তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ০৯ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


আমরা রিসোর্টে পৌঁছলাম যখন, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। আমি ঘুরতে যাওয়া বলতে বুঝতাম শুধু কক্সবাজার যাওয়াকে। বাবা মায়ের সঙ্গে ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম সেখানে। সাগরে বড় বড় স্রোত আছে, এর বেশী আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। এইযে ঢাকা শহরের কাছেই এমন চমৎকার একটা ঘুরতে যাওয়ার জায়গা আছে, এটাও তো আমার অজানা। আমি বিস্ময়ে চুপ করে আছি। 

আমার বিস্মিত চোখ দুটো রৈনীলের নজর এড়ালো না। সে এসে বলল, 'মিস বিজয় সরণী, এই নিন আপনার ওয়েলকাম ড্রিংকস।'

ঘাড় ঘুরে তাকিয়ে দেখি তার হাতে জুসের গ্লাস। আমার দিকে এগিয়ে ধরে রেখেছে। আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিলাম না এটা কী জন্য! পরে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আমি ছাড়া সকলেই জুস খাচ্ছে। বিভ্রম কাটতেই আমি গ্লাস হাতে নিয়ে রৈনীলকে ধন্যবাদ জানালাম। 

রৈনীলকে প্রথমদিন দেখে যতটা গম্ভীর, ভাবুক আর বয়সী বলে মনে হয়েছিল, আজ তেমন লাগছে না। সে সপ্রতিভ, চনমনে, হেসে হেসে সকলের সাথে কথা বলছে। আবার আমার সঙ্গে দুষ্টুমিও করছে। আমি বুঝতে পারছি না কোনটা তার আসল রূপ। সেদিন যা দেখেছি তা, নাকি আজ যা দেখছি সেটা?

জুসটা অসম্ভব মজার। খাওয়ার পর আমার আরো এক গ্লাস খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু এসব ইচ্ছের কথা তো বলা শোভা পায় না। আমি মনেমনে ভেবে রাখলাম, একটু সুযোগ পেলেই ওদের কাছে জুস কিনে খাবো। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা এক গ্লাস জুস খেলেই প্রাণটা কেমন জুড়িয়ে যায়!

স্বাগতা আপুরা রিসেপশনে কথা বলা শেষে রুমের দিকে চললো। আজকের জন্য আমাদেরকে নাকি দুইটা রুমও দেয়া হয়েছে। সারাদিন আমরা ওই রুমে বিশ্রাম নিতে পারবো। এখন সবাই মিলে যাচ্ছে ফ্রেশ হতে। তারপর বের হয়ে যে যার মতো ঘুরবে বা আড্ডা দেবে। আমি প্রতিমুহূর্তে নতুন করে উত্তেজনায় ভাসছি। আমার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা নতুন, একেবারেই নতুন। 

রুমটা আমার দারুণ পছন্দ হলো। আমাদের বাড়ির বিশাল ফ্ল্যাটে বাহারী ইন্টেরিয়র ডিজাইন করে বানানো রুমের চাইতে এই অল্প ডিজাইনে করা নান্দনিক রুমটাই আমার কাছে বেশী স্বস্তিদায়ক মনে হচ্ছে। আমাদের মেয়েদের জন্য আলাদা একটা রুম আর ছেলেদের জন্য একটা রুম। বড়রা ফ্রেশ হতে গেলে আমি জানালার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। 

আপু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, 'আহ আরাম! ভাবছি এমন একটা ম্যাট্রেস বানিয়ে ফেলবো বাসার জন্য। ভালো হবে না?'

আমি এসে বিছানায় বসলাম। কয়েক ইঞ্চি দেবে গেল ম্যাট্রেসটা। নরম তুলতুলে। যেন আরামের বাক্স। আমিও শুয়ে পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। শুয়ে এদিক সেদিক গড়াগড়ি খেয়ে খিলখিল করে হাসছি। 

স্বাগতা আপু বলল, 'তোকে খুব সুন্দর লাগছে রে। আজকে সায়েম থাকলে তো বিপদে পড়তি।'
'ছি, ওনার কথা বোলো না।'
'ও জানলেই কিন্তু তোকে দেখতে আসবে।'
'এখানে!' আমি বিস্ফারিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।
'আরে না। আমার বাসায়।'
'থাক। বলার দরকার নেই। আমি আমার মতো আনন্দে আছি। উনি বড্ড বেশি বিব্রতকর আমার জন্য।'
'ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি আর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি।' 

আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আপু কফি হাতে বসে আছে। আমাকে বলল, 'এটা খা। আমি এখন শুয়ে থাকবো। তুই কি বাইরে যাবি?'

আমি কি করবো তা তো জানিনা। তাই চুপ করে চেয়ে রইলাম আপুর দিকে। আপু বলল, 'বাইরে গেলে যাস। ঘুরে আয় ভালো লাগবে। আমি একটু আরাম করে তারপর উঠবো। রুমে বা আশেপাশেই থাকবো। তুই আমার ফোনটা নিয়ে বের হোস। তাহলে দরকার হলে কল দিতে পারবি। পাসওয়ার্ড জানা আছে?'

আমার মনে ততক্ষণে আনন্দের খই ফুটছে। এই আনন্দের চাপে কিছু বলতেই পারছি না। শুধু দুদিকে ঘাড় নাড়লাম। আপু ফোনের স্ক্রিনে দেখিয়ে দিয়ে বলল, 'এইযে এটা পাসওয়ার্ড। দেখ। মনে থাকবে?'
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, 'হুম। থাকবে।'
'আমার মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, গ্যালারি কোথাও ঢুকবি না। আমি প্রাইভেসি পছন্দ করি। শুধু ফোনকলের জন্য ইউজ করবি। আর সেলফি তুলতে চাইলে তুলবি।'
'আচ্ছা আপু। আমিও প্রাইভেসি মেইনটেইন করি। কারো ফোন, ডায়েরি এসব কখনো চেক করিনা আমি।'
আপু আমার গাল টেনে দিয়ে বললো, 'তুই তো গুড গার্ল।'

আমি ফোনটা হাতে নিয়ে বের হয়ে এলাম। বারান্দার চেয়ার দুটোতে বসার লোভ হচ্ছিল। তবে রুমের বারান্দা ই তো, পরেও বসা যাবে। এই ভেবে হাঁটতে হাঁটতে রুম থেকে সরে এলাম।  

সামনে প্রশস্ত সবুজ মাঠ। জুতা খুলে কয়েক পা হাঁটলাম। এদিকে আমার ঘাসের ওপর বসে থাকার লোভ হচ্ছে। জুতার ওপর বসে সবুজ ঘাসের ওপর হাত বুলাচ্ছি। এখানে তেমন রোদ নেই। গাছের ছায়া আছে বেশ। হঠাৎ খেয়াল করলাম দূরে দাঁড়িয়ে রৈনীল হাত নাড়ছে। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, 'আসবো?'
আমি মাথা নেড়ে বোঝালাম, 'না।' 
রৈনীল হাতের ইশারায় বলল, 'ওকে।'

সবসময় কারো সঙ্গে থাকতে ভালো লাগে না। কিছু সময় একান্তই নিজের মতো কাটাতে ভালো লাগে। এইযে সবুজ ঘাস, লতাপাতায় ঘেরা একটা জায়গা, যেদিকে চোখ যাচ্ছে, শুধু সবুজ আর সবুজ। এত শান্তি তো কোথাও পাইনি আমি। এত স্বাধীনতাও! 

আজ এখানে আমার ভুল ধরার জন্য কেউ বসে নেই। শাসন করবার কেউ নেই, রাগ দেখানোর কেউ নেই। কোথাও দুই পা বাড়াতে হলে কারো বারণ নেই। যতক্ষণ ইচ্ছে নিজের মতো হাঁটো, যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকো খোলা প্রান্তরে। এইটুকু স্বাধীনতাই তো চেয়েছি জীবনে! 

খানিকক্ষণ বসে থাকার পর দেখি দূরের সুইমিংপুলে অনেকজন মিলে লাফালাফি করছে। সবার আনন্দই চোখে পড়ার মতো। বাচ্চারাও যোগ দিয়েছে সঙ্গে। শুনেছি পুলে আমরাও নামবো। বাসা থেকে জামাকাপড় নিয়ে এসেছি সঙ্গে করে। আমার অবশ্য এত মানুষের সামনে হৈ হুল্লোড় করতে লজ্জাই লাগবে। তবে ওই নীল পানিতে শুয়ে থাকার লোভ সামলাতে পারছি না। আশেপাশে কেউ নেই। অগত্যা উঠে রুমেই চলে এলাম। 

সবাই আড্ডা দিচ্ছে। কেউ বিছানায় শোয়া, কেউবা বসা, আবার কেউ সোফায়। হাসাহাসি হচ্ছে তুমুল। আমি রুমে প্রবেশ করতেই ভাইয়া বলল, 'মহারাণী এলেন। কেমন লাগছে এখানে এসে?'
'অসাধারণ জায়গা। খুব ভালো লাগছে। আমরা পুলে নামবো কখন?'
'একটু পরে। দুপুরের রোদের সময় ঠাণ্ডা পানিতে নামলে মজা হবে।'
'ঠিক আছে।'

আমি বিছানার এক কোণে এসে বসলাম। ওদের গল্পগুজব জমে উঠেছে। হয়তো শেষও হয়ে গেছে এরমধ্যে। খানিক্ষণ পরেই স্বাগতা আপু বলল, 'আমি বের হচ্ছি। সরণী চল।'

আপুর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে ঘুরে দেখলাম। জুবায়ের ভাইয়া ওনার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বসে সিগারেট ফুঁকছে আর আড্ডা দিচ্ছে। আমরা দুই বোন নিজেরাও বেশ মজা করলাম। আমি নতুন করে প্রেমে পড়েছি এই শান্ত প্রকৃতির। এর আগে আমার কখনো এত সবুজের ভেতর যাওয়া হয়নি। কী সুন্দর সবকিছু! কী সুন্দর।

জুবায়ের ভাইয়ার ডাকে স্বাগতা আপু চলে গেল সেদিকে। আমি একটা বেঞ্চিতে বসে রইলাম একা। আশেপাশে ঝলমলে রোদ। কিন্তু আমার মাথার ওপর রোদ নেই, আছে গাছের ছায়া। হঠাৎ পাশ ফিরে দেখি রৈনীল দাঁড়িয়ে। কখন এসেছে খেয়াল করেনি। বলল, 'গন্ধরাজ ফুল দেখবে বলেছিলে না? তোমার জন্য এখানে একটা গন্ধরাজ ফুটেছে।'
'এই সময়ে! এখন তো ওর সিজন নয়।'
'কিছু গন্ধরাজ বারো মাসে হয়। ওদের রান্নাঘরের দিকে পেলাম এটা।'

রৈনীল একটা সাদা ধবধবে ফুল এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি বিস্মিত চোখে ফুলটা হাতে নিলাম। শুভ্র পাপড়ি, সবুজ ডাটা, দুটো পাতাও রয়েছে সঙ্গে। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম আমি। 
রৈনীল বললো, 'ফুলের ঘ্রাণ নাও। দেখ কি সুন্দর।'

আমি নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিলাম। রীতিমতো আমার অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেলো সেই ঘ্রাণ। এত শান্তিময়, এত স্নিগ্ধতায় ভরপুর সেই ঘ্রাণ! 
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp