রৈনীলের বইগুলোর চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। সারাদিন কেটে গেলো। মা আমাকে কিছুই বললেন না। বিকেলে বাবা ফিরলেন। আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। এই প্রথম একা আমি কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলাম। বাবা উদ্বেগ প্রকাশ শেষে বললেন, 'আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সরণী।'
আমি চমকে উঠে বাবার দিকে তাকাই। আমার দুচোখ ব্যকুল হয়ে চেয়ে আছে। কীসের সিদ্ধান্ত জানার জন্য তর সইছে না।
বাবা বললেন, 'তুমি ভর্তির পরে ভার্সিটির হলে থাকবে।'
আমি বিস্ফারিত চোখে তাকালাম। আমার জীবনে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথাটা এইমুহুর্তে শুনেছি আমি। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না এমন ধরনের অনুভূতি হচ্ছে আমার। আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে বাবা বললেন, 'তোমার কি হলে থাকতে আপত্তি আছে?'
আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম, 'আমি তো এ ব্যাপারে কিছুই জানিনা। তোমরা যা বলবে তাই করবো।'
'এখানেই তো সমস্যা। সবকিছুই তো আমাদের ইচ্ছায় হয়। তোমার কি নিজের ইচ্ছা বলে কিছু নেই?'
আমি হতচকিত অবস্থায় এখনও তাকিয়ে আছি। বাবা বললেন, 'তোমার পেন্সিলটা পর্যন্ত তোমার মা কিনে দেয়। পেন্সিলের শার্পনার আমি কিনে আনি। এভাবে তো তুমি কোনোদিন লাইফে কিছু করতে পারবা না। তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো। এখন নিজের ছোট ছোট সিদ্ধান্ত গুলো নিজেই নেয়ার মতো বয়স হয়েছে। তবুও আমরা তোমাকে শেকলে আবদ্ধ করে রেখেছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে হলে রাখবো। তুমি নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু করবে। ইচ্ছে হলে ক্লাসে যাবে, ইচ্ছে না হলে যাবেনা। মন যেভাবে চাইবে সেভাবে জামাকাপড় পরবে, সেভাবে সাজবে, সেভাবে শুয়ে থাকবে। কেউ তোমার পারসোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করবে না। তুমি কি রাজি?'
আমি আকাশ থেকে পড়েছি। আবেগে, উত্তেজনায় আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবো। আমি নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করছি। বাবা বললেন, 'এই সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি। তোমার মাকে এখনো কিছু জানাই নি। তোমার মা যদি জিজ্ঞেস করে তুমি থাকতে চাও কিনা? তাহলে তুমি কি বলবা?'
'কি বলবো বাবা?'
'বোকা মেয়ে। কি বলবা সেটা আমাকেই আবার জিজ্ঞেস করছো কেন? এখন যাও। রুমে গিয়ে নিজে নিজে ভাবো কী করবা।'
আমার এক দৌড়ে রুমে যেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে বুঝলাম পা চলছে না। ধীরপায়ে রুমে এলাম। দরজা বন্ধ করে দিয়ে সোজা বাথরুমে এসে শাওয়ার ছেড়ে দিলাম। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে হাউমাউ করে কাঁদলাম। আমি নিজেও জানিনা আমার ভাগ্য কীভাবে এতটা সুপ্রসন্ন হয়ে গেল। কয়েকদিন যাবত সবকিছু আশ্চর্যজনকভাবে ঘটছে। আমি আমার সারাজীবনে এতটা আশ্চর্য কখনো হইনি যা এই কয়েকদিনে হয়েছি।
দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেলেও মা রৈনীলের বইগুলো নিয়ে কিছু বললেন না। আমি ভীষণ উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে সময় পার করলাম। ভাবলাম মা হয়তো বইয়ের ভেতর কিছু পেয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে মা কিছু বললো না বিধায় আমিও আর উদ্বেগ বাড়ালাম না। ধরে নিলাম বইগুলো মা এমনিই ঘাটাঘাটি করেছেন।
আমি রাত্রিবেলা ল্যাম্প জ্বালিয়ে বইগুলো পড়ি। কখনোবা বারান্দায় বসে দিনের আলোতে বই পড়ি। অনেক বড় বড় সাহিত্য, উচ্চমার্গীয় ধ্যানধারণার বই। এগুলো রৈনীল কেন পাঠিয়েছে জানিনা। কিন্তু বই পড়তে পড়তেই মাঝেমাঝেই আমার খুব অন্যরকম লাগে। বইয়ের পাতায় রৈনীলের ঘ্রাণ টের পাই। মনে হয়, এই বই রৈনীল ছুঁয়েছে, পড়েছে, স্পর্শ করেছে। ভাবলেই প্রশান্তিতে মন ছেয়ে যায়। আমি জানিনা রৈনীলের ভাবনা কেন আমাকে এতটা স্বস্তি দেয়।
একদিন বিকেলবেলা স্বাগতা আপু চলে এলো। আমি রুমে বসে বই পড়ছি। আপুর গলা শুনে দৌড়ে গেলাম লিভিংরুমে। মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করছে আপু। আমি ছুটে গিয়ে আপুর হাত ধরে বললাম, কেমন আছো তুমি?
'ভালো আছি। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। জরুরি খুব। রুমে চল।'
মাকে রেখে আপু আমার সঙ্গে উঠে এলো। আমি বুঝে উঠতে পারিনি আপু কি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আপু জানালো, সায়েম নামের সেই বন্ধুটি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আপুকে বারবার তাড়া দিচ্ছে আমার ফোন নাম্বার দেয়ার জন্য। আমার নিজস্ব ফোন নেই জানার পর সে নাকি সরাসরি দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
আমি অবিশ্বাসের সুরে বললাম, 'যা! কি বলো এসব?'
আপু খানিক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিলো, 'এটা তো সাধারণ একটা কথা। সবচেয়ে সাংঘাতিক বিষয় কি জানিস?'
'কি?'
'সায়েম তোকে বিয়ে করতে চায়।'
আমি বিস্ফারিত কণ্ঠে বললাম, 'কিহ!'
আর কিছুই বলতে পারলাম না। আমার গা শিরশির করছে। মাঝেমাঝে প্রায়ই বুয়ার কাছে শুনি আমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। যদিও মা বাবা সেগুলোকে পাত্তা দেন না। "আমার মেয়ে এখনো ছোট" বলে সবাইকে নাকচ করে দেন বাবা মা। কিন্তু সায়েমের মতো সুশিক্ষিত একজন মানুষ কিভাবে আমার মতো অল্পবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ের কথা বলতে পারে মাথায় আসছে না।
আপু জানালো, 'সায়েম বলেছে তুই চাইলে এখনই বিয়ে করতে পারিস। আবার চাইলে এক বছর সময় নিয়েও করতে পারিস। কিন্তু ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলে ও একটা ডিসিশন ফাইনাল করে রাখতে চায়। যাতে তোর সাথে ওর সম্পর্কটা কনফার্ম থাকে। যদি তোর এতে আপত্তি না থাকে আরকি। আমাকে বরং বলেছিল সরাসরি মমকে প্রস্তাব দিতে। ওর হয়ে সাপোর্ট দিতেও বলেছে। আমি তো ভাই আগে তোর সঙ্গে কথা বলবো। তোর মতামত ছাড়া আমি কিচ্ছু করবো না।'
আমি হতভম্ব স্বরে বললাম, 'আমি এখনো অনেক ছোট আপু। তুমি কিভাবে আমাকে নিয়ে এসব ভাবনাতেও আনতে পারো? আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে আপু?'
'ওর প্রোপোজাল দেয়ার ধরনটাই এমন ছিল। তোর ফোন নেই শুনে বেচারা অবাক হয়েছে। বাসা থেকে সবকিছু ঠিক করে রাখা হলে অন্তত ওপেন রিলেশনশিপে থাকা যাবে। বিয়ে নাহয় পরে যেকোনো সময় হবে। ও আমাকে এগুলো বলতে বলেছে।'
'না আপু। এটা অসম্ভব।'
'ঠিক আছে। আমি ওকে এটাই বলবো।'
আমি উঠে এলাম। এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বরং খুবই বিরক্তবোধ করছি। টেবিলের ড্রয়ার খুলে খুব প্রয়োজনীয় কিছু খুঁজছি এমন ভাব করতে লাগলাম। আপু বলল, 'কেমন আছিস তুই বলতো? তোর দিনকাল যাচ্ছে কেমন?'
'ভালোই।'
'আমার বাসা থেকে আসার পর একদিনও কল দিলি না।'
'তুমিও তো দাও নি।'
'আমি ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম। আমার সঙ্গে বাইরে যাবি?'
'এখন!'
'হুম। মমকে বলি?'
'না থাক। পরে দেখা যাবে মা তোমাকেই অপছন্দ করা শুরু করবে।'
'এই সামান্য কারণে কেউ আমাকে অপছন্দ করলে আমিও তাকে পছন্দ করার বিশেষ কোনো কারণ নেই।'
আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে উত্তর দিলাম, 'আমি যাবোনা কোথাও।'
স্বাগতা আপু আজকে দেরী করলো না। আমার রুম থেকে বের হয়েই মা'র কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আমি বসে রইলাম বই নিয়ে। কিন্তু বইতে মন বসলো না। কোনো এক বিচিত্র ভাবনায় বুদ হয়ে রইলাম।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পরের সময়টা আশ্চর্যজনকভাবে আমাকে উত্তেজিত করে ফেললো। প্রথম দিন ভার্সিটিতে গিয়ে তেমন কারো সঙ্গে পরিচয় হয়নি। তবে নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, সবকিছুকে আমি প্রাণভরে দেখছিলাম। ফেরার পথে ভাইয়া আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলো।
প্রথম কয়েকদিন যাওয়ার পথে বাবা আমাকে ভার্সিটিতে রেখে যান। আর রোজ ফেরার সময় আমি ভাইয়ার সঙ্গে বাসায় ফিরি। আমার যাওয়া আসা নিয়ে কারোরই কোনো উৎকণ্ঠা নেই। আমিও যে খুব একটা বিরক্ত হচ্ছি তাও না। বরং আশ্চর্য হচ্ছি। এত বড় মেয়েকে কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে, আবার নিয়ে আসছে এটাতে আমার বিরক্তির চাইতে আশ্চর্যটাই বেশী হতে হচ্ছে।
একদিন বাসায় ফিরে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়ে গেলাম। ড্রয়িংরুমে সোফার ওপর বসে আছে সায়েম! এতটাই হতবাক হয়ে গেলাম যে নড়তে পর্যন্ত পারলাম না। সায়েম হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, 'হাই সরণী, ভালো আছো?'
রাগে গা জ্বলে গেলো আমার। দ্রুতপদে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। তবে রাগটা সায়েমের ওপর নয়, স্বাগতা আপুর ওপর হচ্ছে। রাগে খানিকক্ষণ খাতার কয়েকটা পৃষ্ঠা টেনে টেনে ছিড়লাম। তারপর শান্ত হয়ে বসে পড়লাম। সায়েমকে শেষ পর্যন্ত বাসার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। এতবার নিষেধ করা সত্ত্বেও?
আপুর সঙ্গে আমি অনেকদিন কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু বেশীক্ষণ সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলাম না। দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। ওপাশ থেকে শোনা গেল আপুর গলার স্বর।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম দরজা খুলবো না। কিন্তু রাগটাও তো দেখানো দরকার। দরজা খুলে আপুর হাত ধরে ভেতরে টেনে নিলাম। তারপর মৃদুস্বরে বললাম, 'তুমি একটা... কথা বলবা না আর আমার সঙ্গে। আমাকে বোন পরিচয় দিবা না আর।'
'হয়েছে। থাম। যা বলার মমকে বলিস।'
'মানে?'
আপু গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু করে আমাকে বললো, 'মা নিজে আমাকে বারবার করে প্রেশার দিয়েছে সায়েমকে বাসায় আসতে বলার জন্য। মম ওর সঙ্গে আলাপ করতে চায়। প্রতিদিন কয়েকবার ফোন করতো মম। বলেছে যদি ওকে নিয়ে না আসি, তাহলে যেন আমিও আর কখনো এই বাসায় না আসি। বাধ্য হয়ে আমি সায়েমকে নিয়ে এসেছি।'
আমি কী বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কোনোমত নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'মা কিভাবে জানলো ওর কথা? তুমি বলেছো?'
'আরে নাহ। আমিও ভেবেছিলাম তুই বলেছিস। পরে মাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আমরা ওইদিন রুমে কথা বলার সময় মম দরজার বাইরে থেকে সব শুনেছে।'
'হায় রে! এমন দিনও আমার দেখতে হলো?'
আমি ধপ করে বসে পড়লাম। জন্মের পর হতেই এই ভদ্রমহিলা আমাকে একদণ্ড শান্তিতে থাকতে দেয়নি। সবসময় এমনভাবে আমাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে যেন আমি জেলখানার কয়েদি। শেষ পর্যন্ত আমার ঘরে আড়িপাতা! এতটুকুও স্বাধীনতা আমাকে কোনোদিন দেয়া হলোনা। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, সায়েমের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইলে আমি নিঃশর্তে রাজি হয়ে যাবো। তাহলে অন্তত কিছুটা হলেও মুক্তির স্বাদ মিলবে।
.
.
.
চলবে........................................................................