তুমি রবে নীরবে - পর্ব ১৭ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


কথাটা তবে দিব্যি মনে রেখেছে মেয়েটা!অথচ রওনক ভেবেছিল কালকের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে কুহু!সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভালই জানে দেখা যাচ্ছে!চোখ ছোট ছোট করে কুহুর ভেজা মুখে তাকিয়ে আছে রওনক।চিকন নাকের ডগা বেয়ে পানির স্রোত নামছে অবলীলায়!ভীড় জমাতে চাচ্ছে পাতলা অধরযুগলে!গালে লেপ্টে আছে চুল!জলের তান্ডবে চোখ বারংবার বুজে আসতে চাইছে।অদ্ভুত এক মোহ নিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে রওনক!ঠিক যেন বর্ষার প্রথম কদম ফুটেছে!যার স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছে রওনকের অন্তঃকরণে!অনেকটা সময় নিশ্চুপ অতিবাহিত হলো।আরো খানিকটা কুহুর দিকে ঝুঁকে গেল রওনক।দ্রুত পেছাতে গিয়ে টাইলসের মেঝেতে পা পিছলে গেল কুহুর!টাল সামলাতে পারলো না সে।পরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে স্বীয় বলিষ্ঠ হাতে সামলে নিল রওনক!চোখমুখ খিঁচিয়ে নিয়েছিল কুহু!কটিদেশে শক্তপোক্ত স্পর্শ পেতেই মুহূর্তে চোখ মেলে তাকাল।সম্মুখে থাকা পুরুষের ভেজা শার্ট খামছে ধরে আছে সে!শুভ্র রঙা ভেজা শার্টে চওড়া বক্ষস্থল সুস্পষ্ট রওনকের!কুহুর মুখের উপর খানিকটা ঝুঁকে থাকার দরুন রওনকের থুতনি চুইয়ে জল পরছে কুহুর মুখাবয়বে!ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত রহস্যময় এক হাসি!এক ঝটকায় কুহুকে দাঁড় করিয়ে দিল রওনক।চারিদিকে পানির শব্দ বদ্ধ ওয়াশরুমে তরঙ্গের মতো বাজছে!কুহু বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাত চেপে ধরলো রওনক।ঘাড় ঘুরিয়ে হাতের উপর দৃষ্টিতে তাকাল কুহু।রওনকের ভেজা হাতে লেপ্টে আছে লোম!হ্যাচকা টানে কুহুকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিল রওনক!বেশ চমকে উঠলো কুহু!দৃষ্টি ফেলল রওনকের চোখে।কুহুর গালে লেপ্টে থাকা চুলগুচ্ছ কানের পেছনে গুঁজে দিল রওনক।অপ্রস্তুত হয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো কুহু।মেঝেতে দৃষ্টি রেখে রওনককে বলল ছেড়ে দিতে।তপ্ত শ্বাস ফেলে কুহুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল রওনক,

"প্রতিশোধ নিতে চাইছ?তবে লড়াই টা সমানে সমানে হোক!যে কারণে আমাকে শাস্তি দিতে চাইছ তুমিও সেই একই কাজ করতে পারো!তাহলেই তো শোধবোধ!আমিও দেখি কতখানি প্রতিবাদী তুমি!এখানে একসপ্তাহ থাকার তো কোনো কারণ দেখছি না!

রওনকের কথায় মৃদু কেঁপে উঠলো কুহু!সাংঘাতিক সব কথাবার্তা!রওনক ভাই চুমু খেয়েছে বলে তাকেও চুমু খেয়ে প্রতিশোধ নিতে হবে?কি বদমাইশি চিন্তাভাবনা!শক্তপোক্ত বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে গেল কুহু!মুচকি হেসে উঠল রওনক!জব্দ ভালই হয়েছে মনে হলো।রুমে আসতেই কুহু খেয়াল করলো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার।পায়ের রগে টান অনুভব হচ্ছে!বেকায়দায় পরে যাওয়ার সময় এমনটা হয়েছে বোধহয়!রাগে চোখমুখ বিশ্রিরকম কুঁচকে গেল কুহুর।সব হয়েছে রওনক ভাইয়ের জন্য।একটু আধটু জ্বালিয়ে তো মন ভরে না মহাশয়ের!এই জন্য কুহুকে সারাজীবনের জন্য বন্ধী করে নিয়েছে কয়লা বানিয়ে ফেলার জন্য!কোনোমতে পা খুঁড়িয়ে গিয়ে ওয়ারড্রব থেকে জামা বের করে নিল কুহু।এগিয়ে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।পা মনে হচ্ছে অসহ্যরকম ব্যাথা করছে!কোনোরকম গা মুছে জামা পাল্টে নিয়ে ফ্যান ছেড়ে চুল খুলে বসল।আকাশ সম্পূর্ণ কালো চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে।এই রাত্তিরে ভেজার ফলে ঈষৎ শীত ভাব চলে এসেছে শরীরে।ওয়াশরুম থেকে রওনকের ডাক আসছে অনবরত!বেশ জোড়াল স্বরে চেঁচাচ্ছে।কপালে আবারও রাগের সুক্ষ্ম ভাজ পরলো কুহুর।এই পা নিয়ে এখন এতদূর কি করে যাবে ও?ফোঁস করে দম ফেলে মেঝে থেকে ভেজা কাপড়চোপড় তুলে নিয়ে কোনোরকম খুঁড়িয়ে ওয়াশরুম অবধি আসল।কুহুর হাঁটা টা স্পষ্ট খেয়াল করল রওনক!ঘরে গিয়ে আবার পরে গেল নাকি মেয়েটা?কুহু দরজার কাছে এসেই দৃষ্টি তুলে তাকাল।শার্টের সবকয়টা বোতাম খোলা রওনকের।ভেজা লোমশ বক্ষস্থলে দৃষ্টি পরতেই কেমন অপ্রতিভ হলো কুহু।রওনক ভাই আসলেই একটা নির্লজ্জ!দাঁত কিরমিরিয়ে বলল,

"ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন কেন?

" পায়ে কি হয়েছে তোমার?

অকপটে প্রশ্ন রওনকের।নিজের পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল কুহু,

"তখন পরে যাওয়ার সময় মনে হয় ব্যাথা পেয়েছি।হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।

রওনকের মুখ জুড়ে চিন্তার ছাপ!ভেজা শরীরে এগিয়ে এসে কুহুর হাত থেকে ভেজা জামাগুলো নিয়ে বাথরুমে ছুঁড়ে ফেলল।নরম গলায় বলল,

" আমি তো ডাকছিলাম তোয়ালে দিয়ে যাওয়ার জন্য।তুমি বললেই হতো পায়ে ব্যাথা!

"আপনি যেভাবে ডাকছিলেন না এসে উপায় ছিল না।

বাকি আর কথা বাড়াল না রওনক।কুহুর গলা থেকে একটানে সুতির ওড়নাটা খুলে নিল।আশ্চর্য হয়ে হতভম্ব হয়ে গেল কুহু!আচমকা শরীর কাটা কাটা করে তুলল তার!রওনক ভাই এরুপ কিছু করবে কল্পনাতীত ছিল!কুহু কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!রওনকের অধরজুড়ে দুষ্টু এক হাসি।কুহুর ওড়না দিয়ে নিজের চুল মোছায় ব্যস্ত সে।

" রওনক কি শাওয়ার নিয়েছ নাকি?

তোহার কথায় চমকে গেল কুহু!ঘুরে তাকাবার সাহস করল না।ভাবী আর মা কখন আসলো?সদর দরজা তো খোলাই ছিল।চোখমুখ খিঁচে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা ফেলল সে।পায়ে টান অনুভব হতেই ধপাস করে বসে পরল!বিচলিত হয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে কুহুর সম্মুখে গিয়ে বসল রওনক।তোহা বুঝতে পারলো না কিছুই!কুহুকে আরো চারদফা অবাক করে দিয়ে তোহার সামনেই কোলে তুলে নিয়ে বলল রওনক,

"ব্যাথা নিয়ে হাঁটতে গেলে কেন?

তোহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!রওনকের গলায় কুহুর ওড়না দেখে মিটিমিটি হাসছে।কুহু লজ্জায় কুটিকুটি হয়ে গেল।ক্রমেই মুখ লুকালো রওনকের চওড়া বুকে!সম্ভব হলে এক্ষুনি এই রওনক ভাইকে জ্যা'ন্ত পু'তে দিত!এতটুকু বয়সে কখনো এরকম লজ্জাকর পরিস্থিতি পরেনি কুহু!রওনক তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,

"ভার্সিটি থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি।ফ্রেশ হওয়ার পর খেয়াল হলো আমি এক্সট্রা ড্রেস আনিনি।ফুয়াদ ভাইয়ের থেকে একটা ম্যানেজ করে দিন ভাবী।

কুহু সেই যে ঘাপটি মেরেছে।মাথা তুলবার খবর নেই।তোহা বেশ বুঝতে পারলো কুহুর লাজুক অবস্থা!শব্দ করে হাসতে হাসতে চলে গেল সে।রুমে এসে খাটের উপর কুহুকে নামিয়ে দিল রওনক।মুহূর্তেই কেমন অগ্নিমূর্তির রূপ নিল কুহু।তেড়ে এসে রওনকের গলায় থাকা ওড়না ধরে বলল,

" কি করলেন এটা ভাবীর সামনে?উপরওয়ালা কি একটুও লাজলজ্জা দেয়নি আপনকে?কি ভাবছে এখন ভাবী?

ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল রওনক,

"আমি সিউর তোহা ভাবী আরো অনেক কিছু ভেবে নিয়েছে!অবশ্য ওসব ব্যাপার না।আমরা নবদম্পতি সেটা সে জানেই।

" জানে মানে?কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন!আর ওড়না কেন টেনে নিলেন?

"কোনো পরপুরুষ তো নেয়নি!আমার সামনে ওভাবে থাকাটা কোনো অসস্থিকর কিছু না সেটাই বোঝাতে নিয়েছি।তবুও মোটা মাথায় যদি একটু বুদ্ধির উদয় হয়!

গলার ওড়না বেশ শক্ত করে টেনে ধরে বলল কুহু,

" মে'রে ফেলবো!এক্ষুনি খু'ন ফেলব আপনাকে!

"ওইটুকু চড়ুইয়ের শক্তিতে আর যাই হোক আমার শ্বাস'রো'ধ করতে পারবে না।একবার যদি আমি শক্তি খাটাই তাহলে কি হবে ভাবতে পারছ?

কুহু যেন হালকা মিইয়ে গেল।তবে রাগের তেজ একটুখানিও কমলো না!পুরুষ শক্তির কাছে অবশ্যই পরাজিত হবে সে।মনে হচ্ছে রাগানো ঠিক হবে না।এই লোক কি করতে কি করে ফেলে ঠিক নেই!দু'হাতেে কুহুর কোমড়ে জড়িয়ে ধরে বলল রওনক,

" মা'রছো না কেন?মে'রে ফেলো!আমি হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়ে দিব!দেখো তখন কিন্তু আবার বলো না,আমি আপনাকে হারাতে পারবা না রওনক ভাই!কুহু অস্তিত্বহীন আপনি ছাড়া!

দরজায় টোকা পরলো।তোহা ডেকে উঠলো।কুহুকে ছেড়ে দিয়ে দরজার কাছে গেল রওনক।হাতে টিশার্ট আর লুঙ্গি নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে তোহা।হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে থমকে গেল রওনক!লুঙ্গি আগে কখনো পড়া হয়নি তার।বাসায় ট্রাউজার নয়তো থ্রি-কোয়ার্টার পরে অভ্যস্ত!কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রওনক।একটা দিনেরই তো ব্যাপার!ম্যানেজ করে নিবে কোনোমতে!


বাসায় আসার পর দুপুরের খাবার খায়নি রিশা।খাটের এককোনায় পরে ছিল।মেয়ের মন খারাপটুকু বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন শারমিন বেগম।মায়ের মন।সন্তানের কিছু হলে সবার আগে টের পায়।মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়ের মনের অবস্থা জানতে চাইলেন।মাথা ব্যাথা আর অসুস্থতার দোহাই দিল রিশা।ছোট থেকে মেয়েটা বড্ড চাপা স্বভাবের আর শান্ত।কখনো মুখ ফুটে কিছু বলে না।পছন্দের খাবার,পোশাক যাই হোক কখনো মন খুলে আবদার করেনি।মা,বাবা যেটা পছন্দ করে দিয়েছে তাতেই রাজ্যের খুশি খুঁজে নিয়েছে।এটা ভাল নাকি মন্দ গুন বুঝতে পারলেন না শারমিন বেগম!সবকিছু চেপে রাখা অনুচিত!রিশার মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে না পেরে ওঠে চলে গেলেন শারমিন বেগম।ঘড়িতে রাত আটটা।মনটা প্রচন্ড খারাপ লাগছে রিশার।ওঠে ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।যাওয়ার আগে মাকে বলে গেল ফুচকা খেতে বেরিয়েছে।অগত্যা আর কিছু বললেন না শারমিন বেগম।


ফার্মেসির দোকানে দাঁড়িয়ে আছে রিশা।তার বন্ধুর বাবার ফার্মেসি।এখান থেকে সহজেই ঘুমের ঔষধ কিনে নিতে পারবে সে।বাকি কাস্টমার বিদায় হতেই হাসিমুখে রিশার সামনে এসে দাঁড়াল আরিয়ান।এখান থেকেই প্রয়োজনীয় সব মেডিসিন নিয়ে যায় রিশার বাবা।একটুখানি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে এক পাতা ঘুমের ট্যাবলেট চাইল রিশা।আরিয়ান খুব ভাল করেই জানে কোন ঔষধ টা রিশার বাবা খায়।সেটাই দিয়ে দিল সে।ছোট্ট একটা হাসি ফিরিয়ে দিয়ে টাকা দিয়ে চলে আসলো রিশা।রাস্তার ফুটপাত ধরে আনমনে হাটতে লাগল।বারংবার চোখে ভেসে উঠছে আশফিক ভাই আর ওই বিদেশিনীর মুখটা!যতবার মানস্পটে ভেসে উঠছে ততবার অন্তঃকরণে র'ক্তক্ষ'রণ বইয়ে দিচ্ছে!এইটুকু ভোলার জন্যও আজকে একগাদা ঘুমের ঔষধ গিলতে হবে রিশার।এই মুহূর্তে ম'রে গেলেও মনে হচ্ছে যন্ত্র'ণা কম হতো!যেটা আমাদের ভাগ্য নেই কেন সেটার জন্য মন পুড়বে?বিধাতা কেন মন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেননি মানুষকে?তাহলেই তো কষ্ট থাকতো না কোনো!

"আইরিশ?

পুরুষসুলভ কন্ঠস্বর পেয়ে ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার।পাশে তাকাতেই দেখল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে রাতিম ভাই।নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো রিশা।ততক্ষণে হাসিমুখে এগিয়ে আসলো রাতিম।

" আজকেই তো দেখলাম হাতভর্তি কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরলে!আরো কিছু বাকি আছে নাকি?এই রাতে বের হলে!

রাতিমের কথার ঠিক কি জবাব দেবে বুঝতে পারলো না রিশা।অপ্রতিভ হয়ে কোনোরকম বলল বাবার জন্য ঔষধ কিনতে বেরিয়েছে সে।রাতিম খানিকটা ভাবুক ভঙ্গিতে রিশাকে পর্যবেক্ষণ করলো।কোথাও একটা মনে হলো রিশা তাকে মিথ্যে বলেছে!চাপা কিছু একটা লুকিয়ে আছে তার মাঝে।নিয়ন বাতির হলদে আলোয় রিশার মলিন মুখখানা সুস্পষ্ট দেখতে পেল রাতিম।কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পরলো।কেন জানি মনে হলো মেয়েটা কেঁদেছে!ভীষণ মন খারাপ তার!কিন্তু কারণ কি?চট করেই রাতিম বলল,

"আমার মন টা আজ খুব খারাপ আইরিশ।হাইওয়ের সাইডে একটু হাঁটবো।তুমি কি আমায় সঙ্গ দিবে?
·
·
·
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন