আশিয়ানা - পর্ব ১১ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


সাদা ফতুয়া আর ঢিলেঢালা পাজামা পরা এক ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুললো সাদাফ। উমাইয়ার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে দেখে চমকে উঠল সাদাফ। তারপর লহু কণ্ঠে বলল,
  'আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।'
ভদ্রলোক সরু চোখে সাদাফের দিকে তাকালেন। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
  'ওয়াআলাইকুমুস সালাম বাবা। তুমি কে? আগে তো এই বাড়িতে তোমাকে দেখিনি।'
সাদাফ সুন্দর করে হেসে বলল,
  'আমার নাম সাদাফ ক্যাসানো। আমি এই ফ্ল্যাটে নতুন। আজ উঠলাম।'
ভদ্রলোক সাদাফের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বললেন, 
  'সাদাফ কসাই। তুমি কি বংশগত ভাবে কসাই?'
সাদাফ লোকটার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
  'কসাই না, ক্যাসানো চাচা।'
উমাইয়া দরজা খুলে দিল। ফারুক হোসেনকে দেখে ম্লান কণ্ঠে বলল,
  'বাবা আজ তোমার ফুফুর বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। যাওনি কেন?'
ফারুক হোসেন উমাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। কণ্ঠ নিচু করে নরম সুরে বললেন,
  'কাল সকালে গ্রামে ফিরব। তোর বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ডে কাছে তাই রাতটুকু তোর বাড়িতেই থাকব।'
উমাইয়া চোখ ঘুরিয়ে সাদাফের দিকে তাকাল। উমাইয়া বিস্মিত ও নিচু গলায় বলল,
  'আপনি?'
সাদাফ মৃদু হেসে বলল, 
  'জি আমি। এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি তাই কয়টা দিন থাকতে এসেছি।'
উমাইয়া ওর বাবার সঙ্গে ভেতরে চলে গেল।

হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সাদাফ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অনেকক্ষণ ধরে বারান্দার দরজার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বারান্দায় রাখা শুকনো কাপড়গুলো বৃষ্টিতে ভিজে যাবে ভেবে উমাইয়া কাপড় নিতে দৌড়ে বারান্দায় আসে হঠাৎ পাশের বারান্দায় সাদাফকে দেখল চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা ও অগোছালো চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে আছে। উমাইয়ার হাত পা কাঁপতে লাগল। হঠাৎ পাশের বারান্দা থেকে সাদাফ ঠাণ্ডা গলায় বলল,
  'উমা! উইল ইয়্যু ম্যারি মি?'
উমাইয়া বিস্মিত, বার দুয়েক চোখের পলক ফেলে শুধল, 
  'কি?'

সাদাফ মাথা তুললো দৃষ্টি ফেলল উমাইয়ার মুখের দিকে। তারপর কয়েক কদম এগিয়ে এসে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। সাদাফ জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে করুণ গলায় বলল,
  'পৃথিবীতে আমার কেউ নেই উমা। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। সপ্তাহে একবার বা মাসে একবার দেখার চেয়ে আমি প্রতিদিন আপনাকে দেখতে চাই। আপনার সঙ্গ ভালো লাগে। আমাকে বিয়ে করবেন?'
উমাইয়া সম্মোহিত কণ্ঠে বলল, 
  'হ্যাঁ।'

মূহুর্তে উমাইয়ার হুঁশশ ফিরল। সে হঠাৎ বারান্দার দরজা খুলে ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসল। মুহূর্তেই উমার সারা শরীরে একটা অদ্ভুত সিরসির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। উমা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর খোলা চুল দুই হাতে ধরে হাত খোঁপা করল। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,
  'আমি কি ভেবে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলেছি? কেন বলেছি? কেন?'
রোদেলা হঠাৎ বলল,
  'কাকে কী বলেছিস?'
উমাইয়া হতভম্ব হয়ে গেল। অস্ফুটস্বরে বলল,
  'কেউ না। কাউকে না।'


বৃষ্টি থেমে গেছে প্রায় ত্রিশ মিনিট হয়েছে। সেহরিশ রান্নাঘর থেকে কফির কাপ হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। সোফায় শুয়ে আছে তূর্ণ। সেহরিশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, 
  'সাদাফের সাথে কথা হয়েছে?'
সেহরিশ মৃদুস্বরে বলল,
  'হুম।'
তূর্ণ বিরক্ত গলায় বলল, 
  'ওর যে পরিমাণ টাকা আছে, তা দিয়ে ওর চেয়ে দ্বিগুন ভালো বাড়ি হাজার বার কিনতে পারে। আমি বুঝতে পারছি না সাদাফ ওই কম মানের ছোট্ট ফ্ল্যাটটা কেন কিনেছে?'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
  'শিউর! কোনো ঝামেলা আছে।'
তূর্ণ সোজা হয়ে বসল। ভারী গলায় বলল,
  'সাদাফ কারো প্রেমে পড়েছে?'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 
  'অসম্ভব। সাদাফ আর প্রেম?'
তূর্ণ ভাঙা গলায় বলল,
  'কেন অসম্ভব? ওর কি অনুভূতি নাই? সে কি রোবট? তাছাড়া প্রেম ভালোবাসা যে কোন সময় হতে পারে।'
সেহরিশ তূর্ণর দিকে একটু ঝুঁকে এলো গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 
  'তুই কি কারো প্রেমে পড়েছিস?'
তূর্ণ হেসে বলল,
  'হুহ। কিন্তু?'
সেহরিশ তীক্ষ্ণ চাহনিতে তূর্ণ দিকে তাকিয়ে বলল,
  'সিরিয়াসলি? সে কে?'
তূর্ণ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল, 
  'জানি না।'
সেহরিশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধমকের গলায় বলল,
  'ফাজলামো হচ্ছে?'

