আশিয়ানা - পর্ব ১২ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


সেহরিশ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, সম্ভবত কিছু ভাবছে। কোনো বিশেষ জল্পনা কল্পনা করছে। খোলা দরজা দিয়ে সাদাফ এগিয়ে এলো। সেহরিশের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
  'কোনো খবর?'
সেহরিশ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে রইল সাদাফের দিকে তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 
  'হুম।'
সেহরিশ প্যান্টের পকেট থেকে হাত দুটো বের করল। তার পাশের চেয়ারটায় বসল। সাদাফ আবার জিজ্ঞেস করল, 
  'জরুরি কিছু?'
সেহরিশ শান্তভাবে বলল,
  'না।'
সাদাফ তখন হঠাৎ বলে ওঠল, 
  'সেই স্বপ্ন?'
সেহরিশ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। বারান্দা থেকে  
যেতে যেতে বলল,
  'না। গ্রামে যেতে হবে।'
  'কেন?'
  'আরুশিকে দেখতে আসবে। মা কল দিয়েছে বাবা না-কি যেতে বলেছেন।'
  'তুমি যাবি?'
  'বাবা চাচ্ছেন আমি যেন ওখানে থাকি।'
  'তোম যাওয়া উচিত। প্রয়োজনে আমরাও যাবো।'

সেহরিশ সাথে সাথে সাদাফের মুখের দিকে তাকাল। অকারণে জিজ্ঞেস করল, 
  'তোরা যাবি?'
সাদাফ মৃদু হাসলো। বলল,
  'হ্যাঁ। তোর বোন তো আমাদের ও বোন। প্রয়োজনে আমরা অবশ্যই যাব। আর ছেলেটাকে দেখেছিস? তুই খোঁজ নিয়েছিস?'
  'শুনেছি, বাবার বন্ধুর ছেলে। এর বাহিরে আমি কিছু জানি না।'
সাদাফ ভাবুক কণ্ঠে বলল, 
  'তোমার খোঁজ নেওয়া উচিত। তুই বড় ভাই তোর একটা দায়িত্ব।'

সেহরিশ গম্ভীর মুখে সাদাফের দিকে তাকাল। সাদাফ হাসল। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
'আমি একজনকে পছন্দ করি। গতকাল তাকে বিয়ের কথা বলেছি।'
সেহরিশ নির্বিকার কণ্ঠে বলল, 
  'এজন্যই ওই ফ্ল্যাট কিনেছিস?'
সাদাফ চমকে উঠে বলল, 
  'তুই জানিস কী করে?'
  'অনেক বছরের বন্ধুত্ব। তোদের বোঝার ক্ষমতা আমার আছে।' বলে থামল সেহরিশ। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,  
  'আমি একটু পর সিরাজগঞ্জ রওনা দেবো।'
সাদাফ জিজ্ঞেস করল, 
  'কনসার্টের কথা কিছু ভাবছিস?'
  'হুম।'
  'কী?'
  'করব।'
  'আমি এখন চলে যাবো?' জিজ্ঞেস করল সাদাফ।
  'প্রয়োজন হলে কল করব।'
  'ওকে। আমি তাহলে যাচ্ছি আর তুই সিরাজগঞ্জ পৌঁছে আমাকে কল করবি।'


  'রোদেলা কোথায়?'
উমাইয়ার প্রশ্নে জুবিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
  'বাজারে গেছে।'
  'একা?'
  'হুহ।'
  'তোর মাথায় কি কোন বুদ্ধি নেই? রোদেলা এখানে কিছু চিনে? একা যেতে দিলি কেন যদি হারিয়ে যায়।'
জুবিয়া কড়া গলায় বলল,
  'হারাবে না। আমি দুই দিনে সব চিনিয়ে দিয়েছি।'

উমাইয়া জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ড্রয়িংরুমে এলো। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। সাদাফ স্মিথ হেসে বলল,
  'সময় হবে?'
উমাইয়া হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাল। জুবিয়া আসছে কিনা দেখে বাহিরে এলো। দরজা বাইরে থেকে হালকা চাপ দিয়ে বলল,
  'কিছু বলবেন?'
সাদাফ হঠাৎ তর্জনী আর মাঝের আঙুল দিয়ে কপাল চুলকে জিজ্ঞেস করল,
  'আপনি কি ভেবেছেন?'
  'কি?'
  'আমাকে কবে বিয়ে করবেন?'
উমাইয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে অস্ফুট স্বরে বলল,
  'একদিনে ভাবা যায়?'
  'আরো সময় লাগবে? ঠিক আছে আপনি যত সম চান তত সময় নিন কিন্তু এক ঘণ্টার বেশি না।'
সাদাফ তার ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। উমাইয়া হতভম্ব দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল, 
  'এক ঘণ্টার বেশি না?'
হঠাৎ জুবিয়া ডাক দিল,
  'উমা আমার হলুদ টপসটা পাচ্ছি না।'

উমাইয়া একটা অস্বস্তিকর নিঃশ্বাস ফেলে ঘরে এলো। জুবিয়ার হলুদ রঙের টপটি আলমারির অনেক কাপড়ের মধ্যে থেকে বের করে বিছানার উপর রাখে। জুবিয়া পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ উমা জিজ্ঞেস করল,
  'কোথাও যাচ্ছি?'
  'হ্যাঁ।' 
  'কোথায়?'
  'তোর কথা শুনে আমি টেনশনে পড়ে গেছি। রোদেলা সেই কখন জোজোর জন্য খাবার কিনতে গেল। এখনো আসছে না আমি গিয়ে দেখে আসি।'
উমাইয়া বিছানায় বসল। তারপর শুধল,
  'তোর কাছে টাকা আছে?'
  'হ্যাঁ। যাবার জন্য যথেষ্ট আছে।'

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দু-এক মিনিট অপেক্ষা করলেই রিকশা পাওয়া যায়। জুবিয়া রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। কালো জামা, কালো জুতো, কালো চশমা পরা পাঁচজন লোক একই রকম পোশাক পরে একটু দূরে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। জুবিয়া ভ্রুকুটি করল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
  'তাদের তো আগে দেখনি আজ হঠাৎ আমাদের বাড়ির সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন? পোশাকের ধরণ দেখে মাফিয়া মনে হচ্ছে।'

জুবিয়া আর ভাবতে চাচ্ছে না তাই চোখ চোখ করল। পেছন থেকে হঠাৎ পুরুষের আওয়াজ শুনে চোখ খুললো জুবিয়া। তারপর পেছনে ঘুরে তাকাল। তূর্ণ জুবিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল,
  'মিস. চিড়িয়াখানা।'
জুবিয়া ভ্রু কুঁচকে ফেলল। প্রতিবাদ করে বলল,
  'চিড়িয়াখানা কে? কাকে এভাবে ডাকছেন?'
তূর্ণ সরল গলায় বলল,
  'যে উত্তর দিল তাকে।'
জুবিয়া তূর্ণর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 
  'আমি চিড়িয়াখানার পশুর মতো দেখতে?'
তূর্ণ আনন্দে সশব্দে হাসল,
  'আমি চিড়িয়াখানার প্রাণী বলিনি। আমি বললাম চিড়িয়াখানা। কারণ তুমি চলাফেরা করা চিড়িয়াখানা।'
কর্কশ গলায় বলল জুবিয়া,
  'আমি চিড়িয়াখানায়?'

তূর্ণ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল, 
  'তোমার নামে চিড়িয়াখানা আছে। জুবিয়ার, জু। আর জু অর্থ চিড়িয়াখানা অর্থাৎ তুমি তাই।'
জুবিয়া হতবাক। তার সাথে এমন ফালতু রসিকতা এর আগে কেউ করেনি। জুবিয়া কিছু বলার আগেই তূর্ণ একটা গাড়িতে উঠে গেল। জুবিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে এক রিকশাওয়ালাকে ডাকল। রাগমিশ্রিত গলায় বলল,
  'এই মামা যাবেন?'
  'কোথায় যাইবেন?'
  'বাজারে যাবো।'
  'হো যামু। ভাড়া কিন্তু বিশ টাকা।'
খুব রাগী গলায় বলল জুবিয়া,
  'আমি প্রতিদিন দশ টাকায় যাই। আজ বিশ টাকা কেন?'
  'দশ টাকা বাড়ছে।'
  'দশ টাকায় যাবেন?'
  'না।'
  'আপনি যেতে পারেন।'
উমাইয়া উচ্চকণ্ঠে বলল,
  'দশ টাকার জন্য রিকশাওয়ালার সঙ্গে তর্ক করছিস কেন?'

উমাইয়া বাড়িতে একা থাকতে চাচ্ছে না। প্রতি পাঁচ মিনিট পর সাদাফ এসে জিজ্ঞেস করছে, সে বিয়ে নিয়ে কী ভাবছে? সাদাফের মুখোমুখি হতে চায় না বলে উমাইয়া জুবিয়ার সাথে বাহিরে যাবে। জুবিয়া ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল। কিঞ্চিত কর্কশ গলায় বলল,
  'দশ টাকার ভাড়া বিশ টাকা চাচ্ছে। তারা কি পেয়েছে? আমরা কি এখানে নতুন?'
উমাইয়া বলল, 
  'হয়ে গেল এখন থাম।'

ফুটপাতে একটা দোকানের সামনে হঠাৎ থেমে গেল জুবিয়া আর উমাইয়া। মেয়েদের হাতব্যাগের দোকান। খুব সুন্দর ডিজাইনের ব্যাগ ঝুলানো আছে। জুবিয়া এগিয়ে গেল। একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল। উমাইয়া দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল,
  'এই ব্যাগের দাম কত?'
দোকানদার বলল,
  'এক হাজার টাকা আপা।'
জুবিয়া লোকটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। অস্ফুটস্বরে বলল,
  'আপনি কি মজা করছেন এই ব্যাগের দাম এক হাজার টাকা? এক দাম বলুন।'

দোকানদার বলল,
  'আপা, এই ব্যাগটা বাজারে নতুন আসছে। আগের সব বিক্রি হয়ে গেছে। একটাই আছে, আপনার জন্য একশো টাকা কম রাখতে পারব।'
উমাইয়া দৃঢ় গলায় বলল,
  'একদাম দেড়শ।'
দোকানদার বলল,
  'আপা, দেড়শ টাকা কম হয়ে যায়। আপনি আটশো টাকা দেন।'
গম্ভীর গলায় বলল জুবিয়া,
  'দেড়শো টাকা দিলে দেন, না দিলে চলে যাই?'
দোকানদার জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
  'আচ্ছা নেন।'

তূর্ণ হঠাৎ গাড়ির ভেতরে কাশতে শুরু করে। ড্রাইভার তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল। সাদাফ চোখ ছোটো-ছোটো করে তূর্ণর দিকে তাকাল। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে তেমন ভিড় নেই। গাড়িতে বসে তূর্ণ, সাদাফের দিকে তাকাল, একা বসে জুবিয়ার আর উমার কথা স্পষ্ট শুনতে পেল ওরা। তূর্ণ নিজের শ্রবণ কেন্দ্রকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সাদাফ তূর্ণকে জানিয়েছে সে উমাকে পছন্দ করে। তূর্ণর কাশি বন্ধ হলো। সে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
  'ওখানে কী হচ্ছে? তারা কি সত্যিই দেড়শ টাকার জন্য দোকানদারের সাথে ঝগড়া করছে?' কথাটি বলে তূর্ণ কিছুক্ষণ থামল। তারপর আবার বলল,
  'একটা ছোট ব্যাগের জন্য কীভাবে ঝগড়াটাই না করল? আমাকে বলুক, আমি পুরো শপিং মল কিনে দেব।'

সাদাফ স্মিথ হাসল। কোমল কণ্ঠে বলল,
  'তারা সাধারণ মানুষ তূর্ণ। দেড়শ টাকা তাদের জন্য অনেক।'
তূর্ণ ফিসফিস করে বলল,
  'যাবি?'
সাদাফ হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
  'কোথায়?'
সাদাফের কানে ফিসফিস করে বলল তূর্ণ,
  'শোন, একটা প্ল্যান আছে। যদি এই প্ল্যান কাজ করলে তুই উমাইয়ার সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারবি।'
  'প্ল্যান কী?'
তূর্ণ বলল,
  'তুই তাকে একটা শান্ত জায়গায় নিয়ে যেতে পারিস যেখানে মানুষের কোলাহল নেই।'
সাদাফ বলল,
  'উমা রাজি হবে না।'
  'আমি কথা বলি?'
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন