অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি - পর্ব ০২ - সাইরা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


'আর ইউ ভার্জিন? আই ডোন্ট থিংক সো। এমন সুদর্শন পুরুষের বিছানায় আজ অবধি কোনো মেয়ে যায়নি এটা বিশ্বাস করা কঠিন।কত নারীর স্বপ্নপুরুষ তুমি, আমার অনুমান ভুল না হলে নারীরা তোমাকে ওপেনলি অফার করে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডের জন্য। অ্যাম আই রাইট? বাট তোমার কি সত্যি-ই কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই? কারোর প্রতি আকৃষ্ট হওনি কখনও?তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ? হট? শর্ট? টল? মর্ডান?'

প্রশ্নগুলো অগ্রাহ্য করে ভাবলেশহীন বসে থাকা যুবকটি কফিপান করছে।চেহারায় ফুটে উঠছে বিরক্তির আভা। তার সম্মুখে বসে থাকা নারীটি ইভিলিন ম্যাম,অফিসের বসের দ্বিতীয় স্ত্রী। বয়স ছত্রিশ, বেশিও হতে পারে।ঠিক কত?এ বিষয়ে অজ্ঞাত সে। অফিসের একটি প্রজেক্টের জন্য আজ ইভিলিন ম্যামের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।তিনি এসে ধরেই ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলছেন। তার সকল বাক্যের সারমর্ম এটাই যে উনিও যুবকটির প্রতি আগ্রহী কিন্তু শতচেষ্টার পরেও তিনি তার উদ্দেশ্যে সফল হতে পারলেন না। যুবকটি তার তী'ক্ষ্ণ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে, প্রজেক্টের প্রয়োজনীয় আলাপ দ্রুতই সম্পন্ন করল। এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ইভিলিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুচকি হেসে বলল,

'আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো ম্যাম। থ্যাংকস ফর ইউর কোলাবরেশন।'

ইভিলিনকে অসন্তুষ্ট দেখালো। যুবকটি তা পরোয়া না করে দ্রুত ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে আসে। প্যান্টের পকেটে অনবরত ভাইব্রেট করতে থাকা ফোনটি এবার বের করল সে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ের আহাজারি শুনতে পেল। প্রচণ্ড কান্নাকাটি করছেন তিনি। যুবকটি গম্ভীরগলায় বলল,
'কি হয়েছে? জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সময় তো এত কষ্ট হয়নি।এখন এত কাঁদছ কেন? এবার কি চাও? আমাকে আর কি করতে হবে?'

'তুই ফিরে আয়,আমার আর কিচ্ছু চাই না।তুই যা চাইবি তাই হবে, আমি তোর বাবাকে বোঝাবো।আমার কথাটা একবার ভাব, আর কতদিনই বা বাঁচব? ম'রার সময়ও নিজের ছেলেকে ছুঁয়ে দেখতে পারব না? এত নিষ্ঠুর হোস না, দয়া করে ফিরে আয় বাবা।'

মায়ের কান্না শুনে মন নরম হলো যুবকটির। সে সুদূরে তাঁকিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
'আসব বললেই তো আসা যায় না মা। এখানে সবকিছু মেলে বসেছি আমি। এসব গুছিয়ে তারপর আসার চেষ্টা করব। কেঁদো না, তোমার শরীর এমনিতেও কিছুদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না।'

মা জেদ দেখিয়ে বললেন, 'কবে আসবি? সময় বল।'

'সময় কিভাবে বলব?কাজ কতদিনে মিটবে তার হিসেব এখন..'

'তুই সময় বল, আর কিছু শুনব না আমি।কতদিনের মধ্যে আসবি তুই?'

যুবকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'নতুন প্রজেক্টের কাজটা এমাসের মধ্যে শেষ হবে। সব গুছিয়ে নিতে পারলে তিন মাসের মধ্যেই ফিরতে পারব। এবার কান্নাকাটি বন্ধ করো।'

'ঠিক তিন মাস। তিনমাস এক দিনও যেন না হয়। কথা দে আমাকে।'

'এটা কথা দেওয়ার মত কিছু? সবকিছুর কথা নিয়ে তোমরা কেবল নিজেদের কার্যহাসিল করছ। আমার কথাও ভাবো। এখানে আমি চাকরি করি, তারওপর পড়াশোনা, সার্টিফিকেটও তোলা হয়নি। এসব তুলতে কতদিন লাগবে তা না জেনে তোমাকে কিভাবে কথা দেব?'

পুনরায় হু হু করে কেঁদে উঠলেন মা, 'তিনমাসের মধ্যে না আসলে, তুই দেশে ফিরে আমার ম'রা মুখ দেখবি। বলে রাখলাম আমি।' 

কল কেটে যায়। মা-কে জানে সে। রাগের বশবর্তী হয়ে নানা কান্ড ঘটানোর ক্ষমতা আছে মায়ের। মায়ের এই জেদের সঙ্গে সে পেরে উঠবে না। তাই সামনে একটাই পথ খোলা আছে। দেশে ফিরতে হবে। এজন্য কলব্যাক না করে বড় ভাইয়ের কাছে একটি এসএমএস পাঠাল,

'মা-কে বোঝাও, আমি দ্রুত দেশে ফেরার চেষ্টা করবো। আগামী কিছুদিন ব্যস্ত থাকব তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে, এটা নিয়ে যেন কেউ চিন্তা না করে। সবার খেয়াল রেখো।'

🥀________🥀

সভ্যতা ছাদে আসে। চিলেকোঠার ঘরে কিছুটা সময় বসে থেকে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করতে হবে। আরীবকে ওভাবে জবাব দেওয়ায় ভীষণ খারাপ লাগছে সভ্যতার। ছোট থেকেই আরীবের ভক্ত ছিল সে। কিছু হলেই আরীব ভাই, বড় ভাই করা স্বভাব ছিল। বাড়িতে কেউ বকলে, কেউ বেশি কথা বললে ফুপির কাছে নালিশ, আর নম্রতা কিছু বললে আরীবের কাছে নালিশ করা ছিল সভ্যতার অন্যতম অভ্যাস। 
আরীবের থেকে সভ্যতা কখনও কিছু লুকাত না।সভ্যতা ভাবত আরীব হয়ত একদিন ফিরে এসে নম্রতাকে মেনে নিয়ে সবাইকে চমকে দেবে। অথবা নম্রতার অনুভূতি বদলে যাবে, সে আরীবকে ভুলে যাবে। কিন্তু দুটোর একটাও হলো না, নম্রতার অনুভূতি বদলায়নি। আরীব চমকানোর মত কাজ করলেও চমকটা খুশির ছিল না। মারিয়াকে প্রথম দিকে ভালো লাগলেও, পরে সভ্যতা ও নম্রতা বুঝতে পেরেছিল মারিয়া এক পুরুষের আসক্ত থাকার মেয়ে নয়। 
এই মারিয়া নামের মেয়েটির জন্য আরীব ভাই নম্রতাকে ছোট করে,অপমান করে নানা কথা শুনিয়েছে।কয়েক বার তো সভ্যতার সামনেই মারিয়া ও নম্রতার তুলনা করে নম্রতাকে ছোট করেছে, কাঁদতে বাধ্য করেছে। চোখের সামনে এসব দেখে আরীবের প্রতি সভ্যতার ক্রোধ জন্মাতে শুরু করে। 
কেবলমাত্র নম্রতার নম্রস্বভাবের জন্য সভ্যতাকে কঠিন হতে হয়েছে। নম্রতার জায়গায় অন্য কেউ হলে সম্পর্কে এত জটিলতা আসতো না। সভ্যতা ভেবে পায় না, নম্রতা নামের এই মেয়েটা এমন কেন? চোখের সামনে একটা খারাপ মানুষকে চিনেও তার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওদিকে একটা ভালো মানুষ যে নম্রতার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তৃষ্ণার্ত,সেদিকে কোনো নজর-ই নেই। মেয়েদের মনে এত জটিলতা থাকে কেন? কই সভ্যতার মনে তো এত জটিলতা নেই।সভ্যতা হচ্ছে স্পষ্টভাষি মেয়ে। সরল, ধাঁরালো অস্ত্রের ন্যায়। মেয়ে বলেই যে পুরুষের সামনে দুর্বল হতে হবে এমন ধারণা থেকে বের হওয়া উচিত। কিন্তু নম্রতা তা বুঝবে না, বুঝতে হবেনা। সারাজীবন কেঁদে ম'রুক। 

বিরবির করে এসব আওড়ে চৌকির ওপর থাকা ফোনটির দিকে তাঁকাল সভ্যতা।মাহিন কল করছে। সভ্যতা এবার কলটি রিসিভ করে, নরম স্বরে বলল, 
'বলুন শাহজাদা বীরপ্রতীক।'

মাহিন ভীষম খেয়ে, খুকখুক করে কেঁশে উঠল। কপোট রাগ দেখিয়ে বলল, 'এই তোর সভ্যতা?'

'শাহজাদা বললাম, বীরপ্রতীক বললাম তাতেও হবে না? ওকে। বলো হে প্রণয়ভিক্ষুক, তোমারও লাগি আমি কি করিতে পারি। একবার বলো, পাড় হইয়া যাইবো সাত সমুদ্দুর, ভাঙিয়া ফেলিব কঠিন পাহাড়, আকাশ হইতে আনিয়া দিবো রুপোলি চাঁদ,শুধু একবার বলো প্রিয় সখা।'

'তোমাকে চাই হে প্রাণপ্রিয়া সখী, দেবে কি তোমাকে?'

সভ্যতা মুখ কুচকে বলে, 'নোও.. আমার প্রেমিকপুরুষ কষ্ট পাবে। আমি অত্যন্ত সংবেদনশীল তার অনুভূতির প্রতি। দ্বিতীয় পুরুষের প্রেম গ্রহণ কিংবা অন্যকারোর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র আমার প্রেমিকপুরুষে-ই আসক্ত এবং তাঁহার বিরহে রিক্ত আমি।'

মাহিন উচ্চস্বরে হেসে বলল, 'তোরা বোন-দুটো এত ডিফরেন্ট কেন? এর একটা উপযুক্ত কারণ দেখা তো..'

'কারণ সে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে গেছে। আর আমি ছ্যাকা খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।এজন্য আমাদের স্বভাব ও বাচন ভিন্ন।'

'দুই বছর হতে চলল। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, অথচ তোর ওই পাষাণ বোন ফিরেও তাঁকাল না।' নিরাশ কন্ঠস্বর মাহিনের।

সভ্যতার চটপটে উত্তর,'এজন্যই বলেছি রূপচর্চা করো। সপ্তাহে দুবার পার্লারে গিয়ে কড়া একটা ফেসপ্যাক, চুলে রঙ বেরঙের কালার,ঝিংকু টাইপ লুক। ওয়াও! কল্পনা করে-ই আমি প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। আপু তো তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাবে মাহিন ভাই।'

'শুনেছি শালি আধি-ঘরওয়ালী হয়। আমারটা দেখছি ঘসেটি বেগম।'

'এজন্যই লোকের ভালো করতে নেই। সবাই আমার ভালো উপদেশ নিতে পারে না। যাই-হোক ফোন করেছ কেন? প্যাকেট তো পৌঁছে গেছে। দেখো উত্তরও পেয়ে যাবে। আমি তোমাদের দেখাসাক্ষাৎ করাব, এমন আশা যদি করো, তবে বলবো আমার এখন সময় নেই। আমি বর্তমানে ভালো মানুষ খুজতে ব্যস্ত। আপুর পরপরই নিজের বিয়ের কাজ সেরে ফেলবো। এসব পড়াশোনা আর ভালো লাগছে না।' 

মাহিন হাসতে হাসতে বলল, 'তুই পড়াশোনা থেকে বাঁচতে বিয়ে করবি?'

'এছাড়া আর কি কারণে বিয়ে করব?দেখো এসব ভালোবাসা-বাসি আমার দ্বারা হবে না। আমি ভীষণ অলস মানুষ। কারোর জন্য বসে অপেক্ষা করা, রেগুলার টেক্সট করা, দু-তিনদিন পরপর দেখা করা, তার পছন্দ-অপছন্দের লিস্ট মনে রাখা, ডেট টু ডেট উইশ করা, তার রাগ ভাঙানো, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা,জেলাসি,এসব এক্সট্রা কারিকুলাম আমার জন্য না। ওসব তোমাদের জন্য, তোমরা-ই রাখো।'
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন