রোদেলা, জুবিয়া ও উমাইয়া আয়ানের বাবার রেস্টুরেন্টে পৌঁছেছে সবে। আয়ান জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে মোহাম্মদ নায়েব খানের অফিস কক্ষে প্রবেশ করল। ছেলের বিবেকহীন কাজে ক্ষুব্ধ নায়েব খান। তিনি রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
'আমার রেস্টুরেন্টের জন্য কর্মী নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছে?'
বাবার উচ্চকণ্ঠে কেঁপে উঠল আয়ান। সে তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। আয়ান দ্রুত ছুটে গেল তার বাবার দিকে। হঠাৎ তার পা জড়িয়ে ধরে বলল,
'বাবা। আমি এমন ভুল দ্বিতীয়বার করব না। তুমি এইবার আমার বন্ধুদের কাজ দিয়ে দাও। আমি বড় মুখ করে ওদের বলেছি আসার জন্য, তুমি এখন ওদের চাকরি না দিলে বন্ধুদের সামনে আমার সম্মান থাকবে না।'
নায়েব খান কড়া গলায় বললেন,
'আমার পা ছেড়ে দাও, আয়ান। তুমি জানো আমি কারো কথায় লোক নিয়োগ করি না। তোমার বন্ধুদের চলে যেতে বলো।'
আয়ান বাবার পা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অনুরোধ করে বলল,
'বাবা, তুমি ওদের চাকরি না দেওয়া পর্যন্ত আমি পা ছাড়ব না।'
আয়ানের চোখ বেয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নায়েব খান টেবিলে চোখ রেখে ফাইল দেখতে লাগলেন। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন তুললেন তিনি, ফোনের ওপাশ থেকে একটি দৃঢ় স্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। সহসা নায়েব খান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ফোন রেখে আয়ানের উদ্দেশ্য চিন্তিত গলায় বললেন,
'তোমার বন্ধুদের নিয়ে এসো। তাদের চাকরি হয়ে গেছে।'
বাবার চেহারা দেখে থমকাল আয়ান। ভাবলো, তার কল পেয়ে হঠাৎ বদলে গেলে কেন? তারপর কিঞ্চিত উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করল,
'বাবা কে কল দিয়েছিল?'
নায়েব খান জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
'সাদাফ ক্যাসানো।'
বিস্ময়ে আয়ান আঁখিদুটি বড়বড় করে তাকাল।
❐
মন খারাপ তূর্ণর। দুই দিন ধরে জুবিয়াকে দেখে না সে। সাদাফ ব্যস্ত চোখে একপলক তূর্ণর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
'বসে বসে ঝিমাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে?
তূর্ণ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
'আমার হৃদয় ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় আমার প্রিয়দর্শিনী?'
সাদাফ লাজুক হাসল। তূর্ণর উদ্দেশ্য লহু কণ্ঠে বলল,
'তোর প্রিয়দর্শিনী রেস্টুরেন্টে কাজে ব্যস্ত।'
তূর্ণ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'রেস্টুরেন্টের কাজ মানে? তার চাকরি চলে গেছিল।'
'আবার অন্য কোথাও হয়েছে।'
মুহূর্তের মধ্যে তূর্ণর মাথা গরম হয়ে গেল। সে রেগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
'কতবার তার ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে ফিরে এলাম। তুই সব জেনেও, আমাকে আগে বলিসনি কেন?'
সাদাফ ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
'তোর ঘুরঘুর করা দেখতে ভালোই লাগছিল।'
তূর্ণ হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
'তুই আমার সাথে এমন করিস কেন?'
সাদাফ একটা লম্বা হাই দিয়ে বলল,
'এখন বলার মুডে নেই।'
তূর্ণ হুট করে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সাদাফ জিজ্ঞেস করল,
'কোথায় যাচ্ছিস?'
'সেহরিশের কাছে।'
সাদাফ তাড়াতাড়ি বলল,
'দাঁড়া, আমিও যাব।'
কলিংবেলের শব্দে সেহরিশ ভেতরঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সদরদরজা খুলতেই দেখল সাদাফ আর তূর্ণ দাঁড়িয়ে আছে। তূর্ণ আর সাদাফকে দেখে সেহরিশ ভ্রু কুঁচকে বলল,
'তোদের জন্য আমি কী আমার বাড়িতেও থাকতে পারব না?'
তূর্ণ জবাব দিল না। হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে সোফায় বসে পা দোলাতে লাগল। সেহরিশ ওদের সাথে বসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তূর্ণ মিটিমিটি হেসে বলল,
'এখানে চায়নিজ ফুড কর্নার নামে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। শুনেছি খাবার খুব ভালো। চল যাই?'
সেহরিশ হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়াল। তূর্ণ সেহরিশের হাত শক্ত করে টেনে ধরল। সেহরিশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
'আমি যাবো না। তোরা যা।'
তূর্ণ করুণ চোখে তাকিয়ে রইল। হয়ে গেল। সেহরিশ সোজা করে বেডরুমের দিকে চলে গেল। তূর্ণ পিছু পিছু রুমে এলো। হঠাৎ পেছন থেকে সেহরিশকে জড়িয়ে ধরে খুশি কণ্ঠে বলল,
'চল যাই।'
সেহরিশ রাগে গরগর করে বলল,
'তুই আমাকে ছাড়বি নাকি আমি তোকে বের করে দেব?'
সাদাফ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
'একদিনের ব্যাপার। একটু বাইরে খেলে তোর স্বাস্থ্যের আহামরি ক্ষতি হবে না।'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'আজ না।'
❐
জুবিয়া রোদেলার দিকে তাকাল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
'আমরা জোজোকে সঙ্গে নিচ্ছি কেন? রেস্টুরেন্টে তার কাজ কি? রেস্টুরেন্টের মালিক জোজোকে ঢুকতে অনুমতি দেবেন?'
উমাইয়া মৃদুস্বরে বলল,
'জোজোর কথাও আমাদের ভাবা উচিত। সারাদিন বাড়িতে একা থাকতে ওরও ভালো লাগবে না। তাছাড়া জোজো বাহিরে গেলে রাস্তার কুকুররা তাকে কামড়াবে। তুই টেনশন করিস না। রেস্তোরাঁর উত্তর পাশে একটা খালি জায়গা আছে। জোজোকে সেখানে রাখব।'
জুবিয়া চিন্তিত গলায় বলল,
'আয়নের বাবা যদি রাগ হন?'
'আমরা কথা বলে নেব, বুঝিয়ে বললে উনি ঠিক বুঝবেন।' উমাইয়া বলল।
জোজো রোদেলার পাশে চুপ করে বসে আছে। রোদেলা জোজোর মাথায় হাত বুলাতে লাগল। তারপর আস্তে করে জোজোর উদ্দেশ্য বলল,
'জোজো, ওখানে গিয়ে কোনো পাগলামি করবি না। তোর একটা ভুলে আমরা কিন্তু চাকরি হারাব।'
জুবিয়া ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
'ঠিক আছে চল।'
জুবিয়া অর্ডার নিতে এগিয়ে গেল। উত্তর দিকে একটা টেবিলে এক পরিবার বসে আছে। তাদের টেবিলে মেনু কার্ড নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াল উমাইয়া। একজন মহিলা কার্ড দেখে কিছু অর্ডার করলেন, উমাইয়া অর্ডার নিয়ে চলে যায়। পূর্ব দিকের একটি টেবিলে দুটি ছোট ছেলে তাদের বাবা-মায়ের সাথে বসে দুজন একটা গ্লাসের জন্য কাড়াকাড়ি করছে। হঠাৎ গ্লাসটা মাটিতে পড়ে গেল। ম্যানেজার এসে রোদেলাকে ডেকে বললেন,
'ভাঙা গ্লাসটা তুলে বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে তারপর মেঝে ভালো করে মুছে দাও।'
রোদেলা মাথা উপর নিচু করে বলল,
'আমি এখুনি করছি স্যার।'
রোদেলা কাচগুলো এক টুকরো কাপড়ে রেখে ভালো করে বেঁধে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। ফ্লোরের পানি মুছতে লাগল সে। টিভিতে একটা হিন্দি গান চলছে। গান শেষ হওয়ার পর চ্যানেল বদলে দিল ম্যানেজার। বেশ মনোযোগ দিয়ে খবর দেখছেন তিনি। সাংবাদিক ওবায়দা হক স্বাভাবিকভাবে সংবাদ পরিচালনা করছেন। তার বক্তব্যের উৎপত্তিস্থল বিশ্ববিখ্যাত ইতালিয়ান মিউজিক ব্যান্ড বি-এম। টেবিলে রাখা কাগজের দিকে তাকাল ওয়াবদা। তারপর বললেন,
'বিশ্বখ্যাত মিউজিক বিএম ব্যান্ডের তিন তারকা বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছেন। খুব শিগগিরই দেশে তাদের প্রথম কনসার্ট হবে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এমন একটি দিনের অপেক্ষায় ভক্তরা বহুদিন ধরে। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি বিএম ব্যান্ড লিডার সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী।'
টিভি পর্দার একপাশে একজন মহিলা কথা বলছেন। আর ওপাশে ঝলমল করছে বিএম ব্যান্ডের সদস্যদের ছবি। ছবি দেখে রোদেলা অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাদাফ ও তূর্ণকে চিনতে দ্বিধা হলো না তার। জুবিয়া ও উমাইয়ার দিকে ছুটে গেল সে। তিনজন এক সাথে দাঁড়িয়ে আছে। উমাইয়া চমকাল ভীষণ। ফিচেল স্বরে বলল,
'ওরা অন্য দেশের গায়ক।'
জুবিয়া বলল, 'তূর্ণ একজন বড় সেলিব্রিটি। এজন্যই প্রথম দিন যখন তাকে সাহায্য করি তখন শপিংমলের সামনে লোকজন ও সাংবাদিকরা ভিড় করেছিল। তাছাড়া ওদের সবসময় ক্যাপ, সানগ্লাস এবং মাস্ক পরে দেখা যায়। আর আমাদের বাড়ির সামনে সব সময় কালো পোশাক পরা দশ-পনেরো জন লোক দাঁড়িয়ে থাকে।'
উমাইয়া দৃঢ় গলায় বলল,
'সম্ভবত তারা ওদের দেহরক্ষী।'
জুবিয়া বলল,
'বাড়িওয়ালা খালা কেন তার ছেলের জন্য রাখা ফ্ল্যাটটা তাদের কাছে বিক্রি করেন এখন বুঝলাম। সেলিব্রেটি হওয়ার সুযোগ নিয়ে সাদাফ সে ফ্ল্যাট কিনে নেয়।'
উমাইয়া চাপা গলায় বলল,
'কিন্তু তারা আমাদের কাছ থেকে তাদের পরিচয় গোপন রাখল কেন?'
রোদেলা চোখ সরু করে সেহরিশের ছবির দিকে তাকিয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
'আমি উনাকে কোথাও দেখেছি?'
হঠাৎ আয়ান এলো। দূর থেকে হাত নেড়ে ডাকল জুবিয়াকে। তবে আয়ানের ডাক জুবিয়ার কানে পৌঁছাল না। আয়ান এগিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। তারপর টিভির দিকে তাকিয়ে খুশি মনে জিজ্ঞেস করল,
'তোরা ও তাদের ভক্ত আমি জানতাম না।'
উমাইয়া শুধল,
'তুই তাদের চিনিস?'
আয়ান বলল,
'হ্যাঁ। তাদের গান আমার ভীষণ ভালো লাগে। আর গানের সাথে তাদের নাচও অসাধারণ। তাদের প্রতিটি গান রেকর্ড গড়েছে।'
করুণ গলায় বলল জুবিয়া,
'তোর ফোন কোথায়?'
আয়ান প্যান্টের পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করল। অনেক দিন ধরেই স্মার্ট ফোন কিনতে চাচ্ছে জুবিয়া। টাকার জন্য এখনো কিনতে পারেনি। আয়ান নিচু গলায় বলল,
'তুই ফোনে কি দেখতে চাস? আমাকে বল আমি বের করে দিচ্ছি।'
জুবিয়া ফোনের স্কিনের দিকে তাকাল। টিভির ভেতরকার সাদাফ ও তূর্ণর ছবির দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল,
'আমি তাদের সম্পর্কে জানতে চাই।'
আয়ান বিএম ব্যান্ডের সদস্যদের ভক্ত। সে ওদের সম্পর্কে সবকিছু জানে। জুবিয়া ওর মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। তাই আয়ান সোজা চলে গেল গোগোলে। বিএম লিখে সার্চ করল। সঙ্গে সঙ্গেই শতাধিক খবর সামনে এলো। সাদাফ বিএম মিউজিক বয় ব্যান্ডের সদস্য। পুরো নাম সাদাফ ক্যাসানো। জাতীয়তা বাংলাদেশি। বিএম ব্যান্ডের গায়ক, গীতিকার ও নৃত্যশিল্পী সে। ফর্সা গায়ের রং, উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। বয়স ঊনত্রিশ। পরিবারের সদস্যরা কয়েক বছর আগে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সে এতিম। মাহাবুব তূর্ণ। সে একজন গায়ক এবং প্রধান নৃত্যশিল্পী। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা। বাবরি চুল, উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। বয়স সাতাশ। পরিবারের সদস্য শুধু বাবা ও মা।
আয়ান ফোনটা পকেটে রাখল। উমাইয়া ও জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে আয়ান বলল,
'কি হয়েছে? তোদের মুখ এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন?'
জুবিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বজ্রকণ্ঠে বলল,
'তুই আগে থেকে জানিস যে তারা গায়ক? আমাকে বলিসনি কেন?'
অবাক গলায় বলল আয়ান,
'আমি কি বলবো? তোরা কখনও কাজ এবং পড়াশোনার বাইরে কিছুতে আগ্রহ দেখাসনি। তোরা তো গান বাজনা পছন্দ করিস না।'
জুবিয়া জোরে চিৎকার করে উঠল,
'আমার পথ থেকে সরে যা।'
উমাইয়া সরু চোখে রোদেলার দিকে তাকাল। করুণ কণ্ঠে বলল,
'আমরা তাদের চিনি না। তাই সে আমাদের বোকা বানিয়েছে।'
রোদেলা এগিয়ে এলো। উমাইয়া তার হাতে হাত রেখে বলল,
'একতরফা চিন্তা করে তাদের ভুল বুঝিস না। তাদের না বলার পেছনে কারণ থাকতে পারে।'
উমাইয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
'তুই আমাকে মিথ্যা স্বান্ত্বনা দিচ্ছিস কেন?'
.
.
.
চলবে......................................