আশিয়ানা - পর্ব ৪২ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


রাত্রির আটটা কী নয়টা বাজে। চারদিক শাঁ শাঁ শব্দে ব্যস্ত গাড়ি ছুটে চলেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো আছড়ে পড়ছে পিচ ঢালা রাস্তার দক্ষিণ দিকে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে রোদেলা আপন মনে বসে আকাশের তাঁরা গুনছে। কিংবা নিস্তব্ধ আকাশটা দেখে গোপনে ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে। কাঁধের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রাখল রোদেলা এরপর উদাস চোখে মাটির উপর দৃষ্টি নামিয়ে আনলো। একটু আগে মামার সঙ্গে কথা হয়েছে তার এই মিনিট পাঁচেকের মতো। আজকাল মামার শরীরটা খুব বেশি খারাপ থাকছে। প্রায় সময় তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন। মামি এক মিনিট কথা বলেছেন, এক মিনিট জুড়ে ছিল আগামী মাসের বেতন। অগ্রিম বেতন তুলে ওনাকে পাঠানোর জন্য পিড়াপিড়ি করলেন কিছুক্ষণ। অবশ্য রোদেলা এর জন্য রাজি হলো না। হুট করে এডভান্স বেতন চাওয়া খুবই লজ্জাজনক। যেখানে তার জবের মাত্র দুই মাস বয়স। রোদেলা কেবল জানে সে কারো চোখে এতটা নিচু হতে পারবে না। জুবিয়ার আজ সন্ধ্যায় ছুটি হয়ে গেছে রোদেলার আজ তিনঘণ্টা দেরি হলো।রিকশার টুংটাং বেলের আওয়াজ শুনে মাথা তুললো রোদেলা। একটা খালি রিকশা সামনে দাঁড় করিয়ে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন, 'কই যাইবেন আপা?'

রোদেলার ইচ্ছা করছিল কথা বলার শরীর ভীষণ ক্লান্ত। এই শরীরে মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের হতে চাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর জবাব দিল, 'আমি হেঁটে যাব। আপনি চলে যান।' রিকশাওয়ালা ফের জিজ্ঞেস করলেন, 'হাঁইটা যাইবেন কেন? আমার রিকশায় উঠেন। আমি আস্তে আস্তে চালামু।'
রোদেলার ওনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও জোর করে উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে চলতে চলতে বলল, 'আমি হেঁটে যাব আমার কাছে টাকা নেই।'
রিকশাওয়ালা যেন হতাশ হলেন এবং রিকশা চালিয়ে অন্য দিকে অগ্রসর হলেন। রোদেলা বাটন ফোনে একবার সময় দেখে নিল। এরপর বাড়ির উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করতে নিয়ে দেখল পা সঙ্গ দিচ্ছে না। অবশ লাগছে। একটুও নড়াতে পারছে না সে। গাড়ি ভাড়া ছিল তবু মিথ্যা বলেছে রোদেলা শুধু রিকশাওয়ালা কে তাড়ানোর জন্য। হটাৎ অচেনা একজন মানুষ এত সহৃদয় হচ্ছেন দেখে মোটেও ভালো লাগেনি রোদেলার এজন্য ইচ্ছে করেই বলেছে তার কাছে টাকা নেই। আর না হলে লোকটা পিছু ছাড়ত না। বেশ কয়েকদিন ধরে একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে রিকশা, সিএনজি বা অটোওয়ালা পেসেঞ্জারদের নির্জন জায়গায় নিয়ে তাদের থেকে সবকিছু নিয়ে চলে যান এবং অনেকে তো জায়গায় মেরেও ফেলে যায়। ভয়ে সাহস করেনি রোদেলা। দেখেশুনে একটা রিকশা থামাল তারপর জায়গার নাম বলে ভাড়া কত জিজ্ঞেস করে, রিকশায় উঠে বসল। প্রায় এই টাইমে বাড়ি ফিরার সময় দেখা যায় প্রচুর জ্যাম পড়ে আজ তেমন জ্যাম নেই কিন্তু একটার পর একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। অন্ধকারে গাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে না কিন্তু গাড়িগুলো রঙীন হেডলাইন গুলো অন্ধকারে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। তীব্র বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়তে লাগল। রোদেলা আলতো হাতে চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে রাখল এরপর আবার দৃষ্টি ফেলল রাস্তার দিকে। হঠাৎ আকাশে মেঘেদের তাণ্ডব শুরু হলো, মেঘের গর্জন শুনে আকাশের দিকে তাকাল রোদেলা। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। ঠাণ্ডা শীতল বইছে এবং পথের ধুলোকণা উড়ে এসে চোখে পড়ছে। রোদেলা একহাতে রিকশার হুটটা তুলে দিল। সহজ কণ্ঠে বলল, ' একটু তারাতাড়ি চালাবেন প্লিজ।'
রিকশাওয়ালা ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে হাসি মুখে বললেন, 'এই তো আর একটু অপেক্ষা করো। আইসা পরছি।'
.
.
দু'বার কলিংবেল চাপার কর জুবিয়া দরজা খুলে দিল। রোদেলা দ্রুত পা চালিয়ে রুমে এলো এবং কাঁধ থেকে ব্যাগ ও ওড়না খুলে বিছানার উপর রাখল। তারপর চটজলদি জোজোর কাছে এলো৷ জোজোর খাবার বাটিতে ভরপুর খাবার রয়েছে। সে এই খাবার কিনে আনেনি। তাহলে জোজো এসব খাবার কোথায় পেল? রোদেলা ঘুরে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে জুবিয়ার দিকে তাকাল। ততক্ষণে জুবিয়া বারান্দা থেকে চলে গেছে। রোদেলা বারান্দা থেকে রান্নাঘরে এলো। জুবিয়া এখনও কিছু রান্না করেনি। রান্নার পাতিল গুলোর ঢাকনা সরিয়ে সবগুলো দেখে তারপর বেরিয়ে এলো। জোজো এসে রোদেলার পিছু পিছু হাঁটছে। রোদেলা জোজোকে পাশ কাটিয়ে ভেতর রুমে এলো দেখল জুবিয়া নতুন নতুন পোশাক বের করছে এবং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক এক করে জামাগুলো দেখছে। অবশেষে আকাশী রঙের একটা শাড়ি সিলেক্ট করল। জুবিয়াকে দেখে রোদেলা ঠাণ্ডা স্বরে বলল, 

'একরাতে শাড়ি পরে কোথায় যাবি?'

জুবিয়া বিরক্তিতে থতমত মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পর কঠিন কণ্ঠে বলল, 'আমি না। তুই পরবি।'

রোদেলা অবাক চোখে তাকাল। বলল, 'আমি কেন পরব?'

জুবিয়ার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। জুবিয়া ওর কাজ করতে করতে আয়নার দিকে তাকাল তারপর রোদেলার চোখে চোখ রেখে বলল, 'সন্ধ্যায় উমাইয়া ও সাদাফ ভাইয়া এসেছিল। ভাইয়া ওনার বাসায় গেটটুগেদারের পার্টি রাখছেন। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের ইনভাইট করেছেন। জোর গলায় বলেছেন আমাদের যেতেই হবে।'

রোদেলা ঠোঁট কামড়ে জুবিয়ার দিকে সেকেণ্ড কয়েক তাকিয়ে থেকে বলল, 

'জোজোর খাবার ভাইয়া নিয়ে আসছেন?'

'হ্যাঁ আবার না।' বলল জুবিয়া।

রোদেলা কিছু বুঝতে পারলো না। সে বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, 'মানে?'

জুবিয়া মাথা নিচু করে চমৎকার ভাবে হাসল,

'জোজোর জন্য খাবার সাদাফ ভাইয়া আমাদের এখানে নিয়ে আসছেন। কিন্তু খাবারটা উনি কিনেন নি।'

'উনি কিনেনি? তাহলে কে কিনল?'

জুবিয়া ফের হাসল।

'সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী।'

রোদেলা এর জবাবে কিছু বলল না। যেন সে কোনো মাটির মূর্তি ওভাবে দাঁড়িয়ে রইল। জুবিয়া কাপড় নিয়ে চেঞ্জ করতে যেতে যেতে বলল, 

'জলদি শাড়িটা পরে নে। এরপর আমি তোকে সাজিয়ে দিবো। সময় বেশি নেই জলদি কর।'

রোদেলা জিজ্ঞেস করল,

'আমরা তো সাদাফ ভাইয়ার বাড়িতে যাইনি। ওনার বাড়ি কীভাবে চিনবো?'

জুবিয়া নির্বিকার কণ্ঠে বলল, 

'আমাদের জন্য নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখন জলদি কর দশটা বাজতে সময় বেশি নেই।'

শরীরের ক্লান্তি এক নিমিষে দূরে ছুড়ে ফেলে রোদেলা চট করে শাড়ি পরে নিল। প্রিয় মানুষ জনের খুশির জন্য এতটুকু কষ্ট সহ্য করা যায়। প্রসাধনী ব্যবহার করা রোদেলার পছন্দ নয়। জুবিয়া জানে তবুও মাঝেমধ্যে জোর করে হালকা সাজিয়ে দেয় সে রোদেলাকে। রোদেলা ভেতর রুম থেকে বেরিয়ে এলো জোজোর কাছে গিয়ে দেখল সে ভরপেট খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। রোদেলা ভ্রু উঁচিয়ে থমথমে কণ্ঠে বলল, 

'উনি আমাকে বিস্মিত করছেন ওনার মতন কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষের এত নরম, কোমল। অথচ আমি ওনাকে কতই না ভুল বুঝেছি।'

জুবিয়া অপেক্ষা করল না। দরজার দিকে হাঁটা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, 'রোদু তোর হলো?'

'আসছি।'

রোদেলা দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। একসঙ্গে গাড়িতে উঠে বসল। বেশ কিছুক্ষণ পর সাদাফের বাড়ির গেইট দিয়ে গাড়িটা ভেতরে ঢুকলো। তিনটা পরিচিত মুখ দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল রোদেলা। এখানে কাউকেই সে চিনেনা তাই একপাশে গিয়ে দাঁড়াল। সাদাফের বুদ্ধির উপর ভীষণ হতাশ হলো সেহরিশ। গেটটুগেদার পার্টি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে করতে চেয়েছিল সে। যেন সহজে বুঝতে পারে জুবিয়ার মনে তূর্ণর জন্য ফিলিংস আছে কী নেই? কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। এতগুলো মানুষের সামনে জুবিয়ার সঙ্গে কথা বলা কঠিন। সেহরিশ চাচ্ছে তূর্ণর বিয়ে দিয়ে সে দেশ ছাড়বে। যতদ্রুত সম্ভব এই দেশ থেকে যেতে হবে তার। মন ও অনুভূতি কখনও বেঁধে রাখা যায় না। এই মন হুট করে ব্যতিক্রম কিছু চাচ্ছে। মনকে প্রশ্রয় দিতে চায় না সেহরিশ রোদেলার থেকে দুরত্ব বজায় রাখা তার জন্য উত্তম বলে ভেবে নেয়। সাদাফের উপর অতিরিক্ত রাগ ও ক্ষোভের কারণপ সেহরিশের মুখখানা রক্তিমবর্ণ হয়ে গেছে। মন-মেজাজ ভয়ংকর খারাপ চোখে-মুখে স্পষ্ট। দূর থেকে সেহরিশকে দেখে গলা শুকিয়ে গেল রোদেলার। টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে কয়েক ঢোক পানি গিলে গ্লাসটা আবার রেখে দিল। হঠাৎ পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠল রোদেলা। 

'রোদেলা!'

আচমকা ঘুরে তাকাল রোদেলা। পুরুষ লোকটা তুড়ি বাজিয়ে রোদেলাকে ডাকলো। পরোক্ষণে সম্বিত ফিরে পেল রোদলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে শুধাল,

'আপনি এখানে?'

লোকটা তার হাত ঘড়িতে একপলক সময় দেখে নিল। এরপর সহজ ও স্পষ্ট স্বরে বলল,

'এখনও আপনি করে বলবেন?'

রোদেলা যেন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। সে ইতস্তত করে বলল, 'আমাকে যেতে হবে। আজ আসি।'

'কিন্তু?' বলে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল সে। তারপর ফের বলল, 'আপনার উপর আমার নজর সবসময় থাকবে।'
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন