তখন আমার মন কয়ে ওঠে, 'ওহে মনিব, যদি মন খারাপই না হয় তবে ভালোটার উপলব্ধি করবে কেমন করে।'– সত্যিই তো যদি মন খারাপ না হয় তবে কি ভালোটা বোঝা যেত।"
আরহানের কল আসলো। সে রোজকারের মতো শ্রোতার সাথে কথা বলতে লাগল। ফাবিহা কান থেকে ইয়ারফুন সরাল। তার ইচ্ছে করছে আরহানকে একটা কল করতে। করে বসবে কি! ছেলেটা কি বুঝে যাবে ফাবিহা তাকে কল করছে। না বোঝানো যাবে না। ফাবিহা নাম্বারটা ভাবল। কি যেন বলেছিল আরহান 82903 না না থ্রি নয় 82904. ফাবিহা নাম্বারটা উঠিয়ে কল করল। ভাগ্যক্রমে প্রথম কলটাই লেগে গেল আরহানের। রিং হচ্ছে। কিছু সময়ের মাঝেই কলটা রিসিভ করে আরহান তার ভাড়ি কণ্ঠে শুধাল,
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন– কোথা থেকে বলছেন?”
কণ্ঠ শুনে ফাবিহার বুক দক করে উঠল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার হাত-পা কাঁপছে। কণ্ঠনালি আঁটকে আসছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আশ্চর্য! এমনটা হচ্ছে কেন?
.
.
.
চলবে.......................................................................