তূর্ণ জবাব দিল, সেহরিশকে জুবিয়ার কথা বলল। সেহরিশ আগের মতোই গম্ভীর ও বিরক্ত গলায় বলল,
  'তোকে সহ্য করা অসম্ভব।'
তূর্ণ উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, 
  'কিন্তু কেনো?'

গভীর রাত তিনটার দিকে সময়। স্বপ্নে রক্ত ​​দেখে সেহরিশের ঘুম ভেঙে গেল। একটু পর সেহরিশ বারান্দায় এসে রাতের ঘন কালো আকাশটার দিকে তাকাল। সেহরিশ রেলিংয়ের উপরে উঠে বসল। হালকা বাতাসে তার চুল খানিক উড়ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে পাহারাদারের বাঁশির আওয়াজ। হঠাৎ ঘরের ভিতর থাকা ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। সেহরিশ রুমে এসে একটু ঝুঁকে ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বার দেখে সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিল।

 ❐

এতগুলি সিঁড়ি ভেঙে উঠে তূর্ণ হাঁপিয়ে গেছে। তূর্ণর পা ব্যথা করছে। তূর্ণ একটানা কয়েকবার সাদাফের ফ্ল্যাটের বেল বাজাতে লাগল। পাশের ফ্ল্যাটের বেলের শব্দ জুবিয়ার কান পর্যন্ত আসছে, জুবিয়া ড্রয়িংরুম থেকে উঠে এসে হঠাৎ দরজা খুললো। দরজা খোলার আওয়াজ শুনে তূর্ণ পেছনে ঘুরে তাকাল সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে।
তূর্ণ স্তম্ভিত সহসা বলে ওঠল,
  'তুমি এখানে থাকো?'

জুবিয়া মলিন গলায় বলল,
  'হ্যাঁ, আমি এখানে থাকি। আর আপনি এতবার বেল বাজাচ্ছেন কেন? আপনি জানেন এতে অন্যরা বিরক্ত হতে পারে?'

তূর্ণ ঠোঁট উল্টিয়ে চুপ করে রইল। জুবিয়া দুই আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
  'উত্তর দিচ্ছেন না কেন? শুনতে পাচ্ছেন না?'

ওষ্ঠদ্বয়ে দুষ্টু হাসি লেপ্টে তূর্ণ জুবিয়ার দিকে তাকাল। তারপর নরম গলায় বলল,
  'আমাকে চিনতে পারোনি? সে সেদিন আমার গাড়ি চালিয়ে তুমি আমাকে মিডিয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।'
জুবিয়া নির্বিকার কণ্ঠে বলল, 
  'আমার নামে চিকেন শপে কিছু রেখে আসছিলেন?'
তূর্ণ বলল,
  'হ্যাঁ, উপহার হিসেবে ফুল পাঠিয়েছিলাম। পেয়েছ?'
জুবিয়া রাগমিশ্রিত গলায় বলল, 
  'না।'

জুবিয়া আর কথা বাড়াল না হঠাৎ দরজা বন্ধ করে দিল। তার রুমে ঢুকে দেয়ালের দিকে তাকাল। তূর্ণর পাঠানো ফুলগুলো শপ থেকে নিয়ে আসে জুবিয়া। দড়ি দিয়ে বেঁধে দক্ষিণের দেয়ালে পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে। জুবিয়া চেয়ারে বসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। জুবিয়া বিড়বিড় করে বলল, 
  'ইশশ, সামান্য ফুলের জন্য এক মানুষের কাছে মিথ্যা বলেছি?

সাদাফ দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। তূর্ণ সাদাফের দিকে তাকাল। তূর্ণ ভিতরে ঢুকলো। তারপর সোফায় বসে বেশ কিছুক্ষণ একা একা হাসতে লাগল। সাদাফ ভ্রু তুলে তূর্ণর হাসিমাখা মুখ দেখে সরল গলায় জিজ্ঞেস করল, 
  'এভাবে হাসার কারণ?'
সাদাফকে চমকে দেওয়ার তূর্ণ সোফা থেকে উঠে সাদাফের গলা জড়িয়ে ধরল। সাদাফ খুব বিরক্ত গলায় বলল,
  'তূর্ণ কি করছিস? আমাকে ছাড়।'
তূর্ণ মুখে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
  'আমি একা থাকতে পারছি না। আজ থেকে আমি তোর সাথে থাকব।'

সাদাফ চমকে উঠে দাঁড়াল। তূর্ণর উদ্দেশ্য কঠিন গলায় বলল, 
  'নাহ। তুই এখানে থাকতে পারবি না।'
তূর্ণ বলল,
  'আমি থাকতে পারব না কেন?'
সাদাফ বাহানা খুঁজতে লাগল,
  'এই ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুম। আমি একটায় থাকি আর অন্যটা এখনো পরিষ্কার করা হয়নি।'
তূর্ণ খুশি হয়ে সোফায় বসল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
  'কোন সমস্যা নেই। পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জানালে তারা আজই এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে।'
সাদাফ ওর ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলল,
  'আমি তোকে আমার কাছে রাখব না।'
তূর্ণ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। সাদাফের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, 
  'কেন? আমি থাকলে সমস্যা কি?'
সাদাফ হাত জোর করে বলল, 
  'একটা সমস্যা আছে প্লিজ চলে যা।'
তূর্ণ আরাম করে সোফায় বসল। দৃঢ়ভাবে বলল, 
  'কিছুতেই যাবো না।'
.
.
.
চলবে...................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন