'আরীব ভাই দেশে ফিরছে। ফুপি একটু আগে ফোন করে জানিয়েছে। আ'ম সো এক্সাইটেড আপু। কতদিন পর ভাইয়াকে ফেস টু ফেস দেখবো।'
কুহু মৃদু হেসে বলল,'৭বছর ৩মাস ১৫ দিন।'
পিহু কুহুর দিকে কয়েকমুহূর্ত তাঁকিয়ে থেকে বলল, 'ভাইয়াকে এখনও ভালোবাসিস আপু?এত কিছুর পরও?'
'এত কিছু কোথায়?সে আমাকে কখনও ভালোবাসেনি আর আমি বেসেছি। এটুকুই তো। হ্যাঁ তবে মাঝে মাঝে বেহায়া হয়েছি, প্রেমভিক্ষা চেয়েছি, কেঁদে ভাসিয়েছি, কাকুতি-মিনতি করেছি। এছাড়া কি? ভালোবাসলে মরণকেও বরণ করে নেওয়া যায় পিহু, যখন বড় হবি তখন বুঝতে পারবি।'
'ভালোবাসলে মরণকেও বরণ করে নেওয়া যায়।' পিহু সেদিন বোঝেনি কথাটির অর্থ। আজ বুঝতে পারছে। আরীব ভাই দেশে ফিরেছে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে। নাম মারিয়া আফরা। বিদেশিনী হলেও তাকে নিজেদেরই একজন মনে হয়, তার আন্তরিকতার জন্য। পিহুর মারিয়াকে বেশ ভালো লেগেছে কিন্তু নিজের বড় আপুর মুখের দিকে তাঁকালে বুকটা কেমন ধড়ফড় করে ওঠে।
কুহুর মলিন ফ্যাকাশে চেহারা, চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রুকণা, জামা মুঠো করে মোচড়ানো, ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর বৃথা প্রয়াস। এভাবে কুহুকে দেখতে পিহুর একদম ভালো লাগে না। পিহু সবসময় চেয়েছে ওর আপু একটু ভালো থাকুক। বেশি কিছু তো চায়নি। দীর্ঘ আটবছরের কান্নার পরে একটুখানি হাসি চাওয়া কি অনেক বেশি ছিল?
আরীব ভাই তার কথা রেখেছে,সে কুহু আপুকে কখনও মানবে না বলেছিল, মানেনি। বিয়ে করবে না বলেছিল, করেনি। ভালোবাসবে না বলেছিল, ভালোবাসেনি। কিন্তু কুহু আপুর কি দোষ ছিল? সে শ্যামলা বলে? গায়ের রঙটা একটু চাপা বলে? পড়াশোনায় অ্যাভারেজ বলে? নাকি গোপনীয় কারনটি?
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পিহু দেখছে, কুহুর বালিশে মুখ গুজে কান্নার দৃশ্য। হাত-পা ছুড়ছে সে। চুল টেনে হু হু করে কেঁদে উঠছে। পিহু দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। চোখ বুজে নেয়। চোখের কার্নিশ বেয়ে তপ্ত তরল গড়িয়ে পড়ে। দুহাতে তা মুছে পিহু পুনরায় কুহুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। মৃদু হেসে বলল,
'তোর জীবনেও ভালোবাসা আসবে আপু।ট্রাস্ট মি, এর থেকেও বেটার কেউ আসবে।'
.
.
৩ বছর পর_________________
সকাল ৭টা। কলিংবেল বাজছে। বাড়িতে আজ কেউ নেই। যে ছিল সেও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চোখের পাতায় ঘুমেরা পাঁকাপোক্তভাবে ঘাটি গেড়েছে। সে ঘুম থেকে উঠতে না চাইলেও কলিংবেলের শব্দ তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দিল না। চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাঁকাল সে। ৭:১০ বাজে, এত সকালে কে আসবে? ওরনা বুকে জড়িয়ে খোলা চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে সে দরজা খুলল। একটি ছেলে পার্সেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে দেখেই সে দ্রুত বলল,
'একটা পার্সেল ছিল ম্যাম, আপনার নাম?'
'সভ্যতা চৌধুরি।'
'কিন্তু পার্সেলটা পিহু ও কুহুর নামে পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে তাদের হাতেই দিতে। যদি তাদের কাউকে ডেকে দিতেন।'
সভ্যতা সরুচোখে তাকিয়ে বলল, 'জ্বী আমার ডাকনাম পিহু।'
'ওহ, নিন। এখানে সাইন করতে হবে।'
সভ্যতা সই করার আগে পার্সেলটা নেড়েচেড়ে দেখল। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। পার্সেলটার ভেতরে কি থাকতে পারে?
'কে পাঠিয়েছে? কিছু বলেছে? এখানে কোনো নাম ঠিকানা দেখছি না।'
'ম্যাম উনি বলেছেন ভেতরে যা আছে তা দেখলেই আপনারা ওনাকে চিনতে পারবেন।'
'আচ্ছা।'
পার্সেলটি নিয়ে সভ্যতা নিজের ঘরে এলো। ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় কাঁচি নিয়ে বসলো। ছেলেটি বলেছে পার্সেলটি নাকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আজকের মধ্যেই তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তাই সে এত দ্রুত এই কাকডাকা ভোরে হাজির হয়েছে।
সভ্যতা একবার ভাবল কুহুর জন্য অপেক্ষা করবে। বিকালেই আসবে সবাই, কিন্তু বরাবরই ওর ধৈর্য কম। অপেক্ষা করা ওর পক্ষে সম্ভব না।তাই কুহুকে ভিডিও কল করল। ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। হয়তো ঘুম থেকে উঠেছে কিন্তু এই মুহূর্তে ফোনের কাছে নেই কুহু। নয়তো কল রিং হলো কি করে? নেট অন আছে যখন, তখন পরে কলব্যাক করবে সে।
সভ্যতা খুব সাবধানে পার্সেলটি কেটে ফেলে। ভেতরে রঙিন কাগজে মোড়ানো দুটো বস্তু। নীল রঙের যেটা সেটায় পিহু লেখা, আর বেগুণি রঙেরটায় কুহু। যে পাঠিয়েছে সে দুবোনের পছন্দের রঙের ব্যাপারে অবগত। পরিচিত কেউ হবে, এমন ভেবে নিজের নামের প্যাকেটটি নিল সভ্যতা। সেটা খুলতেই ওর চোখ ক্রোধে জ্বলজ্বল করে উঠল,
'পিহু... ভালো আছিস? আমি ভালো নেই রে পিহু। টেনশনে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তোর বোনটা আমাকে একটুও পাত্তা দিচ্ছে না। ফোন করলে ফোন ধরেনা। কথা বলেনা, সেদিন দেখতে গেলাম, আমাকে দেখেই উল্টোপথে চলে গেল। তুই আমাকে এ কোন মসিবতে ফেললি? জোর করে এমন একজনের প্রেমে পড়তে বাধ্য করলি যে আমার দিকে ফিরেও তাঁকায় না। আমার এখন নদীর একূল-ওকূল সব ঝাপসা লাগছে। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই.. কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। পিহু রে..বরবাদ করে ছাড়লি আমাকে... তুই এমনটা কিভাবে করতে পারলি? আমার নাম্বারও ব্লক করে রেখেছিস,আমার সাথে তোরা দুবোন এমন করছিস কি করে? দেখ...'
এমন অহেতুক কথাবার্তা দেখে সভ্যতা বেজায় রেগে গেল। এই মাহিন ভাইটা আস্ত বলদ নাকি? আশ্চর্য! তবে গিফট দেখে অবশ্য রাগ কমে গেল সভ্যতার। দুটো রেয়ার বইয়ের খোজ দিতে বলেছিল, মাহিন দুটো বই'ই কিনে পাঠিয়েছে। এটাকে উপহার বলবে নাকি ঘুষ বুঝতে পারল না সভ্যতা। তবে যাই হোক, আপাততো বই পাওয়ার খুশিতে তাকে একটু সাহায্য করা যেতেই পারে। তাই ব্লক খুলে লম্বা একটি ম্যাসেজ লিখতে বসলো সে।
"অপ্রিয় মাহিন ভাই,
আমি আমার নামের মত সভ্যতা বজায় রাখতে পছন্দ করি। তাই আপনার অহেতুক কথাবার্তার প্রসঙ্গ টেনে না এনে আসল কথাতে আসি, আপনাকে আমি আমার বোনের ব্যাপারে সব জানিয়েছি। আটবছর প্লাস এক বছর, মোট ন-বছর এক গাধাকে ভালোবেসে পস্তাচ্ছে সে। স্বাভাবিক সে আপনার প্রেমের প্রস্তাব সহজে মেনে নেবে না। আপনাকে বিশ্বাস করতে পারবে না। তাই যা করার আপনাকেই করতে হবে, বিশ্বাস জিতুন। প্রমাণ দিন আপনি তাকে ভালোবাসেন, সারাজীবন এভাবেই ভালোবাসবেন। একবার যদি সে, আবার ভালোবাসতে রাজি হয় তবে আর কোনো কথা নেই,
আপনারা দুজন থাকলে রাজি,
আমি নিজে ডেকে আনবো কাজী
চো চাপ ব্রো...
এবার মনে মনে খুশি হয়ে চটপট দোয়া করে দিন যেন আমিও দ্রুত মনের মানুষ খুজে পাই। অন্যের সম্পর্কের পিয়নগিরি করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত আমি। আর হ্যাঁ, বইগুলোর জন্য ধন্যবাদ। টেক্সটের রিপ্লাই দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার হা-হুতাশ শোনার আগ্রহ নেই আমার। কেঁদে ভাসানোর ইচ্ছে হলে জায়গামত কাঁদেন। আর ধন্যবাদ দিতে হবে না, আমি উপদেশের বিনিময়ে কিছু নেই না। আমার মন অনেক বড় তাই আমি ফ্রিতেই অ্যাডভাইস দেই। স্টে হ্যাপি অ্যান্ড সাউন্ড।'
.
.
বিছানার ওপর অনাদরে পড়ে থাকা ফোনটা নিয়ে চেক করলো নম্রতা। স্ক্রীনে "পিহু" নাম দেখে ফোন করবে ভাবলেও ফোন করার সময় পেল না। ব্যাগ গোছাতে হবে। দেড়ঘন্টা পর বাস ছাড়বে, রাতে ব্যাগ গোছাবে গোছাবে করেও গোছানো হয়নি। এখন গোছাতে শুরু না করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। ব্যাগ গুছিয়ে সবার সাথে বাসে উঠে সভ্যতাকে ফোন করে সে। কিন্তু ফোন বেজে বেজে কেটে যায়। স্বাভাবিক দশটা থেকে সভ্যতার ক্লাস শুরু হয়েছে। যেটা মনে ছিল না নম্রতার।
বাড়িতে ফিরে গোসল করে সভ্যতার ঘরে আসে সে। সভ্যতার বিছানার ওপর "কুহু" নামের প্যাকেটটি পড়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে সভ্যতা টেক্সট করে জানিয়েছে নম্রতা যেন প্যাকেটটা দ্রুত দেখে। তাই না খেয়েই নম্রতা প্যাকেট নিতে এসেছে।প্যাকেট খুলে নম্রতা একটি শাড়ির কম্ব পেল, সঙ্গে ছোট্ট চিরকুট। নম্রতা ভাবলো সভ্যতা বোধ হয় তাকে উপহার দিচ্ছে।তাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে চিরকুটটি নিয়ে পড়তে শুরু করে,
'স্বার্থপর মেয়ে কুহু,
এই শুভ্র শাড়িটা তোমার জন্য।আমার চাকরিটা হয়ে গেছে।তোমাকে জানাতে এসেছিলাম,কিন্তু তুমি জানতে চাওনি। চলে গিয়েছিলে।আমার এ ঘটনায় রেগে যাওয়া উচিত হলেও আমি মোটেও রাগ করিনি। গতপরশু আমি আমার প্রথম বেতন পেলাম। বাড়ির সবার জন্য টুকটাক জিনিস কিনেছি। ভাবলাম তোমাকেও কিছু দেই। শাড়িটি এখন পড়তে না চাইলে, পড়না। তবে ফেলে দিওনা। নিজের কাছে রেখো। আমাকে রাখলে না, আমার দেওয়া জিনিসটা অন্ততো রেখো। এরপর যখন আমাকে নিজের করবে তখন শাড়িটাকেও না হয় কোরো। এই বিশেষ শাড়িটা আপাততো সেই বিশেষ দিনের জন্য তোলা থাক।
ইতি তোমার অপছন্দের মানুষ।'
সভ্যতা মাত্রই ফিরেছে। নম্রতাকে চিরকুট পড়তে দেখে সে ঘরে ঢুকলো না। মাহিন ফোন করছে বারবার। নম্রতার কথা জানতে চাইছে। সভ্যতা ফোন রিসিভ করল না। এদের দুজনকে এক করতে হলে কিছুটা কাঠখড় পোড়াতে হবে। আপাততো দুজনেই ধৈর্যের পরীক্ষা দিক। কিন্তু আচমকা আরীবের কল আসায় খানিকটা চমকাল সভ্যতা।
প্রায় মাসখানেক পর কল করেছে আরীব। ফুপির শরীর কিছুদিন হলো ভালো নেই।আরীবের বউও নাকি ফুপির যত্ন নেয়না।রাগ করে সভ্যতা আরীবের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল এসব কারণে।নম্রতার অনুভূতি নিয়ে অনেক কথাও শুনিয়েছিল। আরীব ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল, সুতরাং জরুরি না হলে তার ফোন করার প্রশ্নই আসেনা। সভ্যতা সেসব ভেবেই কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে পিনপতন নিরবতা। সভ্যতা রাগতস্বরে বলল,
'কথা না বললে বারবার ফোন করছ কেন? প্রয়োজন ছাড়া আমাকে ফোন করবে না আরীব ভাই। কোনো প্রতারক আমার ভাইয়ের পরিচয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুক আমি তা চাইনা।'
আরীব অনুতপ্ত, ক্লান্তস্বরে বলল, 'কুহুকে বলিস আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়।'
সভ্যতা তাচ্ছিল্য হেসে বলে, 'বলবো না। ক্ষমা চাইতে হলে অহংকার চূর্ণ করে নিজে এসে চাও। যার জন্য আমার নরম বোনটাকে ছাড়লে আজ তোমায় ছেড়েছে সে। ব্যাপারটি আনন্দের না হলেও কিছুটা শান্তি পেয়েছি আমি। কেন জানো? থাক জানার প্রয়োজন নেই। শুধু এটা মনে রেখো, মানুষ তার কর্মফল পাবেই।'
সভ্যতা কল কেটে দিল।পরপর-ই কিছু একটা মনে পড়ায় দ্রুত আরীবের নাম্বারে ছোট্ট একটি এসএমএস পাঠাল,
'তোমার ব্রোকেন হার্ট নিয়ে এবাড়ি এসে সিমপ্যাথি কুড়ানোর দরকার নেই। আর এসব অনুতাপের নাটক অন্যকোথাও গিয়ে করো। আমি নম্রতা নই যে তোমার দুঃখে গলে যাবো। আমি সভ্যতা, সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আমি ঘিয়ের বয়ামটাই ভেঙে ফেলি। তুমি নিশ্চই জানো, ভাঙা জিনিস সহজে জোড়া লাগে না। লাগলেও দাগ থেকে যায়।তাই দুঃখিত!আরীব ভাই।আমি তোমাকে সমবেদনা জানাতে পারলাম না। ভালো থেকো।'
.
.
.
চলবে.............................