শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৬১ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


কাঠের বারান্দাটা সেকেলে। আপাতত ভেজাটে। ভোরের বৃষ্টির সংস্পর্শে এখনো পিচ্ছিল ভাব। বুঝেশুনে পদচারণ না ফেললে —মুখ থুবড়ে পড়ে যাবার সম্ভবনা দারুণ। স্থির, শীতল বাতাস বইছে। বৃষ্টির সুমধুর ঘ্রাণ যেন এখনো বাতাসে বাতাসে লেপ্টে। আনোয়ার সাহেব কল করেছেন। অরু চতুরভাবে নগ্ন পায়ে হেঁটে-হেঁটে কথা বলছে। তার উচ্ছ্বাসিত বদন এবং উচ্চধ্বনির হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠস্বর তন্ময় ঘরে বসে শুনতে পারছে। সে কিছুক্ষণ আগেই গোসল নিয়ে বেরিয়েছে। পাশেই বের করে রাখা শার্ট-টা পরার সময় হয়ে উঠেনি। গুরুত্বপূর্ণ কল এসেছে। এক জরুরি ইমেইল এপ্রুভড করতে হবে। ল্যাপটপ কোলে নিয়ে চেয়ারে বসল। ইমেইল-টা পড়তে নিতেই তার ম্যানেজারের কল এলো। ডান কানে কাঁধের সাহায্যে ফোন চেপে ধরে—চার-পাঁচ বাক্যে কথা শেষ করে ফোন সরাল। অরু বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে এসেছে। তন্ময়ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটা শেষ করে ল্যাপটপ সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। পাশে রাখা শার্ট তুলে নিয়েছে। শার্ট-টা অরু পছন্দসই বের করেছে তার ল্যাগেজ হাতড়ে। বোধহয় আজ ম্যাচিং করে জামাকাপড় পরতে চাচ্ছে। এতটুকু বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।

'আমরা কোথায় যাব?' 

অরুর নিভু কণ্ঠের প্রশ্নের সামনে তন্ময় নির্লিপ্ত থাকল। চোখ তুলে তাকাল না। হাতের আঙুল গুলো তখন ব্যস্ত কালো শার্টের সোনালি রঙের বোতামগুলো লাগাতে। সুবিস্তৃত; শক্তপোক্ত, সুঠোম বুকের দিকটা পরিষ্কার। ফরসা বুকে কালো শার্ট-টা অপূর্বভাবে মানিয়েছে। ঠিক বামদিকের জানালাটা আপাতত খোলা। পর্দা গুলো দু'পাশে ছড়িয়ে দেয়া। সূর্যের সোনালি দ্যুতি এসে মেঝেতে পড়েছে শীর্ণ পথ ধরে। এখান থেকে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যাচ্ছে। গাছটি সূর্যের রশ্মির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। শ্যাওলায় আধঢাকা প্রাচীরের ওপর কোয়েল পাখির জোড়া বসে। মিহি সুরে ডাকছে। যেই ডাক কানে ভাসতেই বুকভরে আলোড়ন হয়। 
এবেলাতে অরু প্রশ্নের জবাব না পেয়ে আরেকটু কাছে এসে দাঁড়াল। পায়ের গোড়ালিতে সম্পূর্ণ ভারটুকু ছেড়ে কাধটা ছুঁইছুঁই করল। মুখ বাড়িয়ে চোখ দাবিয়ে আবারো যেন একই প্রশ্নটি করছে। উতলা ওর কর্মকাণ্ড তন্ময় দেখেও দেখল না। এই একই প্রশ্নের জবাবটি সে দু'বার ইতোমধ্যে দিয়েছে। তৃতীয়বারের জবাবটুকু দিতে বাধ্য হলে সে সভ্যভাবে আর বাক্যে দেবে না। অভদ্রোচিত শক্ত এক চুমুতে দেবে। অসন্তুষ্ট অরু এযাত্রায় তন্ময়ের পাশে থেকে একদম সামনে এসে দাঁড়াল। লম্বাচওড়া তন্ময়ের সামনে সে অতিষ্ঠ ভাবভঙ্গি নিয়ে বলল,

‘এতক্ষণ লাগে বোতাম লাগাতে? দেখি…দেখি আমাকে দেন। এক মিনিটেই সবগুলো লাগিয়ে দিচ্ছি।’

বলতে-বলতে তাড়াহুড়ো হাত দুটো বাড়াল। তন্ময় শান্তভাবেই নিজের হাত দুটো সরিয়ে নিলো। আরামকরে সটানদেহে দাঁড়াল। নত দৃষ্টি অরুর মুখে নিবিষ্ট। বড়ো চোখের কালো পাপড়িজোড়া কাঁপছে। বেশ ঘনঘন পলক ফেলছে। হাত দুটো দু'তিন চেষ্টায় একটি বোতাম লাগতে মিনিটখানেক সময় নিচ্ছে। আঙুলগুলোর মাথা ছুঁয়ে দিচ্ছে বুকের অংশটুকু। অরু নিজেও হয়তোবা বুঝতে পারল বিষয়টা। বোকার মতন মৃদু হাসার চেষ্টায় জানাতে উদগ্রীব হলো,

'আপনি লম্বা দেখে দেরি হচ্ছে। খাটো হলে সেকেন্ডে হয়ে যেতো।’

তন্ময় সাবলীলভাবেই উদার কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে কি মাথাটা কে টে পেটে লাগাব? খাটো দেখাবে। তোর বোতাম লাগাতে মাত্র সেকেন্ডে লাগবে।’

অরু স্তম্ভিত হয়। দৃষ্টি তুলে চায়। থমথমে গম্ভীরমুখ থেকে এইকথা বেরুবে তা ভাবতেও পারেনি হয়তোবা। এমন মুখ নিয়ে কৌতুককর কথাবার্তাটুকু হাস্যকর না লাগাটাই বরং স্বাভাবিক। অসহ্যকর জোকস-টা তার হজম হলো না। ক্ষুব্ধ চোখ রাঙিয়ে চাইল। হাত দুটো নিরালায় সরিয়ে আনতে উদগ্রীব। নিঠুরভাবে সরে যেতে উতলা হতেই তন্ময় মুখ বাড়িয়ে ঝুঁকে। শীতল স্বরে আদেশ ছুঁড়ে, 

‘সবগুলো বোতাম লাগাতে হবে। ইট'স এন অর্ডার।’

অরু মুখ ভেঙাল। বিড়বিড় করল। তবে বাধ্য মেয়ের মত পুনরায় হাত বাড়াল। লাগাতে ধরল বোতাম গুলো। দৃষ্টি তন্ময়ের সুঠোম বুকের কাছটায়। ভুলবশতও চোখ তুলে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাল না। বোতাম লাগাতে নিয়েই মিনমিনে গলায় বলল,

‘তাহলে কথা শোনাচ্ছেন কেন? একটু দেরি হলে কী এমন হয়েছে?’ 

তন্ময় অপলক চোখে দেখতে পেলো অরুর ঠোঁটের একেকটি ভাঁজ। গোলাপি ঠোঁটের ভাঁজগুলো যেন তার ঠোঁটের ভাঁজগুলোকে ইশারায় ডাকছে। সেই ডাকে ঠোঁটদুটো সাড়া দিতে মরিয়া হলেও তন্ময় দিলো না। একইভাবে অনড়ভাবে ঝুঁকে থাকল। শুধুই দেখে গেল একগুঁয়ে দৃষ্টিতে। অরু যেন সেই দৃঢ়তম দৃষ্টির সংকেত অনুভব করছে। মৃদু মৃদু কাঁপছে হাত দুটো। অরুর নাস্তানাবুদ মলিন মুখ দেখে তন্ময় নিঃশব্দে হাসল। সটানদেহে দাঁড়িয়ে বাদবাকি বুকের দিকের দুটো বোতাম নিজেই লাগাল— দুটো স্টেপে। এক পলকে, অতিদ্রুত। এই দৃশ্যে অরুর দ্বিধান্বিত চোখজোড়া লাজুক হলো। দাঁড়িয়ে রইল ভাবসূচক অভিনিবেশে। 
করুণ কণ্ঠে নিজের সাফাই গাইতে বলল,

‘আপনি তো বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিন শার্ট পরেন। এতে বোতাম লাগানোর স্পিড আমার থেকে একটু ভালো থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই নয় কি?’

তন্ময় ভ্রু তুলল, ‘হ্যাঁ। সেক্ষেত্রে এক কাজ করতে পারিস।’

‘কী কাজ?’ অরুর স্বরে উত্তেজনা। দৃষ্টি নিবিড়। জানার আগ্রহবোধ অসীম। তন্ময় স্বাভাবিকভাবে বলল,

‘নিয়মিত শার্টের ঘ্রাণ না শুঁকে–প্রত্যেক রাতে পরতে পারিস। পরতে পরতে বোতাম লাগানোর স্পিড বেড়ে যাবে।’

অরুর ছোটোছোটো চোখজোড়া বড়ো হয়ে এলো। থতমত খাওয়া মুখটা দেখে তন্ময় ঠোঁট টিপে হাসল। অরুর সময় লাগল বাক্য গুলো বুঝতে। বুঝে সে আশ্চর্য হলো। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল কিছু সেকেন্ড। ঠোঁট দুটো নাড়াল কিছু বলতে। কয়েকবার চেষ্টা করে, ‘আপ…আপনি… ’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারল না। লজ্জায় স্তম্ভিত সে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ওকে আড়চোখে দেখে —তন্ময় কথা ঘুরিয়ে বসল, 

‘কী বলেছিলাম তখন?’

অরুর চোখমুখ লজ্জায় নুইয়ে আছে তখনো। তবুও প্রত্যুত্তর করে কিঞ্চিৎ সন্দেহজনিত জিজ্ঞাসাবাদে, ‘কী বলেছেন?’

ডান হাতা ভাঁজে-ভাঁজে কনুইতে তুলতে নিয়েই তন্ময় বলল, ‘তৈরি হতে। নাকি বেরুনোর ইচ্ছে নেই?’

‘যাচ্ছি’ আওড়ে অরু দ্রুত সরে গেল। তন্ময় সুস্পষ্ট দেখল ওর ব্যস্ত দেহ। ল্যাগেজ হাতড়ে কালো কামিজ বের করেছে। সেটি স্কার্ফের নিচে ঢেকে বাথরুম ঢুকেছে তড়িঘড়ি করে। তন্ময় এবারে শব্দ করেই হাসল। বাম হাতা কনুইতে তুলে হাত ঘড়ি পরল। এগুল অরুর
খোলা ল্যাগেজের দিক। পায়ের পাতায় ভার রেখে ল্যাগেজ ছুঁতেই, অরুর পার্সোনাল ডায়েরিতে নজর আটকাল। ওপরের এককোণেতে পড়ে আছে। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে নিয়েও ছুঁলো না শেষমেশ। ল্যাগেজের চেইন লাগাল। অরু বেরুলো পাঁচ মিনিটের মাথায়। কালো চুড়িদার পরেছে। কালোতে ওকে সর্বদাই চমৎকার দেখায়। অবশ্য তন্ময়ের কাছে সবভাবেই, সব পোশাকেই —ওকে চমৎকার লাগে। আড়চোখে দু'বার চেয়ে নিজের দৃষ্টি সংযত করল। সাবলীলভাবে বসল চেয়ারে। ছন্নছাড়া দৃষ্টির সামনে রাখল ফোন। স্ক্রিনে এটেনশন দেবার তীব্র প্রচেষ্টা। সে চাইলেই বেরিয়ে যেতে পারে। মাহিন একের পর এক মেসেজ দিচ্ছে। সবগুলো বন্ধু প্রাঙ্গণে বসে। অথচ তার যেতে ইচ্ছে করছে না। মন যেতে চাইছে না। হৃদয় বলছে,

 ‘বাইরে আছেটা কী? অরুর সাজসজ্জা দেখার চেয়ে আপাতত ইম্পরট্যান্ট কিছু নেই তোর। চুপচাপ বসে বসে দেখ।’ 

অরু ছুটে-ছুটে তৈরি হচ্ছে। তাড়াহুড়ো হাতে দুল পরছে। টিপ পরছে। ঘড়ি পরছে। সাইড ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। দৃশ্য গুলো ভীষণভাবে উপভোগ করছে সে।

———

রৌদ্রজ্জ্বল আকাশপানে চেয়ে মাহিন ভাবুক কণ্ঠে বলে, 

‘আবহাওয়া অধিদপ্তর ভুয়া গবেষণা করেন। আকাশ দেখলেই বোঝা যায় আজ কোনো বৃষ্টি-টৃষ্টি হবে না। আমার কথা মিলিয়ে নে। দেখ কী চমৎকার রোদ্দুর! রোদ পারছে না জাস্ট নাচতে।’

রিয়ান ফোন বের করল পকেট থেকে। নিশ্চিত হতে পুনরায় ওয়েদার অ্যাপ-এ ঢুকল। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা দুটো পঁয়তাল্লিশ থেকে। একটা ত্রিশ থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হবে দেখাচ্ছে। রিয়ান ভ্রু তুলে জানাতেই মাহিন বিরক্ত হলো,

‘শোন এসব ওয়েদার ফয়েদার বাদ। তুই আমার কথা শোন। আমিই হচ্ছি উন্নতমানের আবহাওয়া অধিদপ্তর।’

শুহানি হেসে শুধাল, ‘তা আপনি কি চার্জ করেন, স্যার?’

মাহিন উদারতার বহিঃপ্রকাশ করল, ‘জি। খুব কম। মাত্র পাঁচশো। পার সেন্টেন্সে।’

সৈয়দ আশ্চর্য গলায় বলে বসল, ‘তোর একেকটি বাক্য কী স্বর্ণে বাঁধাই করা?’

মাহিন সাদা ফকফকে দাঁতগুলো দেখিয়ে জানাল,

 ‘দাঁত মাজি নাই সকালে। দাঁত না মাজা মুখ হলো স্বর্ণখনি। তাই এই মুখ দিয়ে আসা একেকটি বাক্য দামি। চার্জ বাড়িয়ে দিলাম। এখন প্রত্যেকটি বাক্যে হাজার টাকা।’

ইব্রাহিম অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘মামা, তুই ডেট এক্সপায়ার গাঁজা দিন-দুপুরে আর খাইস না।’

মাহিন শব্দ করে হাসল, ‘একা একা খেয়ে মজা নাই। আয় মিলেমিশে খাই। খুউউব টেস্ট।’

বন্ধুদের তর্কবিতর্কের মাঝেই অরুকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে তন্ময়। অরু খুব মনোযোগ সহ সামনে চেয়ে। তার বন্ধুদের তর্কবিতর্ক শোনার প্রবণতা প্রখর।
প্রাঙ্গণে ইতোমধ্যে সবাই আসন পেতেছে। গতকাল রাতেই আলোচনা করা হয়েছে কোথায় যাবে। তারা মাইক্রো করে লেকের পাড়ে যাবে। আধঘণ্টার পথ। সিলেটের ওই প্রাকৃতিক লেকপাড় জুড়ে কয়েকটি টং আছে। দলবদ্ধভাবে চেয়ার পাতা থাকে। বৃষ্টির দিনে ছাউনির নিচে চা খেয়ে আড্ডা দেবার মতন সু-ব্যবস্থা করা। আজ যেহেতু বৃষ্টির দিন। কাছাকাছিই থাকবে। আগামীকাল ভ্রমণে বেরুবে। এইমুহূর্তে প্রত্যেকের দৃষ্টি তন্ময় এবং অরুর ওপর। তন্ময় গলা পরিষ্কারের ছুঁতোতে বন্ধুদের দিকে চেয়ে শুধায়,

‘তাহলে বেরুনো যাক? সবাই রেডি?’

মাহিন মুখ টিপে হাসে। অগোচরে ডান চোখ টিপে বলে, ‘আমরা ভালোভাবেই রেডি। তোর রেডি হতে এত গুলো ঘন্টা লাগল। উফ!’

অরু ঘাবড়াল। তন্ময়ের হয়ে সাফাই দিতে উতলা হলো, ‘ভাইয়া, আমি রেডি হতে সময় নিয়েছি। তন্ময় ভাই তো সেই কখন রেডি হয়েছেন।’

অরুর সহজসরল প্রত্যুত্তরে সবাই ফিক করে হেসে উঠল। অরু ঠিক বুঝল না কেন হাসাহাসি হচ্ছে। তবে বেশ লজ্জা পেলো। চুপসে গেল মুখটা। শুহানি মাহিনের কাঁধে দুটো চড় বসিয়ে –ধমকাল। এগিয়ে গিয়ে অরুকে টেনে নিজের পাশে এনে হেসে আশ্বস্ত করল, ‘ও মজা করছে।’ 

অরু এযাত্রায় বুঝতে পারল। অস্বস্তিতে পড়ল। শুহানি অরুর গাল ছুঁয়ে প্রশংসায় ভাসাল, ‘কী মিষ্টি লাগছে! আমাদের তন্ময় কী আর শুধু শুধু পাগল হয়েছে, হুঁ? এমন মিষ্টি দেখতে মেয়েটার জন্য পাগল হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমারই তো তোমাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে।’

অরু লাজুক ভঙ্গিতে চায়। বড়ো বড়ো চোখে হাসে। ভদ্রসভ্য ভাবে, ‘ধন্যবাদ’টুকু।' বলে সেও প্রশংসায় মাতোয়ারা হয় শুহানির। তন্ময় পার্কিং এর দিক এলো। মাইক্রোর পেছনে এসে বনেট তুলল। ব্যস্ত হাতে কিছু ছোটোখাটো কার্যক্রম সেরে বনেট বন্ধ করল। সামনে এসে দরজা খুলে স্টিয়ারিং-এ বসল। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। অরুকে আলগোছে তন্ময়ের পাশে চড়িয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। সে গিয়ে উঠে বসল পেছনে। সবাই বসতেই তন্ময় গাড়ি স্টার্ট করল। তরতর করে চলতে শুরু করল গড়িটি। বেরিয়ে গেল বাগানবাড়ি ছেড়ে। লেকপাড়ের উদ্দেশ্যে।

———
 
সিলেটে ঘনঘন বৃষ্টি হয়। জনমুখে শোনা যায়, সিলেট বৃষ্টিতেই সুন্দর। অরুও তাই মানে। এভাবেই ও বৃষ্টি বলতে অজ্ঞান। তবে তন্ময়ের বিষয় ভিন্ন। সে বৃষ্টি পছন্দই করতো না। বলা চলে অপছন্দের ছিল। ইদানীংকালে অরুর জন্য একটু-একটু মেনে নিচ্ছে। তবে ঘুরতে গিয়েও বৃষ্টি মেনে নিতে তীব্র নারাজ সে।
এইযে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই রোদ হারিয়ে গেল। সূর্য ডুবল! কালো কালো মেঘ আকাশ জুড়ে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আশেপাশে উচ্চধ্বনিতে বজ্রপাত পড়ছে। এখনো ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়নি। তবে ফোঁটা ফোঁটা পড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। শীঘ্রই ঝমঝমিয়ে নামবে বলে। ইতোমধ্যে তাদের গাড়ি লেকপাড়ে পৌঁছেছে। মানুষজন কম। নিরিবিলি বেশ। হৈ-হৈ করে বেরুলো সকলে। জনমানবশূন্য জায়গাটি মুহূর্তেই প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠল। কাছের গোলাকৃতি দশ-বারো জনের টেবিলজুড়ে বসল রাজাদের মতন। গাড়ি-টা রাস্তার পাশে রেখে বেরিয়েছে তন্ময়। অরুকে নিয়ে এগুচ্ছে বন্ধুদের দিক। অরু মুখ তুলে চেয়ে ধীর কণ্ঠে আবদার সুরে বলল,

‘বসব না এখন। একটু লেকের কাছাকাছি যাব।’

তন্ময় আবদার মানল। বন্ধুদের ইশারা করে অরুকে নিয়ে চলল পাথরের লেকের দিকটায়। যেতে যেতে অরুর নরম হাতটা মুঠোভরতি করে নিলো। অরু এতে ক্যাটফুড পাওয়া সন্তুষ্ট বিড়ালে রূপান্তরিত যেন। মুখ টিপে মুচকি মুচকি হেসে চলল। তন্ময় নরম কণ্ঠে সতর্ক করল,

 ‘বৃষ্টি হবে। দু'মিনিটের বেশি না।’

জবাবে অরু মাথা দোলাল। তারা এলো লেকের কাছাকাছি। লেকের পানি স্বচ্ছ। নীলচে। গভীরটা দেখা যাচ্ছে। রঙবেরঙের ছোটো ছোটো পাথর আছে। অরু নিচে নেমে পানি ছুঁতেও প্রস্তুত। তন্ময় ওর হাবভাবের সঙ্গে পূর্বপরিচিত। আলতোভাবে হাত টেনে রাখল। এরমধ্যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টিতে রূপান্তরিত হলো। তন্ময় অরুকে টেনে ছুটল বন্ধুদের দিক। বেশি দূরে যায়নি বলে পৌঁছাতে মিনিট খানেক লাগল। চুলগুলো ব্যতীত তেমন ভিজেনি দুজন। অরুকে ফাঁকা চেয়ারে বসিয়ে পাশে নিজেও বসল। 
ইতোমধ্যে কফি এবং চা এসেছে। যার যেটা পছন্দ সে মোতাবেক অর্ডার দেয়া হয়েছিল। অরু চা নিলো চটপট। তন্ময় কফি। বৃষ্টির উচ্চধ্বনির রিমঝিম শব্দে মুখরিত চারপাশ। শুহানি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,

‘আজ রাতে বারবিকিউ পার্টি করলে কেমন হয়?’ 

ঐশী চেঁচিয়ে বলে, ‘চমৎকার।’

রিয়ান তাকায় রুস্তমের দিকে। রুস্তম ভ্রু তুলে, ‘তাকানোর কী আছে? চাইলে করব। আমি বাবু চাচাকে কল করে জানাচ্ছি। সব বন্দোবস্ত করে রাখবে।’

ইব্রাহিম আঙুল নাড়িয়ে জানায়, ‘একটা নতুন টুন তুলেছি গিটারে। আজ তোদের শোনাব।’

এতে যেন উত্তেজনা বাড়ল। অরুও উজ্জ্বল চোখে তন্ময়ের দিকে তাকাল। তন্ময় ওর চোখে যেন আকাশের তারা দেখতে পেলো। কী সুন্দর পরিষ্কার উজ্জ্বল চোখদুটো! এই চোখদুটোর উজ্জ্বলতা দেখতে সে সব করতে পারবে। সব। তন্ময় রুস্তমকে বলল,

‘দে বাবু চাচার নাম্বার। আমি কথা বলছি। টাকাপয়সা চাচার কাছে আছে? রেখে এসেছিস কিছু?’
‘দিয়ে এসেছি। যা আছে হয়ে যাবে।’

বৃষ্টির মাত্রা বাড়ছে। বাতাসে বসে বৃষ্টি দুলে এসে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। তন্ময় দাঁড়িয়ে ফোনে আলাপ সারল। অন্যপাশে মাহিন, রিয়ান, ইব্রাহিম এবং সৈয়দ চাপাস্বরে কানে-কানে ফুসুরফাসুর করছে। চারজনের মাথা একত্রিত। তন্ময় আড়চোখে সে দৃশ্যে বিচলিত হয়। 
সে নিজের বন্ধুদের ভালোভাবে চেনে। কিছু একটা নিশ্চয়ই পাকাচ্ছে! কী করতে চাচ্ছে ওরা? তন্ময়কে বসতে দেখে চারজনই আগের মত পিঠ এলিয়ে বসেছে চেয়ারে। যেন তার আড়ালে ফুসুরফাসুর করা ছেলেপেলে ওরা নয়। তন্ময়ও আর মাথা ঘামাল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠান্ডা কফিটা ফের হাতে নিলো। এলিজা শুহানি এবং ঐশীর উদ্দেশ্যে বলল,

‘আজ রাতে শাড়ি পরলে কেমন হয়? ভাবছি কিছু ছবি তুলব সবাই মিলে। আমি দুটো শাড়ি এনেছি।’

শুহানি খুশিতে আত্মহারা, ‘সাদা শাড়ি এনেছি আমি। দারুণ হবে।’ কথাটুকু শেষ করে শুহানি মাথা ঘুরিয়ে অরুকে শুধাল, ‘শাড়ি এনেছ, অরু?’

অরু মাথা দু'পাশে নাড়াল। সে তো জানতো না এতকিছু। জানলে নিশ্চয়ই সাথে আনতো। টপস, কামিজ এবং চুড়িদার ব্যতীত কিচ্ছুটি আনেনি সে। তন্ময় এরমধ্যে দ্রুত গলায় বাঁধ সাধল, ‘তোরা পর। ওকে এসবে জড়াস না।’ অরু শাড়িটাড়ি পরলে শুভকর হবে না বিষয়টা। এই অমঙ্গল সে হতেই দেবে না। মাহিন দুষ্টু ভঙ্গিতে হাসছে। ভ্রু নাচাচ্ছে। এযাত্রায় গুনগুন সুরে গান ধরল,

‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে,
মধুচন্দ্রিমা না চাওয়াটাই ভুল।
সারাটিজীবন কাছে পেতে হলে…
করতে হবে এই একটিমাত্র ভুউউউল…..’
.
.
.
 চলবে…..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন