আশফিকের কথায় অপ্রস্তুত হলো রিশা।অনেকটা নমনীয় ভাব বোঝা যাচ্ছে অপরপ্রান্তের পুরুষটির।মুহূর্তে অনেক কিছু ভেবে ফেলল রিশা।তবে কি উত্তর দেবে ভাবতে থাকল।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
"আমরা একটা মানুষকে বাহির থেকে যতটুকু বুঝি, যেমন ভাবি হয়তো ভেতরটা ভিন্নও হতে পারে।আমি সেই ছোট রিশা নেই আশফিক ভাই।ভয় পাবার কোনো কিছুই না।হয়তো সেভাবে কথা বলার মতো সুযোগ হয়নি আপনার সঙ্গে।তাই এরকম মনে হয়েছে আপনার।
রিশার কথায় থমকে গেল আশফিক।এখনো রিশা তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে কিনা সেটুকু যাচাই করতেই ফোন করেছিল সে। মাঝে বহুদিন রিশার কোনোরকম উপস্থিতি ছিল না তার পোস্টে। আজকে হঠাৎই রিশার মন্তব্য দেখে ভেবেছিল মেয়েটা বুঝি মুভ অন করে নিয়েছে।এখন মনে হচ্ছে পরিস্থিতি আগের মতোই!ভেতরে এক দীর্ঘশ্বাস গুমোট হয়ে রইল আশফিকের।রিশার জন্য কোথাও একটা সুক্ষ্ম খারাপ লাগা কাজ করছে!অন্য কিছুর আবদার করলে হয়তো আশফিকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হতো!প্রিয় মানুষের একটুখানি অবহেলা কতখানি য'ন্ত্রণা দেয় সেটা আশফিকের চেয়ে ভাল কেউ জানে না।জেনিথ মেয়েটিকে এক দেখাতেই পছন্দ করে ফেলেছিল সে।কত কাঠখড় পুড়িয়েছে সুশ্রী ললনার মন জয় করতে!প্রতিটি মানুষের জীবনের গল্পই ভিন্ন হয়,যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সেই পরিস্থিতিতে উপনীত হই ততক্ষণ তা উপলব্ধি করতে পারি না।আশফিকের ভাবনার মাঝে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল।নীরবতা ভঙ্গ করে কথার প্রসঙ্গ পাল্টাল আশফিক।রিশার পড়াশোনা সম্পর্কে টুকিটাকি জিগ্যেস করে লাইন কেটে দিল।মনে হচ্ছে এভাবে মেয়েটাকে হুটহাট কল দিয়ে কষ্ট বাড়িয়ে দিয়ে কাজ নেই।আশফিক মনেপ্রাণে চায় রিশার জীবনে কেউ আসুক!ক্ষনিকের এই আবেকটুকু ভুলিয়ে দিয়ে,ভালবাসায় জীবন ভরিয়ে দিক!খাটের উপর ফোন ফেলে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিশা।হঠাৎই মনখারাপের দল তার চারিপাশ ঘিরে ধরল।কবে মুক্তি মিলবে এদের থেকে?
!!২৫!!
রাতের খাবারে রওনকের জন্য বেশ আয়োজন হয়েছিল।জামাই আদর কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে রওনক!পেট নয় যেন আস্ত একটা গোডাউন ভেবেছে তারা!ঠিকমতো নড়তে চড়তে পারছে না এখন।কুহু ইচ্ছে করে তার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছিল বেশি বেশি।সুযোগ পেলে টুক করে মুখেও পুরে দিচ্ছিল খাবার!সবই যে রওনককে হেনস্তা করার জন্য করেছে, বুঝতে বাকি নেই রওনকের।শাড়ির আঁচল কোমড়ে বেঁধে নিয়ে বিছানা গোছাচ্ছে কুহু।আড় চোখে রওনকের বিরক্তমাখা চেহারাটা উপভোগ করছে।ঠোঁট চেপে হাসছে খানিক।খাট থেকে নেমে দাঁড়াল কুহু। গুঁজে রাখা শাড়ির আঁচল ঠিক করে বলল,
"এই তো রেডি।এবার জলহস্তির মতো শরীরটা নিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ুন তো।
কুহুর কথার বিস্মিত দৃষ্টি ফেলে তাকাল রওনক।
"কোনদিক থেকে জলহস্তি মনে হয় আমাকে?
" জলহস্তি না হলে এতগুলো খাবার কোনো মানুষ খেতে পারে বলুন?
কথার পৃষ্ঠে জবাব তৈরি কুহুর।রাগ হলো রওনক।সবাই মিলে জোরজবরদস্তি করে খাইয়ে এখন জলহস্তির তকমা দেওয়া হচ্ছে তাকে!এই কুহুটা খুব বিচ্ছু!আপাতত ঝগড়া করার মতো অবস্থায় নেই রওনক।খানিক্ষন হাঁটাহাঁটি করল সে।খাটের উপর দৃষ্টি পরতেই কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল,
"তোমার এইটুকু সিঙ্গেল খাটে দুজন ঘুমাব কি করে?
ছোট একটা ওয়ারড্রব থেকে জামা বের করছিল কুহু।রওনকের কথায় তড়াৎ করে দৃষ্টি ফেলল।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
" আপনি একা ঘুমাবেন।আমি চলে যাব মায়ের রুমে।
"চলে যাবে মানে?আমার কোনোকিছু দরকার পরলে কাকে বলব?
"জগ ভর্তি পানি রেখে যাব আমি।আর রুম থেকে বের হলে বাম দিকে একটু গেলেই ওয়াশরুম পাবেন।আশা করি আমার আর প্রয়োজন নেই এখানে।
কথাটুকু বলেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল কুহু।আঁচলে টান পরতেই চলন্ত পা দু'টো থেমে গেল।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবার সাহস পেল না।রওনক ভাই যে শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছে এতে সন্দেহ নেই!কেমন অসস্থিতে পড়ে গেল।ততক্ষণে কুহুর শাড়ির আঁচল ধরে একেবারে কাছাকাছি চলে আসল রওনক।খানিকটা নিচু হয়ে কুহুর কানে পাশে ভরাট স্বরে ফিসফিস করে বলল,
" তুমি আমার নব বিবাহিতা স্ত্রী!এই মুহূর্তে তোমাকেই তো আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন!কি ভেবেছ পালিয়ে যাবে?খাট ছোট তাতে কি হয়েছে?দরকার হয় বুকে নিয়ে সারারাত ঘুমাব !
উষ্ণ নিশ্বাস কান ছুঁতেই মৃদু কেঁপে উঠছিল কুহু।কথা শেষে শব্দ করে হাসল রওনক।ঘুরে দাঁড়িয়ে রওনকের ঠিক চোখ বরাবর দৃষ্টি রাখল কুহু।হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে সাদা টিশার্ট পরা লম্বাটে গড়নের বলিষ্ঠ দেহি এক পুরুষ।
"ভালবাসা ছাড়া কোনো সম্পর্ক হয় না রওনক ভাই।করুণায় তো আর একটা সংসার সারাজীবন টেকে না!আমাদের এই অস্বাভাবিক বিয়ের পরিণতি নিয়ে ভয় হয় আমার।এত বাঁধার মধ্যে দিয়ে ভাল কিছু কি করে আশা করা যায়?এই বিয়েতে কি আপনি মন থেকে রাজি ছিলেন না আমি ছিলাম?হতে পারে আমি আপনার স্ত্রী।অধিকার সম্পূর্ণ রাখেন আপনি।কিন্তু আপনাকে মানতে আমার সময় লাগবে রওনক ভাই।
কথাটুকু বলেই কুহু বেরিয়ে গেল।রওনক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে।শুধুমাত্র এই ভয়টার জন্য কুহুকে সে কোনোদিন মনের কথা জানাতে পারেনি।অনুভূতিটুকু নীরবেই লালিত করে গেছে বক্ষপিঞ্জিরায়!এই মুহূর্তে কুহুর সঙ্গে নমনীয় আচরণ করায় হয়তো মেয়েটা ভাবছে কেবল নিজের পৌরুষ চাহিদার জন্য কাছ ঘেঁষছে রওনক!এরুপটা হতে থাকলে তো ভালবাসার জায়গায় উল্টো ঘৃণা জন্ম নিবে!চলুক এই বৈবাহিক সম্পর্ক তার দ্বারা মোতাবেক।কুহুর ভালবাসার জন্য আমৃত্যু অপেক্ষায় থাকবে রওনক!কৌশলে কুহুকে নিজের করে নিয়েছে। ও চোখে তাকিয়েও সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে অনায়াসে!দু-কদম হেঁটে কুহুর ছোট বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল রওনক।আকাশে আজ মস্তবড়ো একটা চাঁদ উঠেছে!অগণিত নক্ষত্রের ছড়াছড়ি!মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।কপালে পরে থাকা চুলগুলো দুলছে রওনকের।আচমকা কোণায় দৃষ্টি থমকাল।লাল রঙা একটা গোলাপ গাছেই শুকিয়ে আছে!এগিয়ে গিয়ে তাতে আঙ্গুল বুলাল রওনক।তার কুহুর প্রিয় ফুল!মনেপ্রাণে চাইল কুহুর ভেতরে থাকা রাগ,ভুল এই ফুলটার মতোই শুকিয়ে ঝরে যাক!সেখানে ভালবাসার জন্ম হয়ে ফুটুক নব্য গোলাপ!
•
শাড়ি পাল্টে কলাপাতা রঙা সুতির থ্রিপিস পরে ওয়াশ রুম থেকে বের হলো কুহু।বারংবার তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে অজানা কারণে।সেই ছোট বেলা রওনক ভাইয়ের আচরণে মনে হতো খুব রাগী সে!কুহুকে সহ্য করতে পারে না।যখন বড়ো হলো অনেক কিছু বুঝতে শিখলো,তখন মনে হতো রওনক ভাই তাকে পছন্দ করে হয়তো বা!এক সময় সেটাও ভুল প্রমাণিত হলো।প্রিয় কারো সঙ্গে বাজে আচরণ কেউ করে নাকি?তবে রওনক ভাই মন্দ আচরণ করলে সেদিন বাড়ি ফিরে কুহুর ঘুম হতো না সারারাত!অন্যরকম এক কষ্ট অনুভব হতো!প্রায়শই রওনক ভাইয়ের এরকম রাগ রাগ আচরণ একপ্রকার হেঁসে আর উদ্ভট কথায় উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।আর পন নিয়েছিল যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখবে।সেই কিনা জনমভর বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে গেল!বিয়েটা করতে চায়নি কুহু!তবে কেন জানি বাঁধাও দিতে পারেনি।মন সবকিছু মেনে বসেছিল!পরিস্থিতিতেই হয়তো।যেমনটা পরিস্থিতির জন্য রওনক ভাই দয়া করল।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ মুছে মায়ের রুমের দিকে পা বাড়াল কুহু।
"কোথায় যাচ্ছ কুহু?
ভাবীর ডাকে চমকে তাকাল কুহু!তোহার হাতে পানির বোতল।কেমন সন্দিহান চাহনি।হাসার চেষ্টা করে বলল কুহু,
" মায়ের ঘরে যাচ্ছি ভাবী।
"মাকে তো ঘুমের মেডিসিন দিয়েছি অনেক্ষণ আগেই।ঘুমিয়ে গেছে।কিছু বলবে?
কুহু একটু অপ্রস্তুত হলো।মায়ের ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছে শুনলে এখন ভাবী তাকে একগাদা জ্ঞান দিবে।সেই রওনক ভাইয়ের কাছেই পাঠাবে।এগিয়ে এসে ভাবীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
" মা ঘুমিয়ে গেছে?কথা ছিল।আচ্ছা চলে যাচ্ছি তাহলে।
কথাটুকু বলে দেরি করল না কুহু।চলে আসলো নিজের কক্ষে।সারা রুম জুড়ে রওনকের দেখা নেই!খানিকটা ভয় পেয়ে গেল কুহু!রাগ চলে আবার চলে যায়নি তো লোকটা!বেলকনির কথা মনে হতেই ছুটলো সেদিকে।ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে দূরে আকাশে মত্ত রওনক!আবছা অন্ধকারে তার লম্বাটে অবয়বের দিকে কিছু পল তাকিয়ে রইল কুহু।রিনরিনে স্বরে শুধাল,
"ঘুমাননি এখনো?
