প্রেমান্বেষা - পর্ব ০২ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


স্মরণ ও সাদ অনেকক্ষণ যাবত বাড়ির প্রধান দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্তও কেউ দরজা খোলেনি। স্মরণ অকপট ক্রোধ নিয়ে বললো,
" আজ না কদরের রাত! আজ ঘুমাচ্ছে কেনো সবাই? কেউই দরজা খুলছে না! আশ্চর্য! সাদ, আম্মুকে কল কর। আমার ফোনে চার্জ নেই।"

সাদ এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলো, মা'কে কল করবে কি না। স্মরণ ফোন করতে বলায় এবার সে পকেট থেকে ফোন বের করলো। কিন্তু কল করার আগেই তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো লোহার প্রধান দরজার উপর। এখান থেকে চাইলে সহজেই ডিঙিয়ে ভেতরে ঢোকা যাবে। তার পাজি মস্তিষ্কে এই বুদ্ধি এসেই ধরা দিলো। সে চুপিচুপি পকেটে ফোন ঢোকালো। স্মরণের দিকে চেয়ে দু পাটি দাঁত বের করে ভ্রু নাচালো। তার এ উদ্ভট মুখভঙ্গিমা দেখা মাত্রই স্মরণ হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
" আবার কি শয়তানি বুদ্ধি চাপলো আপনার মাথায়?"

সাদের হাসি বিস্তৃত হলো। দুষ্টু চাহনিতে দরজার উপরের দিকে তাকালো। বললো,
" দেখছো ভাইয়া? "

স্মরণ সাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকালো। তাদের বাড়ির লোহার এ দরজার উচ্চতা প্রায় সাত ফুটের কাছাকাছি। একটু চেষ্টা করলে যে কেউই এর উপর দিয়ে বাড়ির ভেতর চলে যেতে পারবে। স্মরণ এবার ভ্রু তুলে সন্দিহান চাহনিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" তুই কি বলতে চাচ্ছিস,দরজা ডিঙিয়ে বাড়িতে ঢুকবি? "

সাদের দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দেখা মিললো। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
" হ্যাঁ হ্যাঁ! যেহেতু দরজা খুলছে না। এর মানে সবাই ঘুম। চলো, এভাবে গিয়ে সারপ্রাইজ দেই।"

স্মরণ সরু দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
" সবাই জানে আমরা আসবো আজকে। সো এখানে সারপ্রাইজের কোনো মানে নেই।"

" সবাই জানে আমরা আসবো। কিন্তু আমরা যে চলে এসেছি তা তো আর জানে না। চলো ভাইয়া। একটুখানি এডভেঞ্চার হয়ে যাক।"

স্মরণ ঠোঁট উল্টে বললো,
" এই গেট ডিঙানোকে এডভেঞ্চার বলিস! ছোট মস্তিষ্ক ছোট চিন্তা। হাহ"
বলেই স্মরণ ব্যাগ রেখে এক লাফে লোহার দরজার পাশের পিলারে পা দিলো। তার এ আকস্মিক কাজে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থ বনে গেলো সাদ। 
সাদ জানে সে ভীষণ দুষ্টু। কিন্তু সে এ-ও জানে তার তুলনায় দ্বিগুণ দুষ্টু স্মরণ। শুধু মাঝে মাঝ একটু বড় হওয়ার চেষ্টা করে সে। তবে সুযোগ পেলে দুষ্টু বুদ্ধিতে কোনো ছাড় নেই তার। আজ আবারও সে প্রমাণ দিলো স্মরণ।

এদিকে নীলিমা ও রাফি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরের উঠোনে এসে পড়েছে। নীলিমার হাতে মাঝারী সাইজের সেই বাঁশটা৷ আর রাফির হাতে মোবাইল। দুজনের দু জোড়া পা চুপিসারে এগিয়ে যাচ্ছে। ভেতরটা টানটান উত্তেজনায় পূর্ণ। তবে নীলিমার ভয় হচ্ছে ভীষণ। যতই এগুচ্ছে ততই ভয় বাড়ছে। এ পর্যায়ে মনে হলো বাড়ির বড় কাউকে সাথে না এনে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। এদিকে রাফির মাঝে কাজ করছে চাপা উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা। আজ সরাসরি ডাকাত চোখে দেখবে সে। এতদিন শুধু বইপত্রে শব্দটা পড়ে এসেছিলো। আর আজ সচক্ষে দেখবে। কি দারুণ এক সুযোগ!

নীলিমা ও রাফি দরজার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। এমন সময় তাদের দৃষ্টি আটকালো দরজার নিচের অংশে। দূরে কোথাও থেকে আবছা আলোয় দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে দু জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। সাথে একটা লাগেজ ব্যাগও। রাফি ব্যাগ দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো। ফিসফিস করে নীলিমাকে জিজ্ঞেস করলো,
" ডাকাত লাগেজ নিয়েও চলাফেরা করে!"

নীলিমা চট করে তাকালো। বাড়ির বাইরের হলদে লাইটের আলোয় তার ক্রোধান্বিত চাহনির সাক্ষী হলো রাফি। দ্বিতীয় কথা না বলে চুপসে গেলো। নীলিমার পাশাপাশি এগিয়ে যেতে লাগলো। এরই মধ্যে তাদের অবাক করে কথিত ডাকাত দরজার পিলারে এক পা রাখলো ও অপর পা লোহার দরজায় ঠেকালো। দরজায় পা ঠেকানোর শব্দ কানে এলো দুজনেরই। ব্যস, এই কাজেই ভয় পেয়ে গেলো রাফি। কিসের ভাইয়ের দায়িত্ব, কিসের ডাকাত শিকার। ফোন নিয়ে 'ডাকাত' বলে এক চিৎকারে সে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলো নীলিমা। ওদিকে বাড়িতে ঢুকেই আতঙ্কে উচ্চস্বরে 'ডাকাত, ডাকাত' বলে চিৎকার করতে লাগলো। 

স্মরণ মাত্রই দ্বিতীয় পা-টা দরজায় ঠেকিয়েছে। ওমনিই ভেতর থেকে উচ্চ আওয়াজ তার কানে বাড়ি খেলো। কেউ 'ডাকাত' বলে চিৎকার করছে।।অবাক হলো স্মরণ, অবাক হলো সাদও। স্মরণ দ্রুত দরজা ডিঙিয়ে এক লাফে উঠোনে নেমে এলো। 
মাটিতে পা দেয়ার পরমুহূর্তেই তার সাক্ষাৎ হলো এক যুবতীর সাথে। মেয়েটির ঠিক বিপরীতে আলোর উৎস থাকায় স্মরণ চেহারা চিনতে পেলো না। কিন্তু তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি ঠিকই তাকে চিনতে পেলো। 

স্মরণকে এভাবে আচমকা সামনে দেখে ভয়ে অন্তঃসারশূন্য হয়ে এলো নীলিমার । অকস্মাৎ 'ডাকাত' বলে চিৎকার দেয়ার পূর্বেই সে স্মরণকে চিনে ফেললো। ভাগ্যক্রমে চিনে ফেলেছিলো বলে। নচেৎ হাতে থাকা বাঁশটা দিয়ে হয়তো দু চার ঘা দিয়েই ফেলতো!

রাফি বাড়ির ভেতরে গিয়ে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করছে। তার এ চিৎকারে বাড়িতে উপস্থিত সকল সদস্যের আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেলো। সর্বপ্রথম নিজের রুমে নির্ঘুম পায়চারী করা বাহাদুর শেখ লাঠি ভর দিয়ে বেরিয়ে এলেন। তার সাথে বেরিয়ে এলেন আসমানী বেগমও। এরপর একে একে সকলেই বেরিয়ে এলো নিজ নিজ রুম থেকে।

বাহাদুর শেখ ও আসমানী বেগমের চার সন্তান। বড় দুই ছেলে, অতঃপর দুটো মেয়ে। বড় ছেলের নাম আনিস শেখ, তার স্ত্রী নাজমা বেগম। তাদের দু ছেলের নাম যথাক্রমে স্মরণ ও সাদ। ছোট ছেলের নাম আনোয়ার শেখ, স্ত্রী মাসুদা বেগম। তাদের বড় ছেলের নাম মাহবুব, যে কি না স্মরণের সমবয়সী। এবং মেয়ের নাম মানতাসা, যার বিয়ে উপলক্ষে সকলে এসেছে এ বাড়িতে।
বাহাদুর শেখের বড় মেয়ের নাম মিলি, স্বামী ইমাদ হোসেন। বড় মেয়ে নওরীন, যে তার স্বামী সাজিদের সাথে ঢাকা থাকে ও ছোট মেয়ে নীলিমা, যে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত। 
বাহাদুর শেখের ছোট মেয়ের নাম লিলি, স্বামী ইয়াকুব সাহেব। তাদের প্রথম সন্তানের নাম রাফা, যে কি না নীলিমার বয়সী। এরপর ছোট দুই জমজ সন্তানের নাম যথাক্রমে রাফি ও পাখি।

রাফির চিৎকারে সকলে ঘুম জড়ানো চোখে বেরিয়ে এলো। আনিস সাহেব গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
" কি হয়েছে? এত চিৎকার করছিস কেনো?"

রাফি আতঙ্কিত গলায় বললো,
" মা-মামা মামা, ডাকাত আসছে ডাকাত।"

রাফির মুখে 'ডাকাত' শব্দটা শোনা মাত্রই সকলের চোখের ঘুম উড়ে গেলো। মুহূর্তেই সকলের চাহনিতে ভয় ও আতঙ্কের দেখা মিললো। পাশের গ্রামে ডাকাতি হওয়ার ঘটনা মনে পড়ায় আরোও ভীত হয়ে উঠলো সকলে। নীলিমার মা মিলি বেগম শঙ্কিত চাহনিতে নীলিমাকে খুঁজছেন। এতজনের মাঝেও যখন নীলিমাকে দেখলেন না, তখন দ্রুত এগিয়ে এসে ত্রস্ত গলায় রাফিকে জিজ্ঞেস করলেন,
" এ্যাই রাফি! নীলু কই? ওকে দেখি না কেনো!"

রাফি শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো,
" আপু ডাকাত মা' র' তে বের হয়েছে। আমি ভয়ে আপুকে ওখানেই রেখে এসেছি খালামনি।"

লিলি বেগমের মুখখানা মুহূর্তেই পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। মেয়ের মান ও প্রাণ নিয়ে তার মনে কু ডাক দিলো। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো সকলে। এমন মুহূর্তে বাহাদুরে শেখ হাতের লাঠি উঠিয়ে কম্পিত পায়ে দাঁড়িয়ে হুংকার ছাড়লেন,
" আমার নীলুরে বাঁচা। আমার নীলুর কিছু হইলে সব কটারে মা' ই' রা ফেলমু।"
বলেই লাঠি নামিয়ে তাতে ভর দিয়ে দূর্বল পায়ে তবে দৃঢ় চিত্তে ক্রোধ নিয়ে হাঁটা দিলেন।
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন