সন্ধ্যা হতেই তুমুল উত্তেজনায় ভরপুর হলো মায়াকুঞ্জ। বাড়ির ছাঁদে বানানো হলো বড় স্টেজ। কিছুক্ষণের মাঝেই হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে আহির বসবে সেখানে। সাউন্ড-বক্স চালানোর হট্টগোল পড়েছে ইতিমধ্যে। বাড়িতে মেহমান আসতেও শুরু করেছে। মাসুদ উদ্দিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরহান। তিনি এটা সেটা বলছেন আরহানও বলছে সব ঠিক আছে। অন্যদিকে তৌহিদকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত রিনা বেগম। ছেলেটা এত কাজের– যতবার ডাকে ততবারই দ্বিধাহীন ছুটে আসে। আরহানও হয়েছে তেমন। শান্তও হাতে হাতে কাজ করছে রিনা বেগমের। যদিও শান্ত কথা বলতে পারে না শুনে কি দুঃখ তার। তিনটে ছেলের প্রতি এতটা নির্ভরশীল কখন হয়ে গেলেন বুঝতেই পারছেন না রিনা বেগম। ফাবিহা তো সকাল থেকে মায়ের কান্ড দেখে অবাক। অথচ প্রথম দিন এদের দেখে বাবার সাথে সে কি ঝগড়া! ফাবিহার ভালো লাগছে। সঙ্গে আছে জমজমাট রাহেলা। পরিবেশটা যেন আজ একটু বেশিই সুন্দর।'
রাহেলা হাতে করে দু'দুটো লাউ নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। রিনা বেগম তখন তৌহিদকে কি যেন বোঝাচ্ছেন! শান্ত পাশে দাঁড়িয়ে। আরহান মাসুদ উদ্দিনের কাছে। রাহেলা লাউ হাতে গাইতে গাইতে ঢুকল,
“লাউয়ের আগা খাইলাম,
ডগা গো খাইলাম।
লাউ দিয়া বানাইলাম ডুগডুগি।
সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী।
ও সাধের লাউ...।”
রাহেলার গান শুনে তৌহিদ, শান্ত হাসল। রিনা বেগম তেতে উঠে বললেন,
“রাহেলা চুপ কর।”
রাহেলা চুপ করল না। বলল,
“চাচি আইজ গো আমি আপনার কোনো কতা হুনতাম না।”
রিনা বেগম সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন,
“তুই আবার কোনদিন আমার কথা শোনোছ।”
“দেহেন চাচি ওইসব আমি জানি না। তয় আইজ গো কথা হুনমু না এইডা নাইনাল।”
তৌহিদের কথা আসে,
“ওইটা নাইনাল না ফাইনাল রাহেলা।”
রাহেলা তৌহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ এহন আমনেও আপার নাহান আমার ভুল ধরবেন।”
“ভুল বললে ভুল ধরব না।”
“হেয়াও ঠিক। ঠ্যাংগে ঘু ভাইজান।”
তৌহিদ নাক কুঁচকে 'আস্তাগফিরুল্লাহ্' পড়ল। বলল, “ওহ রাহেলা ওইটা থ্যাংক ইউ হবে।”
রাহেলা ঠোঁটে কামড় দিল। শান্ত মুখ চেপে হাসছে। এই মেয়েটা এত মজাদার। তার কোনো এক বইয়ে এই মেয়ের চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে হবে। বইয়ের নাম হবে চমলক্ক রাহেলা খাতুন। শান্ত হেঁসে ফেলে। রাহেলা বলে, “শান্ত ভাইজান আপনে হাসলে এত চমৎকার লাগে। আপনে সবসময় হাসবেন।”
শান্ত মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, 'আচ্ছা।'
সব কথোপকথন বাদ দিয়ে এতক্ষণ পর রাহেলা বলল, “ওহ চাচি একখান কথা তো ভুইলাই গেছি কেডা জানি কল করছিল চাচায় আপনারে ডাকে।”
রিনা বেগম বিস্মিত হয়ে বললেন,
“এতক্ষণ পর এই কথা মনে পড়ল।”
“চলি চাচি।”
রাহেলা বেগম কিছু বললেন না। তবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছুটে গেলেন ঘরে। এই মেয়ে আর ঠিক হলো না। সকালেও অরিনের আগমনের কি কাণ্ডটাই না ঘটাল। খামোখা ঘর মাথায় তুলল। ভাগ্যিস অরিন রেগে যায়নি।
•••••••••••••••
দোতলার বারান্দায় তখন ফুল লাগাচ্ছিল আরহান। প্রায় কাজ শেষ। পুরো দোতলার দেয়ালটাকে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। নানান রঙের ফুল। তবে লাল গোলাপটা একটু বেশিই দেয়া। আচমকাই কর্নারের রুমটা দিয়ে খটখট আওয়াজ হলো। কেউ বুঝি খুলছে। আরহান দৃষ্টি রাখল কর্ণারে। না কেউ আসছে না। শব্দটা আর একটু তীক্ষ্ণ হলো। জোড়ালো ভাব আসলো। আরহানের মনোযোগ ভঙ্গ হচ্ছে। সে স্বল্প আওয়াজে বলল, “কে?”
উত্তর আসলো না। উপরে কেউ নেই। আরহান একাই আছে। তার কাজও শেষ পর্যায়ে। এখন প্রায় মানুষই ছাঁদে গেছে। সেও যাবে। আবারও খটখট শব্দ আসলো। কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। আচমকাই সাউন্ড বক্সের প্রবল শব্দ কানে বিঁধল আরহানের। দরজার শব্দটা থেকে তার মনোযোগ বেরিয়ে আসলো। আরহান লাস্টবার ফুলের গিটটা শক্ত করল। কানে আসা সাউন্ড-বক্সের আওয়াজটা ভূমিকম্পের মতো পুরো বাড়ি লাফিয়ে মারছে। আরহান কর্ণারে তাকাল। কাউকে আসতে দেখা যাচ্ছে না। আর ভাবল না। চলে যেতে লাগল। এবার কারো কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে,
“কেউ আছো, মা আমার দরজা কে আঁটকেছে?”
কণ্ঠখানা খুব কম স্বরে শোনা গেল। আরহান কৌতুহলী এগিয়ে গেল এবার। সাউন্ড বক্সের প্রকোপটা তখন থামল। গানটা যে শেষ হয়েছে। এবার সম্পূর্ণরূপে আরহানের কানে আসলো কণ্ঠটা। ফাবিহার কণ্ঠ। সে ডাকছে,
“রাহেলা, মা, অরিন।”
আরহান দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল তখন। কোনো বিপদ ঘটল না তো। ততক্ষণে সাউন্ড বক্সে আরেকটা গান চালু হয়ে গেছে সঙ্গে মানুষদের চিৎকার। এইসব ব্যাপার আরহানের বড্ড অপছন্দ। একপ্রকার বাধ্য হয়েই এসব শুনছে। দরজার কাছে এগোতেই আরহান দেখল ফাবিহার রুমের দরজাটা বাহির থেকে আটকানো। সে দ্রুত দরজা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ফাবিহাকে দেখা গেল। সে আজ হলদে রঙের চুড়িদার পড়েছে। চুলগুলো দিয়েছে খুলে। দু'হাত ভর্তি হলুদ কাঁচের চুড়ি। বেশ লাগছে মেয়েটাকে। এমনিতেও সাজলে সব মেয়েদেরই সুন্দর লাগে।”
দরজা খুলতেই ঘাম জড়ানো শরীরে ক্লান্তিত আরহানকে দেখে একপ্রকার অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ফাবিহা। শুঁকনো হেঁসে বলল,
“আপনি?”
আরহান কপাল চুলকে উত্তর দিল,
“জি আমি। আপনি এখানে কি করছেন— সবাই উপরে চলে গেছে তো।”
“আর বলবেন না কে যেন বাহির থেকে দরজা আঁটকে চলে গেছে।”
“বুঝলাম। দ্রুত যান। সবাই বোধহয় আপনার অপেক্ষা করছে।”
ফাবিহা যেতে নিল। আবার পা থামিয়ে বলল,
“আপনি যাবেন না?”
আরহান হাত ঘড়িটা দেখল। আটটা যাবে। ন'টার মধ্যে তাকে বের হতে হবে। যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বলল,
“দেখি।”
“আপনাদের ওপর বড্ড অনিয়ম হচ্ছে তাই না।”
“জি না। উল্টো আপন বলে মনে হচ্ছে।”
ফাবিহা মুগ্ধ হলো আরহানের উত্তরে। বলল,
“অবশ্যই ছাঁদে আসবেন।”
“দেখছি আমার আবার রেডিওতে যেতে হবে।”
ফাবিহা একপ্রকার অবাক হয়ে বলল,
“আজও যাবেন?”
“যেতেই হবে।”
“না গেলে হয় না?”
“মানুষ আমার অপেক্ষা করছে।”
“ছুটি নিলেই তো হতো।”
“মানুষ বড্ড রাগ করে।”
“নিজের দিকটাও তো দেখা উচিত।”
“আমি যে অন্যের খুশিতেই অভ্যস্ত রৌদ্রময়ী।”
“সব কথার জবাব কি দিতেই হবে?”
“দেয়ার চেষ্টা করি।”
“আপনার সাথে কথায় পারা যাবে না।”
“আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন— আমি মানুষটা আরজে।”
“আরজেরা কি চুপ থাকতে জানে না?”
“জানে বোধহয়, আমি পারি না।”
ফাবিহার কথা আঁটকে গেল। বলার মতো আর কিছু খুঁজেই পেল না। আরহান হয়তো বুঝল। মৃদু হেসে বলল, “আপনার বোধহয় দেরি হচ্ছে।”
এতক্ষণ পর ফাবিহার টনক নড়ল। সে তো প্রায় ভুলতেই বসেছিল ব্যাপারটা। ফাবিহা হেঁটে গেল। হঠাৎ পিছন থেকে আরহান ডাকল, “শুনুন।”
ফাবিহার পা থেমে গেল। সে কৌতুহলী তাকিয়ে রইল। সাউন্ড-বক্সটা এতক্ষণ বন্ধ ছিল। আবার চালু হলো। আরহানের ঠোঁট নড়ল। সে যেন কি বলল! ফাবিহা শুনতে পেল না। সে জিজ্ঞেস করল,
“কি বললেন?”
আরহান আবারও বলল। শোনা গেল না। সাউন্ড বক্সের আওয়াজটা এত তীব্র। কিছু সময় পর সাউন্ড বক্স থেমে গেল। ফাবিহা স্বস্তি পেল। এববার শান্ত স্বরে শুধাল,
“এবার বলুন।”
আরহানের 'না' বোধক উত্তর। এখন আর বলবে না। ফাবিহা নিরাশ হয়ে বলল, “আমি কিছু শুনতে পাইনি।”
আরহানের পলকহীন চাহনি। কণ্ঠে শীতলতার ছোঁয়া। সে আওড়ায়, “আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে ফাবিহা।”
এতক্ষণ পর কাঙ্ক্ষিত কথাটি শুনতে পেয়েও ঠিক মতো বোধগম্য হলো না। ফাবিহা কিছু সময় পর বুঝতে পেরে— কি বলবে বুঝতে পারল না। কণ্ঠনালি আবার আঁটকে গেল। এতক্ষণ তো দিব্বি কথা বলতে পারছিল। এখন কি হলো!'
আরহান হাঁটা ধরল। ফাবিহা তাকিয়ে। ধন্যবাদ কি জানাবে! ছেলেটা তো চলে যাচ্ছে। ফাবিহা ডাকতে চাইল। ডাকা হলো না। তার আগেই আরহান তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। অদ্ভুত ছেলে! ফাবিহার আগে যাওয়ার কথা ছিল। অভদ্র ছেলে জবাব না নিয়েই চলে গেল।
••••••••••••••
ছাদঘরে সেজেগুজে সবুজরঙা পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। অপেক্ষা করছে ফাবিহার। মেয়েটা কেন যে এখনও আসছে না। এদিকে তার ড্যান্স করার সময় এসে গেছে। ভাবল ফোন করবে। আবার করল না। হয়তো এখনও সাজচ্ছে। হঠাৎ পিছন থেকে কোন ছেলের যেন কণ্ঠ শোনা গেল। সে অরিনকে উদ্দেশ্য করে আরেকজনকে বলছে,
“দেখছিস দোস্ত কি মাল! বিয়ের বাড়িতে আসলেই এই এক মজা চারিদিকে খালি সুন্দরী মাল আর মাল। আর এই গ্রীণ কালার মালটা তো সবার চেয়ে আলাদা। কি ফিগার দেখেছিস? আহা কোমড়!”
অরিনের গা জ্বলে উঠল। সে তক্ষৎণাৎ পিছনে ফিরল। তখনই দেখতে পেল। সকালের সেই চশমা পড়া ছেলেটা। নামটা যদিও জানা হয়নি। অরিনের এত খারাপ লাগল। কিছু বলবে ভেবেও বলল না। সকালে এই ছেলেটাকে সে সাহায্য করেছিল। আর এই ছেলে কিনা তাকে নিয়েই এত বাজে মন্তব্য করল। অরিনের ঘৃণা আসলো। সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল।
.
.
.
চলবে.......................................................................