আরহান কারো সাথে কথা বলছে। খুব সম্ভবত কোনো ছেলে। তার কথা হচ্ছে,
“আরহান ভাই সিঙ্গেল আছি মিঙ্গেল হতে ভয় পাচ্ছি এখন উপায় কি?”
হাস্যকর প্রশ্ন। তবুও আরহান বলছে,
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই ব্রো। যদি মিঙ্গেল পার্টনার ভালো হয় তবে লাইফ বিউটিফুল আর যদি খারাপ হয় তাহলে ব্যাডফুল।"
“ভাই কাউকে মনে ধরে না তাহলে উপায়?”
“এক কাজ কর সমুদ্র থেকে ঘুরে আসো ঠিক কাউকে না কাউকে মনে ধরে যাবে।”
উত্তরে মৃদু হাসে অপরপ্রান্তের ছেলেটি। বলে,
“আচ্ছা ভাই।”
কল কেটে গেল। আরহান মাইক্রোফোনে মৃদু হেঁসে জানাল, “এক সিঙ্গেল যখন আরেক সিঙ্গেলকে মিঙ্গেল হওয়ার পরামর্শ দেয় তখন ব্যাপারটা ঠিক যেরকম হয় আমার বর্তমান অবস্থাও হচ্ছে সে রকম। দুঃখিত ভাই।”
আরহানের সামনে বসা ছিল শফিক। আরহানের কথা শুনে সে হাসে। এরপর আবার কল আসে। আরহান কলটা ধরে। শান্ত স্বরে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম।”
কিছুক্ষণ পরই উত্তর আসে,
“ওলাইকুম আসসালাম।”
“কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?”
“এগুলোর উত্তর দেয়া খুব কি প্রয়োজন?”
আরহান খানিকটা অবাক হয়। হঠাৎ তার মনে পড়ে। এমন কথা এর আগেও কে যেন বলেছিল। নামটাও তো বলেনি। আরহান বলে,
“আমরা কি খুব অপরিচিত?”
“খুব একটা পরিচিতও নই।”
“আমাদের এর আগেও কথা হয়েছিল তাই না?"
“হা হয়েছিল। আপনাকে একটা গানের অনুরোধ করে ছিলাম কিন্তু আপনি গানটা ছাড়েননি।”
আরহান নিজের মস্তিষ্কে খানিকটা চাপ প্রয়োগ করল। কিন্তু না গানের নামটা– মনে পড়ছে না। রোজ এত এত মানুষের সাথে কথা বলে। গানের নাম শোনে। সবারটা কি মনে রাখা সম্ভব! আরহান খানিকটা বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,
“দুঃখিত। হয়তো কোনো এক কারণে গানটা ছাড়তে ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে আবার গানের নামটা বলুন আমার ঠিক মনে নেই। নামটা বললেই আমি ছাড়ছি।”
ফাবিহা তখন তাদের বাড়ির গোলাপ গাছটার সামনে দাঁড়ান। ঠোঁটে জড়ানো মিষ্টি হাসি। মোবাইলের সাথে রুমালটা লেপ্টানো। সে বলে,
“থাক গানটা ছাড়তে হবে না।”
“আপনি কি রাগ করলেন?”
ভাড়ি কণ্ঠে শুধাল আরহান। ফাবিহা আকাশ পানে চাইল। মৃদুস্বরে শুধাল,
“রাগ করার মতো সম্পর্ক কি আমাদের হয়েছে?"
“তা হয়তো হয়নি। তবুও আমার মনে হচ্ছে আপনি রাগ করেছেন।"
“না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে রাগ করার মতো কিছু নেই।"
“আচ্ছা আমাদের কি সামনাসামনি কখনো কথা হয়েছিল? না কণ্ঠটা কেন যেন চেনা চেনা লাগছে!”
বিপাকে পড়ল ফাবিহা। এবার কি বলবে! ধরা পড়ে গেল নাকি। সে তড়িগড়ি করে উত্তর দিল,
“না তো।”
“আচ্ছা। এবার বলুন আপনাকে সাহায্য কিভাবে করতে পারি?”
“খুব করে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো। মনে হলো আপনাকে কলটা করা যায়। তাই দিলাম।”
“কোনো কারণে কি ডিপ্রেসড?"
“না। তেমন কোনো ব্যাপার নেই।”
“তবে?”
“এই তবের উত্তর আমিও খুঁজচ্ছি।”
“তাহলে খুঁজতে থাকুন পেয়ে গেলে আমাকে জানাবেন। আমি সন্ধ্যা অবধি আছি।"
কল কেটে গেল। একরাশ হতাশা ভরা আক্ষেপ নিয়ে কানে ফোন চেপে দাঁড়িয়ে রইল ফাবিহা। তার হঠাৎ খারাপ লাগল কিনা বোঝা গেল না।"
অন্যদিকে,
আরহান মাইক্রোফোনে বলে উঠল,
“এবার ছাড়ছি একজন শ্রোতার অনুরোধের গান, 'দেহ পাশে কেউ কেঁদোনা।'
গানের নাম শুনে ফাবিহার বিস্ময়ের শেষ নেই। বললো তো গানের নাম মনে নেই তাহলে ছাড়ল কি করে! কান ছুঁয়ে এলো গিটারের শব্দ। কিছুসময় পড়ই ভেসে আসল,
“একা বসে তুমি,
দেখছো কি একই আকাশ?...’’
••••••••••••••
বাড়ির পিছনের বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে শান্ত। পায়ের ব্যাথা আগের চেয়ে বেশ কমেছে। এবার হাঁটতেও পারছে। বাহিরের আকাশটা মেঘলাময়। কালো কালো মেঘ দেখা যায়। যদিও শান্তর ধারণা আকাশে কালো মেঘ থাকলেও আজ আর বৃষ্টি হবে না। শান্তর হাতে রবীন্দ্রনাথের বই। বইয়ের নাম 'শেষের কবিতা।' – শান্তর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে উচ্চ আওয়াজে বই পড়তে। কিন্তু নিয়তির কাছে সে বড়ই অসহায়। শান্ত মাঝে মাঝে ভাবে, যদি তার কাছে আলাউদ্দিনের চেরাগ থাকত। তাহলে শান্তর উইস হত, কেবলই বাকশক্তি পাওয়া। যদিও এগুলো হয় না। তবুও আশায় বাঁচে মানুষ। শান্ত কল্পনাপ্রবণ মানুষ। এসব ভাবনা তার জন্য খুব একটা অপরিকল্পিত ব্যাপার নয়।'
শান্তর বাকশক্তি নেই। এ ব্যাপার নিয়ে আগে আক্ষেপ লাগলেও এখন আর লাগে না। যদি শান্ত দুনিয়াতে ভালো কাজ করে– মৃত্যুর পর জান্নাতে যায়। তাহলে নিশ্চিয়ই আল্লাহ তাকে বাকশক্তি দিবেন। তখন পুরো একটা দিন শান্ত শুধু কথা বলবে, কথা বলবে, শুধুই কথা বলবে। মৃত্যু নিয়ে শান্তর অনেক কৌতুহল। নিশ্চয়ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর রহস্যময় একটা ব্যাপার হলো মৃত্যু। শান্তর মতে, পৃথিবীর সকল মানুষকে দিনে একবার হলেও স্মরণ করা উচিত মৃত্যুর। মাটির ঘর, ঘুটঘুটে অন্ধকার, আশেপাশে কেউ নেই, শুধুই একা একটা মানুষ। কি ভয়ংকর একটা ব্যাপার। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো শান্তর।'
কারো পদধ্বনি পাওয়া গেল। শান্তর বাকশক্তি না থাকলেও শ্রবণশক্তি প্রবল। শান্ত পিছন ঘুরল। দেখল, গায়ে মোটা কাঁথা জড়িয়ে তৌহিদ এগিয়ে আসছে। সে শান্তের পাশ দিয়ে বসল। কৌতুহল নিয়ে বলল, “একা একা বসে আছিস কেন?”
শান্ত রবীন্দ্রনাথের বইটা দেখাল। তৌহিদ বলল,
“বই পড়ছিস।”
মাথা নাড়াল শান্ত। যার অর্থ, 'হুম।'
শান্ত হাতের ইশারায় বলল,
“তোর জ্বর কমেছে?”
তৌহিদ কথা বুঝতে পেরে উত্তর দিল,
“হুম। মোটামুটি সুস্থ।”
শান্ত হাত নারায়। তা দেখে তৌহিদ বলে,
“তাহলে কাঁথা নিয়ে কি করিস?”
হেঁসে ফেলে তৌহিদ। জানায়,
“খানিকটা শীত লাগে।”
কথা শুনে মৃদু হাসল শান্ত।
•••••••••••••••
বর্ষণের পরের পরিবেশটা বেশ চমৎকার লাগে ফাবিহার কাছে। যেমন এখন লাগছে। সন্ধ্যা শেষে সে বাহিরের এসেছে। আহামরি কোনো কাজ নেই। হাঁটাহাটি যাকে বলে। পায়ে ফোস্কা পড়ার পর খুব একটা বাড়ি থেকে বের হওয়া হয়নি তাই ভাবল আজ বের হবে। মোড়ের মাথায় ফুচকা বেচে। ফাবিহা মূলত ওগুলোই খেতে যাচ্ছে। ফাবিহাদের বাড়ি থেকে কুরিয়ার সার্ভিস খুব কাছে। ফাবিহা ভেবেছে সে হাসান মাহবুবকে একটা চিঠি লিখবে সঙ্গে কিছু গিফট পাঠাবে। সঠিক ঠিকানাটা জানতে হবে। তবে ফাবিহা এতটুকু জানে হাসান মাহবুব এই ঢাকাতেই থাকেন। কিন্তু কোথায় তা জানে না! লোকটা যে কেন নিজেকে লুকিয়ে রাখে কে জানে! কোনোদিন দেখা হলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে,
“আপনি আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন কেন?”
ফাবিহা ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়াল। ফটাফট বলে উঠল, “মামা এক প্লেট ফুচকা দেন।”
ফুচকাওয়ালাও হাসিমুখে দাঁড়াতে বললেন।'
কুরিয়ার সার্ভিসে মানুষের ভীড় কম। আরহান মুখে মাস্ক পড়ে ঢুকল দ্রুত। এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আমার নামে কিছু পার্সেল এসেছে।"
ফোন নাম্বার, আর মেসেজ দেখাল আরহান। কিছুক্ষণের মাঝে কুরিয়ারের কর্মরত এক ব্যক্তি সেলের নাম্বার অনুসারে পার্সেল বের করল। বড় কার্টনের বাক্স। আরহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কর্মরত ব্যক্তিটি বলল, “হাসান মাহবুব”
মাথা নাড়ায় আরহান। যার অর্থ, “হা।”
একটা রশিদ দেয়া হলো। বলা হলো ফোন নম্বর আর নাম লিখতে। আরহান লিখল। এরপরই বাক্স নিয়ে সে বেরিয়ে আসলো।
মোড়ের মাথায় আসতে না আসতেই ফাবিহার সঙ্গে দেখা। ফাবিহা কেবলই খাওয়া শেষ করে– পাওনা মিটিয়ে বাড়ি ফিরছিল। আরহানকে দেখেই প্রশ্ন করল, “কেমন আছেন?”
আরহান প্রথমে খেয়াল করেনি। পরবর্তীতেই কণ্ঠ শুনে হেঁসে বলল,
“এই তো। তা আপনি এখানে কি করছেন?”
“ফুচকা খেতে আসলাম।”
“ওহ আচ্ছা।”
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“বাসায়।”
“আমিও যাচ্ছি। একসাথেই যাই সমস্যা আছে আপনার?”
“একদমই না।”
আরহান আর ফাবিহা একসাথে হাঁটছে। ফাবিহাই বলল,
“এত বড় বাক্সে কি আছে?”
“গিফট।”
“এত বড় বাক্সে?”
“জি।”
“নিশ্চয়ই স্পেশাল কেউ দিয়েছে।”
“তেমনটাই ধরা যায়।”
মনটা খারাপ হয়ে গেল ফাবিহার। কেন হলো জানা নেই। পুরো রাস্তায় আর কোনো কথাই হলো না। বাড়ির গেটের দু'পাশে ল্যামপোস্ট লাগানো। দুটোই জ্বলছে। ফকফকা আলো দিচ্ছে। আরহান গেটে কাছে আসতেই বলল, “তাহলে কি ভালো থাকবেন?”
ফাবিহাও বলল, “জি আপনিও।”
হঠাৎই ফাবিহার নজরে পড়ল বাক্সের গায়ের লেখা নামটার দিকে। সেখানে লেখা,
প্রাপক,
“হাসান মাহবুব”
ঠিকানা আর ফোন নাম্বারও দেয়া। ফাবিহা স্তব্ধ বনে গেল। তাহলে কি তার ধারণাই ঠিক আরহানই তাহলে বিখ্যাত লেখক 'হাসান মাহবুব'।
আরহান ফাবিহাকে রেখে আগেই যেতে নিচ্ছিল। তখনই ফাবিহা বলে ওঠে, “শুনুন।”
আরহান পিছন ফেরে। পা দুটো যায় থেমে। সে নীরব কণ্ঠ আওড়ায়,
“জি বলুন।”
ফাবিহা বলতে পারে না। তাকিয়ে রয়। আশ্চর্য! সে কথা বলতে পারছে না কেন। আরহান অপেক্ষা করছে। কিন্তু না ফাবিহা সেদিনের স্বপ্নের মতো আটকে গেছে। কণ্ঠস্বর আচমকাই বুঝি গায়েব হয়ে গেছে। এমনটা কেন হচ্ছে– সন্দেহ সঠিক হওয়ায়, নাকি প্রিয় লেখককে কাছ থেকে দেখায়। আরহান কিছুটা অধৈর্য নিয়ে বলল, “আপনি কি সত্যিই কিছু বলবেন?”
ফাবিহা বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আরহান ভিতরে ঢোকে। ফাবিহা দেখতে পাচ্ছে তবুও কিছু বলছে না।
.
.
.
চলবে.......................................................................