" আমার জিলাপি!?"
স্মরণের বিস্ময়ে উচ্চারিত প্রশ্নে সকলে খেতে খেতে দৃষ্টি তুলে তাকালো। নীলিমা যেতে যেতে পিছন ফিরে স্মরণকে উদ্দেশ্য করে মিলি বেগমকে বললো,
" আম্মু, জিলাপি শেষ। প্যাকেট ফেলতে যাচ্ছি। "
মিলি বেগম নীলিমার কথা শোনা মাত্র স্মরণের দিকে চাইলো। পাশে রাফিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
" অত জিলাপি খেয়ে কি করবি রাফি! স্মরণকে দে।"
ভীষণ মিষ্টি পাগল রাফির মুখটা ক্ষণিকের মধ্যেই শুকিয়ে এলো। ভেবেছিলো আজ অতিরিক্ত জিলাপি খেয়ে মনে খানিক আনন্দৎসব করবে। কিন্তু এখন স্মরণকে আবার জিলাপি দিতে হবে! এ যে অসম্ভব! তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে! কিন্তু না দিলেও যে স্মরণ পরে গিয়ে উদোম কেলানি বসাবে! সব দিকেই বিপদ!
রাফি কাঁদো কাঁদো অসহায় চাহনিতে স্মরণের দিকে চাইলো, যার অর্থ আজকের জন্য বেচারা জিলাপি দুটোকে তার পেটে যেতে দেয়া হোক। কিন্তু স্মরণও মেনে নেয়ার পাত্র নয়। মিষ্টি যে তারও ভীষণ পছন্দের!
স্মরণ চোখ গরম করে রাফির দিকে চাইলো। তার নিশ্চুপ চোখের চাহনিই রাফি জিলাপিগুলো দিতে বাধ্য করলো। রাফি জোরপূর্বক তার হাত দিয়ে জিলাপি উঠিয়ে স্মরণের প্লেটে দিলো। স্মরণ চওড়া হেসে রাফির উদ্দেশ্যে বিরবির করে বললো,
" দ্যাটস লাইক এ গুড বয়। একটু কম কম খা। দিন দিন তো বেলুনের মতো ফুলছিস।"
রাফি কিছু বললো না। জিলাপির শোকে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়খানা নিয়ে বাকি ইফতারটুকু খেয়ে ফেললো।
ইফতার শেষে বাড়ির বিশাল বড় বৈঠকখানায় কাজিন মহলের সবাই একত্রিত হয়েছ। সবাই এ রুমকে বৈঠকখানা বলেই ডাকে। কারণ বাহাদুর শেখ ইংরেজ নাম অর্থাৎ ড্রয়িংরুম ডাকতে নারাজ। তাঁর মতে বৈঠকখানা নান্দনিক একটা শব্দ। এই প্রেক্ষিতে সবাই যেখানে রুম বলে সেখানো তিনি কামরা বলতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু কাল পরিক্রমায় সবার মুখে 'রুম' শব্দটা শুনতে শুনতে এখন৷ নিজেও রুম বলেন। তবে সেটা কালভেদে এক দুবার। এছাড়া 'ঘর' শব্দটাই বেশি উচ্চারণ করেন।
১০জন সদস্যের বিশাল কাজিন মহল সোফা, মেঝে, বৈঠকখানার ছোট্ট চকি, এসব মিলিয়েই বসে আছে। সবাই আড্ডা দিচ্ছে তুমুল আনন্দে। ঈদের পরিকল্পনা, মানতাসার বিয়ের পরিকল্পনা, এ নিয়ে হাসি ঠাট্টা, আলাপ আলোচনা চলছে। এর এক পর্যন্ত সাদ, মাহবুব ও সাজিদ চা খাওয়ার বায়না ধরলো। সবার মধ্যে নীলিমা চা পাগল বলে তাকেই চা বানানোর দায়িত্ব দেয়া হলো। রাফাকে সাথে নিয়ে সে রান্নাঘরে এলো চা বানাতে। এত লোকের চা একসাথে বানানো বেশ দুষ্কর। চা পাতা, চিনি, দুধের অনুপাত ঠিক রেখে মজাদার চা বানানো একটু কষ্ট বটে। নীলিমা তারপরও কাপ মেপে বড় পাতিলে পানি বসালো। এর মধ্যেই রাফি এসে নীলিমাকে বললো,
" নীলুপু, মাহবুব ভাইয়া র'চা আর স্মরণ ভাইয়া চিনি ছাড়া চা খাবে। আর আমি অনেক বেশি গুঁড়ো দিয়ে চা খাবো।"
বলেই সে চোখ টিপ দিয়ে চলে গেলো। নীলিমা তার কান্ডে হেসে রাফাকে বললো,
" তোর ভাইটা দিন দিন বজ্জাতের ঝাড় হচ্ছে।"
রাফাকে রান্নাঘরের দরজার দিকে চেয়ে বললো,
" এর চেয়েও বেশি কিছু। এত শয়তানি বুদ্ধি ওর মাথায়!"
চায়ে দুধ দেয়ার আগে একটা কাপে আগে থেকেই মাহবুবের জন্য চা ঢেলে রাখলো নীলিমা। এরপর দুধ দিয়ে ভালোভাবো জ্বাল করে বাকি সবার জন্য দুধ চা বানালো। প্রত্যেকের কাপেই চা দিয়ে চিনি দিলো। রাফির কাপে দু চামচ অতিরিক্ত দুধ দিলো। আর স্মরণের কাপে দু চামচ ভরে ভরে চিনি দিলো। তার চিনি দেয়া মাত্রই রাফা আঁতকে উঠে বললো,
" কি রে নীলু! স্মরণ ভাই চিনি ছাড়া খাবে। তুই একটা কাপও তো চিনি ছাড়া রাখলি না। "
নীলিমা স্মরণের উপরের ঝাল মেটালো চায়ের কাপে ও চামচে। চামচ দিয়ে চিনি নাড়তে নাড়তে আক্রোশ মিটিয়ে বললো,
" দু চামচ কম হয়ে গিয়েছে। পুরো বয়াম ধরে ঢেলে দেয়া উচিত ছিলো। এতে যদি উনার মুখ দিয়ে মিষ্টি কথা বের হয়। এখনও আমার সেদিনকার কথাগুলো মনে পড়ে। উনি কিন্তু চাইলেই আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সবসময় হাসি ঠাট্টা করেছেন,আমাকে পিঞ্চ করেছেন। "
রাফা হতাশ গলায় বললো,
" তুই এখনও ওসব ভুলতে পারছিস না নীলু!"
" না রে রাফা। আমি পারছি না। সম্ভবত উনার কলার চেপে দু চারটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে পারলে শান্তি পেতাম, হয়তো সব ভুলেও যেতাম। "
বলেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অতঃপর রাফার হাতে চায়ের একটা ট্রে আর নিজের হাতে অপর ট্রে নিয়ে বৈঠকখানার উদ্দেশ্যে চললো।
রাফা ও নীলিমাকে চা আনতে দেখে হইহট্টগোল সব থেমে গেলো মুহূর্তেই। সবাই চা নিতে হাত এগিয়ে দিলো। নীলিমা মানতাসা ও পাখিকে চা দিয়ে রাফি ও মাহবুবকে তাদের চা দিলো। অতঃপর স্মরণের সম্মুখে এসে চা এগিয়ে অতি ভদ্রতাপূর্ণ মেকি হাসি দিয়ে বললো,
" এই নিন স্মরণ ভাই, আপনার স্পেশাল চিনি ছাড়া।"
স্মরণ নীলিমার এমন আচরণে সন্দিহান চাহনিতে ভ্রু তুলে তাকালো। আপনমনে নিজেকে শুধালো,
" হঠাৎ এত ভালো আচরণ! মিষ্টি হাসি! আড়ালে তিতা ছড়িয়ে দিলো নাকি!"
বলেই স্মরণ চায়ের কাপ হাতে নিলো। নীলিমাও নিজের কাপ এনে মেঝেতে বসে পড়লো। সকলে চা খাচ্ছে, বেশ তৃপ্তিতে। স্মরণও সেই তৃপ্তি সাথে করে চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিলো। আর ওমনিই তার সমস্ত শরীর ঝিনঝিন করে উঠলো। এটুকু চায়ে অতিরিক্ত চিনির স্বাদে তার গা গুলিয়ে উঠলো। মুহূর্তেই মুখের বাকি চা'টুকু চায়ের কাপে ফেলে কাপ সরিয়ে রাখলো। খেঁকানো গলায় বললো,
" এ চা নাকি চিনির গোডাউন! আমি চিনি ছাড়া চা চেয়েছিলাম। এত চিনি কে দিয়েছে!"
বলেই সে নীলিমার দিকে ক্রোধান্বিত চাহনিতে চাইলো। ইতোমধ্যে সবার চা পানে জোরেশোরে একটা ব্রেক পড়লো। নীলিমা দায়সারাভাবে হালকা গলায় বললো,
" আপনি চিনি খান না! কই বলেননি তো!"
স্মরণ তেঁতে উঠে রাফির দিকে তাকিয়ে বললো,
" এই তোকে না বললাম, আমার চিনি ছাড়া চা দেয়ার কথা বলবি!"
রাফি চা'টা রেখে ভয়ার্ত চাহনিতে চেয়ে ঢোক গিলে বললো,
" আমি বলেছিলাম স্মরণ ভাইয়া!"
স্মরণ কিছু বলতে যাবে এর পূর্বে নীলিমা পূর্বের ন্যায় বললো,
" বলেছিলি? কই আমি তো শুনিনি। কখন বললি?"
বলেই সে স্মরণকে বললো,
" একটু চিনি দিয়ে চা খেলে কিছু হয় না। আপনার তেঁতো মুখটা একটু মিষ্টি হবে। "
" তাই বলে এত চিনি!"
নওরীন এবার খানিক অবাক হয়ে বললো,
" কি রে স্মরণ, তুই না মিষ্টি খাস? তাহলে চায়ের চিনিতে এত এলার্জি কেনো?"
সাদ স্মরণের হয়ে জবাব দিলো,
" ভাইয়ার মতে চায়ের আসল স্বাদ উপভোগ করতে চিনি ছাড়া চা খাওয়া উচিত। যত্তসব আজগুবি যুক্তি তার।"
বলেি চায়ের কাপে সুড়ুৎ করে চুমুক দিলো। এখন স্মরণের ব্যাপারটাকে কেউ পাত্তা না দিয়ে যে যার মতো চা খেতে লাগলো। সাজিদ বললো,
" আরে খাও খাও। জীবনে একবার চিনি দিয়ে চা খেলে কিছু হয় না। সেই টেস্ট হয়েছে চা। তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে দেখো।"
স্মরণ ক্রোধে প্রায় লাল হয়ে বললো,
" আর তৃপ্তি! "
বলেই সে উঠে গেলো। যাওয়ার পূর্বেই নীলিমার দিকে তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে গেলো। ভাবখানা তার এমন, এখন পারলে নীলিমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। নীলিমা অবশ্য সেসবের তোয়াক্কা করলো না। সে মনের সুখে চায়ের কাপে একের পর এক চুমুক বসালো।
-------------------
ছোট মামা আনোয়ার সাহেব বাজার থেকে গরম গরম জিলাপি আনতে দুই মিষ্টিখোর স্মরণ ও রাফিকে পাঠিয়েছেন। স্মরণের সাথে রাফি কোনোমতেই যাবে না। যাবে না তো যাবেই না, এমন ভাব। গোঁ ধরে বসেছিলো। পরে স্মরণের এক ধমকে একদম সোজা হয়ে যায় সে। বাজারে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড় হয়ে যায়।
এদিকটায় ছোট বাজার, যেখানে ইফতারের জন্য বিভিন্ন রকমের স্পেশাল আইটেম পাওয়া যায়, সেখানে যেতে হলে বাড়ি থেকে ধানের ক্ষেত, মেঠোপথ পেরিয়ে যেতে হয়।
স্মরণ ও রাফি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ধানের ক্ষেতের আইল ধরে এগুতে লাগলো। স্মরণ সামনে, রাফি ঠিক তার পিছনে। দুজন বেশ ধীরে ধীরেই এগুচ্ছে। আজও জোহর নামাজের পর বেশ বৃষ্টি হয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে মাটির রাস্তাগুলো পিচ্ছিল হয়ে যায়। টানা বেশ কয়েক দিনের বৃষ্টিতে কিছু জায়গায় শ্যাওলাও জমে যায়।
দু পাশে সবুজ ধানের ক্ষেত, মাঝে সরু আইল। প্রকৃতিতে শীতল হাওয়া বইছে। আকাশেও গুঁড়ো গুঁড়ো মেঘ জমে আছে। এই শীতল পরিবেশে এভাবে হাঁটতে ভালোই লাগছে।
স্মরণ মনের সুখে দিগ্বিদিক ভুলে আইল ধরে হাঁটছে। হঠাৎ পিছন থেকে রাফির চিৎকার শুনে চট করে পিছনে ফিরে তাকালো। কিন্তু এ কি! রাফি কোথায়! চিৎকার ভেসে আসছে কোথ থেকে!
স্মরণ উদ্বিগ্ন হয়ে নিজেও গলা ছেড়ে রাফিকে ডাক দিলো। রাফি আতঙ্কিত গলায় জবাব নিলো। তবে তার থেকে প্রায় পাঁচ কদম দূরে ডান পাশের ধানের ক্ষেতের ভিতর থেকে। ধানের ক্ষেতের ভেতর থেকে রাফি হাত উঁচু করে ডাকছে,
" স্মরণ ভাইয়া, বাঁচাও আমাকে। আমি পরে গিয়েছে।"
স্মরণ দ্রুত সাবধানে এগিয়ে ডান দিকে ঝুঁকে দেখলো, ধান-টান মারিয়ে দিয়ে রাফি ধানের উপরই শুয়ে আছে। তার সমস্ত শরীর কাঁদায় জর্জরিত। বেচারা উঠতে পারছে না।
রাফির এ অবস্থা দেখে স্মরণ কয়েক সেকেন্ডের জন্য পলকহীন চেয়ে রইলো। অতঃপর রাফিকে অবাক করে দিয়ে তাকে সাহায্য না করে গগন কাঁপিয়ে হাসি দিয়ে উঠলো। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা তার। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে কার-ই বা হাসি আটকে থাকবে। এদিকে রাফির অবস্থা করুণ। তার চাহনিতে অসহায়ত্ব। সে স্মরণের কাছে সাহায্য চাইছে। আর স্মরণ সাহায্য না করে হো হো করে হাসছে। কি নিষ্ঠুর!
স্মরণের দুষ্টু মস্তিষ্কে দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। এ অবস্থার আরেকটু মজা লুটতে মিথ্যে বললো,
" ঐ যে দেখ সাপ আসছে। রাফি সাপ আসছে। "
রাফি এবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করে দিলো। ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে বললো,
" এ ভাইয়া.....আমাকে উঠাও ভাইয়া.....আমি মরে যাবো.....বাঁচাও ভাইয়া.......বাঁ-চা-ও।"
.
.
.
চলবে.............................