ঘুরে তাকাল না রওনক।অম্বরে দৃষ্টি রেখেই বলল,
"আমরা সবসময় পরিস্থিতির স্বীকার হই ঠিক আছে।কিন্তু তার পেছনেও অনেক কারণ থাকে কুহু।হয়তো আমরা সেভাবে তার ব্যাখ্যা খুঁজি না।আমাদের বিয়ে নিয়ে যদি তোমার মনের ভীতি থাকে তাহলে বলব এটা নিছক তোমার মনের ভয়।হোক যেভাবে বিয়ে,সত্যি এটাই আমরা স্বামী-স্ত্রী।সম্পর্ক জোড় করে টিকিয়ে রাখার মতো কিছু নয়।বিয়ে হয়ে গেছেই বলে যে আমিও স্বাভাবিক সবটা মেনে নিয়েছি এমন নয়।সময় দুজনেরই প্রয়োজন।বাকি সম্পর্কের পরিণতি সময় বলবে।
রওনকের শক্ত কথাগুলো শুনে নীরব দাঁড়িয়ে রইল কুহু।কোথাও একটা যৌক্তিক মনে হলো সব।রওনক পাশ কাটিয়ে চলে গেল কুহুকে।একমুহূর্তের জন্য মনে হলো রওনক তাকে অবজ্ঞা করল!কুহুর মন থেকে অহেতুক সন্দেহ,ভয় দূর করতেই এটুকু কথা বলে গেল রওনক।মেয়েটা তাকে বুঝুক একটু একটু করে।ভালবাসতে শিখুক।তখন রওনকের অনুভূতির যথাযথ মূল্যায়ন করবে।সে অবধি অপেক্ষায় রওনক।ততদিন নীরবেই ভালবেসে যাবে।
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসল কুহু।দেওয়ালের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের পানে চাইল।ছোট্ট একটা তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো।এই পুরুষকে যে সে বুঝতেই পারে না!এক জনম কেটে গেলেও মনের হদিস করতে পারবে বলে মনে হয় না।কি লেখা আছে কুহুর এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের খাতায়?খুব যে ভাবায়!
!!২৬!!
আকাশে ঝলমলে রোদ্দুর।ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে রিশা।টুকিটাকি কেনাকাটা বাকি ছিল।মন খারাপের জন্য বের হওয়া হয়নি এতদিন।আজকেই বের হওয়ার জন্য উপযুক্ত দিন মনে হলো।কালকে প্রচন্ড মন খারাপ ছিল।আজ বের হয়ে মন ভাল করার একটুখানি চেষ্টা ছিল।হাতভর্তি ব্যাগ সমেত ছাতা সামলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে রীতিমতো।এই মুহূর্তে কোল্ডকফি খেলে মন্দ হতো না।তবে এই হাতভর্তি ব্যাগপত্র নিয়ে কোনোরকম রিকশা ডেকে বাড়ি চলে যাওয়াই শান্তি মনে হচ্ছে।বাসায় গিয়ে ঝটপট ঠান্ডা কিছু করে খেলেই হবে।কপাল চুইয়ে ঘাম পরছে রিশার।ভরদুপুরে খুব একটা রিকশার আনাগোনা নেই।বাম হাতের উল্টো পিঠে ঘাম মুছতে গিয়ে খসে পরল একটা শপিং ব্যাগ পিচঢালা রাস্তায়।সেটা নেওয়ার জন্য সবে উবু হলো রিশা।একজন পুরুষ এগিয়ে এসে ব্যাগটা তুলে নিল সযত্নে।চমকাল রিশা!ছেলেটি উঠে দাঁড়াতেই হতবাক হলো!চোয়াল ঝুলে গেল!এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি!তীব্র রোদে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা হাসিমুখে বলল,
"তুমি চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি আইরিশ!ব্যাগ গুলো সামলে নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তোমার।
·
·
·
চলবে............................................