প্রেমান্বেষা - পর্ব ০৭ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


" তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো নীলিমা?"

নীলিমা তেরছা কণ্ঠে বললো,
" জি হ্যাঁ! আই এম ইগনোরিং ইউ মিস্টার স্মরণ শেখ। এখন কি প্রমাণস্বরূপ খাতাকলমে লিখে দিবো?"

নীলিমার চটপট জবাবে খানিক থতমত খেলো স্মরণ। ধাতস্থ হয়ে বললো,
" না মানে সেটা বলিনি আমি৷ আচ্ছা, এখানে একটু বসো। বসে কথা বলি। প্লিজ নীলিমা।"

স্মরণের শেষোক্ত কথায় অনুনয়ের ছোঁয়া পেয়ে নীলিমার মন খানিক গললো বোধহয়৷ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,
" এবার তো হাতটা ছাড়ুন। বসছি আমি।"

পরিস্থিতির শিকারে অপ্রস্তুত হলো স্মরণ। ক্ষণেই নীলিমার হাত ছেড়ে মিনমিন স্বরে বললো,
" সরি।"

নীলিমা অবশ্য তা শুনলো না। বাড়ির ভেতরকার গ্যাঞ্জামে এমন মিনমিনে কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হওয়া দায়৷ নীলিমা চায়ের মগটা অপর হাতে নিয়ে চেয়ারটা খানিক দূরে সরিয়ে বসতে চাইলো। স্মরণের পাশাপাশি, এত কাছে থাকা সম্ভব নয়। তাই চেয়ারটা ধরে একটুখানি দূরে রেখে সে বসতে নিলো। তখনই উঠোনোর ছোট্ট মাটির ঢিপিতে চেয়ার আটকে ক্ষণিকের মাঝেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নিলো নীলিমা। ক্ষণেই স্মরণ এক হাতে তার হাত ধরে অপর হাতে চেয়ার সামলে নিলো। ঘটনাটি ঘটে যেতে সময় নিলো মাত্র কয়েক সেকেন্ড। 
আকস্মিক বিপদে লজ্জা, সংকোচ ও ভয় ঘিরে ধরলো নীলিমাকে। বুকের খাঁচার ভেতরের ছোট্ট হৃদযন্ত্রখানি তুমুল গতিতে ছুটে চলতে আরম্ভ করলো। ভয়ের চোটে বুকে থুথু দিলো নীলিমা, বাঙালির স্বভাবজাত স্বভাব যা!
স্মরণও ক্ষণিকের জন্য ঘাবড়ে গিয়েছিলো। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
" ঠিক আছো তো?"

নীলিমা কয়েক পলের মাঝে নিজেকে ধাতস্থ করে শুধুমাত্র 'হুম' বললো। স্মরণ এবার সতর্কতার সাথে চেয়ারটা ঠিকঠাক বসিয়ে নীলিমাকে বললো,
" এবার বসো। মনে হয় মাটি উঁচু ছিলো। "

নীলিমা জবাব দিলো না। ছোট্ট এই ঘটনাটি দ্রুতই ভুলে চটপটে হয়ে উঠলো। গলায় জোর রেখে বললো,
" আমারই ভুল ছিলো আসলে। জায়গা দেখে বসিনি। তা, কি কথা বলবেন দ্রুত বলুন।"

স্মরণ সামান্য বিস্মিত হলো। মনে হলো এই মেয়েটাই অপ্রস্তুতকর এক পরিবেশে পড়ে একদম মিইয়ে গিয়েছে। অথচ এখন পটরপটর শুরু করে দিয়েছে!

স্মরণও জোর গলায় বললো,
" হ্যাঁ, তো, বলছিলাম যে, মানে আমাকে ইগনোরের কারণটা কি? এসেছি দুদিনের মতো। অথচ একটাবারের জন্যও কেমন আছি জিজ্ঞেস করোনি। কিন্তু বাকি সবার সাথে হেসেখেলে বেড়াচ্ছো। এর কারণ বলো। শুনতে চাই।"

নীলিমা হালকা একটু কেশে নিলো। সহজ গলায় বললো,
" আমাকে না জিজ্ঞেস করে আপনি বরং টাইম মেশিনে গিয়ে ছয় বছর আগের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে আসুন।"

স্মরণের বুঝতে বাকি রইলো না নীলিমা কোন স্মৃতি বা ঘটনাগুলোর কথা বলছে। স্মরণ মৃদুস্বরে হেসে উঠলো। খানিকটা কটাক্ষের সুরেই বললো,
" সিরিয়াসলি নীলিমা! তুমি এখনও ওসব ঘটনা নিয়ে পড়ে আছো? তখন বাচ্চা ছিলে, আর এখন বড় হয়ে গিয়েছো। বুঝ এসেছে। এখনও......"

স্মরণের কথাগুলো নীলিমার আত্মসম্মানে সুক্ষ্ম একটা আঘাত হানলো। তবে আঘাতের ক্ষত লুকিয়ে জোর গলায় বললো,
" এক্স্যাক্টলি। আমিও সেটা বলছি। আমি তখন ছোট ছিলাম। অবুঝ ছিলাম এসব ব্যাপারে। বান্ধবীর প্ররোচনায় একটা ভুল কাজ করে বসেছিলাম। ঐ বয়সটাই ছিলো ভুলের। আমি ভুল করেছি, আমি মানছি। কিন্তু আপনি মানছেন না কেনো? আপনি তো তখন বুঝদার ছিলেন। আমার বয়স পেরিয়ে এসেছিলেন। আপনি চাইলেই আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। ইচ্ছেমতো মজা লুটেছেন। আপুকে সব বলে দিয়েছেন। ঈদের সময়ও আমাকে খোঁচা দিয়েছেন। এই যে এতকিছু হয়ে গেলো আর আপনি জিজ্ঞেস করছেন আপনাকে ইগনোর কেনো করছি! আপনাকে ইগনোর না করার কারণটা বলুন। পারবেন না আপনি। "
বলেই ফোঁস করে দম ফেললো নীলিমা। বেশ বড়সড় একটা ভাষণ ঝেড়েছে সে। এভাবে স্মরণের সামনে একনাগারে কিভাবে কথা বলে গেলো তাই ভাবছে সে। 
স্মরণ কিছুক্ষণ হা করে রইলো। নীলিমার এই অনর্গল কথায় ফাঁকে সে কিছু বলার সুযোগ পেলো না। স্মরণ খানিকটা নড়েচড়ে বসলো। এখন নীলিমার সাথে বুঝেশুনে সামলে কথা বলতে হবে। নচেৎ আবার মুখ দিয়ে হাই স্পিডের ট্রেন ছেড়ে দিবে। 
স্মরণ ছোট্ট একটা ঢোক গিললো। রয়েসয়ে বললো,
" আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি নীলিমা। কিন্তু এখন কি করতে হবে? "

নীলিমা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকালো। আবছা আলোয় সে দৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে বোঝা না গেলেও এই আগুনের আঁচ কাছ থেকে অনুভব করতে পারছে স্মরণ। নীলিমা দাঁত কিড়মিড় করে ক্রোধান্বিত গলায় বললো,
" আপনি আসলেই আবুলের নাতি আবুল।"
বলেই বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো নীলিমা। আর স্মরণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। নীলিমার বলা ঐ একটি লাইনের অর্থোদ্ধার করতে তৎপর হলো সে। নিজেকেই শুধালো,
" নীলিমা কি আমার মাধ্যমে আমার নানাকে গালি দিয়ে গেলো!" 

--------------------------

তারাবির নামাজ পড়ে মাত্রই আনোয়ার সাহেব রুমে ঢুকেছেন। রুমে ঢোকা মাত্রই দেখলেন মাসুদা বেগম খাতা কলম নিয়ে কিছু হিসেব কষছেন৷ তিনি এগিয়ে গেলেন৷ উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
" কি হিসাব করছো মাহবুবের মা?"

মাসুদা বেগম স্বামীকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চট করে খাতা বন্ধ করে কলমটা পাশে রেখে বললেন,
" টাকার তো শর্ট পড়ে যায় গো। ঐ জমিটা বেঁচেও তো খরচাপাতি উঠবে না মনে হচ্ছে। "

আনোয়ার সাহেব মৃদু হাসলেন। ফুরফুরে মেজাজে বললেন,
" যা উঠে তাতেই হয়ে যাবে। কালকে আমি আর বড় ভাই গিয়ে বাবুর্চির সাথে আবার কথা বলে আসবো। বরযাত্রীর খাবারে ক্ষীর যোগ করার কথা মনে ছিলো না। "

" আবার ক্ষীর যোগ করবে! এমনিতেই তো খরচ কম হচ্ছে না। বলছি কি, বড় ভাইজানের কাছে কিছু টাকা ধার করি। দোকান থেকে যা উঠবে পরে সব শোধ করে দিবো। "

আনোয়ার সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ের বাবা হওয়ার মতো কঠিন দায়িত্ব পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই বোধহয়। ছোট থেকে মেয়েকে চোখে চোখে মানুষ করা, বড় হলে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো, এসব দিয়েও মেয়েটা শেষ সময়ে এসে পর হয়ে যায়। আদরের মেয়েটা তখন আর বাড়ির থাকে না। নরম মেয়েটা হয়ে উঠে কোনো বাড়ির বউ। সেখানে গিয়ে দায়িত্বের বেড়াজালে পড়ে বাবা মা'কে সময় দিতে পারে না। কালক্রমে তাদের প্রতি মায়ামমতা কমে গিয়ে স্বামী সন্তানের প্রতি মায়ামমতা বাড়ে। কি অদ্ভুত নিয়ম এ দুনিয়ার! 
আনোয়ার সাহেব মেয়ের জন্য ইঞ্জিনিয়ার পাত্র বেছে নিয়েছিলেন। এ যুগে ভালো পাত্র পাওয়ায় যৌতুকের মতো জঘন্য জিনিস থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। তবে মেহমানদারী নামক বিশাল শব্দটা তার ঘাড়ে এসে চেপে বসে। গ্রামে থাকেন বলে আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ দাওয়াত করে না খাওয়ালে নানারকম কথা বলবে, এ ভয়ে তিনি বিশাল দাওয়াতের আয়োজন করছেন। আর এর খরচাপাতির পুরো খরচটা নিজের পকেট থেকে দিতে চাইছেন। আনোয়ার সাহেবের একটাই কথা, নিজের মেয়ের বিয়ে নিজের টাকা দিয়ে করাবেন। কারোর কাছ থেকে এক পয়সা পরিমাণ ধারও নিবেন না। কেননা তখন মনে হবে ধারের টাকায় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পাঠাচ্ছেন তিনি। 
 আনোয়ার সাহেব এবার মাসুদা বেগমের হাতে হাত রেখে নম্র গলায় বললেন, 
" আমি তোমাকে আগেও একই কথা বলেছি মাসুদা। মেয়ের বিয়ে সম্পূর্ণ নিজের টাকায় দিবো। বরযাত্রী, খাওয়াদাওয়া সব নিজের টাকায় করবো। আর মাহবুব তো নিজের সাধ্যমতো কিছু টাকাও দিচ্ছে। তাহলে এত চিন্তা কিসের? আর বড় ভাইজান বা মিলি আপার কাছ থেকে বা লিলির কাছ থেকে অনুষ্টানের একটা টাকাও চাই না আমি। তারা খুশি হয়ে মানতাসাকে গহনা শাড়ি যা দিবে তাতেই সন্তুষ্ট আমি। আমার কিছু লাগবে না। এজন্য দয়া করে এসব চিন্তা বাদ দাও। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর না হলে এদিক ওদিক থেকে অনুষ্ঠানের কিছু কাটছাট করবো। ঠিক আছে? "

মাসুদা বেগম অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নাড়ালেন। আনোয়ার সাহেব স্ত্রীর থুতনি ধরে আদুরে গলায় বললেন,
" এবার একটু হাসি দিয়ে দাও বউ আমার। শাশুড়ী হয়ে যাবে কিছুদিন পর। এমন দুঃখী দুঃখী মুখ করে রাখলে চলবে!"

মাসুদা বেগম এবার আলতো হেসে ফেললেন। তার হাসির তালে আনোয়ার সাহেবও হাসলেন। 

-------------------

সেহরির পর থেকে স্মরণের চোখে আর ঘুম নেই। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে দেখলো সূর্য উঠতে আরম্ভ করেছে। পাশ ফিরে দেখলো মাহবুব নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আহ কি শান্তির ঘুম!
স্মরণ কিছুক্ষণ চোখ বুজে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম বাবাজি এবারও চোখে এসে ধরা দিলো না। অগত্যা বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। যেহেতু সূর্যোদয় আরম্ভ হয়েছে, সেহেতু আজ সূর্যোদয় দেখেই সকালটা কাটানো যাক!

স্মরণ উঠে ওয়াশরুমে গেলো। চোখমুখ ধুয়ে টিশার্টটা গায়ে জড়িয়ে রুমের দরজা খুললো। দরজা খুলতেই বিপরীত দিকের বাহাদুর শেখের রুমের দরজা খোলা দেখলো। তার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই দেখলো আসমানী বেগম বেরিয়ে আসছেন। ঠিক তাঁর পিছেই বাহাদুর শেখ লাঠি ভর করে তাঁর হাত ধরে এগিয়ে আসছেন। স্মরণ খানিকটা অবাক হলো, এই ভোরে দাদা দাদীকে এভাবে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে। ভাবলো দাদীকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু এর পূর্বেই বাহাদুর শেখ বললেন,
" শুনো দিল, আমারে আজ পুকুরঘাটে নিয়া যাবা। কিছুক্ষণ বইসা থাকবো।"

" আচ্ছা আচ্ছা। চলো আগে। সূর্য তো উইঠা গেছে অনেকক্ষণ আগেই। চলো এবার।"

বলেই আসমানী বেগম ধীর পায়ে বাহাদুর শেখের হাত ধরে এগুতে লাগলেন। বাহাদুর শেখ বিয়ের পর থেকে আসমানী বেগমকে 'দিল' বলে ডাকেন। ইংরেজ আমলে তাদের বিয়ে হয়েছিলো। সেসময় এক ভারতীয় কর্মচারীর সাথে বাহাদুর শেখের বেশ সখ্যতা ছিলো৷ তাঁর জবান হতেই জেনেছিলেন, হৃদপিণ্ডকে ভারতীয়রা 'দিল' বলে। সেই থেকেই আসমানী বেগমকে আদর করে নিজের হৃদপিণ্ড অর্থাৎ 'দিল' বলে সম্বোধন করেন। বাড়ির সকলেই এ সম্বোধন সম্পর্কে জানে। স্মরণও জানে। তবে বহুদিন বাদে আজ এ সম্বোধনটা শুনলো সে। দাদা দাদীর এ মোহাব্বতে তার আপাদমস্তক খুশির ঢেউয়ে দুলে উঠলো। নির্ঘুম শরীরটা মুহূর্তেই ফুরফুরে হয়ে উঠলো। 
দাদা দাদীকে না জানিয়েই স্মরণ তাঁদের পিছু নিলো। কোথায় কোথায় যাচ্ছে, এ দেখার তীব্র আকাঙ্খা জাগ্রত হলো তার মধ্যে। তাই নিজেকে বাঁধা না দিয়ে আড়ালে দুজনের পিছু নিলো। ভাগ্যিস রুম থেকে বের হওয়ার সময় কেউই তাকে লক্ষ্য করেনি। 

বাহাদুর শেখ ও আসমানী বেগম পাশাপাশি হাঁটছেন। বাহাদুর শেখের বড্ড দূর্বল শরীরটা তাঁর 'দিল' এর আশ্রয়ে শক্তি পেয়েছে। দুজনের শরীরই বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে। তবুও দুজনার একে অপরের প্রতি ভালোবাসা নুইয়ে পড়েনি। বরং রোজকার তাজা গোলাপের ন্যায় তা সুভাস ছড়িয়ে বেড়ায়। 

দুজনে ধীরেসুস্থে হাঁটতে হাঁটতে গেট খুলে বেরিয়ে পড়লো। স্মরণও তাদের পিছু পিছু বেরিয়ে পড়লো। রোজ সকালে দুজনে এভাবে হাঁটতে বের হয়। প্রকৃতির তাজা তাজা ঘ্রাণ নিতে দুজনই ব্যাকুল হয়ে উঠে। এ হাঁটাহাঁটি এখন তাদের অভ্যাস, রুটিন। রোজকার রুটিন। একদিন না হাঁটলে শরীরটা ভীষণ দূর্বল বোধ হয়।

বাহাদুর শেখ ও আসমানী বেগম মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁদের পুকুরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। এ পুকুর তাদের নিজস্ব। পাশের বিশাল আকৃতির পুকুরটাও তাদের নিজস্ব। ওটাতে দু ভাই মিলে মাছ চাষ করে। আর এটাতে গ্রামের লোকজন গোসল করে। মাঝেমধ্যে তারাও গোসল করেন। যেহেতু এ পুকুরে মাছ নেই তাই সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য এক পাশে শাপলা ফুলও লাগিয়েছেন আনিস সাহেব।
এ পুকুরটা ঘাঁট বাঁধানো পুকুর। সিমেন্ট দিয়ে ঘাঁট বাঁধা হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। এর আগে বিশাল এক বাঁশের মাচার ঘাঁট ছিলো। এখনও অবশ্য তা আছে। তবে সিমেন্টের ঘাঁটের কয়েক কদম পরে তা নতুন করে বানানো হয়েছে। 
দুই বৃদ্ধ দম্পতি দূর্বল পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাঁশের মাচার সামনে যান। মাচাটা সামান্য একটু উঁচু হওয়ায় বসা কষ্ট হয়ে যায়। আসমানী বেগম বাহাদুর শেখকে নিজ হাতে ধরে মাচায় বসতে সাহায্য করেন। অতঃপর নিজেও বসেন ওখানে। দূরের ঝোপের আড়াল থেকে স্মরণ এর সবটাই দেখলো। আসমানী বেগমকে কষ্ট করতে দেখে একবার ভাবলো দৌড়ে গিয়ে বাহাদুর শেখকে মাচায় বসিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু এমনটা করলে যে তাদের একান্তে কাটানো মুহূর্তটুকু নষ্ট হয়ে যাবে! এই ভেবে স্মরণ আর এগোয়নি। 

যৌবনের প্রেম ভালোবাসাকে অন্তরের মাঝে তালাবদ্ধ করে রেখে বাহাদুর শেখ ও আসমানী বেগম বিবাহিত জীবনের পঁচাত্তর বছর অতিবাহিত করছেন। এ যুগের ঠুনকো অনুভূতিগুলোর ন্যায় সময়ের সাথে তাদের ভালোবাসা ফিকে হয়নি। বরং কালের পরিক্রমায় তা যত্ন ও সম্মান হয়ে একে অপরের প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। 
মাচায় বসে বসে দুই কপোত-কপোতী সকালের মৃদু শীতল হাওয়া অনুভব করছে। হালকা হাওয়ার তোড়ে পুকুরে সৃষ্টি হওয়া ক্ষুদ্র ঢেউয়ে একে অপরকে অনুভব করছে তারা। 
সময় যেতে যেতে বাহাদুর শেখ এক পর্যায়ে আসমানী বেগমের হাড্ডিসার দূর্বল কাঁধে নিজের মাথা ঠেকিয়ে কম্পনরত গলায় বললেন,
" আল্লাহ যে তোমারে আমার জন্য বানাইছিলো এইডা জানলে বুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথেই তোমারে বউ করে আনতাম দিল।"
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন