আমি হা করে চেয়ে আছি রৈনীলের দিকে। চা খাবো কিনা বুঝতে পারছি না। হতভম্ব ভাব কাটতে সময় লাগলো। রৈনীল চায়ের কাপে চিনি মেশাচ্ছে। টুংটাং করে আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। আমি ধীরেধীরে উঠে বসলাম। রৈনীল চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো আমার দিকে।
এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছি যে, ধন্যবাদ বলতেও ভুলে গেলাম। রৈনীল বললো, কি হয়েছে সরণী?
আমি লজ্জা এড়াতে বললাম, 'ঘুম লেগে এসেছিল।'
'ওহ শিট। সরি সরি। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে আর আমি কিনা তোমাকেই চা খাওয়াচ্ছি।'
কথাটা বলেই রৈনীল চায়ের কাপটা আবার ফেরত নিয়ে নিলো। আমি বললাম, 'দিন আমাকে। চা খাই।'
'তুমি ঘুমাচ্ছিলে না? চা টা অন্য কাউকে দেই।'
'আরে আশ্চর্য! আমার তো এখন চা খেতে হবে।'
কথাটা এত জোরে বলে ফেললাম যে রৈনীল হকচকিয়ে গেল। আবারও ফেরত দিলো চায়ের কাপখানি। আমি বললাম, 'আমি মোটেও ঘুমাতে চাচ্ছি না। আমার বাইরে হাঁটতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ক্লান্ত অনুভব করছি। চা খেলে আমার ক্লান্তিভাব কাটবে। থ্যাঙ্কিউ।'
রৈনীল মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, 'তাহলে খাও।'
রৈনীল আবারও বলল, 'চিনি ঠিক আছে?'
আমি এক চুমুক দিয়ে বললাম, 'হ্যাঁ ঠিক আছে।'
যদিও চায়ে চিনি বেশী হয়েছে। হয়তো অন্য মেয়েরা এরকমই চিনি খায়। আমি একেবারে চায়ে খুব সামান্য চিনি মেশাই। সেটা তো রৈনীলের জানার কথা নয়। রৈনীল বসে আছে সোফায়। আর আমি বিছানায়। দুজনেই নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ওর সঙ্গে আমার চা খাওয়ার মধুর অভিজ্ঞতা।
রৈনীলকে দেখলেই আমার মনে হয় যেন সে একটা কবিতা। কবিতার মতো ওর নান্দনিক মুখচ্ছবি। ঝাঁকড়া চুল, গালভরা এলোমেলো দাড়ি গোঁফ। এই চেহারা নিয়ে সে কীভাবে অফিসে যায় আমার জানা নেই। কথাটা জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। আমি যেহেতু কথা বলার জন্য কোনো টপিক খুঁজে পাচ্ছিনা। তাই এটাকেই বেছে নিলাম।
বললাম, 'আপনি কি সবসময় এভাবে থাকেন?'
'কিভাবে?'
'এতটা ক্যাজুয়াল। অফিসে কি এভাবেই যান?'
মৃদু হেসে রৈনীল উত্তর দিলো, 'শুধু আমার জন্য এভাবে যাওয়ার নিয়ম চালু আছে।'
'শুধু আপনি কেন?'
'বস আমাকে ভীষণ পছন্দ করেন। এজন্য আমি যেভাবে ইচ্ছে অফিসে যেতে পারি।'
'বসের বয়স কত?'
'ছাপ্পান সাতান্ন।'
'ওনার মেয়ের সঙ্গে আপনার বিয়ে দিতে চায় নাকি?'
রৈনীল হাসিতে পাগল হয়ে গেল। কতক্ষণ হাসলো খেয়াল নেই। ওকে আমি এর আগে এভাবে হাসতে দেখিনি। অবশ্য এতটা ব্যক্তিগতভাবে আমি কাউকেই কাছ থেকে হাসতে দেখিনি আগে।
রৈনীল বললো, 'বসের মেয়ে নেই। তিনজন ছেলে। ছেলের বউদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।'
'দেখা হলে কি হত?'
'দেখা হলে বুঝতে পারতাম বস ওনার ছেলের বউদের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ভাবছেন কিনা।'
এবার আমি হেসে উঠলাম। রৈনীল কথাটা এমন মজার সুরে বললো যে, না হেসে পারলাম না। আমি হাসি থামিয়ে বললাম, 'আপনি ভালো চা বানান কিন্তু।'
'চা খাওয়ার সঙ্গী হিসেবে তুমিও বেশ ভালো।'
আমার শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। মৃদু শিউরে উঠি আমি। অজান্তেই চোখ রাখি রৈনীলের চোখে। আমার সর্বাঙ্গে রিনরিন করে কিছু একটা দোলা দিয়ে যায়। টের পাই, আমি স্বপ্নের ভেতর ঘুরপাক খাওয়ার মতো আপন লয়ে টলছি। আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। ক্ষণিকের এই ক্ষুদ্র মুহুর্তের অনুভূতি আমার জীবনে একেবারেই প্রথম।
রৈনীল চায়ের কাপ নিয়ে উঠে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, 'বাইরে যাবে বলছিলে?'
'হুম। একটু ফ্রেশ হতে হবে। বাইরে দাঁড়ান, আমি আসছি।'
আমি বিব্রত পরিস্থিতি এড়াতে দৌড়ে বাথরুমে চলে এলাম। আমার সাজসজ্জা আগের মতোই আছে দেখে গর্বিত বোধ করলাম। নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো। কিন্তু খানিকক্ষণ আগে, ঠিক কি হয়েছিল আমার? ওর একটামাত্র সাধারণ বাক্য, আর ওর সেই চোখে কি এমন ছিল, যা আমাকে এভাবে নাড়া দিয়ে গেল! আমি জানিনা। কিচ্ছু জানিনা।
বের হয়ে দেখি রৈনীল ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে। আমি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম, 'চলুন আপুদের ওখানে যাই। আচ্ছা, আপনি লাঞ্চ করেছেন?'
'না।'
'তাহলে চা খেলেন কেন?'
'তোমার মতোই ঘুম কাটাতে।'
'ওহ আচ্ছা। খিদে পায়নি?'
'অতটাও না। একটু পরে খাবো।'
আর কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। স্বাগতা আপুরা সবাই একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আমরাও এসে যোগ দিলাম। ওদের কথা ধরে ফেলতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো আমার। খুব জলদিই মিশে গেলাম আড্ডার মাঝে। এক ফাঁকে রৈনীল উঠে ভাত খেতে চলে গেলো। আমার অবচেতন মন বারবার চাইছিল, গিয়ে রৈনীলের পাশের চেয়ারে বসে থাকতে। চুপচাপ ওর খাওয়ার দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করতে। কিন্তু মনকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। বসে রইলাম আমি।
দূর থেকে দেখছি রৈনীল মাথা নিচু করে ভাত খাচ্ছে। শান্ত, সরল ভঙ্গীতে। ওর চেহারাটাই সরল। দেখলেই মনে হয় এই লোককে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যেতে পারে। অবশ্য আমার মায়ের ধারণা নিজের বাপকেও চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা উচিৎ না।
রৈনীল খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরিয়েছে। ওর সিগারেট টানার দৃশ্যটা আমার কাছে শিল্পের মতো। আমি মাঝেমাঝে সেদিকে তাকাচ্ছি। আড্ডার ফাঁকে একজন উঠে যেতেই আড্ডায় ইস্তফা ঘটলো। জমলো না আর। আমরাও সদলবলে উঠে পড়লাম। স্বাগতা আপুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের ভেতর চলে এলাম।
সূর্য ডোবার মুহুর্তে চারিদিক শীতল হয়ে গেলো। আমরা হালকা নাস্তা ও চা খেয়ে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে সকলের মুখে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। এর মাঝে একবারও ঘুম ভাঙেনি। কেউ ডাকেও নি আমায়। যখন ঘুম ভাংলো, দেখি আমরা বাসার গেটে ঢুকছি। আমাকে চোখ মেলতে দেখে আপু বলল, 'যাক তোকে ডেকে তুলতে হয়নি। আমি তো ভাবছি এত সুন্দর করে ঘুমাচ্ছিস, কিভাবে ডাকি তোকে!'
'সে কী! বাকিরা নেমে গেছে সবাই?'
'হ্যাঁ। তুই তো মহাঘুমে ছিলি। তাই টের পাসনি।'
'এত বড় জার্নিতে আমার একবারও ঘুম ভাংলো না?'
'তা আমি কি করে জানি? তোর ঘুম দেখতে আমারও ভালো লাগছিল। এজন্য একবারও ডাকিনি।'
আমার কিঞ্চিৎ মন খারাপ হয়ে গেল। ট্যুরটা খুব সুন্দরভাবে শেষ করেই গাড়িতে উঠেছি। তবুও ওইটুকু জার্নিও আমার মিস করতে ইচ্ছে করছিল না। আর কখনো হয়তো এভাবে যাওয়া হবেনা কোথাও। এই সুন্দর স্মৃতি গুলো আমার আজীবনের রসদ হয়ে রইবে।
ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আমি আরাম করছি। কখনো উঠে বই নিয়ে বসছি, আবার কখনো টিভিতে গান ছেড়ে দিয়ে শুনছি। কোনোটাই ভালো লাগছে না। বেড়াতে যাওয়ার আগে সবকিছুকে মোহনীয় মনে হলেও ফিরে এসে সব যেন পানসে হয়ে গেছে। আমার অদ্ভুতভাবে মন উচাটন হয়ে আছে। বালিশে ভর দিয়ে আমি কিছুক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে রইলাম।
পরেরদিন সকাল সকাল আমার মা এসে হাজির। আমি তখনও ঘুম থেকে উঠিনি। হঠাৎ চোখ মেলে দেখি মা আমার বিছানায় বসা। আমার দিকে চেয়ে আছে মায়াভরা চোখে। আমি হকচকিয়ে উঠে বসি। জিজ্ঞেস করি, কখন এসেছো?
মা জানালো এসেই আমার ঘরে এসে বসেছে। আমি আশ্চর্য হই খুব। কিন্তু কিছুই বললাম না। হেসে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম।
মা আমার পিছুপিছু ওয়াশরুমের দরজা অবধি এলো। আমি পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, 'কিছু বলবে মা?'
মা কোনো উত্তর দিলো না। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে চলে গেলো। আমি হতভম্ব না হওয়ার চেষ্টা করেও পারলাম না। যদিও এই দৃশ্য আমার কাছে নতুন কিছু না।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে জানতে পারলাম, আর কিছুক্ষণ পরেই বাসায় ফিরতে হবে। দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিতে বলা হলো আমাকে। আমিও কথা বাড়াই নি। নিজের যেসব জামাকাপড় নিয়ে এসেছিলাম, সবকিছু গুছিয়ে বসে রইলাম। মা এসে পাশে বসলো। বলল, 'এই ক'দিনেই তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো!'
আমি অবাক হলাম। মা সাধারণত এমন ধরনের কথা আমাকে কখনো বলেন না। সত্যিই কি তবে আমি চট করে বড় হয়ে গেলাম!
বাড়ি ফিরে আমার রুমে এসে দেখি টেবিলের ওপর রৈনীলের বইগুলো। সব বই এলোমেলোভাবে রাখা। আমার সন্দেহ হলো। মা কি বইয়ের ভেতর উল্টেপাল্টে দেখেছে? এমন কিছু কি পেয়েছে যেটা পাওয়ার কথা ছিলো না!
.
.
.
চলবে......................................................................