নবোঢ়া - পর্ব ১৩ - ইলমা বেহরোজ - ধারাবাহিক গল্প


বসন্তের কোমল রোদ্দুরে ভরা দুপুরবেলা। বাতাসে ভেসে আসছে নতুন গজানো পাতার মিষ্টি গন্ধ। রাইহা, যে সর্বদা নাভেদের সান্নিধ্য খুঁজে বেড়ায়, আজ তার সাহসের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। সে বসে আছে নাভেদের ঘোড়ার পিঠে, আর নাভেদ নিজে হাতে লাগাম ধরে ঘোড়াটিকে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখন ফিরে আসছে বাড়ির দিকে।

রাইহার মুখজুড়ে উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তার চোখে দোলা দিচ্ছে ভয়ের ছায়া, কিন্তু সেই সঙ্গে ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে আছে একটু চাপা হাসি। নাভেদ মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখছে, মৃদু হেসে বলছে, "ভয় নেই রাইহা, আমি আছি।" তার এই আশ্বাসবাণীতে রাইহার বুকের ধুকপুকুনি একটু শান্ত হচ্ছে। নাভেদ উজ্জ্বল আলোর মতো। তার হাসিখুশি স্বভাব, অমায়িক ব্যবহার সকলের মনে এক গভীর ছাপ ফেলেছে। শুধু রাইহাকেই নয়, এমনকি মনির ও সিদ্দিককেও সে ঘোড়ায় চড়িয়েছে। তার এই সহজ-সরল ভালোবাসায় সবাই মুগ্ধ। 

রাইহাকে ঘোড়ায় চড়তে দেখে জুলফার অন্তরে জাগে তীব্র বেদনাবোধ। সে জানালার পর্দার আড়াল থেকে নীরবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। রাইহাকে তার শিলপাটায় ফেলে মরিচ দিয়ে পিষে ফেলতে ইচ্ছে হয়। হায়! যদি সেও রাইহার মতো নাভেদের সান্নিধ্যে আসতে পারত, তার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠতে পারত, তাহলে কতই না ভালো হতো।

জুলফা মনে মনে ভাবল, "যদি রাইহা বাড়ির হবু বউ হয়ে পর পুরুষের সঙ্গে এতো হাসাহাসি করতে পারে, আমিও তো যেতে পারি নাভেদের কাছে। নিশ্চয়ই সবার মতো উনি আমার সঙ্গেও হেসে কথা বলবেন। আমার সঙ্গেও গল্প করবেন। আমার জন্য এইটুকুই তো যথেষ্ট।" এই চিন্তায় তার মনে জাগে এক নতুন সাহস। তৎক্ষণাৎ সে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। তার পরনে একটি হালকা নীল রঙের শাড়ি, যার আঁচল মেঝে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বারান্দা ধরে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ কানে এল একটি করুণ কান্নার শব্দ। সেই অশ্রুসিক্ত আর্তনাদ বাতাসকেও ভারী করে তুলেছে। জুলফার পা থমকে গেল। তার মনের মধ্যে নাভেদের সাথে কথা বলার উত্তেজনা আর এই অজানা কান্নার রহস্য দুই-ই খেলা করতে লাগল। সে ধীরে ধীরে সেই কান্নার উৎস খুঁজতে থাকে। বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে খালি ঘরগুলোর দিকে চলে যায়। বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু সেই কান্নার শব্দ আর জুলফার পায়ের শব্দ ভেসে আসছে।
একটা ঘরের সামনে এসে জুলফা থমকে দাঁড়াল। ঘরের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কে কাঁদছে? কেন কাঁদছে? সন্তর্পণে জুলফা দরজার কাছে এগিয়ে যায়। তারপর আস্তে করে উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকায়। যা দেখল তাতে সে হতবাক হয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে একটি জায়নামাজ পাতা। তার উপর উবু হয়ে বসে আছেন সুফিয়ান। তার শরীর কাঁপছে, চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। তিনি বারবার সেজদায় লুটিয়ে পড়ছেন। প্রতিবার মাথা তুলে কাতর কণ্ঠে বলছেন, "ইয়া আল্লাহ। ইয়া আল্লাহ। ক্ষমা করো।"

সুফিয়ানের এই অবস্থা দেখে জুলফার বুক টনটন করে ওঠে। এমন একজন শক্তিশালী মানুষ, যিনি সবসময় নিজেকে সামলে রাখেন, সবাই যাকে মান্য করে, ভয় করে তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখা জুলফার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল। সুফিয়ানের প্রতিটি কান্নায় মনে হচ্ছে, তিনি নিজের অন্তরের গভীর থেকে কোনো বেদনা বের করে আনতে চাইছেন। তার প্রার্থনার মধ্যে একটা গভীর আকুতি, যেন তিনি কোনো অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছেন।

নাভেদ নিশ্চয়ই চলে এসেছে। সে নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে এল। সিঁড়ির কাছে আসতেই জাওয়াদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। জুলফার তাড়াতাড়ি আঁচল তুলে মাথা ঢেকে নিল। জাওয়াদকে দেখলেই কেন জানি তার গা ছমছম করে। জাওয়াদের সর্বদা গম্ভীর মুখ, সারাক্ষণ কী যেন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকে। বয়সে অনেক ছোট হলেও, সম্পর্কে জুলফা কাকি। অথচ তার ব্যবহারে কোনো আপনজনের স্নেহ কিংবা আগ্রহ নেই। শুধু একটা কঠোর শীতলতা। শব্দর দুইবার জাওয়াদের কাছে গিয়েছে কথা বলতে। কিন্তু জাওয়াদ তেমন কোনো সাড়াই দেয়নি। এই ছেলে নাকি হঠাৎ এমন পাল্টে গেছে। আগে এমন ছিল না। জুলফা সৌজন্যবোধ থেকে একটু হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই জাওয়াদ তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। যেন জুলফাকে সে দেখেইনি। 

জুলফা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। জাওয়াদের চেহারাটাই কেমন রাগী রাগী, মারমুখো গোছের। তার উপস্থিতিতে বাতাসও থমকে যায়। ওদিকে নাভেদ, তার চেহারাটা কী সুন্দর! সবসময় হাসি হাসি মুখ করে থাকে। সর্বদা চোখে মুখে ছড়িয়ে থাকে একরাশ আন্তরিকতা।
জুলফা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। বাড়ির বারান্দায় পা রাখতেই তার চোখে পড়ল, বারান্দার একপাশে, মোটা স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে একটি চেয়ারে বসে আছে নাভেদ। তার পাশেই দাঁড়িয়ে রাইহা। দুজনের মুখে হাসি ছড়ানো, মুখে কথার ফোয়ারা।

জুলফার সারা শরীরে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। বুকের ভেতরটা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে এল। কেন? কেন রাইহা সবসময় নাভেদের আশেপাশে থাকবে?
হঠাৎ একটা উদ্ভট চিন্তা তার মাথায় এল। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ওদের দিকে। নিজের কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু তবুও একটু কাঠখোট্টা শোনাল, জুলফা মিথ্যা করে বলল, "এইযে, তোমাকে জাওয়াদ ডাকছে।"
রাইহা ভুরু কুঁচকে তাকাল। তার চোখে-মুখে বিস্ময় ও সন্দেহের ছায়া। "জাওয়াদ?" সে জিজ্ঞেস করল, "কিন্তু আমি তো দেখলাম ও এইমাত্র বেরিয়ে গেল।"
জুলফা মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। "আসলে..." সে আমতা আমতা করতে লাগল, "মানে... আমি ভুল বলেছি। জাওয়াদ নয়, ভাবি ডাকছেন। তোমার শ্বাশুড়ি।"
রাইহার চোখে এবার বিস্ময়ের সাথে সন্দেহও মিশে গেল। "আমার শ্বাশুড়ি?" তার কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর "এই চার দিনে উনি আমার দিকে তাকালেনও না, আর এখন হঠাৎ ডাকছেন!"
জুলফা এবার সত্যিই অস্বস্তিতে পড়ে গেল, "আমি... আমি ঠিক জানি না," সে বলল, "তবে মনে হয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতে পারে।"
রাইহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর নাভেদের দিকে ফিরে বলল, "দুঃখিত, আমাকে যেতে হবে। পরে কথা হবে।"
নাভেদ মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। "নিশ্চয়ই," সে বলল, "তুমি যাও। আমি এখানেই আছি।"
রাইহা আবার জুলফার দিকে ফিরল। "আচ্ছা, কোথায় যেতে হবে?" 
জুলফা দ্রুত উত্তর দিল, "দোতলায়। বাঁদিকের ঘরে।"
রাইহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। সে চলে যাওয়ার পর জুলফার মাথায় যেন বাজ পড়ল। সে বিড়বিড় করে বলল, "ও মা! এ যে বাংলায় কথা বলছে!"

নাভেদের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, "ওর দাদা বিলেতি, কিন্তু দাদি বাংলাদেশের। দাদা-দাদীর বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর রাইহার আব্বুকে নিয়ে ওর দাদি দেশে চলে আসেন। তখন ওর আব্বু মাত্র দুই বছরের শিশু।"

সঙ্গে সঙ্গে জুলফার হৃদয়ের ভেতর একটা ফুলের কুঁড়ি ফুটে উঠল। নাভেদ তার সঙ্গে কথা বলছে! সে ঘাড় ঘুরিয়ে নাভেদের দিকে তাকায়। সূর্যের আলো এসে পড়েছে নাভেদের চোখের উপর। সেই দৃশ্য দেখে জুলফার শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। মাথার ভেতর হাজার মৌমাছি ভন্‌ভন্‌ করে উড়ছে। একটা অদ্ভুত জড়তা তাকে গ্রাস করে ফেলে।

নিজেকে সামলাতে জুলফা দ্রুত স্তম্ভের আড়ালে সরে যায়। সেখান থেকে সে কোনোমতে বলল, "ওহ্, আচ্ছা।" তারপর নিজের অস্বস্তি ঢাকতে, সে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, "আপনি এখন আর বেহালা বাজান না কেন?"

নাভেদ এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর একটু হেসে উত্তর দিল, "জাওয়াদ সাহেব নাকি রাতে কোনো কিছুর শব্দ হলে ঘুমাতে পারেন না। তাই আর বাজাই না।"

জুলফার মনে মনে রাগে গজগজ করতে লাগল, 'এই জাওয়াদ! এত বিরক্তিকর!' সে মনে মনে জাওয়াদকে বেশ কয়েকটা কড়া গালি দিল। 

জুলফা আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নাভেদ স্তম্ভের ওপাশ থেকে বলে উঠল, "ক্ষমা করবেন জমিদার বেগম, আমাকে একটু যেতে হবে।"

এই কথাটি জুলফার হৃদয়ে ছুরির মতো বিঁধল। সবার জন্যই নাভেদের সময় আছে, শুধু তার জন্যই নেই। এমনকি তার অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করল না। নাভেদ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে জুলফার মনে হলো, তার জীবনের সব আলো নিভে যাচ্ছে। সে চাইলেও নাভেদকে ডেকে দাঁড়াতে বলতে পারবে না। তার সেই অধিকার নেই। সে অনুভব করে, তার চারপাশের পৃথিবী ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। শুধু রয়ে গেল নাভেদের কণ্ঠস্বর, তার চোখের সেই উজ্জ্বল দৃষ্টি, আর নিজের বুকের ভেতর একটা অব্যক্ত বেদনা।

||

জমিদার বাড়ির প্রাচীন পুকুরের কাছে, বিশাল গাছের ছায়ায় ঢাকা নিরিবিলি কোণে একটা পুরনো দোলনা ঝুলছে। সেই দোলনায় আরাম করে শুয়ে আছে জাওয়াদ। তার দেহটা দোলনার সাথে একাকার হয়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ করে সে উপভোগ করছে শীতল বাতাসের স্পর্শ। মাথার ওপরের পাতার ফাঁক দিয়ে বিকালের সূর্যের কোমল আলো এসে ছড়িয়ে পড়ছে তার মুখজুড়ে।

মনির একজন অনুগত ভৃত্যের মতো, কয়েকটা ডাব নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়েছিল। মাঝে মাঝে জাওয়াদ চোখ মেলে ডাবের জল পান করে।
হঠাৎ করে চোখ খুলে জাওয়াদ জিজ্ঞেস করল, "তোদের ছোট জমিদার বিয়ে করলেন কবে?"
মনিরের মুখে বিস্ময় আর বিভ্রান্তির ছাপ ফুটে উঠল। 'ছোট জমিদার' বলতে তো জাওয়াদ নিজেই। জাওয়াদ তার বিভ্রান্তি লক্ষ্য করে নিজেই সংশোধন করে নিল, "আমার চাচা বিয়ে করল কবে?"
মনির একটু হেসে জবাব দিল, "হুজুর, প্রায় তিন-চার মাস হয়ে গেল।"

জাওয়াদের দৃষ্টি তখন জমিদার বাড়ির দিকে নিবদ্ধ হয়। বিশাল বাড়ির বারান্দায় একা বসে আছে জুলফা, তার নতুন কাকিমা। মেয়েটির চোখে-মুখে একটা গভীর উদাসীনতা। 
"বুড়ো বয়সে এসে বিয়ের নেশা চাপল!" জাওয়াদ বিদ্রুপের সুরে বলল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, "বয়স কত?"
মনির একটু ইতস্তত করে বলল, "কার বয়স, হুজুর?"
"তোদের নতুন ছোট বেগমের।"
মনির একটু ভেবে নিয়ে জবাব দিল, "যতদূর শুনেছি, বিশ-একুশ বছর হবে।"
জাওয়াদের কণ্ঠস্বর হিম শীতল, "আর একটু হলেই আমার হাঁটু বয়সী হয়ে যেত!"
হঠাৎ করে তার মেজাজ পাল্টে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "চল, একটু ঘুরে আসি।"
জাওয়াদ দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল। মনির নীরবে তার পিছু নিল। তারা বেরিয়ে এল সেই নিরিবিলি জায়গা থেকে। সামনে বিশাল প্রাসাদোপম জমিদার বাড়ি। লাল সুরকির রঙে আগাগোড়া মোড়া, সামনে বিশাল বারান্দা, উঁচু উঁচু থাম। বাড়ির চারপাশে সুন্দর করে সাজানো বাগান। নানা রকমের ফুলগাছ আর ফলের গাছে ভরা। জাওয়াদ আর মনির ধীরে ধীরে বাড়ির চারপাশে ঘুরতে লাগল।
ষাট বিঘা জমির বিস্তৃতিতে ছড়িয়ে থাকা এই সম্পত্তি স্বপ্নরাজ্যের আভাস দেয়। একদিকে মখমলের মতো নরম সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল মাঠ, অন্যদিকে ছোট ছোট খামারবাড়ি আর পশুশালার সারি।

দূরে গরু-ছাগলের আস্তাবল থেকে ভেসে আসা হাম্বা রব আর কর্মব্যস্ত মানুষের কলরব মিলেমিশে একাকার। কিন্তু এসব কোলাহল বাতাসে মিলিয়ে যায় বাড়ির মূল অংশে এসে। চারদিকে উঁচু ইটের প্রাচীর, তার ওপর লোহার কাঁটাতারের বেড়া যেন কোনো দুর্ভেদ্য দুর্গ। 

খামারের দিকে একটা গেট, যা দিয়ে কর্মচারীরা যাতায়াত করে। আর অন্যদিকে, যেখানে মাঠ শেষ হয়ে শুরু হয়েছে নিবিড় বন, সেখানে আরেকটি প্রবেশপথ। সাহসী শিকারী ছাড়া কেউ সে বনে পা বাড়ায় না। জাওয়াদ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল খামারবাড়ির দিকে। সেখানে কর্মরত মানুষগুলোর সাথে গল্প জুড়ে দিল। তাদের চোখে ফুটে ওঠা শ্রদ্ধা আর ভয়মিশ্রিত সম্মান লক্ষ্য করল সে। এখান থেকে তাকিয়ে দেখা যায় তাদের বাড়িটা। দুই তলা লাল ইটের বিশাল অট্টালিকা, যা প্রায় আট বিঘা জমি জুড়ে বিস্তৃত।

বাড়িটার জটিল গঠন গোলকধাঁধার মতো। এত ঘর, এত বারান্দা যে নতুন কেউ এলে পথ হারিয়ে ফেলবে নিঃসন্দেহে। একসময় এই বাড়ি ছিল জীবন্ত, মানুষের কলরবে মুখর। দাস-দাসীর ভিড়ে গমগম করত প্রতিটি কোণ। কিন্তু এখন, জাওয়াদের দাদার আমল থেকেই, বাড়ির অধিকাংশ অংশ নিঃঝুম, নীরব।

বর্তমানে যারা আছে, তারা সিঁড়ির কাছাকাছি কয়েকটি ঘরে সীমাবদ্ধ। বাকি সব ঘর খালি, অতীতের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। খাসমহলের পাশেই বিশাল অতিথিশালা। যেখানে বিশের বেশি ঘর। দুটো দরজা, একটা বাইরে যাওয়ার, অন্যটা খাসমহলে প্রবেশের। বারান্দা কিন্তু একই। অথচ এই বিশাল অতিথিশালায় এখন মাত্র দুজন থাকছে। নাভেদ পাটোয়ারী আর তার একজন কর্মচারী। বাকি সব ঘর খালি, নীরব। 

গোধূলির আলো-আঁধারি মুহূর্তে, জাওয়াদের পা যখন বাড়ির পেছন দিকের পথ ধরেছে, তখনই আকাশ থেকে খসে পড়ে একটি কাগজের বিমান। সন্ধ্যার মৃদু বাতাসে ভেসে এসে নরম ঘাসের উপর নামল সেটি। 

জাওয়াদ অবাক হয়ে উপরের দিকে তাকায়। ছাদে কারও ছায়াও নেই। কে এমন শৈশবসুলভ কাণ্ড করল? কে বানাল এই কাগজের বিমান? ধীরে ধীরে সে কাগজটি কুড়িয়ে নিল। ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে কী যেন লেখা রয়েছে। অস্পষ্ট আলোয় চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করে জাওয়াদ। তার মনে পড়ে যায় তার বাল্যকাল। তখন সেও এমনি করে কাগজের বিমান বানিয়ে উড়াত, তার মনের কথা লিখে। সেই স্মৃতি তাকে উৎসাহিত করে কাগজটি খোলার জন্য।

শুধু কৌতূহল নয়, একটা অজানা আকর্ষণ টানছে তাকে। জাওয়াদ ধীরে ধীরে কাগজের ভাঁজ খুলতে শুরু করল। যখন সে কাগজটি সম্পূর্ণ খুলল, তখন সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু ঠিক তার হাতের উপর এসে পড়ে। সেই ক্ষীণ আলোয় জাওয়াদের চোখ ধীরে ধীরে পড়তে লাগল লেখাগুলো...

প্রিয় অজানা,

আজ তোমাকে লিখছি আমার অন্তরের গহন থেকে, যেখানে আলো আর অন্ধকার নিরন্তর দ্বন্দ্বে মগ্ন। তুমি কে, জানি না। তবে জানি, তুমি বুঝবে এই হৃদয়ের ব্যথা, এই আত্মার আর্তনাদ।

আমার সঙ্গী আছে একজন, তার নাম দুঃখ। সে আমার ছায়ার মতো, কখনো পিছনে, কখনো সামনে। তার উপস্থিতি এমন যে, নিজের শ্বাসের শব্দেও তাকে শুনতে পাই। সে আমার রক্তের প্রতিটি কণায় মিশে আছে, আমার চিন্তার প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে।

জানো, যখন হাসি ফোটে আমার ঠোঁটে, তখন দুঃখের চোখে জলের ধারা নামে। সে ভয় পায়, পাছে আমি তাকে ভুলে যাই। কিন্তু কেমন করে ভুলব তাকে? সে যে আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে ভাবি, কেন এমন হলো? কেন দুঃখ আমাকে এত ভালোবাসে? আমি কি তার এতই আপন? নাকি আমিই তাকে এত আপন করে নিয়েছি? উত্তর খুঁজে পাই না, শুধু অনুভব করি তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার কানের পাশে।

প্রিয় অজানা, তুমি কি কখনো অনুভব করেছো এমন ভালোবাসা? যা তোমাকে গ্রাস করে, তোমাকে শূন্য করে, আবার তোমাকে পূর্ণ করে? দুঃখের ভালোবাসা এমনই। সে আমাকে এত ভালোবাসে যে, আমার সুখের মুহূর্তগুলোকেও সে নিজের রঙে রাঙিয়ে নেয়।

আমি চাই না তাকে। আমি চাই মুক্তি। কিন্তু সে আসে, বার বার আসে। প্রতিটি আগমনে আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে, আমার আত্মা চিৎকার করে ওঠে। তবুও, তার স্পর্শে আমি অদ্ভুত এক শান্তি খুঁজে পাই। এ কেমন বিরোধাভাস, বলো তো?

কখনো কখনো ভাবি, দুঃখ ছাড়া আমি কে? সে না থাকলে আমার অস্তিত্বের অর্থ কী? তার অনুপস্থিতিতে আমি কি সত্যিই সুখী হতে পারব? নাকি তখন আমি হারিয়ে যাব, নিজেকে খুঁজে পাব না?

প্রিয় অজানা, তুমি হয়তো ভাবছো আমি পাগল। হয়তো তাই। কিন্তু এই পাগলামিতেই আমি খুঁজে পেয়েছি জীবনের গভীরতম অর্থ। দুঃখের মাধ্যমেই আমি শিখেছি সুখের মূল্য। তার কালো রঙের মাঝেই আমি দেখেছি আলোর ঝিলিক।

আজ রাতে, যখন চাঁদ আকাশে হাসবে, আমি জানি দুঃখ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি তার হাত ধরব, তার চোখের দিকে তাকাব। হয়তো একদিন আমরা দুজনে মিলে এক হয়ে যাব, হয়তো একদিন আমরা দুজনে আলাদা হয়ে যাব। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, আমরা এক সাথে আছি দুই প্রেমিকের মতো, দুই শত্রুর মতো।

তুমি কি বুঝতে পারছো, প্রিয় অজানা? তুমি কি অনুভব করতে পারছো আমার হৃদয়ের স্পন্দন? আমার আত্মার আর্তনাদ? যদি পারো, তবে আমাকে জানিও। আর যদি না পারো, তবে এই চিঠিকে উড়িয়ে দিও বাতাসে। হয়তো কোথাও, কেউ একজন এটা পড়বে, আর বুঝবে দুঃখের সাথে ভালোবাসার কী অদ্ভুত খেলা।

তোমার অজানা,
এক ক্লান্ত আত্মা। 

সন্ধ্যার আবছা আলোয় জাওয়াদের হৃদয় অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ভরে ওঠে। তার মনের প্রতিটি কোণ মুগ্ধতার রঙে রাঙা হয়ে গেল। কারো দুঃখের কথা শুনে কি কেউ এভাবে মুগ্ধ হয়? 

জাওয়াদ আবার ছাদের দিকে তাকায়।তার মনে প্রশ্নের ভিড়। কে ছিল সেখানে? কে লিখেছে এই হৃদয়স্পর্শী চিঠি? যার হাতের লেখা এত সুন্দর, যার কথার বুনন এত মনোমুগ্ধকর, সে কে? এত গভীর অনুভূতি, এত সূক্ষ্ম আবেগ, এ কি কোনো পুরুষের লেখা হতে পারে? নাকি এটি কোনো নারীর হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত? জাওয়াদের মন বলল, এমন আবেগময় ভাষা, এমন সুন্দর প্রকাশভঙ্গি শুধুমাত্র একজন নারীরই হতে পারে।
এই চিন্তায় মগ্ন হয়ে জাওয়াদ দ্রুত পায়ে ছাদের দিকে অগ্রসর হয়। তার পা নিজের থেকেই চলছে, মন টানছে তাকে সেই রহস্যময় লেখিকার দিকে। 

পথে তার মা ললিতা তাকে ডেকে কথা বলতে চাইল। কিন্তু জাওয়াদের কানে সে ডাক পৌঁছলই না। তার সমস্ত মন জুড়ে তখন শুধু সেই অজানা লেখিকার চিন্তা। অবশেষে সে ছাদে পৌঁছে গেল। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তার আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ছাদ ফাঁকা, কেউ নেই সেখানে। শুধু সন্ধ্যার হালকা বাতাস বইছে আর দূরের আকাশে তারারা একে একে জ্বলে উঠছে।
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন